আজকের বাঙলা কবিতা : কতিপয় প্রবণতার কথা



 বিতাকে অভিজ্ঞতা প্রকাশের স্মারক হিশেবে গ্রহণ করেই প্রথম আধুনিক কবিকূল কাব্যচর্চা শুরু করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের কবি শব্দকে বক্তব্য প্রকাশের বাহন হিশেবে গ্রহণ করেছেন অনায়াসে। কাব্যদেবীকে খুঁজতে গিয়ে কবি যে সব অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন তার সঙ্গে বস্তুর রূপ-রস-গন্ধ-ধর্মের বৈচিত্র্য বর্ণনাই শেষ নয়; তার সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রাণের আপেকি অনুষঙ্গ। উপরন্তু সমকালীন রাজনীতি, সমাজ, সমাজ ব্যবস্থা, সমাজের কাঠামোগত ও রুচিগত পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজস্থ মানুষের মনোবৈকল্য আধুনিক কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। কবিতায় ভৌগলিকচেতনা জলবায়ু  ও ভূ-প্রকৃতির বিপুল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আচরণে স্বাভাবিক পরিবর্তনের অনুষঙ্গের মানচিত্র আঁকতে গিয়ে কবি সংশয় প্রকাশ করেন ।
হাজার বছরের বাঙলা কবিতার ইতিহাসে আধুনিক বাঙলা কবিতার যে তাৎপর্যপূর্ণ অহংকার, সমকালীন বাঙলা কবিতা সে ক্রমবিবর্তনের একটি মর্যাদাপূর্ণ শানিত অধ্যায়। যে অধ্যায় কবিতা থেকে অলৌকিতার সকল অযৌক্তিক মোহকে বিচ্ছিন্ন করে বস্তুগত সৌন্দর্য ও ভাববাদের সমন্বয়ে প্রাণধর্মের সমন্বিত রূপরেখা অঙ্কন করে তাকেই অনিবর্চনীয়রূপে চিত্রায়িত করতে সমর্থ হয়েছে। এভাবে সমকালীন কবিতা হয়ে উঠেছে বহুরৈখিক ও বহুবর্ণিল। কেবল বৃন্তচ্যূত কুঁড়ির পতন্মুুখ প্রবণতাই কবিতার মৌল প্রেরণা কিংবা বৈশিষ্ট্য নয়। শুধু বিচ্যূতি ও মূল্যবোধের অবয় ও য়িষ্ণু সভ্যতার বিকৃতি সমকালীন কবিকূলের মানস গঠনে ভূমিকা পালন করে নি; সঙ্গে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের প্রভাব এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বহুল অনুষঙ্গও সে মানস গঠনকে বহুগুনে শিল্পিত মহিমা দানের পে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। যার প্রতিটি কার্যকারণ সম্পর্কের অনুপুক্স বিশেষণ পেশ করা এখানে সম্ভব নয়। সমকালীন কবিতা ভূঁইপোড় কিংবা বায়বীয় কোন বিষয় নয় যে, এ বস্তু প্রথম দর্শনেই পাঠককূলকে সহসা সচকিত করে তুলবে।

এসময়ের কবিতার শব্দসমবায় বিচারে এবং নির্বিচারে দেশী ও বিদেশী শব্দের মিথস্ক্রিয়ায় ভিন্নতর ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ হয়ে উঠে। শব্দকে অতিগীতল স্বভাব ও অতিগদ্যধর্মীতা থেকে মুক্তি দিয়ে ঝর ঝরে ও প্রাঞ্জল রূপে উপস্থাপন করার যে শৈলী কবিরা আত্মস্থ করেছেন তাতে কবিতা কি গদ্যের সঙ্গে ভেদরেখা মুছে দেয়ার পে অনেকটা দায়ী নয়? আর এ বৈশিষ্ট্য কবিতার পে কোন মাঙ্গলিক বার্তা বয়ে আনতে  পেরেছে কি না? পারলে তার ব্যাপ্তি ও পরিধি কতটুকু?
আমেরিকান কবি জড়নবৎঃ খবব ঋৎড়ংঃ একবার কবির দায়িত্ব সম্পর্কে উচ্চারণ করেছিলেন_A poet is essentially and accidental Collector of impression and knowledge. এ গদ্যে আলোচনা করে দেখাবার চেষ্টা করব এ সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল কবিরা impression I knowledge KZUv Collect করতে পেরেছেন। আর নিজেরা কতটা হয়ে উঠেছেন essentially and accidental Collector এর প্রতিভূ। আধুনিক বাঙলা কবিতায় ভাবাবেগের স্থান মর্যাদাপূর্ণ হলেও ভাবালুতা রোমান্টিক কবিদের উদ্বেলিত করলেও আধুনিক কবির রুচীকে ধারণ করার মত কোন যৌক্তিক প্রপঞ্চ হয়ে উঠতে পারে নি। তার কারণ হয়তো এইযে, আধুনিক মানুষের জীবন অনেকটাই যান্ত্রিক ও গতির। এই যন্ত্রশাসিত গতির যুগে সময়ের সংপ্তিতম অবসরে ক্রন্দনহীন বিলাপের গুরুত্ব মানুষের কাছে কিশে হয়ে আসে। আধুনিক কবি মনে কোন সংবেদ জাগাতে ব্যর্থ হওয়ায় আধুনিক কবিগোষ্ঠীর কাছে ভাবালুতা উপেতি বিষয় হিশেবে বিবেচিত এবং বিশুদ্ধ ভাবাবেগ ও চিন্তার বৈদগ্ধ্য সাদরে গৃহিত হতে থাকে। সে হিশেবে সম্প্রতি কবিগণ কবিতাকে অভিজ্ঞতার স্মারক হিশেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেও সেখানে নিরংকুশ বস্তুসত্যের জয়গান গান নি; সঙ্গে কবির কল্পনাকেও বস্তগত সত্যের সামীপ্যে গ্রহণ করার কাক্সা ব্যক্ত করলেন। এ সময়ের কবিতার সাধারণ প্রবণতাগুলো মোটামুটি এরকম_
০১.    উত্তর ঔপনিবেশিক চেতনা ও বিশ্বায়নের প্রভাব
০২.    ছন্দো মুক্তির নামে ছন্দ উচ্ছেদের সচেতন প্রয়াস
০৩.    প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব
০৪.    জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের তাৎনিক প্রতিক্রিয়াজনিত অনুভূতি প্রকাশের তাড়না
০৫.    দ্রুত জনপ্রিয়তার মোহ
০৬.    প্রগতিশীল বনাম প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার দ্বন্দ্ব
০৭.    দর্শন ও চিন্তাজগতের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের প্রভাব
০৮.    ঈশ্বরকেন্দ্রিক চিন্তার বিভ্রান্তি
০৯.    বিষয়হীনতার যাত্রা
১০.    চলচ্চিত্র ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার প্রভাব
১১.    সমবায়ী কণ্ঠের কোরাস
১২.    নতুন সুর সৃষ্টির প্রণোদনা
উপর্যুক্ত প্রবণতাগুলো একইসঙ্গে সমহারে সকল কবির েেত্র প্রয্ক্তু না হলেও অধিকাংশের বেলা প্রায় পূর্ণসত্য। অবাক হবার বিষয় এই যে, উপর্যুক্ত প্রবণতাগুলো পরস্পরের পরিপূরক নয় ততটা, যতটা বৈপরিত্যের। সময়টাও বোধ করি অস্থির-চাঞ্চল্যের ও গতির; সম্ভবত বিচিত্র স্বভাব ও রুচিরও।
বাঙালির মানসিকতা মূলতঃ ঔপনিবেশিক মানসিকতা। প্রায় দুইশত বছরের বৃটিশ শাসন, প্রায় সিকি শতাব্দির পাকিস্তানিদের শাসন ব্যবস্থায় থাকতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের তোষণ ও স্তবগাঁথা রচনায় বহু মেধাবী কবিকে ব্যাপৃত থাকতে দেখা গেছে। দুই একজন যে জ্বলে উঠেন নি_হঠাৎ দাবানলের মত তাও নয়। কোন কোন শক্তিমান কবি সার্বভৌম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কবিতা লিখেছিলেন, জাতির দুর্দিনে অভয় বাণী শোনাতে চেয়েছিলেন বাঙালিকে। বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের পতন হলেও কাল্পনীক প্রতিপরে প্রতি কটামূলক বাকচাতূর্য সর্বস্ব শোগানধর্মী পঙক্তি রচনার সাময়িক হিড়িক পড়েছিল। তার পুরোটাই যে বায়বীয় ছিল তা নয়; শাসকবর্গের সীমাহীন দুর্নীতি ও প্রতিক্রিয়াশীলদের পুনরুত্থানে জাতীয় জীবনে বিভ্রান্তির মেঘাবরণ সাময়িকভাবে হলেও পড়েছিল। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে কবিরা সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন আপন আপন স্বভাবের স্বাতন্ত্র্যে। তবে বহু কবি রাজনীতিশিষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে কবিতা থেকে শোগানকে পৃথক করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তদুপরি প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার আদর্শিক দ্বন্দ্ব ও বড় হয়ে উঠেছিল। মননশীলতা ও সৃজনশীলতার অঞ্চলগুলো দ্বিদ্বাবিভক্ত হতে শুরু করে। তার রেশ আজকের কবিতায়ও প্রবহমান। আজকের কবি ঔপনিবেশিক মনস্তত্বের মূলে কুড়াল মেরে বিশ্বায়নের  যুগে নিজেকে বিশ্ব নাগরিক হিশেবে আত্মোন্মোচনের দ্বার উন্মুক্ত করার প।ে ফলে আজকের কবিতায় প্রগতিশীল চেতনা কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার চর্বিত চর্বনের চেয়ে বড় হয়ে উঠে সার্বভৌম চেতনাকে বৈশ্বিক চেতনায় উন্নীত করার চিন্তা ও চেতনার নিরন্তর পরিচর্যার প্রক্রিয়া।
সমকালীন বিশ্ব রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধবিগ্রহ সহ নানা রকম ঘটনাপ্রবাহের ফলে কবি মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে তাৎণিক অনুভূতি প্রকাশের তাড়নায় কাতর হয়ে উঠেন। সে সঙ্গে দ্রুত জনপ্রিয়তার মোহও তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর্থিক বিচেনাও এেেত্র ভূমিকা পালন করে অনেকটা। অগ্রজ ও সমকালীন ক্রীড়া ও চলচ্চিত্র জগতের তারকা ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের জনপ্রিয়তার সুবাদে আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রসঙ্গটি আজকের কবি মনে রেখা পাত করে। সঙ্গতকারণে ব্যতিক্রম কোন প্রকরণ বা আঙ্গিকের উপস্থাপনায় পাঠককে চমকে দেওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠেন। তাই সস্তা জনপ্রিয়তার মোহ কবিকে আচ্ছন্ন না করে পারে না। ফলশ্র“তিতে কবি কবিতার তন্বী-তরুণীর মনের সংবাদ জানার আগেই রূপের দ্যূতি দেখেই বিস্ময়বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকেন এবং অন্যকেও সে দৃশ্য দেখানোর জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন।
নারীবাদী তত্ত্ব আজকের কবিকুলকে স্পর্শ করে প্রায় তড়িৎগতিতে। ফলে কেউ কেউ নারীবাদী তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরুষ বিদ্বেষী ও নারীর প্রতি পপাতমূলক বক্তব্য সমৃদ্ধ কবিতা চর্চায় ব্রত হন। মৌলবাদ যেমন প্রতিক্রিয়াশীলতার রূপান্তরিত প্রপঞ্চ, তেমনি নারীবাদী তত্ত্বও একধরণের প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব। ধর্মীয় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠী যেমন আগে মুসলমান, হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-তেমনি নারীবাদীরাও আগে নারী অথবা নারীবাদী পুরুষসম্প্রদায় তারপরই মানুষ।
আজকের  কোন কোন কবি শব্দকে মার্জিত ও পরিশীলিত রূপে প্রয়োগে না করে অসংস্কৃত ও অপরিশীলিতরূপে প্রয়োগ করে কাব্যভাষা নির্মাণের প।ে অবশ্যই ইতোপূর্বে অগ্রজ কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু হাসান শাহরিয়ার, আমিনুল ইসলাম, রহমান হেনরী, ব্রাইত্য রাইসু, মুজিব মেহদি অন্ত্যজশ্রেণীর মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে শিতি ভদ্রোজনোচিত ভাষা থেকে নির্বাচিত শব্দসমবায়ে নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণ করে নিয়েছেন। এবং তাদের সে ভাষায় স্বতঃসিদ্ধতাও অর্জিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। তাদের কবিতার আঞ্চলিক ও আটপৌরে শব্দসমবায় ব্যবহৃত হয়েছে, যতটা না বক্তব্য প্রকাশের প্রয়োজনে, ততোধিক শৈল্পিক সুষমায় ঋদ্ধ হয়েই। কিন্তু আজকের কবি শিল্পের দাবীকে উপো করে কেবল বক্তব্যের সামীপ্যে শব্দের অসংস্কৃতরূপকে উপস্থাপন করে কবিতা সম্পর্কে সাধারণ পাঠকতো বটেই, বোদ্ধা পাঠককেও কবিতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলছেন। মালার্মের মত কেউ কেউ বলে থাকেনÑশব্দই কবিতা; কথাটা সর্বাংশে সত্য না হলেও বহুলাংশে সত্য। ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে অজ্ঞেয়বাদীদের ধারণাকে স্বীকার করে বলা যায়Ñহয়তো ঈশ্বর  মানুষের ধারণাগত বিষয় মাত্র। এই ধারণা  যদি সত্যও হয়, তা হলে এও সত্য-মানুষের প্রধান সৃষ্টি কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ সমবায় ঈশ্বরের অস্তিত্বের চেয়েও বেশী শক্তিমান। 
খেলোয়াড়, অভিনেতা অভিনেত্রীর নগদ প্রাপ্তির মোহ তরুণ কবি মানসকে প্রলুব্ধ না করে পারে না। ফলে তারুণ্য অনেকটা ইলেক্ট্রনিক্স মিড়িয়া প্রীতিতে আক্রান্ত। আবার ঈশ্বরকেন্দ্রিক বিভ্রান্তিও তরুণ মনকে বিভ্রান্ত করে নানাভাবে। বেদবাক্য কিংবা ঐশীবাণী ও ধর্মগ্রন্থ বর্ণিত ঐশী শক্তি কিংবা দৈবশক্তি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, পারমানবিক অস্ত্রের মোকাবিলায় অসমর্থ হওয়ায় মানুষের বিশ্বাসের জগতে বিরূপ রেখাপাত করে। বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে সন্ত্রাসবাদ ও অস্ত্রবাজীর বিপুল আয়োজনের ভেতর ঐশীবাণীর অকার্যকর ভূমিকায় নৈরাশ্যবাদীরা বিচলিত না হলেও অজ্ঞেয়বাদীরা ও অস্তিবাদীরা অনেকটাই বিচলিত এবং সন্ধিগ্ধ। এসব বিষয়ে আজকের কবি অনিবার্য সত্যের মতই নিরন্তর দূর্ভাবনার গহনে ডুবে থাকেন  চিন্তার অনেকটা সময়-এবং কোনরূপ ফলাফলশূন্য হাতে ভেসে উঠেন দীর্ঘশ্বাসকে সঙ্গী করে। কবিতা বিষয়হীনতার জ্বরে আক্রান্ত ভয়ানক ব্যাধীর মতই। প্রায় কবিতা নামক বিচূর্ণ অনুভূতিমালার শব্দপুঞ্জে কোন বিষয় আদৌ আছে কি না তা পরিস্কার বোঝা যায় না। উদ্দেশ্যহীন বন্ধনহীন অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাকচাতূর্যের সমবায়ে কবিতার শারীরিক আকার স্পষ্ট হয়ে উঠার কারণে অনেকেরই কণ্ঠস্বরে নতুন কোন সুর বেজে উঠে না। এর সঙ্গে একদল মনে করছেন লেখায় স্বাতন্ত্র্যবোধ স্পষ্ট করার জন্য প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা অপরিহার্য। সে সঙ্গে তারা ছোটকাগজকেন্দ্রিক গোষ্ঠীপ্রীতির সংকীর্ণতায় ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিতণ্ডায় নিজেদের উৎকৃষ্ট সময় ও মেধার বিপুল অপচয়ে প্রতিযোগীতায় মগ্ন। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও শব্দপ্রয়োগের যথেচ্ছাচার স্বভাবের কারণে আজকের কবিতাকে শেকড় উপড়ানো উম্মুল জীবনের ইতস্তত বিপ্তি ও সুষমাহীন মানচিত্র বলেই মনে হয়। এসমবায়ী কণ্ঠস্বরের বিপরীতেও আপন শিা-রুচী-রোধ ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে নতুন ভাষা-সুর-শৈলীতে ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, শেকড়মুখী ও স্বরাট স্বরের শব্দ সমবায়ে কবিতা লিখে দল ছুট দুই একজনকে দৃঢ় পদেেপ কবিতার প্রান্তরে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে দেখা যায়। সে দলছুট কবিদের মধ্যে অনন্য কাজী নাসির মামুন, চন্দন চৌধুরী, ফেরদৌস মাহমুদ, মামুন রশীদ, রবু শেঠ, ইসলাম রফিক, রনজু রাইম, অতনু তিয়াস, জাকির জাফরান, শাসীস হোসেন, ইমতিয়াজ মাহমুদ, মাদল হাসান, অবনি অনার্য ও বিনয় সরকার। কবিতায় এ কবিগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য শনাক্ত করার আগে আধুনিক কবিতার সূচনাকালের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার বলে মনে করি।  
বাঙলা কবিতার প্রথম আধুনিক কবি গোষ্ঠী পূর্ববর্তী কাব্যধারা থেকে নিজেদেরকে বিশিষ্ট ও বিশিষ্ট করে উপস্থাপন করার জন্য কতগুলো বৈশিষ্ট্য নিজেদের কবিতার শরীরে ও আত্মায় সেঁটে দিয়েছিলেন। সেগুলো মোটামুটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈরাশ্যচেতনা, হতাশা, অবয়, সংশয় ও অনিকেত জীবনের চর্চা। প্রথম আধুনিকদের প্রায় প্রত্যেকেই আধুনিক শিায় শিতি ছিলেন ও সমসাময়িক ইংরেজি সাহিত্য ও শিল্পকলার নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও আন্দোলনের প্রাথমিক পাঠ অন্তত নিয়েছিলেন। অনেকটা বাধ্য হয়ে। কারণ তাদের সামনে একা রবীন্দ্রনাথ তার বিপুল কর্মযজ্ঞের পসরা নিযে বিশাল সৃজনবলয় নির্মাণ করে রেখেছিলেন, যা থেকে মুক্তি প্রত্যাশী কবিকূলকে বিকল্প পথ ও ভিন্নতর স্বাদের সন্ধানে বের হতে হয়েছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ রার অদম্য কাক্সা তাড়িত হয়েই। কিন্তু শুধু অধিত বিদ্যার সাহায্যে ব্যক্তি মানুষের জীবনে নিখিল নাস্তির অনিবার্যরূপ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তার জন্য চায় ব্যক্তির জীবনের বিশেষ মুহূর্তের চরম অভিঘাত ও মর্মযাতনার সংযোগ। সে সঙ্গে পারিবারীক ধর্মবিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানের নানা অনুষঙ্গও ব্যক্তির মানস গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ব্যত্যয়ে আপতত স্বপ্নবিলাসী নাস্তিক্য, কার্যতঃ সংশয়বাদ আর অজ্ঞেয়বাদে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। ইউরোপের সমাজ জীবন যান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার ফলে মানুষের বিশ্বাসের জগতে অলৌকিকতার প্রতি আকর্ষণ জন্মানোর বিপরীতে ক্রমাগত সংশয় বাসা বেঁধেছিল। মানবমনের সে বিশেষ অনুভূতি ও অবস্থা কবিদেরকেই বিশেষভাবে আন্দোলিত করেছিল। ফলে ইংরেজি কবিতার আধুনিকতা গোড়াতেই এজরা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট, ডবিউ বি ইয়েটস প্রমূখ কবি কবিতার সঙ্গে ধর্ম ও নীতিবোধের সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। কবিতাকে সাধারণত তাৎণিক অভিজ্ঞতা প্রকাশের স্মারক হিশেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রপঞ্চ হিশেবে ধর্ম-বিশ্বাসকে ঘৃণার্হ করে তুললেন না। আবার কবিতার সঙ্গে এসবের সংযোগও রা করতে চাইলেন না। দুটি প্রপঞ্চকে সার্বভৌম অনন্য সত্বার ভেতর আবিষ্কার করে ধর্ম ও বিশ্বাস বিষয়ে কবিদের জন্য নিস্পৃহ অবস্থানকে অনিবার্য করে তুললেন। তারা হয়তো চেয়েছিলেন, বুদ্ধির মুক্তি ও চিন্তার অবাধ স্বাধীনতা। ধর্মের অনুশাসনকে উপো করার জন্য চিত্তের দার্ঢ্যও কাম্য হয়ে উঠেছিল। অথচ বাঙলা কবিতার আধুনিকতার শুরুতে রোমান্টিকতাও যুগপৎ সহযাত্রী হওয়ার কারণে পূর্ববর্তী কবিদের অতি লালিত্যপূর্ণ কাব্যভাষাসমৃদ্ধ রোমান্টিক কবিতার আবহ পাঠক মনকে তখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তদুপরি রবীন্দ্র নাথের বিশাল কর্মবিশ্বের সামনে তার সমক কোন কবিকে বাঙালি তার মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গগনচুম্বি ভাবমূর্তির সামনে একা কাজী নজরুল ইসলাম অনেকটা ্যাপা বাউলের মত শব্দ ও চেতনার দ্রোহী শৈলীর প্রয়োগ ঘটিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত বিচলিত করে তুলেছিলেন। হয়তো সে কারণে পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলাকা ও পুণশ্চ কাব্যে তার অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গতীহীন কাব্যভাষা নির্মাণে বাধ্য হয়েছিলেন। আর্থিক স্বচ্ছল জমিদার সুস্বাস্থ্যের অধিকারী রবীন্দ্রনাথের সামনে প্রবল অস্থির চিত্তের কাজী নজরুল ইসলাম অনেকটা প্রশান্ত সমুদ্রের বুকে ীণ ঝড়ের ঘূর্ণির মত ঢেউ তুললেন মাত্র। শব্দকে আপন স্বভাবের বশ করে সুচিন্তিত ভাবনাবলয় নির্মাণ করে মানুষের রুচিকে ধারণ করে, নতুন রুচি নির্মাণের জন্য উন্নততর ও সৌম্য-গাম্ভীর্যপূর্ণ কাব্যভাষা উপহার দিতে কাজী নজরুল ইসলাম অসমর্থ ছিলেন। কিন্তু  কেন? তার উত্তর খুঁজতে গেলে পেয়ে যাই_ পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং স্বাস্থ্যগত  দৌর্বল্যও কোন একটি  নির্দিষ্ট  প্রপঞ্চ  বিষয়ে  দীর্ঘস্থায়ী ি চন্তা  ও  ভাবনাবলয় নির্মাণের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করি। চরম দারিদ্র্য ও নৈরাজ্যের ভেতর বেড়ে উঠা দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী কবির পে দ্রোহী হওয়া সহজ, সম্ভব উদ্দীপনাপূর্ণ গণজাগরণের ও শ্রেণী সচেতনমূলক শোগানধর্মী পঙক্তি রচনাও; কিন্তু হৃদয়ের গহনে জেগে উঠা তীব্র ভাবাবেগের সুসংহত রূপের যু্িক্তগ্রাহ্য পরম্পরায় শৈল্পীক বিন্যাস কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই তীব্র মেধার প্রাখর্য থাকা সত্বেও আধুনিক যুগের প্রধান অসুখ শনাক্ত করার সকল যোগ্যতা ধারণ করেও সম্পন্ন পাঠকের বিবেচনাবোধের কাছে কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় অনাধুনিক। অসংখ্য দ্রোহী চেতনাঋদ্ধ কবিতা লিখেও বহু রৈখিক চেতনা সম্পন্ন কবিতার পটভূমি নির্মাণে সম হন নি। ব্যতিক্রম দারিদ্র্য, পূজারীনি, বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি প্রভৃতি কবিতা। এসব কবিতা লেখার আগেই কবির আর্থিক স্বচ্ছলতা সামান্য পরিমাণ হলেও এসেছিল। ততদিনে কবি আর্থিক সংকট অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। হয়তো একারণে তার দারিদ্র্য কবিতাটি বুদ্ধদেব বসুর বন্দির বন্দনা, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের উটপাখি, বিষ্ণুদের ঘোড়সওয়ার  এমনকি জীবনানন্দ দাশের আট বছর আগের একদিন কবিতার চেয়ে কোন বিবেচনায় অনাধুনিক নয়। এদিক থেকে জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্র নাথ দত্ত যদি সামগ্রিক কাব্য কীর্তিতে একজন বড় বড় গ্রহ কিংবা অংশত নত্রও হন, তা হলে জোনাকির সমান সার্বভৌম আলোর অহংকার নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম নত্রই। সে নত্রের আলো ও উত্তাপ জীবনানন্দ দাশ সমেত পঞ্চপাণ্ডবের গ্রহবলয়ের গ্রহ ও উপগ্রহগুলোও কি গ্রহণ করেন নি? প্রথম আধুনিক কবিকূলকে কেবল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যবলয়কে অস্বীকার করে নতুন পথের সন্ধানে ব্যাপৃত হতে হয়েছিল। পরবর্তীতে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদরাও অল্পসংখ্যক অগ্রজ স্বতন্ত্রস্বরের বিপরীতে নতুন স্বর সৃষ্টির কাঙাপোষণ করতে হয়েছিল। এভাবে পরবর্তীকাল খণ্ডে আবির্ভূত কবিকূলও আরও বেশী কবির কাব্যভূমকে ভিত্তি জেনে সে ভিত্তিভূমকে নতুন আলোয় ও চেতনায় আত্মস্থ করেই আপন আপন কাব্যভাষা নির্মাণ করার কঠিন পথ নির্মাণ করেছেন। তাদের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান, আবিদ আজাদ, কামাল চৌধুরী, ময়ূখ চৌধুরী, আবু হাসান শাহরিয়ার, আমিনুল ইসলাম, শিমুল মাহমুদ, হেনরী স্বপন, রহমান হেনরী, ব্রাইত্য রাইসু প্রমুখ সার্বভৌম কবিদের কবিতা পাঠক সহজে শনাক্ত করতে পারে। আজকের তরুরতর কবির সামনে উপস্থাপিত অগ্রজ সকল স্বতন্ত্র স্বরকে আত্মস্থ করে নতুন স্বর সৃষ্টির পথে পদপে নিতে হয়েছে। সুতরাং পূর্ববর্তী স্বতন্ত্র কবিদের কণ্ঠস্বরের এতটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর উপহার দিতে না পারাটা এ কবিকূলের ব্যর্থতা নয়; অজস্্র কণ্ঠস্বরের ভিড়ে স্বতন্ত্রস্বর শনাক্তির  েেত্র পাঠকের অপ্রস্তুত মানসিকতাও অনেকটা দায়ী। 
আজকের কবিতা পাঠের আগে উপর্যুক্ত অবতরণীকার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।  সে সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে বর্তমান সময়ের কবিতার ভিন্ন ধারার প্রকাশও লণীয়।  সে বৈশিষ্ট্যগুলো মোটামুটি এরকম_
০১. উত্তর ঔপনিবেশিক চেতনা ও বিশ্বায়নের সুর
০২. ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল
০৩. মিথপ্রীতি ও স্বাদেশিকতা
০৪. ধর্মীয় চেতনার েেত্র নিস্পৃহ ও স্বধর্মের প্রতি সনিষ্ঠ থাকা
০৫. ছন্দের প্রতি পপাত
০৬. স্বতন্ত্র স্বর সৃষ্টির প্রতি যত্লশীল
০৭. আঞ্চলিক সংকীর্ণতাকে পরিহার করে সার্বজনীন বোধের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা
০৮. সমকালীন বিষয়কে চিরকালীন ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ করার সচেতন প্রয়াস
উপর্যুক্ত প্রবণতাগুলো আমার আলোচ্য কবিদের েেত্র সমহারে না হলেও মোটামুটি প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত বলে ধরে নিতে পারি। সে বিবেচনায় আজকের কবি কাজী নাসির মামুন শব্দব্যবহারে স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাঞ্জল, চিন্তায় ও মননে বৈদগ্ধের স্বার রেখেছেন। তার কবিতায় গীতিময়তার অনুপস্থিতি বাঙলা কবিতার অভ্যস্ত পাঠককে বিব্রত করে না। তার কবিতায় পাঠককে চমকে দেয়ার মত কোন জৌলুস নেই। আছে এক ধরণের সম্মোহনী শক্তি ও ঘোরের স্বার। নিসর্গ চেতনা তার কবিতার মৌল প্রণোদনা হওয়ায় তার রূপ-রস-প্রকৃতি আবহমান বাংলার প্রতিনিধিত্বশীল রূপবৈচিত্রের সঙ্গে সঙ্গতীপূর্ণ চিত্র নির্মাণে প্রতিশ্র“তিশীল। অগ্রজ ও সমকালীন প্রধান কবিদের কাব্যভঙ্গিকে অতিক্রম করার স্বতঃসিদ্ধতা তার অর্জিত হলেও ছন্দ নিয়ে ব্যাপক পরীা-নিরীার কাজকে কি কবি দুরুহ মনে করেছেন? চিন্তার দৈন্য প্রকাশে কাজী নাসির মামুন অনীহ, হৃদয়ার্তির সামীপ্যে তাই প্রবল অলৌকিক বা ঐশ্বরিক ধর্মকে একমেঅদ্বিতীয়ম জ্ঞান না করেও নিখিল নাস্তির স্তোত্র রচনা করলে না; বরং যেখানে বস্তু বিশ্বের সংগে ভাবলোকের সম্পর্ক প্রায় সাংঘর্ষিক ও নিষ্ফল ব্যথিত প্রাণের ক্রন্দনহীন বিলাপের মত আবিলতাময় হয়ে উঠে সেখানে প্রবল সংশয়বাদী হয়ে উঠেন। তার কবিতায় ব্যবহৃত অনুষঙ্গ গ্রামীন বাঙলার বিভিন্ন জনপদ এবং আবহমান বাঙলার মিথ ও লোক কাহিনীর মিথস্ক্রিয়ায় নবতর প্রকরণ শৈলীতে প্রকাশিত।
তার দীর্ঘ কবিতা সাবলিলভাবে এগিয়ে চলে এবং কোথাও ঝুলে না পড়ে প্রলম্বিত দমের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে নাড়ির স্পন্দনের বেগে অনিবার্যভাবে বাঙময় হয়ে ওঠে। যাতে পাঠকের ধর্যচ্যূতি ঘটে না; কৌতুহল বেড়ে যায় সহস্রগুন। যারা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ বামন, তারা দীর্ঘ কবিতা কী বস্তু, উপলব্ধি করার কোন রকম অপো না করেই সহজাত প্রবৃত্তির দোষেই দীর্ঘ কবিতার প্রলম্বিত স্বাদ গ্রহণ এবং রসাস্বাদন থেকে বরাবরই বঞ্চিত ও ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়। তার নিবিড় পরিচর্যায় লোককাহিনীর লখিন্দর হয়ে ওঠে আধুনিক মানুষের বিপন্ন প্রতিভূ। লখিন্দরের প্রতীকি চিহ্নের আবরণে ধীরপদেেপ বাঙলা কবিতার কালমঞ্চে উঠে এসে স্বরাট অথচ পরিশীলিত কণ্ঠের দীপ্ত উচ্চারণে নিজের আগমন বার্তা জানান দেন স্বয়ং গানঅলা কাজী নাসির মামুন। কবিতার ক্যানভাস জুড়ে মানুষের অহংবোধ, হাহাকার, নস্টালজিয়া, উত্তরাধিকারের দায়, পূর্বপূরুষের ঋণস্বীকার, প্রকৃতির প্রতি গভীর প্রেমবোধ, গ্রামীণ জীবনের নানা অনুষঙ্গকে আন্তরিক দরদ দিয়ে চিত্রায়িত করেছেন। কোথাও দীর্ঘ অনুভবের বিচ্ছেদ ঘটে না।
মানুষের অসহায়তা, ণিক আনন্দের বিভ্রম, বিরহের অনলসুখ, অথর্ব মানুষের মোড়লীপনা, মানবিক প্রেম, মনোবৈকল্য, øেহপ্রবণতা, কাম ও কামশীতলতা, প্রকৃতির খেয়ালিপনা, নিষ্ঠুরতা এবং নান্দনিক রূপরাশির মোহনীয় চিত্র অঙ্কন করার পাশাপাশি নানা রকম  পরীা-নিরীার প্রমাণ সমেত, চিন্তা ও চেতনার একান্ত উপলব্ধি প্রকাশের স্বার আছে। সে সঙ্গে উপমার প্রাতিস্বিকতা এবং চিত্রকল্পের নৈপুণ্য কবিতাকে ব্যঞ্জনাঋদ্ধ করেছে। একবি শব্দ নির্বাচন ও গঠনে স্বতঃস্ফূূর্ত, কিন্তু পরিশ্রমী; নিটোল চিত্রকল্প নির্মাণে সিদ্ধহস্ত। তার কবিতা সালঙ্কৃত হওয়ার পরও অলঙ্কারের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে না, বরং চৌষট্টি কলায় পরিপূর্ণ হয়ে ছত্রিশ ব্যঞ্জনে বেজে ওঠে। আর আছে চোখ জ্বলা ঐন্দ্রজালিক যত চিত্রকল্পের সমাহার।
বাগান সংগুপ্ত রেখে
তুমি কেন পাথর ভালবাসো?
দেয়ালে শ্যাওলা জমে
কাঠামো গুঁড়িয়ে দিলে ধূলো জমে
প্রত্ম-প্রবেশিকায়
অতীত মোহিত করে তুমি কেন
     পিছনে হাঁটো?
তালগাছ নীরবে বাড়ে। ঝড়েও লুটিয়ে পড়ে না।
তোমাকে পাহাড় দিলাম।  মৌনতায় উঠে আসো।
(লবণ প্রার্থনার দিনলিপি : লখিন্দরের গান)
কাজী নাসির মামুনের পূর্ববর্তী কবিগণ বিশেষতঃ বাংলা কবিতার প্রথম আধুনিক পঞ্চপাণ্ডব এবং পরবর্তীতে শামসুর রাহমান ইউরোপ মনস্ক ও ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে তাদের কাছে ইকারুশ, ডেডেলাস, আলেক জান্ডার, লেলিনরা মহানায়ক হয়ে উঠলেও নিজের প্রাণের জিনিষ লখিন্দর, ঘরের মানুষ লালন, হাছন, লক্ষ্মণ সেন আর তিতুমীর কিংবা শ্রীকৃষ্ণ কেউই এদের চিন্তার জগতে ঢেউ খেলাতে পারে নি। ফলত তারা বাংলা ভাষায় ইউরোপিয় চিন্তা ও চেতনার এবং মিথের সার্থক ও মৌলিক অনুবাদ করেছেন মাত্র। ঐসব ধার করা অনুষঙ্গকে না পেরেছেন নিজের প্রাণের জিনিষে রূপান্তরিত করতে, না পেরেছেন বঙ্গীয়করণে স্বতঃস্ফূর্ততা অর্জন করতে। অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের অন্ধ-বিশ্বাস, লোকাচার ও লোক কাহিনীর সমন্বিত রূপ অঙ্কন করেছেন, প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ও প্রবহমান অনুভূতির ঢেউ জাগানিয়া চিন্তার স্রোতকে হৃদয়াঙ্গমের অনুষঙ্গ করেই। এসবের সমন্বয়ে তার নিসর্গপ্রীতি জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ এবং আবু হাসান শাহরিয়ারের নৈসর্গিক ভূবন থেকে ভিন্নতর ব্যঞ্জনায় ভিন্নতর রূপ পরিগ্রহণ করে অনিবার্য পরিণতির মত। মানব সভ্যতার ইতিহাস, নৃতত্ব, প্রকৃতির মগ্নচৈতন্যের বিবরণও বিধৃত করেছেন। কোথাও সিনেমাটিক লংশর্ট,  কোথাও আবার কোজ শর্টে বন্দী করেছেন অনেক নান্দনিক পরাদৃশ্যও।  প্রথাগত ধারণা ও চিত্রকল্পের বিপরীতে স্বতন্ত্র ও মৌলিক চিন্তার দ্যূতি ও চিত্রকল্প নির্মাণের ঝুঁকি কবি সচেতনভাবে নিয়েছেন। মানব প্রজাতির সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও প্রত্ম-ইতিহাস দিয়ে শুরু করে  নিজের জন্য একটি শক্ত অবস্থান নির্মাণ করেছেন সহজ শর্তে। কেরামান কাতেবিনকে দ্রাবিড় অঞ্চলের মাটিবর্তী লিপিকারেই পরিণত করেছেন। এটিই একজন মহৎ এবং সৎ কবির সবচেয়ে বড় গুণ ও কীর্তি। এভাবে তার কবিতা হয়ে ওঠে দ্রোহ-সঞ্জাত, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধের নিটোল এবং দীপ্ত উচ্চারণ। বাঙলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাস তার কণ্ঠস্থ, ভিত্তিভূম নিঃশংক ও সংশয়হীন। ফলে তিনি করতলে ধারণ করেন_আধুনিক বাংলা কবিতার অতীত, বর্তমান আর চিরকালীন কবিতার বাঁক ও বাঁকের ঢেউ এবং ঢেউ এর নিচের চোরা স্রোতও। ফলে স্বভাবতই উচ্চারণ করতে পারেন এমন অজর ও অবিনাশী পঙক্তিমালা_
ক্রন্দসী বেহুলা ঘুমে,
সোনার রেকাবে তার এসেছি নোলক।
মাছে-ভাতে স্বপ্নমোড়া গুপ্ত পুলসেরাত;
আমাকে দাঁড়াতে হবে।
কেরামান-কাতেবিন, দ্রাবিড় কিতাবে লিখ প্রত্ম-ইতিহাস।
অ-হল্য জীবন চরে এইখানে দাঁড়ালাম ধৃষ্টলাঠিয়াল:
আমার দখল নেবে কে আছে এমন?
(১০ম সর্গ : লখিন্দরের গান লখিন্দরের গান)
তার উচ্চারণের দার্ঢ্যে পাঠক চমকে ওঠে না; বরং অনিবার্য সম্মোহনে মোহিত হয়।
রনজু রাইম এ সময়ের প্রতিভাবান কবি। তার প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচু স্বরের সমন্বয় ও ভারসাম্যপূর্ণ শব্দসমবায়ের সংরাগ সৃষ্টি করে তাতে আপন স্বভাবের অনুকূলে স্বতন্ত্রস্বর নির্মাণের চেষ্টা করা। তার ভাষা মৃদু ও ঋজু। তার কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়_ব্যক্তির যাপিত জীবনে সৃষ্ট কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের প্রপঞ্চ কবিতা নয়। সংবেদনশীল পাঠক সংকটে-সংশয়ে এবং মনোবিকারের বিশেষ মূহুর্তে কবিতার গহনে ডুব দেন সত্য; কিন্তু সে অবগাহন তার জন্য কোন বস্তুগত সহায়ক অনুষঙ্গ না হয়ে উঠলেও মানসিক প্রশান্তির পথে তাৎপর্যপূর্ণ নিয়ামক শক্তি হিশেবে কাজ করে_নিরন্তর ভাবনার অবসরে ও মাহেন্দ্রণে।  সে অর্থে কবি ও পাঠক যদি হরিহর আত্মার সম্পর্কীয় হন, তা হলে কবির বক্তব্য এবং বাচন সমবায় সংক্রমিত হয় সহজ শর্তে ও শর্তহীন বিবেচনায় সংবেদনশীল পাঠক মনেও। বিশেষ সমাজ ব্যবস্থার বিশেষ জনপদের সংস্কৃতি ও চিন্তার সারাংশ ও মানব সমাজের আচরণের নানা অনুষঙ্গ কবি মনকে উদ্বেলিত করে; করে আবেগে মথিত। সে সঙ্গে বিশ্ব চরাচরের নানা প্রপঞ্চ কবি মনের গোপন কাক্সা ও প্রশ্নের উদ্রেক করে। যে প্রশ্নশীল মানসিকতাই কবিকে নিয়ে যায় বিশ্বচরাচরের নানা প্রান্তে ও প্রপঞ্চে। সংশিষ্ট বিষয় অথবা প্রপঞ্চ কবি মনে সে রেখাপাত করে, তার সহযাত্রী সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে বোদ্ধা পাঠক বলয়ও। যুগের প্রধান অসুখ ও মৌল সংক্রাম শনাক্ত করে, নতুন রুচির নির্মাণে কবির বোধের সঙ্গে পাঠকের কাক্সা সমান্তরাল না হলেও তি নেই; তবে পরস্পরের মধ্যে বোধের অসম বিনিময় হলেও কবিতার সৌন্দর্য উপলব্ধি সহজ হয়। অন্যতর বিবেচনায় সৎ কবি ও সংবেদনশীল পাঠক একই মনন রথের সারথী ও সহযাত্রী। তাই সৎ কবি স্বভাবতঃ প্রত্যাশা করেন সংবেদনশীল পাঠকের সহৃদয়তা ও নিবিড় পাঠোদ্ধার। কারণ, হয়তো নিবিড় পাঠোদ্ধার ব্যতিরেকে কবিতার সৎ উপলব্ধি সম্ভব নয়। তাই দেখা যায় তার কবিতায় অতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ও কবিতার অনুষঙ্গ হিশেবে দীপ্তি ছড়ায়। এই প্রস্তাবনার সমর্থনে তার একমাত্র কবিতাগ্রন্থ চিত্রল প্রতিবেদন থেকে শিমফুল কবিতার পাঠোদ্ধার করা যাক।
মেরেজ ডে-তে তুমি দিলে একটা শিমফুল
উপহার হিসাবে এটা অভিনব_ অদ্ভুত
শুনে আমার বন্ধুদের সহাস্য কৌতুক
আমার কাছে যদিও তা অতিশয় শ্রেয়
(শিমফূল : চিত্রল প্রতিবেদন)
ধর্মীয় বিশ্বাস বিতর্কে তিনি নিস্পৃহ। কোন রকম অযাচিত বিতর্কে জড়ানোর উদ্দেশ্য তার নেই। বাক সংহতি তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তালিকা প্রধান কবিতা কিংবা বিবরণ ধর্মীতাকে এড়িয়ে চলেন, সেখানে অনুভূতির বিশেষ মূহূর্তকে বাক্সময় করে উপস্থাপন করা তার মৌল প্রেরণা। স্বদেশের জলবায়ু, প্রকৃতি, নিসর্গকে কেন্দ্রে রেখে প্রান্তে বিশ্ব চরাচরের নানা প্রপঞ্চকে মূর্ত করে তোলার কাক্সা তার করোটিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার ও সমকালের নানা অনুষঙ্গ এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সারাংশকে  সৌন্দর্যে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় নতুন প্রপঞ্চ হিশেবে কবিতা পাঠক সমালোচক ও সতীর্থ কবিকূলকে প্রলুব্ধ করে। তাতে কবিতা আপামর জনরুচির পে সহায়ক না হলেও বোদ্ধা ও দীতি পাঠক শ্রেণীকে প্রাণীত করে_নিরন্তর সৌন্দর্য উপলব্ধির সন্ধিণ।  আনন্দ উপলব্ধি করতে হলে রনজু রাইমের কবিতার কাছে সৎ পাঠককে বার বার ফিরে আসতে হবে। যেহেতু কবিতা কোন সংকট মোকাবিলা করে না; করে না সমাধানও, সেহেতু কবিতার উদ্দেশ্য নিয়ে দুর্ভাবনায় সময় ব্যয় করাও অবান্তর। সৎ কবিতা স্থান-কাল-নৈতিকতা নিরপে প্রপঞ্চ; তাই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলাও সঙ্গত নয়। কালের প্রধান অসুখ নৈতিক অবয় ও য়িষ্ণু সভ্যতার অবস্থান্তরের প্রভাব কবির মনোভূমিকে আচ্ছন্ন না করে পারে না। তাই সমাজের বিভিন্ন পরিবর্তন তার লেখায় ফুটে উঠে_ অনিবার্য পরিণতির মতই।
কেবল সমাজ ও সমাজস্থ  মানুষের  বাহ্যিক  আচরণ  ও  সংস্কৃতিই  নয়; সঙ্গে মনস্তাত্বিক পটভূমিও কবির হৃদয়কে আন্দোলিত করে। কবি বিস্ময়-বিস্ফোরিত চোখে দেখেন প্রকৃতির সমস্ত লীলা, সঙ্গতি ও অসঙ্গতি। অনুভূতির সুক্ষ্মতম প্রকাশ কবি থেকে পাঠকের হৃদয়ে ও মননে সংক্রমিত হয় স্বতঃসিদ্ধ ব্যাধীর মতই। জীবনানন্দ দাশ প্রচলিত অর্থে নির্জনতার কবি কার্যতঃ বিষণ্ন ও নিঃসঙ্গ। একজন সাংসারিক মানুষের হঠাৎ মনোবৈকল্যের কারণ ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে তার অনিবার্য পরিণতির সংবাদ কবি পাঠকের জন্য রচনা করে যান_ অবচেতন মনে? এ উপলব্ধি একা জীবনানন্দ  দাশের এমনটা এখন আর ভাবা যায় না।  কারণ ইতোমধ্যে অসংখ্য বিভ্রান্ত মানুষ সময়ের নিষ্ঠুরতার কাছে হার মেনে জীবনকে অন্যতর দৃষ্টিকোন থেকে পর্যবেণের কথা ভাবছেন। কেউ কেউ জীবনের কাছে উত্তরহীন প্রশ্ন জমা রেখে অভিমানে জীবনানন্দের নায়কের ভাগ্যবরণ করছেন। জীবনানন্দ দাশও কি সে রকম ভাগ্য নির্ধারণ করেন নি নিজের জন্য? রনজু রাইমের কবিতা পড়তে পড়তে এ উপলব্ধি সহজতর হয় রনজু রাইম মূলত আত্মমগ্ন কবি। বিশ্ব চরাচরের নানা প্রপঞ্চ ও সংবাদে বিচলিত হলেও সে বিচলিত ভাব প্রকাশ পায় না; কিন্তু বিশ্বকে নিজের ভুবনে এনে আপন স্বভাবের অনুকূলে স্বতন্ত্র রঙ-রূপে উপস্থাপন করেন। এতে পাঠক বিস্মিত ও অনুপ্রাণিত হন।
চন্দন চৌধুরী এ সময়ের স্বরাট ও মৃদৃভাষী স্বতন্ত্রস্বরের কবি। তার কবিতার প্রধান সুর আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ও ভারসাম্য রা। এেেত্র তার সঙ্গে আরেক অন্যতম কবি কাজী নাসির মামুনের অন্তর্গত সাদৃশ্য রয়েছে বলে মনে করি। তার প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ যাবে হে মাঝি দিকশূন্যপুর এবং লাল কাঁকড়ার নদী। প্রথম কাব্যেই অগ্রজের ঋণভূমে দাঁড়িয়ে নিজের আগমন বার্তা জানিয়ে দেন। এ গ্রন্থে প্রকাশ নামক কবিতার সম্মোহনে আধুনিক সম্পন্ন পাঠকের মনোযোগ পূর্ণ আকর্ষণে সমর্থ কবি। দ্বিতীয় কাব্য লাল কাঁকড়ার নদীতে এসে কবি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমকালীন আর দশজন কবি থেকে আলাদা করে নিয়েছেন শব্দনির্বাচন_ গঠন ও অলংকার প্রয়োগের অনন্য শৈলীতে। জন্ম কবিতায় তার স্পষ্ট উচ্চারণ_শব্দ আমার কাছে শৈশবের লাটিম, হাতের তালুতে রেখে/ অবাক বোলাতে পারি। এবং শেষ দুই পঙক্তিতে সরল স্বীকারুক্তি_হরিণীর সমস্ত পেয়েও আমি সম্ভোগ শিখি নি; অথচ তার গর্ভেই / জন্ম নিয়েছে  আমার সমস্ত কবিতা। তার একবিতা পাঠ শেষে আরেক অগ্রজ কবি মজনু শাহ এর এই পঙক্তি মনে পড়ে যায়_বিজেত্রির ঘরে আমি যাই নি সেদিন; তবু লোকে আমাকেই বেরুতে দেখেছে। এ এক অনন্য উপলব্ধি। সৎ কবিতে কবিতে কালে কালে উপলব্ধির এ এক সমন্বয় ও ভারসাম্যের এবং  ঐতিহ্যের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধার শিল্পিত প্রকাশ। তার ধানের কবচ_ ২ কবিতায় যখন বলেন_ এইনে ছড়ালাম ধান, খেয়ে যা রে পাখি, খেয়ে যা তখন পাঠক হিশেবে স্মরণ করতে অনুপ্রাণিত হই, কাজী নাসির মামুনের রোগ লক্ষ্মণ ও তার গোলকধাঁধায়: পাঁচ চিরঞ্জীব বনৌষধি কবিতার এই পঙক্তির দ্যোতনাও_ পথে রোগনিকেতন। / উৎপেনের আশা হলে করবীর বিষ খেয়ে নিও। কিন্তু কী আশ্চর্য তবু দুইজনের কবিতার স্বাদ সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র। প্রথমজন স্বরাট স্বরে উচ্চারণ করেন অপরজন মৃদুস্বরে  আবহমান বাঙলার শস্যের সপে থেকে নারী ও ফসলের ভেতর সমন্বয় ও ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিতুলনাঋদ্ধ চিত্র অংকন করেন। তার উপলব্ধির আকাশ এতই স্বতন্ত্র ও একান্ত যে, খুব সহজেই তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় শুকনো বরফ কবিতায় এমন ব্যাঞ্জনাঋদ্ধ পঙক্তি_ বালকেরা ঘুড়ি নয়, এক-একটা বালিকা ওড়ায়। আসলেও তাই বালকের মনের আকাশে এক একজন স্বপ্নাদ্য বালিকার দেহমনই ওড়ে, যা চিরকাল অস্পৃশ্য ও অধরাই থাকে। তবু শেষ পর্যন্ত এযাবত তার শেষ্ঠতম কবিতাটির নাম প্রকাশ। আর আপতত অনিবার্য সত্য এই যে, প্রকাশ কবিতাটি চন্দনের কবি মানস উন্মোচনের পে প্রায় বার আনা স্যা বহন করে।
রাগিও না নত্র ছেপে দেবো
সেই যে মিনুদি
কৈশোরের গল্পচ্ছলে
দেখিয়েছিলেন দুধাল কোমর
এর আগে বুঝি নি
মানষের কোমরে যে নদী বাস করে
শোনা যায় ঢেউ এর আওয়াজ
রাগিওনা, বলে দেবো সেই কথা।
(প্রকাশ: চন্দন চৌধুরী)
এই যে বোঝা না বোঝার সংবেদ,  সে সংবেদই কি কবি চন্দন চৌধুরীকে সমকালীন আর দশজন কবি থেকে আলাদা করতে পেরেছে? না কি তার প্রকাশ প্ররণের ভিন্ন কোন শৈলী তাকে অনন্য করেছে? সবার কাছে একই রকম উত্তর পাওয়া যাবে মনে হয় না। আর তা সম্ভবও নয়। তার কবিতায় পঁচে যাওয়া নষ্ট সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংুব্ধ মানসকে শিল্পীত মহিমায় উজ্জ্বল করে তোলার গূঢ় মন্ত্র তার করোটিতে অনুরণন তোলে জীবনের ঘাতপ্রতিঘাতকে মোকাবিলা করার বিশেষ মূহূর্তে। এ কবি নিরন্তর যাত্রা পথে দৃঢ়পদেেপ এগিয়ে যাবেন এবং নিজেকে ও সমকালীন অন্য কবিদের অতিক্রমণের চেষ্টাও করবেন, এমনটা মনোযোগী পাঠক হিশেবে অন্য অনেকের মত আমারও।
মাদল হাসান ঐতিহ্য সচেতন। তার কবিতায় কুসংস্কার, অপবিশ্বাস ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ প্রকট হলেও তা শিল্পের দাবীকে অস্বীকার করে না। নিছক বক্তব্য সর্বস্ব শব্দপুঞ্জ নয় তার কবিতা। তার কবিতায় নিজের ও সমাজের নানা অনুষঙ্গ নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠে। জীবনের কোন উপল্যই মিথ্যা বা অনর্থক নয়। বাঁশিঅলা কবিতায় তার দীপ্ত উচ্চরণ:
নিশ্চিত কিছুই শেখাবে না বাঁশিঅলা
ইঁদুর তাড়াবে না সে একথাও ঠিক
শুধু চায় জনে জনে বাঁশি কিনে নিক
তবু ‘চলে যাও’ একথা যাচ্ছে না বলা
(বাঁশিঅলা : মাদল হাসান)
কারণ কবিকে প্রকৃত উপো করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে না চরচরের কোন হৃদয়সংবদী মানুষ।
অতনু তিয়াস শিল্পসচেতন ও স্বতন্ত্রপ্রয়াসী কবি। তার রাংসার কলরোল কাব্যের ওড়ো, পাখি ওড়ো কবিতায় ত্রিভুজ সন্ধ্যায় আকাশে জ্বেলেছো কে অচেনা লণ্ঠন জাতিয় পঙক্তিতে শিল্প সত্ত্বার প্রতি প্রগাঢ় প্রশ্নশীল বিস্ময়ানুভূতি সপ্রকাশিত।
ত্রিভুজ সন্ধ্যায় আকাশে জ্বেলেছো কে অচেনা লণ্ঠন
আমাকে দীতি করো আলোব্রহ্মজ্ঞানে
ভারাক্রান্ত মেঘগুলো পুষে আছি বহুদিন
উষ্ণতা ঢেলে কোনোদিন বৃষ্টি ঝরাবো বলে
বৃষ্টির চুমোয় যদি হেসে ওঠে অন্তত একটি ঘাসফুল
বোবা সময় যদি বলে ওঠে শ্রেষ্ঠ কথকতা
(ওড়ো, পাখি ওড়ো : অতনু তিয়াস)
জাকির জাফরান ইতোমধ্যে তার কণ্ঠস্বরকে আলাদা করতে সমর্থ হয়েছেন। তার চিঠি কবিতাটি অনেকটাই চন্দন চৌধুরীর প্রকাশ কবিতার সমগোত্রীয়। এখানে স্বল্পতম শব্দসমবায়ে মূর্ত হয়ে উঠে মানুষের ভাবনার এক স্তর থেকে অন্যস্তরে অবগাহনের জটিলতম পথ। এখানে একটি ুদ্্র কবিতায় মানবমনের গূঢ় সত্যকে বাক্সময় হতে দেখি।
আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন
বললেন: ধরো, ডালে-বসা দুটি পাখি থেকে
শিকারির গুলিতে একটি পাখি মরে গেল
তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি?
অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেল
বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে-পাখিটির দিকে
আর মনে এলো তুমি আজ স্কুলেই আসো নি।
(চিঠি : জাকির জাফরান)
এই বোধ ব্যক্তিগত নয় কিছুতেই। নৈর্ব্যক্তিক ও সার্বজনিন অনুভবের। এবং এ ব্যথা সকলশ্রেণীর সংবেদনশীল মানুষেরও।
ফেরদৌস মাহমুদ ঐতিহ্য সচেতন শেকড় সন্ধানী কবি। তার বিশেষ কৃতিত্ব চিত্রকল্প নির্মাণে প্রাতীস্বিকতা অর্জনের পথে নিজেকে সচেতনভাবে চালিত করা। আবার সমকালীন ও অগ্রজ কবিদের কাব্যভূমকে ঋণভূম জেনে নিজের জন্য স্বতন্ত্র কাব্যভূম নির্মাণের পথে কাক্সাপোষণও গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞান বলে মনে হয়। তার কাব্যের নাম সাতশো ট্রেন এক যাত্রী, নীল পাগলীর শিস। প্রথম কাব্যেই নিজের স্বতন্ত্র স্বরে পাঠককে সহসা সচকিত করে তুললেন। তার অনুভূতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠে_ লাল ঘুড়ির মায়ের মৃত্যুতে কবিতায় বন্ধু তার বাবার গমেেত উড়িয়ে দিয়েছে বিষাদের পায়রা মা / উড়াতেন। মা আসলে বিষাদের পায়রা উড়াতেন কি না বলা মুশকিল; কিন্তু সন্তান মাত্রই মাকে দুঃখিনী ও শোষিত হিশেবে শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে দেখে। ফেরদৌস মাহমুদের বড় কীর্তি_ তিনি বিষয়কে গুরত্বপূর্ণ অনুষঙ্গে বিবেচনা করতে ও ভাবাতে পারেন। বিষয়কে তিনি চারিয়ে দেন বিষয়হীনতার ধুম্রজালের দিকে। পাঠক বিভ্রান্ত না হয়ে উল্টো বিমোহিত হয়।
 যে দরজা নক করলো সে হচ্ছে আমি
যে দরজা খুললো সেও হচ্ছে আমি
যিনি কিছুই করলেন না তিনি হচ্ছেন
আমাদের লাশ
         কবরে নেমে চকলেটের গন্ধ ছড়ান
(জন্মদিনের কেক : সাতশো ট্রেন এক যাত্রী)
যে কি না আত্মপরিচয়কে কুহেলিকাপূর্ণ করে তুলতে ভালবাসে সেই কবিই নিঃসঙ্গ উল্কা কবিতায় উপলব্ধি করেন_সুমি আন্টির খুব প্রিয় আমার শরীরে লাফানো শীতের ব্যাঙ। শীত রাতের এ রোমাঞ্চিত অভিজ্ঞতার যার ঝুলিতে সেই তো দেখে শীতের কাব্য কবিতায় ছড়ানো ধানের উঠোনে শুকনো খড়ের বিছানা।  এ চিত্রকল্প আবহমান গ্রাম বাংলার কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার সুষম মানচিত্র। তাই আন্তর্জাতিক রাজনীতি, রাষ্ট্র ব্যবস্থার অসারতা নিয়ে প্রতিটি সচেতন সংবেদনশীল মানুষের মত এ কবিও উদ্বিগ্ন ও বিচলিত। রাষ্ট্রীয় সংকীর্ণতার বেড়াজালকে ছিন্ন করে কবি হয়ে উঠতে চান বিশ্ব নাগরিক। তার এ বোধ বাওকুড়ানী হাওয়ায় উড়ে যাওয়া খড়কুটো নয়;মৃত্তিকার গহনে গ্রথিত নাটাইঅলা ঘুড়ির সঙ্গে তুলনা চলে। নীল পাগলীর শিস কাব্যে নীল পাগলীর শিস কবিতায় দেখেন_ জোনাকগুলো আলোর ধান হয়ে জ্বলছে মিটমিট আকাশের খাটে। তার কাছে সময় রাষ্ট্রীয় ধারণার মতই ইতস্ততঃ বিপ্তি। সমকালীন রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোকে তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রুপে জর্জরিত করেছেন কবি। বনের নির্বাচন কবিতায় দেখান_ নির্বাচনী পক্রিয়ায় ভোটারদের  কোন গুরুত্ব নেই। অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কোন সম্পর্ক নেই।
বনের রাজা ফল খাবেন, মাংস খাবেন না
এই শীতে
হরিণরা ভোট দিলো তাকে,
মানুষ বন কাটলো, মাংস খেলো
ফল খেলো
উড়ে গেলো ভোটারদের চোখ-মুখ-নাক
হাড়ের মালার দেশে।
(বনের নির্বাচন : নীল পাগলীর শিস)
এভাবে ফেরদৌস মাহমুদ স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আপন মৃত্তিকার প্রেমে মুগ্ধ হতে হতে বিশ্ব নাগরিকের পথে পদপে ফেলেন। আর এভাবে তিনি হয়ে উঠেন সমাকালীন বাঙলা কবিতার অনন্যস্বর।
মানব চরিত্রের দুই বিপরীত প্রবণতার যুগলবন্দি আচরণের গল্প বয়ন করেন মামুন রশীদ। বিশ্ব চরাচরের বস্তুগত সত্য ভাবজগতের কল্পসত্যের বিশাল আয়োজনের ভেতর স্ববিরোধি আচরণ মূর্ত হয়ে উঠে। বিষয়টা সদর্থক না নঞর্থক তাতে মানুষের আকাক্সার এবং পরিশীলিত স্বপ্ন প্রণয়নের েেত্র তেমন কোন প্রভাব ফেলে না। কিন্তু যু্িক্তনিষ্ঠ মানুষের মনে সন্ধিগ্ধ প্রশ্নের উদ্রেক করে। মামুন রশীদ সে সন্ধিগ্ধ প্রশ্নের উৎস ভূমির বিশেষ মুহূর্তকে মূর্ত করে তুলতে জানেন আপন স্বভাবের অনুকূলে। তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ কালো পাতা ওড়ো সাদা ছাঁই থেকে এর যাত্রা শুরু; এবং দ্বিতীয় কাব্য কুশল তোমার বাঞ্ছা করিতেও সে প্রবণতা বহমান।
মুকুরে প্রতিফলিত মুখ কখনো সত্য বলে না
তবু আমরা আস্থা রাখি বারবার মুকুরেই।
সীমান্তঘেঁষা শরণার্থী শিবিরে দূর ভূমি থেকে অস্পষ্ট
নিভু নিভু আলোকরেখার দেখানো পথে
চৈত্রের হঠাৎ দমকা হাওয়ায়
গাছের পাতায় লিখে রাখা প্রিয় মুখ
ঝরে যায়; শিবিরে হুটোপুটি করা শিশুর সরল চোখে
দুপুরের আলস্য ভেঙে নামগুলো মালা গাঁথে।
কোনো দুঃসংবাদ নয়, বরং প্রতিদিন ডানা-গজানো ঘুড়ি ওড়ে
মুকুরে প্রতিফলিত মিথ্যে মুখের মতো, বদ্ধ কুঠুরিতে।
(প্রবাস : কুশল তোমার বাঞ্ছা করি)
এভাবে মামুন রশীদ সতীর্থ কবিদের থেকে নিজেকে আলাদা করে নেন। ফলে একটু মনোযোগ সমেত তার কবিতা পাঠান্তে পাঠক কোরাসের ভেতরও শনাক্ত করতে পারে তার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। মামুন রশীদ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে শব্দের পর শব্দ গেঁথে নৈর্ব্যক্তিকতায় উন্নীত করেন। কবি হিশেবে সার্বজনীন অভিজ্ঞতা ও বোধের কথাও মাঝে মধ্যে চারিয়ে দেন তার কবিতার পঙক্তির ভাঁজে ভাঁজে। এই যে সার্বজনীন অভিজ্ঞতা কিংবা বোধের আয়নায় প্রত্যেকের মুখ দেখার ও  চেনার আকাক্সা কবির, সে তৃষ্ণা তাকে স্বতন্ত্ররূপে উপস্থাপন করে পাঠকের সামনে। 
অবনি অনার্য ঐতিহ্য সচেতন, মিথপ্রেমি কবি। প্রবাদ ও মিথের মিথস্ক্রিয়ায় অবনি নিজেকে আর দশ জন থেকে আলাদা করে নিয়েছেন।  কণ্ঠস্বর মৃদু কিন্তু ঋজু। তার কবিতার বই লঘু চালে চোরাবালি খেলা ও সরস সতী। সরস সতী কাব্যেই আপন স্বভাবকে উন্মোচন করে নিজের কণ্ঠস্বরকে চিহ্নিত করার বৈশিষ্ট্য অঙ্কন করতে পেরেছেন।
মান-অভিমান মানি ‘রাগ’ এর ঝামেলা মেলা ধারা
‘রাগ’ যদি ধরো তবে ‘ঠাট” জানা চাই তার আগে
ঠাটের আগেতো জানো সপ্তকে পটু হওয়া লাগে
জানো তো সপ্তদশী উদারা মুদারা আর তারা
তার আগে স্বর শেখো, না_জানিলে একসাথে চলো
আমি তাল দেই, তুমি স্বরচিত স্বরে কথা বলো
(ধ্র“পদী প্রেমের কাব্যে : সরস সতী)
কবির কাজই হল স্বরচিত স্বরে কথা বলা। তার আগে নিজের জন্য স্বর সৃষ্টির অনুশীলনের আয়োজন করাও। অবনি অনার্য সে আয়োজকদের অন্যতম, যারা নিজের জন্য স্বর সৃষ্টি করেন এবং অন্যকেও প্রলুব্ধ করেন।
ইসলাম রফিকের কবিতায় গ্রামীণ জীবনের প্রতি পপাত ও স্মৃতিমেদুর গ্রামীণ আবহ পাঠককেও স্মৃতি ভারাতুর করে তোলে। গ্রাম থেকে শহরে আসা অভিবাসী মানুষের মনের মানচিত্র আঁকতে গিয়ে ইসলাম রফিক কেবলই স্মৃতির ভাঁড়ার হাতড়ে বেড়ান। তার প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থের নাম বিজন দ্বীপের বিশ্বাসী বালি হাস। প্রথম কবিতা গ্রন্থে অগ্রজের ঋণভূমকে পলবিত করার পে আপন স্বভাবের স্বপে দৃশ্যের পর দৃশ্য এঁকে তিনি স্বতঃসিদ্ধতার স্বার রাখতে পেরেছেন।
হাঁটতে হাঁটতে পথিক হয়েছি
ভালবাসতে বাসতে প্রেমিক
এখনো কিছুটা রোদ ওঠে উঠোনে
এখনো কিছু আলো দেয় নির্দিষ্ট চাঁদ
এবং তাই_
কিছুটা ধাতু দুর্বলতা নিয়ে
এখনো সঙ্গম করে
সাগাটিয়া গ্রামের রফিক
(পরিবার তন্ত্র : বিজন দ্বীপে বিশ্বাসী বালি হাস)
নিটোল সৌন্দর্য উপলব্ধির অসহনীয় বাকসংযমের শিল্পীত বয়নের রূপকার এ সময়ের কবিকণ্ঠ রবুশেঠ। যুগপৎ দুই বিপরীত চেতনার অন্বয়ের নাম নিসর্গের ঢোল। তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ। অতিবাক সংযম কিংবা স্বল্পভাষিতা সবসময় কবিতার প,ে কবির স্বপে মাঙ্গলিক সংরাগের প্রত্যয় নিয়ে নাও আসতে পারে; কিন্তু কেবল সৃষ্টির প্রাচূর্যের বিপরীতে, সৌন্দর্যের বিপুল আয়োজনের ভেতর সে মিতবাক শৈলীও বত্রিশ ব্যঞ্জনে বাক্সময় হয়ে ওঠে।
চিলমারীর দুঃখ শুয়ে আছে বালুর স্মারকে
তাকে নিয়েছিল এক অন্ধকার সাঁকোর নিচে
গভীর রাত্তির।
ব্রহ্মপুত্রের জঠরে আঁকা হিজিবিজি চিত্রকল্প
ওইখানে মায়ের আঁতুড়
মামার রক্ত অভিমান;
(অন্ধকার সাঁকো আর উন্মাদের গল্প : নিসর্গের ঢোল)
উপর্যুক্ত কবিরাই আজকের বাঙলা কবিতার  শেষ  কথা  নয়।  এদের  বাইরে  প্রান্তিক অঞ্চলের নিভৃতচারী কবি শামীম হোসেন, ইমতিয়াজ মাহমুদ, বিরেন মুখার্জি,  ফজলুল হক তুহিন, মাসুদ আহমেদ অর্ণব, মোস্তাফিজ কারিগর, অচিন্ত্য চয়ন, ইউসুফ তাপস, সিদ্ধার্থ শংকর ধর, সিদ্ধার্থ টিপু, সোমেশ্বর অলির কণ্ঠস্বরও আলাদা ও স্বতন্ত্র। এরা যে কেউ উত্তরকালে  একেকজন মহিরুহ হয়ে উঠবেন না, তাই বা বলি কী করে?
উপমা নির্মাণের েেত্র ইন্দ্রিয় স্পৃশ্য উপমার প্রাবল্য কেবল জীবনানন্দ দাশেই লণীয়, তা নয়, আজকের কবি কাজী নাসির মামুন, চন্দন চৌধুরী, মামুন রশীদ, ফেরদৌস মাহমুদ, অবনি অনার্য, মাদল হাসান, বিনয় সরকারদের কবিতায় উজ্জ্বল ও অনন্যরূপে প্রকাশিত। তবে অনেকের কবিতায় চিত্রকল্প নির্মাণে অযৌক্তিক ও কার্যকারণ সম্পর্ক রহিত সম্বন্ধ স্থাপনই অভিনবরূপে প্রতিভাত হতে দেখি। বস্তুর রূপের সঙ্গে বস্তুর গুণের সাদৃশ্য কল্পনার মধ্য দিয়ে নতুন ধরণের চিত্রকল্প নির্মিত হল। আজকের কবিতায় পরাবাস্তব চেতনা প্রচ্ছন্নরূপে প্রকাশিত; শব্দ নির্বাচন ও গঠনে আপন স্বভাবের স্বার স্পষ্ট। অগ্রজ ও সমকালীন কবিদের  থেকে আপন আপন কণ্ঠস্বরকে আলাদা করতে পেরেছেন মূলত শব্দকে নিজস্ব শৈলীতে উপস্থাপনের মাধ্যমেই। সমকালীন মিছিল কিংবা কোরাস  থেকে স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে কেউ কেউ সচেতনভাবেই  ছন্দ স্পন্ধনঋদ্ধ গদ্যছন্দের সাবলিল প্রয়োগে স্বতঃসিদ্ধতা অর্জনের পথে। দুই একজনের নিরূপিত ছন্দকেই বশিভূত করে স্বতন্ত্র স্বরে কথা বলার গুনটি রপ্ত করার সচেতন প্রয়াস লণীয়। এরা শেকড়সন্ধানী। কবিতায় অতি তুচ্ছ বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে কারও কারও কবিতায়। এ কবিগোষ্ঠীর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, মিথ ও লোক কথার মিথস্ক্রিয়ায় নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণ করা ও আবহমান বাঙালির সংস্কৃতি লালনে তাদের  আত্মবিশ্বাস অটল ও সুনির্দিষ্ট। চিন্তার কেন্দ্রে স্বদেশের মৃত্তিকা ও সংস্কৃতি, প্রান্তে বিশ্বচেতনার রেশ। লৌকিক বাংলার বিভিন্ন মিথ ও অনুষঙ্গের আধুনিকায়ন, সমকালকে মহাকালের পালক পরানোর দীা এদের আছে। কবিতায় অনেক স্পর্শকাতর অনুষঙ্গ ও বিষয়ক প্রথাগত বিশ্বাস ও রীতির সমন্বয়ে আপন কাব্যভাষা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। এ কবিগোষ্ঠীও পূর্ববর্তী আধুনিক কবিগোষ্ঠীর মতই দীতি ও বোদ্ধা পাঠক বলয় পার হয়ে সাধারণ পাঠক বলয়ের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেন নি। এরা মূলত নিজেরাই নিজেদের কবিতার নিবিড় পাঠক ও সমালোচক। নির্মোহ সমালোচনা এদের ভাগ্যে তেমন জোটে নি_এমন সংশয় কি অমূলক? এ কবিগোষ্ঠী আপন আপন সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার নানা অনুষঙ্গ উপমা, চিত্রকল্প ও বক্রোক্তির নতুন প্রকাশ প্রকরণে স্বকীয়তার পথে সক্রিয়। নিরন্তর পরিচর্যায় আত্মমগ্ন হলে অদূর ভবিষ্যতে আজকের কেউ কেউ নতুন বাঁক সৃষ্টির পথে উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন না কে বলবে? সার্বিক বিচারে আধুনিক বাঙলা কবিতার ইতিহাসে সমকালীন কবিতা যতটা না হৃদয়গ্রাহী তারও বেশী বৈদগ্ধ্যপূর্ণ ভাব-ভাষা-চিন্তা-চিত্রকল্পের ও অনুভবের পরম্পরার সুনিয়ন্ত্রিত বিন্যাসে।

Post a Comment

1 Comments

  1. লেখাটি দেরীতে হলেও পড়লাম। বহু পঠনপাঠন ও ভাবনার মৌলিকত্বের ছাপ আছে লেখাটিতে। লেখকের সাথে সব ক্ষেত্রে আমি সহমত পোষণ করি না কিন্তু যেখানে সহমত নই, সেখানেও তার যুক্তির জোর আমাকে ভাবায়। এ ধরনের মননশীল লেখার খুবই প্রয়োজ। মোহাম্মদ নূরুল হক নিজে কবি বলে তার মননশীল লেখাও সৃজনশীলতাগুণে সমৃদ্ধ।

    ReplyDelete