মীর আবদুর রাজজাক এর গদ্য


কবিতার আড়ালে গল্প 

কবিতার আড়ালে গল্প


কবিতার কথা বলতে গিয়ে মাটি ও মানুষের কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, " সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।" তিনি আরো বলেছেন, " যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্য প্রাপ্ত হয়। নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।" তাই কবি হয়ে ওঠা সকলের হয়ে ওঠে না, কেউ কেউ হয়। সম্প্রতি হঠাৎ করে কবিতার জগতে আবির্ভূত হলেন এক কবি তাঁর নাম শেখ রেহানা। তাঁর কবিতা আবৃতি করলেন তাঁরই একমাত্র বড় বোন শেখ হাসিনা। কবিতার নাম "বাবা"। তাঁরা একই বৃন্তের সুবাসিত দুটি ফুল। তাঁদেরকে আলাদা করা যায় না। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের আচমকা এক ঝড়ের মতো সব যেন শেষ হয়ে গেল। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটের আঘাতে নিজ বাড়িতে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। এই দেশের স্বাধীনতার জন্য জেল জুলুম অত্যাচার, সীমাহীন দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছেন এবং তাঁর সোনালি যৌবনকে জাতির জন্যে উৎসর্গ করেছেন। শুধু তাঁর দুই কন্যা ছাড়া সবাইকে হত্যা করা হয়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! এই হৃদয় বিদারক কাহিনী আমরা কম বেশি সবাই জেনে গেছে। তাঁর লেখা কবিতা "বাবা" নিয়ে আলোচনা। তাঁর আবেগ অনুভুতি যে প্রকাশিত হয়েছে, তাই কবিতার বিষয় বস্তু। কবিতায় ৩১ লাইন রয়েছে।
কবিতার প্রথম ৮টি লাইন থেকে দেখি-

"জন্মদিনে প্রতিবার একটি ফুল দিয়ে
শুভেচ্ছা জানানো ছিল
আমার সবচেয়ে আনন্দ।
আর কখনো পাবো না এই সুখ
আর কখনো বলতে পারবো না
শুভ জন্মদিন।
কেন এমন হলো?
কে দেবে আমার প্রশ্নের উত্তর
কোথায় পাবো তোমায়... "
পরানের গহীনে যে বেদনা, যে আবেগ, অনুভুতি শেখ রেহানা মনের মধ্যে পুষেছিলেন তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটলো এই লাইনগুলোতে। তাঁর সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল বাবার জন্মদিন। একগুচ্ছ তোড়া দিবে বাবাকে, এ যে কত মধুর তা বলে শেষ করা যাবে না। বাবার জন্মদিনে ফুলের অপেক্ষায় থাকবে মেয়ে, এই আবেগ,ভালবাসা হৃদয়ের অন্তরে আঁকুপাঁকু করবে। তিনি বলেছেন, এই রকম সুখ আর কখনো পাবেন না। এই কথাটুকু কতো মর্মস্পর্শী হতে পারে, একটু চিন্তা করলে বুঝা যায়। আমার 'বত্রিশ নম্বর বাড়ির আর্তনাদ' কাব্যগ্রন্থে "শেখ রেহানাকে" কবিতায় বলেছি- ভালোবাসার বিন্দু রেখে
সবার অজান্তে
চলে গেল সব না ফেরার দেশে। সবার আদরের মেয়ে ছিল শেখ রেহানা আর তাঁর ছোট ভাই শেখ রাসেল।

আজ থেকে ১৯৭৫ সালে শেখ রেহানার বয়সই বা কত! শেখ রেহানার জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সালে। বাবার হত্যাকান্ডের সময় মাত্র আঠার বছর। এই সময়ে বাবা - মায়ের কাছে কত আবদারই না থাকে। কিন্তু তাঁর বাবা আর নেই, একেবারে না ফেরার দেশে তিনি চলে গেছেন। কত আক্ষেপ না থাকে কমল হৃদয়ের মণিকোঠায়।

তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁর বাবাকে, সন্ধ্যা তারার মাঝে, তাঁর যে বাবাকে শুভ জন্মদিন বলতে বড় সাধ জাগে। তাই বলেছেন তিনি কবিতার মাঝে -
"যদি সন্ধ্যাতারাদের মাঝে থাকো
আকাশের দিকে তাকিয়ে বলবো
শুভ জন্মদিন।
তুমি কি মিটি মিটি জ্বলবে? "

তাঁর বাবা আর কোনদিন ফিরে আসবেন না, কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে যে ব্যাকুলতা- আকুলতা, তা কি কোনদিন শেষ হবে? দুই বোন আকস্মিকভাবে সেদিন রক্ষা পেয়েছিলেন, যদি সেদিন তাঁরা থাকতেন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হতেন এতে সন্দেহ নেই। কারণ, তাঁদের আদরের ছোট ভাই শেখ রাসেলের বয়স ছিল মাত্র দশ বছর, তাকেও রেহাই দেয় নাই। সেহেতু নির্মম ঘাতকের দল তাঁদেরকেও রেহাই দিত না, একথা নির্বিধায় বলা যায়।

পোয়েটিক জাস্টিস পেতে তাই মানুষ প্রকৃতির মাঝে খুঁজে বেড়ায়। প্রকৃতিই একদিন এই বর্বরোচিত হত্যার বিচার করে। বঙ্গবন্ধুর বিচার এই বাংলার মাটিতেই হয়েছে, তাদের শাস্তি খুনিরা পেয়েছে। তাই প্রকৃতির মাঝে তিনি খুঁজেছেন -
"যদি বিশাল সমুদ্রের সামনে
ঢেউদের খেলার মাঝে থাকো বলবো
শুভ জন্মদিন।"
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, পৃথিবীর প্রত্যেক বস্তুর মাঝে সৃষ্টিকর্তা বিরাজিত। তাই সব জায়গাতেই মানুষ খোঁজে তার সৃষ্টিকর্তাকে। সৃষ্টির রহস্যটা বুঝা খুবই মুস্কিল। শেখ রেহানা তাই বলেন,
"সমুদ্রের গর্জনে শুনবো কি
তোমার বজ্রকণ্ঠ?পাহাড়ের চূড়ায় যেখানে মেঘ
নীল আকাশে লুকোচুরি খেলে
তুমি কি ওখানে?
তাকিয়ে বলবো
শুভ জন্মদিন।"
কবিতা কি তা বলতে গিয়ে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ যথার্থ বলেছেন - " the spontaneous overflow of powerful feelings : it takes its origin from emotion recollected in tranquility". আবার Mathew Arnold বলেছেন, "Poetry as a criticism of life." সুতরাং আবেগ, অনুভুতি ও জীবনের কথা শেখ রেহানার এই কবিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে।
কবিতার ভাষা, শব্দ প্রয়োগ ছিল সহজ ও সরল, সবার জন্যে উপলব্ধি করা কঠিন ব্যাপার না। তাই এটি কবিতার বিবেচনায় একটি সার্থক কবিতা। বার বার তিনি তাঁর বাবাকে খুঁজেছেন -
"এক টুকরো সাদা মেঘ ভেসে যাবে
ওখানে কি তুমি?
আকাশে বাতাসে পাহাড়ে উপত্যকায় তোমাকে খুঁজবো, ডাকবো
যে প্রতিধ্বনি হবে
ওখানে কি তুমি?
শুভ জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন।"
লন্ডনে ১৭ মার্চের ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর ৯০ তম জন্মদিনে এই কবিতা লেখেন এবং বাঙালি জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকীতে শেখ রেহানার কবিতা পাঠের উন্মোচন হলো তাঁর বড় বোন মানবতার নেত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে এক নতুন মাত্রার সূচনা করলো। এই জন্মদিনের ফুল শুধু আপনাদেরই নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির। শেখ রেহানার হৃদয়ে আরো কবিতার চাষ হোক। কারণ, জীবনানন্দ দাশের কথায় বলি, নানা চরাচরের মধ্যে আপনার মন মাঝে কবিতা অবসরে কবিতায় প্রস্ফুটিত হোক। পরিশেষে আশার ব্যঞ্জনা দিয়ে সমাপ্তি টানতে চাই- যতদিন অবারিত সোনালি ফসলের মাঠ থাকবে
 যতদিন পাখির কাকলিতে কৃষক জেগে উঠবে
ততদিন থাকবে মুজিবের গৌরবগাঁথা ইতিহাস।




লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক।
# সাবেক বিভাগীয়প্রধান,
ইংরেজি বিভাগ,
 সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া।

Post a Comment

2 Comments

  1. গদ্য হলেও ভাষার শরীরে কাব্যপরশ ছুয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক কবি তাঁর গদ্যেও আবেগঋদ্ধ প্রাঞ্জলতার নূপুর পরিয়ে পাঠকমুগ্ধ রচনা সৃজন করেছেন। মনে হয় যেন কবিতায় পড়ছি। জীবা ও ওয়ার্ড কে তিনি যেভাবে টেনে এনে গদ্যের গায়ে টাঙিয়ে দিয়েছেন তার ঝলক বোদ্ধা পাঠকের চোখে লাগবে ইনশাআল্লাহ্।

    ReplyDelete
  2. গদ্য হলেও ভাষার শরীরে কাব্যপরশ ছুয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক কবি তাঁর গদ্যেও আবেগঋদ্ধ প্রাঞ্জলতার নূপুর পরিয়ে পাঠকমুগ্ধ রচনা সৃজন করেছেন। মনে হয় যেন কবিতায় পড়ছি। জীবা ও ওয়ার্ড কে তিনি যেভাবে টেনে এনে গদ্যের গায়ে টাঙিয়ে দিয়েছেন তার ঝলক বোদ্ধা পাঠকের চোখে লাগবে ইনশাআল্লাহ্। রানামাসুদ

    ReplyDelete