ধারাবাহিক উপন্যাস ‘আমি আমি- (২য় পর্ব)’ # আব্দুল আলিম

Serial novel 'Ami Ami- Part 2' # Abdul Aleem


...শাকেরের মা দরজার সাথে শরীর ভিড়িয়ে নয়নের পেছন থেকে চলে যাওয়া দেখছিল। সে চোখের আবডালে না যাওয়া পর্যন্ত চোখ মিলিয়ে রাখল সেদিকে। নয়ন গেলো কিন্তু কি যেন রেখে গেলো। যার জন্য শাকেরের মায়ের মন অভিসিক্ত আকাঙ্খিত।     

২য় পর্ব-


শাকের পড়তে বসে নিজের পড়া ছেড়ে বোনকে পড়াচ্ছে। শাকের যদি বলছে , অ তার ছোট বোন বলছে, এ্যা। এরকম এ্যা এ্যা খেলা অনেকক্ষণ ধরে চলছে।

শাকের যখন কোনভাবেই বোনকে ‘অ’ বলাতে পারলো না, তখন ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল। 

ধাক্কা খেয়ে সে কান্নার আওয়াজ তুললো। মা ছুটে এসে শাকেরকে ভাতের চুলা খোঁচানো লাঠি দিয়ে বেদম পিটিয়ে নিজের রাগ কমালো। শাকের মার খেয়ে শরীরে ব্যথা নিয়ে দৌড়ে পালালো। 

তার দৌড়ে পালানো দেখে মা বলছে, শুয়োরের বাচ্চা, পালাচ্ছিস কেন? দাঁড়া, আরও দেবো। তোর বাপ একবার জ্বালায়, আবার তুই জ্বালাস। 

শাকের ভয়ে স্কুলের পেছনের মেহগনি বাগানের ভেতর দিয়ে দৌড়ে হারিয়ে গেল। মা প্রচন্ড আওয়াজময় অশ্রাব্য বুলির ঝড়ে মনের যত জমানো ক্রোধ সবই কুৎসিত ভাষায় প্রকাশ করল। 

যে ভাষার উদ্দেশ্য শুধু রজব। সে বাড়িতে নেই, কিছুই শুনতে পারছে না । সে আছে তার মনের খেয়ালে গুরুর ধামে সীমান্ত এলাকায়।    

রজবের বাড়িতে থাকার কথা থাকলেও অনুপস্থিতির জন্য নয়ন এসে তার বউয়ের সাথে খোশগল্প করে গেলো সন্ধ্যায়। 

ধামে সাধুসঙ্গ বসে। রজব তার সহ সাধুদের কাছে শুনেছে এক গুরুতে অধ্যাত্ম শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না তাই সে গুরুর পর গুরু ধরবে। জীবনে প্রতিজ্ঞা করেছে গুরুজ্ঞান তাকে অর্জন করতেই হবে।                       

নির্দিষ্ট সময়ে সাধুসঙ্গ শুরু হয়েছে। সাধুদের হাতে কদুর বশের তৈরি একতারা, কাঁধে ঢোল, কারো পরনে সাদা লুঙ্গি-ফতুয়া, কারো শরীরে গেরুয়া বসন। রজব সবার প্রতি সবার ভক্তিসুধা, কুশল বিনিময়, মৌন চিন্তাশীল চোখমুখ দেখে অভিভূত। খুব ভাল লাগছে তার। 

সে সাধু জমায়েতের এক প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্তে যাচ্ছে। গুরুদের পায়ে হাত দিয়ে সেই হাত কপালে ঠেকাচ্ছে। এরকম সাধুর বাজারে সে আগে কখনো আসেনি। তার কাছে এ-এক নতুন পৃথিবী। 

যে পৃথিবীতে কোন বিষয়ে ভেদাভেদ নেই। আছে মানুষের সাথে মানুষের সখ্য সাম্য ভালবাসা। এত মানুষ একত্রিত হওয়ার পরেও গেরুয়ার সাথে সাদার কোন রেষারেষি নেই।                

সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে অসংখ্য সাধু গুরু বাদ্যযন্ত্র হাতে গোলাকার শৃঙ্খলিত ভাবে বসে গেলো। রজবও বসেছে ভিনদেশী এক গুরুর ধার ঘেঁষে।              

গুরু বলছে, বাবা, বাড়ি কোথায় গো? রজব তার প্রশ্ন শুনে উত্তর দেওয়ার আগে ভক্তি সহকারে হাত ভিড়িয়ে দিয়ে তার সাথে হ্যান্ডশেক করল। 

তারপর তার হাত নিজের ঠোঁটের সাথে ঠেকিয়ে চুক্ চুক্ শব্দ করে চুমু খেয়ে বললো, বাবা, আমার বাড়ি মফস্বলে। আসল বাড়ির খোঁজে অচিন দেশের পথে নেমেছি।    

‘সত্যিই তাই। আমি এ পথে আছি পঞ্চাশ বছর। ঘরদোর ছেড়ে গুরু ধরেছি; খুঁজে ফিরছি সেই আসল ঘর। যে ঘর দেল কাবার সাথে একাকার’।            

গুরু তারপর তর্জনী উঁচু করে রজবকে আকাশ দেখিয়ে বলল, তার কাছে কোন পার্থক্য নেই, সব একাকার। সেখানে কোন এক নেই, আছে শুধু একক। 

তারপর হাত নামিয়ে বুকের সাথে হাত ঠেকিয়ে বলল, এই খাঁচার ভেতর থেকে হাওয়াটুকু বের হয়ে যাবার অপেক্ষায় আছে। অর্ডার পেলে বেরিয়ে যাবে।   

রজব আগে সামান্য সংখ্যক গুরু শিষ্যের গান বাজনা শুনেছে। মাঝে মধ্যে সেও গুরুর কালাম বা বাণী গায়। কিন্তু আজকে অগণিত গুরুশিষ্যের মিলন দেখে আশ্চর্যান্বিত। সবাই একসঙ্গে গাওয়া শুরু করল,      

ও তোর মনের ঘরে কে যে আছে 

তারে দেখিলি না খুঁজিয়া।।        

সে যে দেহের ঘরে আছে নির্জনে বসিয়া

সে যে দেহের ঘরে বসে আছে আসনও দিয়া

ভক্তকে তালাশ করে আল্লা নির্জনে বসিয়া  

সে যে আল্লা

সে যে হরি 

সে যে ভগবান।।

বহুরূপে দেখা দেয় আছেরে প্রমাণ

যেই নামে ডাকো তারে

সেই নামে পাবেরে দরশন।।

রজব গানের গগনবিদারী তুমুল সুরে সাহস আর ভক্তিতে কেঁপে উঠে অন্যের কন্ঠের সাথে সুর না মিলিয়ে পারলো না।     

অনেকক্ষণ ধরে গুরুর প্রতি সূচনা সংগীত গাওয়ার পরে ঘেমে উঠলো সবাই। গানের সুরের দ্যোতনার মধ্যে গঞ্জিকায় সবাই খেয়াল খুশি মত ঝড়ো টান দিচ্ছিল।   

কিছুক্ষণ পর সকলে মিলে একসঙ্গে হাত কপালে ঠেকিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো, ‘ও গুরু তুমিই ভরস ‘ ! 

ভরসা, শব্দের মাধ্যমে শেষ হল আসর। তারপর সবাই উঠে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরল। পরে সবাই-সবার পায়ের পাতার সাথে ডান হাতের আঙুল ঠেকিয়ে নিজের কপালে ঘষে নিল।          

রজব আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পাশের গুরুকে সালাম শেষে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদছে। গুরুও কান্না দেখে কাঁদছে তবে তার চোখে জল নেই। 

সে রজবকে বলছে, কেঁদো না বাবা। এপার-ওপার সব কালেই গুরুকে সাথে পাবে। সাথে পাবার কথা শুনে রজব আরো গভীর ভাবে শব্দ করে কান্নায় লুটিয়ে পড়ল।    

গুরু এবার রজবের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, বাবা জল, স্থল, ভুলোক, দ্যুলোক যেখানেই বিপদে পড়বে আমাকে স্মরণ করবে। সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়ে যাবো। 

রজব কথাগুলো চরমভাবে বিশ্বাস করে নিল। তার বিশ্বাস এখন গুরুতে। তার খেয়াল ইচ্ছা-অনিচ্ছা সকল কিছুই গুরু নিয়ন্ত্রণ করে। গুরু সংসার জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে যে জ্ঞান তাকে দান করেছে, তা তার জীবনে কাজ করে চলেছে অনিবার্যভাবে।         

রজব আগেও ছোট আকারে সাধুসঙ্গ করেছে। এবারে সে সবচে পরিতৃপ্ত; চরম আহ্লাদিত। তার দীর্ঘ পরিভ্রমণ, অচেনা মানুষ, আবেগের সাথে সখ্যতা হওয়ায় মনের মধ্যে অনেক কথা জমেছে।    

আসরে থাকা অবস্থায় অনেকবার নয়নের অভাব বোধ করেছে। সে বাড়িতে ফিরে এসেছে খবরে, নয়ন একটু বিলম্ব করতে পারেনি। শোনা মাত্রই ছুটে এসেছে রজব ভাইয়ের কাছে। 

এসে কথার ব্যয় না করে রজব ভাইকে বুকে জড়িয়ে নিল। 

রজবও কার্পণ্য না করে নয়নের ব্যবহারে খুশি হয়ে পরিতৃপ্তির সাথে বলল, তোমার তো যাওযার সৌভাগ্য হল না। এক অন্য পৃথিবীতে সময় কাটালাম। বৈষয়িক কামনা-বাসনা সাংসারিক ঝামেলা থেকে গুরু আমাকে কটা দিনের জন্য মুক্ত রেখেছিলেন। জীবনে সংসার করে কি ভুল করেছি! আগে বুঝলে বুদ্ধের মত সন্ন্যাস ব্রত নিয়ে নিতাম।        

নয়ন তার উদাসী কথা শুনে বলল, ভাই বুদ্ধ তো বিয়ের পরে সংসারত্যাগী হয়েছিল। আপনের সমস্যা কোথায়?

‘ছেলে-মেয়ের মোহমায়া ভুলতে পারিনা। তাদের জন্য বাইরে বেশী দিন স্থায়ী হতে পারলাম না। তাছাড়া তোমার ভাবিও এটা অপছন্দ করে। দেখা যাক কবে কি করতে পারি। তবে এবারের আসরে গুরুদের বাক্য ছিল মায়ামুক্ত সম্ভোগমুক্ত কামনাবিবর্জিত জীবন সাধনা।      

রজবের কথা শুনে নয়ন বিচলিত। সে মনে মনে ভাবছে রজব সত্যিই গুরু বনে গেলো। যাক্ সবাই গুরু বনে যাক্। আমার সুখ আমি ছাড়তে পারবো না। অত বড় বড় গুরু ধরে, নিজে গুরু হয়ে কি লাভ? দুই দিনের জন্য মানব জনম নিয়ে এসেছি। ভোগ করার সুযোগ থাকলে ছাড়ব কেন? খাব দাব ফুর্তি করবো। 

নয়নের অন্যমনস্ক একাগ্রতা দেখে রজব বললো, কি নয়ন, কি ভাব?

‘কিছু না ভাই। ভাবছি আপনার সাথে যেতে পারলে বড় গুরুদের আশির্বাদ পেতাম। তা-তো হলো না’। 

নয়নের কলুষতা রজব বুঝলো না। রজব সরল প্রাণে পৃথিবীকে সহজ ভাবে দেখে। কিন্তু সরলের ভেতর কুটিলতা, কত জটিলতা তা রজবের অনুমেয়র বাইরে রয়ে গেছে।      

খোশ আলাপের শেষে রজব নয়নকে সাথে করে বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে যেয়ে হিসাবে বসেছে। সবাইকে ডাকা হয়েছে। মিস্ত্রি কর্মী সবাই এসেছে, পাশে নয়নও বসা। হিসাব শেষে রজব এক লক্ষ টাকা পাচ্ছে না। মিস্ত্রি কর্মী হতবাক। ক্যাশ বাক্সে টাকার একটি বান্ডিল নেই। সবাই-সবাইকে দোষারোপ করছে। রজবের মুখে কথা নেই। কষ্টে তার বুক ধড়ফড় করছে। নয়নের মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছে সেও রজবের মত কষ্ট পাচ্ছে। তার মুখের গৌর বরণ কালো হয়ে উঠেছে।    

রজব টাকার কোন খোঁজ না পেয়ে নয়নকে বলল, দেখেছো, আমার সব অপব্যয় শুরু হয়েছে, সাথে অবনতিও চলছে। সংসার যন্ত্রণার সাথে ব্যবসায়িক যন্ত্রণার সূচনা হচ্ছে; কি করবো বলো। 

‘ভাই, গুরু আবার কোন দিক-দিয়ে আপনার ক্ষতি লাভে পরিণত করবে আপনি টেরও পাবেন না। সবই তার দয়া!   কৃপা! 

নয়নের কথা শুনে রজব কিছুটা হলেও স্বস্তি পেল। রজবের এই প্রথম বড় ধরণের ব্যবসায়িক ক্ষতি গেলো। 

রজবের ব্যবসার বয়স কম নয় কিন্তু  তার কোন অপযশ অপব্যয় ক্ষতি কোনটাই দেওয়া লাগেনি। এই প্রথম এমন ঘটনায় সে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। চরম হতাশা মনের দেহে ভর করেছে।     


(৬)

শাকের স্কুল থেকে পালাবার পর বাড়িতে না যেয়ে ফ্যাক্টরীতে দৌড়ে এসে রজবের ঘাড় ধরে ঝুলে বলছে, বলো আব্বু তুমি কোথায় যাও? তুমি খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছ। আমার সাথে দেখা করো না। 

রজব শাকেরে কথা শুনে পকেট থেকে টাকা বের করেছে। 

টাকা দেখে শাকের বলল, তোমার টাকা নেব না। মা আমাকে মিষ্টি খাওয়ার টাকা দেয়। তোমার টাকা নিতে নিষেধ করেছে। আমার পরীক্ষা। আমি আবার স্কুলে ফিরে যাচ্ছি। বলেই  দৌড়ে স্কুলে চলে গ্যালো। 

রজব নয়নকে বলল, আমার ছেলে সেও তার মায়ের শেখানো কথা বলে এত আঘাত দিয়ে গেল।   

নয়ন রজবের কষ্ট দেখে স্বান্তনা যোগাচ্ছে, বলছে, ভাই পৃথিবী এমনই। মানুষ স্বার্থভোগী। স্বার্থের ঘাটতি হলে ভালবাসাও কমে আসে। দেখেন না, আপনি কটা দিন দূরে তাই সকল কিছুতে কত অনিয়ম,দুর্নীতি।  আপনার একলক্ষ টাকা হাওয়া হয়ে গেল। 

শাকের স্কুল থেকে ফিরে দেকছে রজব বিস্কুট ফ্যাক্টরীর বিছানায় কাত হয়ে ঘুমানোর ভান্ করে আছে। 

সে স্কুল ব্যাগ রেখেই বললো, আব্বু, মা যে টাকা দিয়েছিল শেষ হয়েছে। এখন তুমি আবার টাকা দাও। রজব কাত অবস্থায় শার্টের পকেট দেখিয়ে দিল। শাকের কয়েকটা নোট টাকা নিয়ে দোকানে দৌড়ালো। 

শাকের চলে গেলে রজব বাড়িতে এসেছে। তবে এখনো শাকেরের মায়ের সাথে কথা হচ্ছে না। আগে শাকেরের মা রজবকে দেখামাত্র কাছে আসতো। সংসারে ঘটে যাওয়া নিয়মিত-অনিয়মিত ঘটনা নিয়ে কত বাক্য  বিনিময় করে হাসি-মশকরা করত। 

মেয়েকে কাছে দিয়ে বলত, তোমার মেয়ে তুমি মানুষ কর।       

অথচ সেই কত আগে বাড়ির মালিক এসেছে তবু তার সাথে কোনো কথা ভাব বিনিময় নেই। মনে হচ্ছে দুই জনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। 

শাকেরের মা অনেকবার ঘরে ঢুকে এটা ওটা দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে গেল। রজব অবোধ শিশুর মত তাকিয়ে দেখল। সে মোটেও রজবের দিকে ফিরে চাইলো না। 

অনেকক্ষণ পরে আবারো যখন সে ঘরে ঢুকলো রজব নিজের আমিত্ব ভেঙে ডেকে উঠলো। 

 সে এবার রজবের মিনতি শুনে পায়ের কাছে খাটের উপর বসল।        

রজব বলল, কেমন আছ?     

‘তোমার কথা শুনে অবাক হচ্ছি। মুখে আজ এত মিষ্টি কথা কেন? তুমি গুরুর চিন্তা করোগে। আমি তো তোমাকে ওপারে পার করতে পারবো না’।        

‘ওভাবে বলছো কেনো? তোমার যা দরকার সবই তো পাচ্ছ। আমি তোমাদের কোন কিছুর অভাব রাখি’।

‘তোমার সাথে আমি ঝগড়া করতে চাই না’। কথাটি বলেই সে দৌড়ের মত হেঁটে দ্রুত ঘরের বাইরে চলে গেল। 

রজব একা একা বিছানায় পড়ে রইলো। তার আজ অতীত জীবনের অনেককিছুই মনে পড়ছে। কতটা বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। কোনদিন এমন ব্যবহার তার কাছে সে পায়নি। অথচ আজ রাগ দেখিয়ে চলে গেলো। রজব শঙ্কিত হয়ে পড়ছে দিনের পর দিন। সে তো নিজের কাছে নিজে নির্দোষ বলেই জানে। 

মনে মনে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো, সে কি করছে, কি এমন খারাপ ব্যবহার করেছে। যার জন্য সংসারে তুষের আগুন জ্বলতে শুরু করেছে ধিকেধিকে।

সে অন্যের সংসারের সাথে নিজের সংসারের তুলনা করলো। বাড়ির পাশের অনেকের থেকেই তার সংসার সাজানো। সেই সংসারে এখন পর্যন্ত ত্যাগের থেকে প্রাপ্তির ঘনঘটা বেশী। তাদের আশা ভরসা আছে, সেই আশার সাথে আশানুযায়ী প্রাপ্য নেই এ কথা রজবের সংসারের কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। 

তবুও রজবের জীবন আজ বেদনার্ত। তার মনের কাছে সত্যের খোঁজে বেঁচে থাকা জীবনকে অযথা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, মিছে ঘরবাড়ি, ছেলেমেয়ে,বউ, সমাজ,সংসার।

সে চিন্তা করল আপাতত কয়েকদিন ঘর বাড়ি ছেলে মেয়ের সাথে কাটাবে। বউকে খুশি করবে। তাই ফ্যাক্টরীতে না যেয়ে বাড়িতে রয়ে গেলো। প্রতি সন্ধ্যায় তার আড্ডা এবং তামাক খাওয়ার দরকার হয়। সন্ধ্যা আসার সাথে সাথে নয়নের কথা মনে পড়ে। 

বাড়ি থেকে বেরুনো হবে কিনা? সে আসবে কিনা? ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পথের দিকে বারংবার উঁকি দেয়। তার শরীরমনে নেশার অস্থিরতা কাজ করে। বুঝতে পারে না এখন কি করা উচিত। রাতে তামাক খেতে না পারলে তার শারীরিক এবং মানসিক কষ্ট হবে। ঘুম হবে না। শরীর খারাপ লাগবে।             

এজন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। শেষে রাতের আঁধারে তাকে দেখা গেল। নয়ন তীব্র উচ্চ স্বরে হাসতে হাসতে রজবের বাড়িতে সোজা ঢুকে পড়ল। রজব অনেক আগেই রাস্তা ছেড়ে ঘরে এসে অস্থির হয়ে উঠেছিল।

নয়নকে দেখামাত্রই রজবের শরীর মন শ্রান্তিতে ভরে উঠল। 

নয়ন রজবের কাছে পৌঁছানো মাত্র রজব বললো, তামাক এনেছ? 

‘তামাক না নিয়ে কখনো এসেছি’?    

‘চলো নয়ন, রাতের আযান পড়ছে ওযু করে তামাক টানি’। 

তারা টিউবয়েলের বিশুদ্ধ স্বচ্ছ পানি দিয়ে হাত মুখ ঘষে মাদুর, নারকেলের ছোবড়া, দিয়াশলাই, কাটার সহ বাড়ির পিছনের মেহগনি বাগানে বসলো। তামাক সেঁজে কলকি ভর্তি করে রজব কলকিটি ঠোঁটের সাথে ভেড়ালো। নয়ন দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে ফস্ করে বারুদে আগুন জ্বেলে কলকির মুখে স্পর্শ করালো। রজব শোঁ করে এক টান দিয়ে ডান হাত বুকের সাথে আলতো করে ঠেকিয়ে বলল, ও সা.......ধু!! 

এবার নয়ন রজবের হাত থেকে কলকিটি নিয়ে ও......গুরু বলে প্রথমে কপালের সাথে তারপর ঠোঁটে ঠেকিয়ে খুব ভক্তিভয়ে টান দিল। সব শেষে শুকটানের ফস্  ফস্ শব্দ শোনা গেলো।     

গঞ্জিকা সেবন শেষে তারা কিছুক্ষণ বসে আছে। আস্তে আস্তে রাত গভীর  হচ্ছে। কোনো বাক্যালাপ নেই তাদের মধ্যে। 

কিছু সময় পর রজব বলল, নয়ন তোমার ভাবি রান্না করেছে। রাতের খাবার না খেয়ে যেয়ো না।  

দুজনেই চোখ লাল টকটকে অবস্থায় দুলতে দুলতে, হেলতে হেলতে ঘরে এসে বসেছে। শাকেরের মা নয়নকে দেখে তড়িঘড়ি খাবার আয়োজন করে ফেললো। অনেক রাত হলেও  ছেলে মেয়ে কেউই ঘুমাইনি।   

নয়ন, রজব, শাকের, তার ছোট বোন ঘুঙুর গোলাকার হয়ে বসে গেল খাবার খেতে। পাশ থেকে শাকেরের মা খাবার তুলে দিচ্ছে। সবাই সবেমাত্র খাবার শুরু করেছে; বিদ্যুৎ চলে গেলো। শাকেরের মা অন্ধকারের ভেতর তরকারির ডিশটি এগিয়ে এক চামচ বাড়তি তরকারি নয়নের প্লেটে উঠাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। 

এমন সময় নয়ন না বলতে যেয়ে বাম হাত দিয়ে অন্ধকারের ভেতর শাকেরের মায়ের ডান হাত চেপে ধরলো। অমনি কামনায় কেঁপে উঠলো দুজনে। রজব পাশে বসেও সে কামনার তীব্রতা বুঝতে পারল না। 

রাতের খাওয়া শেষে অন্ধকারে দুই গঞ্জিকা সেবকের কথা চলছে। 

রজব বলছে, বুঝলে নয়ন, আজকের তামাক টা খুব কড়া ছিল। ভরপুর নেশা হয়েছে। সে রজবের কথা খেয়াল করে শুনছে না এবং অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করছে শাকেরের মা কোথায়।     

আজকে রজব শাকেরের মায়ের হাসিখুশি ব্যবহার পেয়ে আনন্দিত।  ভাবছে, তার সময় দেওয়ার জন্য হয়তো সহধর্মিনী ভাল ব্যবহার করছে। কিন্তু নয়ন বুঝতে পারছে শাকেরের মায়ের মন হঠাৎ ভালো কেন। সে চুপিসারে অন্তরে অন্তরে আনন্দে আছে। 

শাকেরের মা এ ঘর থেকে ও ঘর, এখান থেকে সেখানে হাঁটাচলা করছে। নয়ন ঘনভাবে চলার ছন্দ, তার শরীরের বেয়াড়া ভাব বোঝার চেষ্টা করছে আর মনের ভেতর কল্পনায় কামনার দৌড় ঝাঁপ করাচ্ছে।     

হঠাৎ রজব অল্প শব্দে নয়নকে আবার বলছে, কয়েকদিন আমি বাড়িতে ছিলাম না বলে তোমার ভাবির মন খারাপ ছিল। তবে আজকে মনটা একটু ভালো। 

নয়ন বলল, ভাববেন না ভাই। মেয়েদের মন তো হালকা কাপাসি তুলার মত। কামনায় লাল হয়ে সামান্য বাতাসেই উড়তে চায়। আবার ক্ষীণ বৃষ্টিতে ভেজার পর থেমে যায় নির্বিশেষে। একটু ভালবাসার বৃষ্টি দেন ঠিক হয়ে যাবে। 

নয়নের দার্শনিক কথা শেষে দুজনে দুই গাল হেসে গভীর রাতে অন্ধকারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিস্কুট ফ্যাক্টরীর পথে হাঁটতে থাকল। 

তাদের চলে যাওয়া দেখে শাকের বলছে, আব্বা, আমিও যাবো। রজব নিতে চাচ্চে না কিন্তু শাকের ছাড়ছে না। নয়ন কৃত্রিম আদরে শাকেরকে থামানোর জন্য পকেট হাতড়াচ্ছে।      

শাকেরের মা এই দৃশ্য দেখে কাছে এসে শাকেরকে বলল, যেয়ো না বাবা তোমার কাকু নিষেধ করছে। 

তাছাড়া এখন অনেক রাত, ঘুমাতে হবে। সে তার মায়ের কথায় থেমে গেল। শাকেরের ছোট বোন খাবার পরপরই ঘুমিয়ে গেছে। 

রজব এবং নয়ন চলে গেলে শাকেরকে নিয়ে তার মা ঘুমাতে গেল। শাকের ঘুমিয়ে গেলেও মা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বিছানায় শুয়ে শরীরের গরমে এপাশ ওপাশ করছে। খুব মনে পড়ছে, নয়নের ঝাকড়া রঙ করা চুল, স্ফীত স্বচ্ছ হাসি, উঁচু দেহখানা, বহু শক্তিময় বাহু দুটির কথা। মনে হচ্ছে নয়নের তুলনায় রজব সর্বদিকে হালকা। সে কত শত দৃষ্টিনন্দন আর রজব খর্বকায়। 

অনেক যন্ত্রণায় নয়নকে ভেবে শাকেরের মায়ের রাত কাটছে। তবু মনের দ্বিধা গেলো না। সমস্ত রাত কি সব ভাবতে ভাবতে ভোরের পাখি গেয়ে উঠল। তবু ভেবে কূল পেল না, কিভাবে নয়নকে অবহিত করবে তার মনের গভীর বাসনা।          

পরের দিন ঘুম থেকে শাকের বেশ সকালেই উঠে বইয়ের সাথে সখ্যতা করবার প্রচেষ্টা করছে। উঠানে মুরগির বাচ্চাগুলো ক্ষুধায় ঘরে বাইরে দৌড়াচ্ছে। তার বোন এখনো ঘুমিয়ে আছে; মা কাজ করতে যেয়ে কোন কাজেই শক্তি পাচ্ছে না। মনের মধ্যে বারবার মনে হচ্ছে কিছু করা দরকার। 

সে ভাবছে নয়ন এবার আসলে মনের কথা খুলে বলবে। সে তার সম্পর্কে যাই ভাবুক, তাকে তার ব্যাকুলতা বলবেই এবং হৃদয়ের কাছে নিয়ে আসবে।          

কয়েকদিন পরে রজব ফ্যাক্টরীতে যেয়ে কাজের অগ্রগতি বুঝে বুদ্ধি হারিয়ে নির্বাক। মিস্ত্রি কর্মী ছুটির নামে বাড়িতে চলে গেছে। মালামাল আগোছালো, টাকায় বেহিসাব, সবকিছুতে ক্ষতির পূর্বাভাস। সে এখন নিজের আত্মবিশ্বাসী মনের শক্তি খাটাতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। আগে কোন সমস্যায় পড়লে মনোবলে তা মেরামত করতো। 

এখন সে কি পারবে? 

বৈষয়িক লোভ, টাকা রোজগারের জন্য কর্ম তাকে টানতে পারছে না। দৈনন্দিন চাহিদা সূচি আটকে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তার চিন্তা চেতনা কর্মচঞ্চলতা এখন সবই ক্ষয়ে যাওয়ার পথে। সে বুঝতে পারছে তার ব্যবসার দুর্দিন অপেক্ষা করছে। সেজন্য নিথর হয়ে ফ্যাক্টরীতে বসে কাঁদছে। নয়ন চলে গেছে নিজের দরকারে। যাবার প্রাক্কালে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে স্বান্তণা কিংবা আশা জাগানিয়া কোন কথা না বলেই গেছে। এতে রজব মনঃক্ষুন্ন ভাবছে এত ঘনিষ্ঠতা, একই সাথে উঠা-বসা, তামাক খাওয়া আমার সবকিছু আজ বিগড়ে যাচ্ছে তবু  সে বুঝেও না বোঝার ভান করে চলে গেলো।     

এ কেমন বন্ধুতা? রজবের মনে প্রশ্নের উদয় হচ্ছে নয়ন কি তার বন্ধু নাকি সুবিধাভোগী? 

অসংখ্য জীবন চিন্তায় রজব কপালে হাত ঠেকিয়ে চেয়ারে বসে পা ঝাঁকাচ্ছে। চিন্তার গভীরতায় মনের গোপনীয়তায় তার অনেক সময় অপব্যয় হলো।  তারপর তার এক পীরভাই এসে জানালো রাত্রে গুরুর দর্গায় এন্তেজাম আছে। শুনে অনেক দুখের মধ্যে প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো। 

সে পীরভাইকে অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য কিছু টাকাও নিঃশঙ্কোচে হাতে ধরিয়ে দিল। পীরভাই গেলে ভাবতে থাকলো গুরুর সাথে চলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবে। তার বিশ্বাস গুরুর কৃপায় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।         

সে ফ্যাক্টরীতে এখনো বসেই আছে। 

হঠাৎ শাকের এসে বলছে, আব্বু তুমি কেম্মা যিন হয়ে যাচ্ছো। 

তার এই বড় মানুষী কথা শুনে রজবের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। 

‘কেমন হয়ে যাচ্ছি আব্বা’?   

‘তুমি খারাপ হয়ে গেছো’। 

‘তুমি বুঝবে না বাবা, আমার শিক্ষা চলছে’।  

শাকেরের বয়স্ক মানুষের মত কথার ভারে রজব বিক্ষত। গভীর মনে চিন্তা করছে, এতটুকু ছেলে বলে কি। ও দেখছি আমার সব স্মৃতি মনে রাখবে। সৃষ্টিকর্তা এত সচেতন করে তাকে পাঠিয়েছে। রজব ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছুটা  চিন্তিত  । ছেলেমেয়ের কি হবে ? তার অবর্তমানে কে দেখবে? আবার এই চিন্তায় স্বান্তণা পাচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা তো আছেন।

রজবের কাছ থেকে শাকের টাকা নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। ঘুঙুরের জন্য বাজার থেকে সুগন্ধিযুক্ত আইসক্রিম কিনবে। তার বাবা যেহেতু তাদের জন্য ইদানিং কোনকিছু কিনতে চায় না তাই সে নিজেই কিনবে। ছোটবোনের আবদার রাখবে। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের কাছে তার মামার দেখা পেলো। মামা খেজুর রস খেতে তাদের বাড়িতে যেতে বলল। 

যাবার সময় মামা তার মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলল, কি রে তুই আর আমাদের বাড়িতে যাস না কেন? খেজুর রস ফুরিয়ে যাচ্ছে। 

‘যাবো কখন, আব্বা গুরুর কাছে যায়’। গুরুর কথা শুনে মামা কিছু বুঝলো না। শুধু বললো, যেয়ে রস খেয়ে আসবি। আমি চলে গেলাম। 

মামা চলে গেলে সে বাজার থেকে ছোট বোনের জন্য আইসক্রিম, ঝালমুড়ি, বাদাম কিনে ফিরে আসলো বাড়িতে।

শাকের শারীরিক এবং মানসিকভাবে বেশ বড় হয়ে প্রচলিত স্কুল শিক্ষার কয়েকটি ক্লাস ডিঙিয়েছে। শরীরে বাড়লেও কতটুকুই বা বেড়েছে। বাবার অবর্তমানে বাজার করা, দোকানীর কাছ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু নিয়ে ছোট বোনের আবদার পূরণ করা তার সহজাত হয়ে উঠেছে। 

সে এখন স্কুলে একা যায় না, সঙ্গে নিয়ে যায় তার থেকে দুই বছরের ছোট বোনকে। ক্লাসে বসিয়ে সেও ক্লাসে যায়। ক্লাস শেষ হলে সতর্ক প্রহরায় আবার বাড়িতে নিয়ে আসে। 

শাকের এবং ঘুঙুরের যতটুকু নিজের প্রতি নিজের খেয়াল, পড়া লেখার প্রতি আগ্রহ, সেই তুলনায় বাবা-মার কোন খেয়াল নেই। 

তাদের জীবন দেখে মনে হয় শুধু খেয়ালের বশে বিধাতার বড় অবুঝ সৃষ্টি তারা। বিধাতা যদি স্বয়ং হাত মেলে দেয় তাদের জীবন পথে, তাহলে অমসৃণ পথে সু-মসৃণ জীবন যাপন করতে পারবে। তাছাড়া তাদের দায়িত্ব বিধাতা যাদের হাতে দিয়েছিলেন তারা তাদের হাত আস্তে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছে।        

       

(৭)

রজব মনের যন্ত্রণায় গুরুর আস্তানায় গিয়েছে। আজ নিজেকে ভাবছে পৃথিবীর আগাছা পরগাছা। ইচ্ছাকৃত খাবার না খেয়ে খুব ঘৃণার সাথে নিজেকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে পেট এবং পিঠ একাকার হয়ে গেছে। চুলগুলো কুকুরের লেজের পশমের মতো ধূসর এলামেলো হয়ে পিঠের উপর ঝুলছে। একটি ময়লা শার্ট গায়ে না দিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে। 

আস্তানায় এসেছে সেই কখন। ঘন্টার পর ঘন্টা গঞ্জিকা, তাড়ি, বাংলা মদ খেয়ে সময় কেটে গেলো। ইতিমধ্যে কয়েকবার বমিও হয়েছে। শরীর প্রচন্ড গরম। খুব অস্বস্তিতে কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখল গায়ে জ্বর। তারপর একটি তেল চিটচিটে মাদুরে লম্বা হয়ে পড়ে থাকলো। সেদিন ভুলে গেলো বাড়ির কথা।    

রাতে অন্ধকারের ভেতর হুড়মুড় শব্দে প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস শুরু হল। আখড়ার ঘর উড়ে যাবার ভয়ে গুরু শিষ্য সবাই চলে গেছে। তার পাশে কোন পীরভাই বা তামাক খাওয়ার সঙ্গী নেই। বাতাসের আক্রমণ টের পেয়ে  সে উঠে বসলো। বাতাসের বেগে একনাগারে মাজারের ঘর নড়ছে। রজব ভয়ে ইতস্ত। 

খুব ঝড়ের সাথে বৃষ্টি শুরু হল। ঘরের চারপাশে জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ভাঙা টিনের চালা ভেদ করে মাজারের উপর পানি পরছে। 

মাজারটি কালো কাপড়ে ঢাকা। সে প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে বলে মাজারের কালো কাপড় তুলে নিজের মাথা এবং শরীরে জড়ালো। তবুও ভেজা থেকে রক্ষা না পেয়ে ঘং ঘং করে কাশছে। ঝড়ের শক্তি আরও বৃদ্ধি পেয়ে কিছুটা দূরের একটা আম গাছের ডাল ভেঙে পড়ল। 

এখন সে কেঁদে মাজারের মাটির সাথে ডান হাত রেখে বলছে, ও গুরু, তুমি এই অধমের প্রতি কৃপা কর। রক্ষা করো দয়াল। ও গুরু! ও গুরু! ও সৃষ্টিকর্তা! ও আল্লাহ্! ও হরি! ও যিশু!     

রজব যতই বিভিন্ন নামে তাকে স্মরণ করছিল ঝড়ের-ঝড়ো বেগ ততো বাড়ছিল। 

সে প্রকৃতির তান্ডবের অভিজ্ঞতায় সিক্ত হলো। কোনোদিন তার জীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি। ঝড়ের অভিজ্ঞতা আরো ভাবিয়ে তুলল তাকে। সে ভাবছে সৃষ্টিকর্তার কতো শক্তি, হাত ভর্তি তার দান- উপাদান। 

আমাদের জন্য যেমন রেখেছে বিলাসিতা। আবার শাসন করার জন্য রেখেছেন মৃত্যু, জরা, ব্যাধি, দুঃখ, ভয়াবহতা অনেক কিছু। তবু মানুষ ভালোকে-ভালবাসে না, ভালবাসে লোভ, হিংসা, অন্যায়। 

সে একান্তে কঠিন সিদ্ধান্তে জীবন নিয়ে ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো গুরু বা শিক্ষকের কাছ থেকে সৃষ্টি রহস্য বুঝবে এবং গুরুকে কোনদিন ছাড়বে না।        

রজবের উদ্দেশ্য-উদ্দেশ্যহীন তা বলতে ভাববার প্রয়োজন। তার চিন্তা নৈতিক। যা বোঝার জন্য আগ্রহী যাদের মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করছে তারা হয়তো সেরকম শিক্ষা দিতে পারবে না। মানুষের জন্য যা অপার রহস্য মনে হয়, স্রষ্টার কাছে তা সহজ সরল।     

ঝড় বৃষ্টি থেমে গেলে সাধুর আখরা থেকে বাড়িতে ফিরে তার বৃদ্ধ মায়ের পায়ে হাত দিয়ে ছালাম করে বুকে জড়িয়ে বলল, মা, তোমার রজব মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছে। গতরাতে ভয়ংকর ঝড়ের তান্ডবে পড়েছিলাম। 

মা বলল, বাবা, তুমি রাত-বে-রাতে ইদানিং কোথায় যাও?

‘মা, আমি গুরু ধরেছি। গুরু ছাড়া পারে যাওয়া যাবে না। গুরুর কাছে আধ্যাত্মিক শিক্ষার উপর ক্লাস ’। 

মা তার কথা কিছুই বুঝল না। সেও গুরু সম্পর্কে এর চেয়ে বেশী বলল না। তাকে দেখে তার ছেলেমেয়ে ছুটে কাছে এসে বাবা, বাবা, বলে চিৎকার করছে।

রজব শাকেরকে বলছে, তুমি স্কুলে গিয়েছিলে?

‘গিয়েছিলাম’। 

ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটি লাফিয়ে তার কোলে উঠে ঝুলতে থাকল। 

রজব শাকেরের মাকে ডাকছে, কই গেলে, দেখে যাও, তোমার ছেলেমেয়ে কি করছে। 

রজবের বউ কাছে না এসে দূর থেকে মুখ কালো করে নাক সিটকা

মারলো। 

সে বিরক্তির দৃশ্য দেখে ব্যথায় মুষড়ে ভাবছে, সংসারের জন্য কতকিছু করি। অথচ আমার সাথে এত খারাপ ব্যবহার কেন করে। কর্তা হিসাবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটার প্রতিবাদ করা দরকার। 

পরক্ষণেই আবার মনে হল, গুরু বলেছে, নারী শক্তি আদ্য শক্তি, তার সাথে বল খাটালে বিনাশ করে দেবে। তাকে আঘাত করা যাবে না। গুরুর এই অমোঘ বাণী মনে পড়ে সে শান্ত হল।        


(৮)

ফ্যাক্টরী থেকে এক কর্মচারী হঠাৎ দৌড়ে এসে বলছে, চাচা, সর্বনাশ, সবকিছু চুরি হয়ে গেছে। 

সে দেরী না করে ছুটল ফ্যাক্টরীর দিকে। যেয়ে দেখল ক্যাশ বাকসোটির তালা ভাঙা। তাতে কয়েকদিনের টাকা ছিল। একটি টাকাও নেই। চোরে সব নিয়ে গেছে। সে ঘামতে ঘামতে মাথা গরম হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। আশপাশের লোকজন ছুটে এসে মাথায় পানি ঢেলে তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করলো। 

পরে ডাক্তার এসে ওষুধ দিয়ে গেল। 

রজব বেশ কয়েকদিন পড়ে রইল বিছানায়। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে একা একা ঘরের মধ্যে হা-হুতাশ করতে থাকল। শাকেরের মা আশ-পাশ দিয়ে ঘোরে। মাঝেমধ্যে তাকিয়ে দেখে। কাছে এসে কোনকিছু জিজ্ঞেস করে না। তার মধ্যে রজবের ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখা যায় না। 

রজব একাকীত্ব মানতে না পেরে শাকেরকে ডেকে বলল, বাবা তুমি আমার কাছে আসো। ঘুঙুরকে ডাকে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। 

শাকের বাবার কথা শুনে দৌড়ে কাছে এসে রজবের চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে চুল টেনে দিতে থাকল। ঘুঙুর এসে পায়ের আঙুল টিপে ফোটনোর চেষ্টা করলো।  

রজব তার ছেলেমেয়ের ভালবাসা পেয়ে বলছে, তোমরাই আমার আশা- ভরসা। আমি অনেক অসুস্থ পাশে কেউ নেই। ভবিষ্যতে আমাকে কেউ দেখার না থাকলে তোমরা দেখো।     

পরেরদিন সে সুস্থ হয়ে উঠল। শাকের তার সুস্থতা দেখে খুশি। সে ভাবছে কিভাবে ব্যবসায়িক লোকশান পুশিয়ে নেওয়া যায়। অনেক টাকা খোয়া গেছে। ব্যবসায় লাভ করতে না পারলে সবকিছু ভেঙে পরবে। হারিয়ে যাওয়া জিনিস পূণরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। তবু মন সবকিছু ফিরে পেতে চায়।   

নয়নও শুনেছে চুরির ঘটনা। সে রজবের সাথে দেখা করতে এসেছে তবে কয়েকদিন দেরী করে। 

রজব তাকে দেখে বলল, আমি অনেকদিন থেকে অসুস্থ। তোমার কোন খোঁজ নেই। 

‘ভাইসাব খুব ব্যস্ত ছিলাম। আমার দিকে তাকান্ সাদা ফতুয়া লুঙ্গি পড়ে মনটাকে সাদা করার চেষ্টা কর’। 

নয়নের রহস্যময় কথার কিছুই না বুঝে রজব বলল, টাকা পয়সা সব শেষ। ব্যবসা করব কিভাবে, তাই ভাবছি।

‘আপনার গুরু আছে। তাকে বলেন টাকা দেবে। 

‘গুরুর কাছে টাকা চাওয়া যায় নাকি? লজ্জা করে’। 

‘উনি তো আপনার বাবা। সব সমস্যার সমাধানকারী। আর বসতে পারছি না। দূরের ট্রিপ আছে। এক ট্রাক পাট নিয়ে দিতে যেতে হবে বন্দরে। উঠলাম’।

নয়ন চলে গেল। রজব নয়নের পথের দিকে পেছন থেকে অহংকারী হাঁটা দেখছিল। সে আকাশের দিকে মুখ উচু করে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে চোখের আড়ালে হয়ে গেল। 

রজব ভাবছে, ও কত সুখি, কোন চিন্তা নেই। যখন যা মন করতে চায় করে। নয়নের জীবনই ভাল। 

রজবের এলাকায় ইদানিং একটা কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, সে  বাড়িতে না থাকলে নয়ন এসে শাকেরের মায়ের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে, খাওয়া-দাওয়া করে। 

রজব বিস্কুট ফ্যাক্টরীর পাশে চায়ের দোকানে গেছে চা পান করতে। দোকান ভর্তি লোকজন। অনেকে-অনেক রকম আলাপ করছে। 

রজব চা পান শেষ করে উঠে আসার মূহুর্তে দোকানদার বলছে, রজব ভাই, একটা কথা শুনতে শুনতে কান ব্যথা হয়ে গেল। 

‘কি কথা’ ?

দোকানদার বলল, নয়ন আপনার বাড়িতে যায়, এলাকার লোকজন দোকানে চা পান করতে এসে আলোচনা করে, হাসি ঠাট্রা করে। 

রজব দোকানদারের কথার কোন উত্তর দিতে পারল না। মুখটা নিচু করে দোকান থেকে থেকে বেরিয়ে আসল। বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে যেয়ে পাগলের মত বসে গভীর টেনশানে ডুবে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিকহারা উদভ্রান্ত নাবিকের মত বসে রইল। 

বিস্কুট মিস্ত্রি এসে বলছে, চাচা রাত হয়ে এল, বাড়িতে যাবেন না?

‘বাড়ি যেতে ভাল লাগছে না। তুমি বাজারে যেয়ে একপুরি গাঁজা কিনে আনতে পারবে’ ?

‘না চাচা, পারব না’।       

মিস্ত্রির কথা শুনে রজব বলল, তোমরা ফ্যাক্টরী বন্ধ করে বাড়ি যাও। আমি মাজারে যাচ্ছি।    

রাত হয়েছে। রজব কোন গাড়িতে না চড়ে তিন মাইল হেঁটে মাজারে পৌছাল। তারপর একপুরি গঞ্জিকা একাই সম্পূর্ণ শেষ করে মুমূর্ষ মানুষের মত বিশাল গাছের নিচে পড়ে রইল। 

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে করতে পারছে না জীবন থেকে আরও একটি রাত চলে গেছে। সকালে সে বাড়িতে যাচ্ছে। পথে কয়েকজন প্রতিবেশীর সাথে দেখা হল।    

কেউ বলল, রজব ভাই কোথায় গিয়েছিলেন ? 

কেউ বলল, ভাই, বাবার দরবার থেকে ফিরছেন নাকি ? 

রজব কারো কথায় কান না দিয়ে বাড়িতে ঢুকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গড়া দিল। 

শাকের তাকে দেখে দৌড়ে এসে বলছে, বাবা, মামার বাড়িতে খেজুর রস খেতে যাব। মামা যেতে বলেছে। তুমি সাইকেলে করে আমাকে নিয়ে যাবে। 

রজব বুঝতে পারছে তার আবেদনে সাড়া না দিলে কান্নাকাটি করবে। 

এ জন্য বলল, ঠিক আছে বিকেলে তোমাকে সাইকেলে চড়িয়ে নিয়ে যাব তোমার নানার বাড়িতে। 

শাকের এ কথা শোনার পর আনন্দে চিৎকার করে ঘুঙুরকে বলছে, বিকেলে খেজুরের রস খেতে যাব। তোকে নেব না।   

বিকেলে শাকের রজবকে বলছে, বাবা চলো মামার বাড়িতে যায়। সন্ধ্যায় গাছ থেকে রস পাড়ে। দেরী হলে বিক্রি হয়ে যাবে। 

রজব শাকেরের কথা শুনে হাতমুখ ধুয়ে বাইসাইকেল নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। শাকেরকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে রজব সাইকেল চালানো শুরু করেছে। সাইকেল চলছে, শাকের নড়াচড়া করে ডানেবামে দুলছে। 

রজব বলছে, বাবা, এত নড়লে পড়ে যাবে। রজবের কথায় শাকের কান দিচ্ছে না। 

সে আরো বেশী নড়ছে আর বলছে, আমার দুলতে খুব ভাল লাগে।

অনেকদূর আসার পর রজব সাইকেল থামিয়ে শাকেরকে বলছে, বাবা সাইকেল খারাপ হয়ে গেলো, চলো হেঁটে যায়। 

শাকের তার বাবার চালাকি বুঝতে না পেরে বলছে, সাইকেলের কি খারাপ হয়েছে আব্বু ?  

রজব বলছে, চাকায় সমস্যা হয়েছে।   

‘ও, তাই, চাকা খারাপ হলে-তো চালানো যায় না। চলো, হেঁটেই যায়’। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে শাকেরের নানার বাড়ির কাছে প্রায় পৌছে গেছে। 

শাকেরের মামা তাদের দেখে ছুটে এসে শাকেরকে জড়িয়ে ধরে বলছে, হেঁটে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে?

শাকের বলল, হ, মামা পা ব্যথা হয়ে গেছে। সাইকেল খারাপ তাই হেঁটে আসছি। 

শাকেরের মামা রজবকে বলছে, দুলাভাই, চলেন বাড়ির ভেতরে চলেন। অনেকদিন পরে আসলেন। আজকে থাকবেন। আগেতো ঘনঘন আসতেন। এখন আসেনই না। 

‘এখন আসতে ইচ্ছে করে না। তোমার বোনও আসতে বলে না। কিভাবে আসি বলো’? 

‘ হ, আপা কেমন যেন হয়ে গেছে, আমাকেও আগের মত ভালবাসে না’। বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করে না। কয়েকদিন আগে আপার কাছে গিয়েছিলাম, সে শুধু নয়ন-নয়ন করতে ছিল। নয়ন কে?

রজব বলছে, নয়ন একজন ট্রাক ড্রাইভার। আমার বন্ধু।

শাকেরের মামা বলছে, নয়নের ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। 

‘ও ভাল ছেলে, কোনদিন আমাদের ক্ষতি করবে না’।

রজব শাকেরের মামার কথায় কষ্ট পেয়ে বাড়িতে না ঢুকে শাকেরকে রেখে ফিরে আসার সময় বলল, শাকের থাকো, কালকে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। 

শাকের থেকে গেল মামার বাড়িতে। রাতে রজব বাড়িতে না গিয়ে ফ্যাক্টরীতে গেল। 

শাকেরের মামা সন্ধ্যার খেজুর রস এনে ডাকছে, তোর জন্য খেজুরের রস এনেছি। 

শাকের মামার ডাক শুনে দৌড়ে যেয়ে বলছে, আমি রস খাব, কি মজা, কি মজা। 

শাকেরের মামা স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে দ্রুত রস ঢেলে শাকেরের হাতে ধরিয়ে দিল। শাকের এক নিমেষে এক গ্লাস রস শেষ করে বলছে, আইসক্রিমের থেকেও ভাল লাগল।

মামা বলল, আবার কালকে সন্ধ্যায় তোকে রস খাওয়াবো।   

শাকের রস খাওয়া শেষ করে বলছে, রাতে রস চোরে নিয়ে যাবে নাতো? 

মামা শাকেরের কথা শুনে অবাক হয়ে বলছে, তুই জানলি কিভাবে?

মামা তার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে বলল, মাঝে মধ্যে রাতে রস চুরি হয়ে যায়। আমরা রাত জেগে পাহারা দেই। 

শাকের বলল, আমি রস পাহারা দিতে যাব। 

মামা বলল, আমি গেলে তোকে নিয়ে যাব। 

এখন বাড়ি চল। শাকের মামার সাথে বাড়ি এসে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। রস পাহারা দিতে যাওয়া হল না। 

পরদিন সকালে উঠে সে বলছে, আমাকে রস পাহারা দিতে নিলে না কেন?  

মামা বলল, আজকে রাতে তোকে নিয়ে যাব। শাকের মামার কথা শুনে অনেক খুশি হল। 

বিকেলে রজব এসেছে শাকেরকে বাড়িতে নেওয়ার জন্য। রজব তার শ্বশুর বাড়িতে না ঢুকে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে শাকের, শাকের বলে ডাকছে। শাকেরের কোন সাড়া নেই। 

ডাক শুনে শাকেরের মামা বের হয়ে বলছে, দুলাভাই বাড়ির ভেতরে চলেন। 

‘না বাড়ির ভেতরে যাব না। শাকেরকে পাঠাও। ওকে নিয়ে যাব। কালকে স্কুল আছে’।

মামা বলল, ওতো পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলতে গ্যাছে। 

রজব কোনভাবেই তার শ্বশুর বাড়ি ঢুকল না। রাস্তার পাশে কাঁঠাল গাছের সাথে সাইকেলটি হেলান দিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে থাকল শাকেরের জন্য। 

শাকেরের মামা গেছে শাকেরকে খুঁজতে। মামা খেজুর বাগানে, আম বাগানে, বাঁশ বাগানের নিচে, স্কুলের খেলার মাঠে কোথাও খুঁজে পেল না। পাড়ার ছেলেদেরকে জিজ্ঞেস করলো, কেউ দিতে পারল না শাকেরের  খোঁজ। 

শাকেরের বাবা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে রেগে গিয়ে বাড়িতে ফিরে গেল। শাকের পরন্ত বিকেলে মামার বাড়িতে ফিরল।    

মামা বলল, তুই কোথায় ছিলি? তোর বাবা তোকে না পেয়ে ফিরে গেছে বাড়িতে। পেলে পেটাবে।  

‘আমিও পেটাতে জানি। মাছ ধরতে গিয়েছিলাম বিলে। কত বড় বড় মাছ ধরেছি’। 

‘ তোকে গ্রামের সব জাগায় খুঁজেছি, তুই সাঁতার জানিস? মাছ ধরতে বিলে গিয়েছিলি, সাহস কত’!  

সাঁতারের কথা শুনে শাকের বলল, আমাকে কেউ তো সাঁতার শেখায় না। খুব ইচ্ছা করে সাঁতার শিখতে।       

পরেরদিন শাকেরের বাবা আবার শাকেরকে নিতে এসেছে। বাবাকে পেয়ে আজকে সে খুশি। তর্ক-বিতর্ক না করে সে বাইসাইকেলের পিছনে উঠে বাবার সাথে বাড়ি ফিরছে। বাবা সাইকেল চালাচ্ছে। সে চুপ করে সাইকেলের পেছনে বসে চারপাশের ধানমাঠ উড়ন্ত আকাশ দেখছে। সাইকেল চালাতে গিয়ে রজব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। 

ফাঁকা বিস্তৃত মাঠের মধ্যে একটি গাছ দেখে রজব বলছে, বাবা তুমি সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াও আমরা এ সবুজ গাছটার নিচে একটু জিরিয়ে নিই।

‘ হ, বাবা। বাতাস খাওয়া শ্যাষ হলে সাইকেল আমি চালাবো। তুমি পিছনে বসবে’। 

শাকেরের কথা শুনে রজব এক গাল হেসে দিল। 

বাপ বেটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে সবুজ গাছের নিচে বসে আছে। 

শাকের তার বাবাকে প্রশ্ন করছে, বাবা মেঘের বাড়ি কোথায়? তার বাড়িতে খুব যেতে ইচ্ছে করে। 

‘মেঘের বাড়ি কোথায় জানি না। জন্মের পর থেকে দেখে আসছি অপূর্ব মেঘদল অনেক রকমের রঙ নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। আমরা যত কিছু নিজ চোখে দেখতে পারি মেঘ তাদের মধ্যে অপার বিস্ময়। মেঘ বৃষ্টি দিয়ে ফল- ফসল ফলায়। ডানা বিহীন ভাবে কি এক শক্তি নিয়ে অনন্তকাল সময়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তার হিসাব জানা নেই।  

রজবের কথা শুনে শাকের বলছে, তুমার কথা একটাও বুঝি না। চলো, বাড়ি চলো। 

রজব শাকেরের কথা শুনে আবার সাইকেলে উঠে পেছনে শাকেরকে বসিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। বেশক্ষণ সাইকেল চালানোর পর তারা বাড়িতে পৌছালো।     


আমি আমি- ১ম পর্ব লিংক

Post a Comment

0 Comments