মোঃ ইসরাফিল আলম এমপি
সারসংক্ষেপ: এ পৃথিবীতে বিক্ষেপচিত্রের মত ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে নানান
জাতি ও আদর্শের মানুষ। বিভিন্ন জাতির
মত বাঙালি জাতিরও রয়েছে এক সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে। তাই বাঙালি জাতি
তার স্বসত্তায় গৌবারান্বিত, মহিমান্বিত ও অনুপ্রাণিত। বিভিন্ন দেশ ও জাতির সমন্বয় ঘটেছে কালের পরিক্রমায় যা অতিসংক্ষেপে আলোচনা করা অতীব দুরূহ
ব্যাপার. তবুও অল্প
সময়ে স্বল্প পরিসরে বাঙালি জাতি সত্তার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে আলোচনা করার
প্রয়াস থাকবে আলোচ্য প্রবন্ধে।
বাংলাদেশের ইতিহাসকে সুষ্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় আট শতক থেকে। এর পূর্বের ইতিহাস আছে,
কিন্তু তা সুস্পষ্ট নয়। তখন সুষ্পষ্টভাবে এবং বিশেষ ধারাক্রম অনুসারে এ অঞ্চলের কর্মকা- প্রবাহিত হয়নি। সুতরাং সে সময়কার কথা আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করার কোন প্রয়োজন হয় না। অষ্টম শতক থেকে
পাল রাজত্বের আরম্ভ। তারা এ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজ্য শাসন করতেন। তাদের
আমলে সুষ্পষ্ট এবং শৃঙ্খলিত কোন নগর-জীবন গড়ে ওঠেনি। এর ফলে সে সময়কার সংস্কৃতি জনসাধারণের মধ্যে
ছড়িয়ে ছিল। নৃত্য,
গীত এবং লোকরঞ্জনের বহুবিধ উপকরণ সকল মানুষের আচরণবিধি এবং জীবন যাপনের মধ্যে
ছড়িয়ে ছিল। পালরা
যেহেতু বৌদ্ধ ছিল,
সুতরাং তারা মানুষে মানুষে বিভাজন মানত
না। তখন এমন অবস্থা ছিল যে, কর্মের দায়ভাগে এবং অধিকারে একজন শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারত,
আবার ব্রাহ্মণও ইচ্ছা করলে শূদ্র হতে পারত। শূদ্র হওয়াটা তখন ঘৃণার বা অপরাধের ছিল না। বাংলা ভাষার প্রথম
কবি সরহপা ব্রাহ্মণের পুত্র ছিলেন, বড় হয়ে তিনি বৌদ্ধ
ভিক্ষু হন এবং নালন্দা বিদ্যাপীঠের একজন আচার্যের সম্মান লাভ করেন। তিনি তাঁর
জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে একজন অন্ত্যজ শ্রেণীর রমণীকে গ্রহণ
করে নিু পর্যায়ের মানুষের মধ্যে বসবাস
করতে থাকেন। এভাবে
তিনি নিজের জীবন
দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, মানুষের পরিচয় হচ্ছে তার বুদ্ধিতে, বিবেকে, অনুভূতিতে এবং মননে, তার পরিচয় জাতিগত বিচারে নয়। রাষ্ট্রের মধ্যে জাতির ভূমিকায় বলা যায়, রাষ্ট্র কখনো
সাগরের বুকে একটি
দ্বীপের মতো হঠাৎ
জেগে ওঠে না। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমারেখারও একটি পুরাতত্ত্ব থাকে, তার একটি অতীত
থাকে। বর্তমান জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম হলো পূর্বপুরুষদের সংগ্রামেরই ধারাবাহিকতা। সেই সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত ভিত্তিভূমিতে প্রোথিত হয় বর্তমান স্বাধীনতার শিকড়। বাংলাদেশের রাষ্টসত্তা ও জাতিসত্তার উদ্বোধন ও বিকাশ ঘটেছে এ পাললিক জনপদের মানুষদের নিরন্তর সংগ্রাম ও অব্যাহত সাধনার মাধ্যমে। এই সংগ্রামের রয়েছে এক বিষ্ময়কর ধারাবাহিকতা ও অসামান্য বহমানতা। সুপ্রাচীন সভ্যতার গৌরব-পতাকা
হাতে এই অঞ্চলের সাহসী ও পরিশ্রমী মানুষেরা শত শত বছর ধরে লড়াই
করেছেন আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তাদের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ সংগ্রাম ও মুক্তির লড়াইয়ের মধ্য
দিয়ে যুগ যুগ ধরে এই জনপদ
বিবেচিত হয়েছে উপমহাদেশের বিশাল মানচিত্রে আর্যপূর্ব সুসভ্য মানবগোষ্ঠীর নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থলরূপে। এ এলাকার জনগণের অস্তিত্ব ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সংগ্রামে স্তরে স্তরে
সঞ্চিত হয়েছে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা। নিকট-অতীতে এ লড়াই
তীব্র হয়েছে ইংরেজ
ও তাদের এদেশীয় কোলাবোরেটর বর্ণহিন্দুদের সাথে। আর্যরা তাদের অধিকার বি¯তৃত করে নানা
ঘোরপথে যখন এ বদ্বীপে উপনীত হলো,
তখন থেকে একেবারে হাল আমলের বাংলাদেশের জনগণের আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াই পর্যন্ত এ জাতির সংগ্রাম ও সংক্ষোভের মূলধারা রচিত
হয়েছে অভিন্ন প্রেরণার এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে।
এ অঞ্চলের মানুষের বংশধারায় বহু-বিচিত্র রক্ত প্রবাহের মিশেল ঘটেছে। সেমিটিক দ্রাবিড় রক্তের সাথে এসে মিশেছে অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলীয়, এমনকি
আর্য-রক্তের ধারা। এ প্রবাহ এমনভাবে মিশে গেছে যে, নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় কাউকে এখন আর স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। চেহারার বৈচিত্র্য সত্ত্বেও এলাকার গরিষ্ট মানুষের মিল রয়েছে তাদের জীবনদৃষ্টিতে। জীবনদৃষ্টির অভিন্নতাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে তাদের
জীবনের অভিন্ন লক্ষ্য এবং একত্রে বসবাসের ও জীবনধারণের স্বতঃস্ফূর্ত বাসনা
ও প্রতিজ্ঞা। অভিন্ন বোধ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে জন্ম হয়েছে
তাদের একটি জীবনচেতনা ও আচরণরীতি। তাদের আকাক্সক্ষায় ও তাদের
সংগ্রামে এই জীবনচেতনারই স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। তাদের সংগ্রামের লক্ষ্যকে এই জীবনচেতনাই নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং নির্মাণ করেছে
তাদের ইতিহাস। এভাবে
এ এলাকার মানুষের বোধ, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনার ভিত্তিতে পরিচালিত নিরন্তর সংগ্রামের ধারাকে অবলম্বন করেই
তাদের একটি পরিচয়
নির্মিত হয়েছে। এ পরিচয়ই তাদের জাতিসত্তার ভিত্তি।
প্রাচীন বাংলার ভূখ-
খ্যাত অঞ্চলগুলো বিভিন্ন নামে
পরিচিত ছিল যা বর্তমানে বঙ্গদেশে বা বাংলাদেশ নামে পরিচিত। ঐ ভূ-খ- গুলোতে যে জনগোষ্ঠিদের নিয়ে বসতি গড়ে উঠেছিল সরল ও সংক্ষিপ্তভাবে তারাই বাঙালি জাতি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে। তাই পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদিম মানব সভ্যতার ও জাতিসত্তার বিকাশ যে ভাবে ঘটেছিল বাঙালি জাতির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশের ভূখ-ে মানব জাতির বসতি
কখন কিভাবে শুরু
হয়ে সে সম্পর্কে পুখানুপুঙ্খ ভাবে জানা
না গেলেও প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলার পার্বত্য সীমান্ত অঞ্চলেই মানব
বসতির শুরু হয় এবং সময় ও জীবন-জীবিকার তাগিদে বিভিন্নভাবে তারা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বৈদিক গ্রন্থাদিতে বাংলার নর-নারীকে অনার্য ও অসভ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর্যরা আসার পূর্বে বিভিন্ন জাতি এ ভূখ-ে বসবাস
করতো- তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে পশ্চ্যাৎপদ হলেও
আর্যদের আগমন এবং সংমিশ্রণে তারা শিক্ষা, দীক্ষা ও সভ্যতায় সমৃদ্ধ হয়ে হয়ে বাঙালি জাতির পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত। জানা যায় আর্যপূর্ব বাঙালিদের উত্তরসূরী হিসেবে এখনো বাংলাদেশে যারা আছে তারা হলো-
কোল, শবর, পুলিন্দ, হাড়ি, ডোম, চন্ডাল- যারা আদিবাসী হিসেবে পরিচিত। ভারত বর্ষের অন্যান্য প্রদেশে এবং তার বাইরেও এ জাতীয় মানুষ পাওয়া
যায়।
বর্তমানে বাঙালি জাতির
জনজীবন প্রায় ১৫০০
বছর ধরে নানা
জাতি ও বর্ণের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। তবে মূল কাঠামো সৃষ্টি হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মুসলমানদের আগমন ও মুসলিম শাসনের পূর্ব পর্যন্ত। বাঙালি জাতিসত্ত্বার উৎপত্তি, উপাদান ও বিকাশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ-
অষ্টিক জাতি: ইন্দ্রোচিন থেকে আসাম হয়ে বাংলায় আগত, বাংলা
জাতীয় জীবনের ভাষা
ও সৃস্কতিতে তাদের প্রভাব গুরুত্বপুর্ণ। তারা ৫/৬ হাজার
পূর্বে এসেছে।
দ্রাবিড়: প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড় জাতি এসে অস্টিকদের গ্রাস করে। যেহেতু তারা সভ্যতায় অগ্রগামী ও সমৃদ্ধ ছিল। দ্রাবিড় ও অস্টিকদের সংমিশ্রণে বাঙালি জাতিগোষ্ঠির সৃষ্টি। তাদের
রক্তই এ জাতির
দেহমনের মধ্যে প্রবাহমান। তাদেরকেই বাঙালি জাতিসত্তার মেরুদ- বা আদিসত্তা বলা হয়ে থাকে।
আর্যজাতি: এভাবেই চলছিল
বাঙালি জাতির বিকাশধারা, তার সাথে এসে যোগ হয় আর্য
জাতি। মৌর্য বিজয়
থেকে গুপ্ত বংশের
অধিকার পর্যন্ত ৮০০শত
ধরে বঙ্গজনপদে ক্রমে ক্রমে আর্যীকরণের পর্ব চলে। তবে গুপ্ত
যুগেই আর্যভাষা ও সংস্কৃতি সুদূর রূপলাভ করে। আর্যরা আর্যবত ত্যাগ করে উত্তর
ভারতে আগমন করে পরে মগ্ধ, অঙ্গঁ,
মিথিলা, কলিঙ্গঁ, রাঢ়,
বঙ্গে নিজেদের ভাষা
ও সংস্কৃতির প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করে। আট শতকে আরবীয়রা বাংলায় ধর্ম প্রচার ও ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য আগমন করে এবং বাঙালিদের সাথে সংমিশ্রিত হয়- তার অনুসরণে নিগ্র রক্তবাহী হিবশিরাও (কাবুলিওয়ালা) এদেশে আগমন করে,
তাদেরকে নেপ্রিটো (নিগ্রপ্রকৃতির) বলা হয়। তাদের সংমিশ্রণ এবং প্রভাব বাঙালি জাতীয় জীবনে অনস্বীকার্য বিষয়।
মঙ্গলীয়: বাঙালি জাতির
আর্যীকরণের পরে মঙ্গলীয়দের আগমন ঘটে বাংলায়। তারা বাঙালি জাতির
মূল ধারায় খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, তবে তারা বাংলার উত্তর
ও উত্তরপূর্ব এলাকায় বসতি গড়েছিল। এরা এখন গারো, কোচ,
ত্রিপুরা, চাকমা ইত্যাদি উপজাতি নামে পরিচিত। এই ভাবেই অন্তত:
১৫০০ বছরের দীর্ঘ
অনুশীলন গ্রহণ, বর্জন
ও রূপান্তরিকতার ভেতর দিয়ে
বাঙালি জনজীবন গড়ে উঠেছে। তাই বর্তমান বাঙালি জাতি অস্টিক, দ্রাবির, আর্য, মঙ্গোলীয়, আরবীয়, নিগ্রো ইত্যাদি বিভিন্ন জাতির রক্ত
ধারার সংমিশ্রণে এক শংকর জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বাঙালি জাতি
সত্তার আত্মপরিচয়ের ধারা সংক্ষেপে এভাবেই বিবৃত্ত হতে পারে। বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে বাংলাদেশের উত্থান তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাঙালি জাতির উৎপত্তি: অন্যান্য অনেক প্রাগ্রসর জাতির মতো বাঙালিরও দর্শন-চিন্তার ঐতিহ্য আছে; আছে সেই ঐতিহ্যের গৌবরময় ইতিহাস। তাই জনৈক আধুনিক প-িত মন্তব্য করেছেন;
“বাঙালী শুধু
ইউরোপের প্রতিধ্বনি মাত্র নয়; আর্যাবর্ত ব্রহ্মাবর্তের, মক্কা-মাদিনার কিংবা মস্কো-পিকিং-এর নিরেট
প্রতিধ্বনিও বাঙালী নয়।...
বাঙালীর স্বকীয় সত্তা
আছে, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে,
স্বকীয় ইতিহাস আছে,
অনন্ত সম্ভাবনা আছে। বাঙালীর এই আত্মবিকাশের ধারায় মিলন-বিরোধ
আছে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত আছে, বকার ও প্রতিকারের প্রয়াস আছে,
অধঃপতন ও নব উত্থান আছে, স্বল্পস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষয়-ক্ষতি
আছে, পরাজয় আছে,
পরাধীনতা আছে, সর্বোপরি আছে পরাজয়ে মনোবল। বাঙালী বাইর থেকে
গ্রহণ করেছে, কিন্তু অপরের মধ্যে বিলীন
হয়নি-নিজেকে বিকিয়ে দেয়নি।” তাই বাঙালির উৎপত্তির ইতিহাস যেমন
সনাতন, বাঙালির চিন্তা চেতনায় মানুষকে নিয়ে
মানুষের ভাবনার ইতিহাসও তেমনি সনাতন। সেই সুপ্রাচীনকালে বাঙলা ভাষা
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক
পূর্বেই যখন এ দেশে সংস্কৃত ভাষার
শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষা চর্চিত হতো,
তখনও বাঙালি তার পাশাপাশি চর্চা করতো
মানবতত্ত্বের। মধ্যযুগের বাঙালি মানসে মানবতত্ত্বের এ চর্চা আরও বিকশিত হয়।
বাংলাদেশে মানুষের বসতি
কখন শুরু হয় তা জানার কোন উপায় নেই। সাধারণত বাংলাভাষী জনসাধারণের আবাসভূমিকেই ‘বাঙলা’
বা ‘বঙ্গদেশ’ এবং বঙ্গদেশীয় জাতিকে ‘বাঙালি’ বলে আখ্যাত করা হয়ে থাকে। আধুনিক প-িতদের মতে বাঙলা, বাঙালা, বা বঙ্গদেশের সর্ব প্রাচীন উল্লেখ আমরা ঐতরের
আরণ্যকে দেখতে পাই। সেখানে বঙ্গবাসী বা বাঙালিদের ‘বয়াংসি’ বা ‘পক্ষি জাতীয়’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আধুনিক প-িতরা
গবেষণায় পেয়েছেন ‘বঙ্গ’
শব্দটি শুরুতে ছিলো
একটি কৌম গোষ্ঠীর নাম। পরে শব্দটি ভৌগোলিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিলো। কৌম গোষ্ঠীর নাম হিসাবে ‘বঙ্গ’
শব্দটির সঙ্গে বৈদিক
যুগের আর্যরাও পরিচিতি ছিলো। তবে ‘বঙ্গদেশ’ বলতে আজ আমাদের মানসনেত্রে বর্তমান বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার,
উড়িষ্যা ও ত্রিপুরা রাজ্যকে নিয়ে যে সম্মিলিত বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিচ্ছতি ভেসে উঠে আদি বঙ্গ বা বঙ্গদেশের আয়তন সে রকম ছিলো না। আবার
বঙ্গ ও বঙ্গাল, শব্দ দুটিও সমানার্থক নয়। কেননা এ শব্দ পৃথক দুটি
ভৌগোলিক স্থানকে নির্দেশ করে। আবার ‘বঙ্গ’
শব্দের দ্বারা বাঙলার এক ব্যাপক অংশকে
বুঝাতো, যার অবস্থিতি আমরা লক্ষ করি ভাগীরথী নদীর পূর্বদিকে। ভাগীরথীর পশ্চিমাংশকে বলা হত রাঢ় দেশ। রাঢ়ের উত্তর-পশ্চিমাংশে ছিলো অঙ্গ দেশ এবং দক্ষিণে কলিঙ্গ। এই অঙ্গ, বঙ্গ,
কলিঙ্গ ও গঙ্গা
নিয়েই বাঙলা। আধুনিক প-িতদের মতে বাঙালির আবাসভূমি বঙ্গ দেশ প্রাচীন কালে
বহু জাতির আবাসস্থল হয়ে বহু জনপদে
বিভক্ত ছিলো। অন্তর্বর্তীকালে এদের
অনেক নাম ছিলো। যেমন, গৌড়, বঙ্গ,
সমতট, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, বঙ্গাল, পু-্র, বরেন্দ্র, রাঢ়, তাম্রলিপ্ত, বারক, কঙ্কগ্রাম, বর্ধমান, জঙ্গল,
দ-ভুক্তি, খাড়ি,
নাব্য ইত্যাদি। এ সকল রাজ্যের ভৌগোলিক সীমারেখা এক এক যুগে এক এক রকম ছিলো। ভাগীরথীকে সীমারেখা ধরলে তার পশ্চিমে অবস্থিত ছিলো
জঙ্গলম বর্ধমান, কর্বট,
সূহ্ম, তাম্রলিপ্ত ও দ-ভুক্তি। আর এর পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত ছিল পু-্র, গৌড় ও বরেন্দ্র; মধ্যভাগে বঙ্গ ও দক্ষিণে হরিকেল, সমতট, বঙ্গাল, খাড়ি
ও নাব্য।
ড. নীহাররঞ্জন রায় বাঙলার সীমা নির্দেশ করেছেন একটু অন্যভাবে। অবিভক্ত বাঙলার সীমারেখা নির্দেশ করতে গিয়ে
তিনি লিখেছেন যে, উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয়কৃত নেপাল, সিকিম
ও ভুটান রাজ্য;
উত্তর-পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ ও উপত্যকা; উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারবঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সমান্তরালবর্তী সমভূমি; পূর্বদিকে গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়া-ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী বহে দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত; পশ্চিমে রাজমহল সাওতাঁল পরগনা ছোটনাগপুর-মালভূমি-ধলভূম-
কেতঞ্চর-ময়ূরভাঞ্চুর শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই প্রাকৃতিক সীমা বিধৃত ভূমিখ-ের মধ্যেই প্রাচীন বাংলার গৌড়-পু-্র-বরেন্দ্র-রাঢ়-সূহ্ম, তাম্রলিপ্ত-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি জনপদ; ভাগীরথী- করতোয়া-ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা- মেঘনা এবং আরও অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত বাঙলার গ্রাম,
নগর, প্রান্তর, পাহাড়, কান্তার। এই ভূখ-ই ঐতিহাসিক কালের বাঙালির কর্মকৃতির উৎস এবং ধর্ম-কর্ম-নর্মভূমি। একদিকে সুউচ্চ পর্বত, দুইদিকে কঠিন
শৈলভূমি, আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র; মাঝখানে সমভূমির সাম্য-এটাই
বাঙালির ভৌগোলিক ভাগ্য।
তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদিম মানব
সভ্যতার যেরূপ বিবর্তন ঘটেছিল বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বৈদিক
গ্রন্থাদিতে বাংলার নর-নারীকে অনার্য ও অসভ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলার আদিম অধিবাসী বা আর্য জাতির বংশসম্ভুত নন। আর্যরা এদেশে
আসার পূর্বে বিভিন্ন জাতি এদেশে বসবাস
করত। “বাংলাদেশে কোল, শবর, পুলিন্দ, হাড়ি,
ডোম, চ-াল প্রভৃতি যে সমুদয়
আদিম জাতি দেখা
যায়, তারাই বাংলার আদিম অধিবাসীদের বংশধর। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে এবং বাহিরেও এই জাতীয়
লোক দেখতে পাওয়া
যায়”। সুতরাং বর্তমান বাঙালি জনগোষ্ঠি বহুকাল ধরে নানা
জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। যেহেতু আর্যদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত অনার্যদেরই বসতি ছিল তাই এই প্রাক-আর্য নরগোষ্ঠিই বাঙালি জাতির মেরুদ-। আর্যদের আগমনে সে জীবন উৎকর্ষ ম-িত হয়। আর্য-পূর্ব জনগোষ্ঠি মূলত নেগ্রিটো, অস্টিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনীয়-এই চার শাখায় বিভক্ত ছিল। অস্ট্রিক গোষ্ঠি থেকে বাঙালি জাতির
প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ তাদের ‘নিষাদ
জাতি’ বলে আখ্যা
দিয়েছেন। নিষাদ-জাতির
পর আরও কয়েকটি জাতি এদেশে আগমন
করে, তাদের একটির
ভাষা দ্রাবিড় এবং আর একটির ভাষা
ব্রহ্ম-তিব্বতীয়। সমুদয় জাতিকে পরাস্ত করে যারা বাংলাদেশে বসবাস স্থাপন করেন- তাদের
বংশধরেরাই বর্তমান কালের
ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ প্রভৃতি উপজাতির পুর্ব
পুরুষ। তারা যে বৈদিক আর্যদের থেকে
ভিন্ন জাতীয় ছিলেন,
এ বিষয়ে প-িতদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। প্রায়
পাঁচ ছ’হাজার
বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে আস্ট্রিক জাতি, নেগ্রিটোদের উৎখাত করে। এরাই
ভীল, সাঁওতাল, মু-া প্রভৃতি উপজাতির পূর্ব পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত। বাঙালির রক্তে
এদের প্রভাব আছে। বাংলা ভাষার শব্দে
ও বাঙালি জীবনের সংস্কৃতিতে এরা প্রভাব বিস্তার করেছে। অস্ট্রিক জাতির সমকালে বা কিছু পরে প্রায়
পাঁচ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড় জাতি
এদেশে আসে এবং সভ্যতায় উন্নততর বলে তারা অস্ট্রিক জাতিকে গ্রাস করে। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির
সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হয়েছে
আর্যপূর্ব-বাঙালি জনগোষ্ঠি। অস্ট্রিক-দ্রাবিড় জাতির
সঙ্গে মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয় গোষ্ঠির জনসমষ্টির সংমিশ্রণ ঘটে। বাংলাদেশ আর্যীকরণের পরেই এদের
আগমন ঘটে বলে বাঙালির রক্তের সঙ্গে
এদের মিশ্রণ উল্লেখযোগ্য নয়, বাংলার উত্তর
ও উত্তর-পূর্ব
সীমান্তে এদের অস্তিত্ব রয়েছে। গারো, কোচ,
ত্রিপুরা, চাকমা ইত্যাদি উপজাতি এই গোষ্ঠিভূক্ত। মৌর্য বিজয় থেকে
গুপ্তবংশের অধিকার পর্যন্ত অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় ৫০০ অব্দ পর্যন্ত সময়ে আটশ (৮০০)
বছর ধরে বাংলাদেশে ক্রমে ক্রমে আর্যীকরণের পালা চলে; তবে চার ও পাঁচ
শতকের গুপ্তযুগে বাংলাদেশে আর্য
ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তি দৃঢ় হয়। আর্যরা ব্রহ্মবর্ত ত্যাগ করে প্রথমে আর্যাবর্তে বা উত্তর ভারতে
আগমন করে এবং পরে মগধ, অঙ্গ,
মিথিলা, কলিঙ্গ, রাঢ়,
বঙ্গে নিজেদের ভাষা
ও সংস্কৃতির অপ্রতিহত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম
হয়। আট শতকের
সেমীয় গোত্রের আরবীয়রা ইসলাম ধর্ম প্রচার ও ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে বাঙালি জাতির
সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়। তাদের অনুসরণে নেগ্রিটো রক্তবাহী হাবশিরা এদেশে
আসে। এমনিভাবে অন্তত দেড় হাজার বছরের
অনুশীলন গ্রহণ বর্জন
ও রূপান্তরিতকরণের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জনজীবন গড়ে উঠেছে। তাই বর্তমান বাঙালি জাতি অস্টিক, দ্রাবিড় আর্য মঙ্গোলীয় সেমীয় নিগ্রো ইত্যাদি বিভিন্ন জনগোষ্ঠির রক্ত ধারায় সংমিশ্রণে এক বিচিত্র জনসমষ্টি হিসেবে বিদ্যমান।
বর্তমানে বাঙালি জাতির
ব্যাপক সমাবেশ ঘটেছে
বাংলাদেশে। বাংলাদেশ এখন একটি জনকল্যাণ মূলক রাষ্ট্র- জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধনাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়ায় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দ্বারা জীবন
যাত্রার মানোন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। শ্রমকল্যাণ সুনিশ্চিত করার
জন্য শ্রম আইন সংশোধন ও শ্রমিকদের নায্য মূল্য আদায়
সহ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করে শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে জ্বালিয়ে দিয়ে জাতিকে উন্নত
শিখরে আহরণ কল্পে
যানবাহনের সুযোগ-সুবিধা, জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, শিশু
কল্যাণ সাধন, পরিবার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে জাতিকে রক্ষা করে প্রগতিশীল এবং উন্নয়নশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু
করে দাঁড়াবার শক্তি বাঙালি জাতির হাতের
মুঠোয় এসে পৌঁছেছে।
2 Comments
very nice
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
ReplyDelete