শাকেরের বয়স দৌড়ে পালাবার।
এ বয়সে সবাই দৌড়ে চলে অজানা গন্তব্যহীন। কোন বাধার বাঁধনে বাধবার উপকরণ উপক্রম সে মানে না। কখনো দৌড়ে যায় উঠোনের মাটির শরীর ছুঁয়ে। ঘরের পেছন দিয়ে রাস্তার কাছে। আবার কখনো খেলার মাঠের উদারতাপূর্ণ ঘাস মাড়িয়ে, ডিঙিয়ে, বেহাল গতিতে।
তার বাবার সাথে হঠাৎই রাস্তায় কিংবা যেখানে সেখানে দেখা হলে বলে, আব্বু আইসক্রিম কিনে দাও।
আব্বু আইসক্রিম কিনে দেয়। সেটি হাতে নিয়ে শীতল ধোঁয়ার ঠান্ডা সইতে না পেরে ভাবে মুখের ভেতর দিলে আরাম হবে। শেষে আইসক্রিমটি মুখের ভেতর পুরে লাফিয়ে ওঠে দাঁত অবশ করা শীতলতায়।
তারপর মুখ থেকে বের করে আইসক্রিমটি হাতে নেয়। দুটি আঙুল দিয়ে আইসক্রিমের কাঠিটি জড়িয়ে ধরে দৌড়ে যায় খেলার মাঠের দিকে। অনেক ছেলেরাই সেখানে দৌড় ঝাঁপ খেলে। সে তাদের খুব নিকটে দাঁড়িয়ে আইসক্রিমটি সম্পূর্ণ শেষ না করেই ফেলে দেয় মাটিতে।
আবার স্কুল ব্যাগটি পিঠে টাঙিয়ে বাবার ডান হাতের সবচে ছোট আঙুল ধরে স্কুলের পথে পাড়ি জমায়।
তাদের পাশ দিয়ে কোনো গাড়ি ভৎ করে চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সে বলে, আব্বু, গাড়ির এত শব্দ হয় কেন? দেখো-দেখো-গাড়ি আমার চেয়েও দ্রুত দৌড়াতে পারে।
তার কথা শুনে বাবা হেসে বলে, আধুনিক যুগের ছেলে অনেক সজাগ, সত্যিই অবাক হওয়ার মতো। তাই নতুন প্রাণগুলো এত প্রাণবন্ত, বুদ্ধিতে বিকশিত, কিছুটা উদ্ধতও বটে।
বাবা কি বলে তার বোঝার সক্ষমতা এখনো তৈরি হয় নি।
তারা দুজনে কথা বলতে-না বলতে-শুনতে-না শুনতে স্কুলে পৌঁছে যায় একসময়।
বাবা বলে, ঐ যে তোমার স্যার ক্লাস নিচ্ছে। যাও ক্লাসে যাও।
ছেলে বাবার আদেশ শুনে বলে, তুমিও চলো, আমার সাথে ক্লাস করবে।
বাবা বলে, আমি বাজার থেকে এসে তোমার সাথে ক্লাস করে তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাব। যাও এখন যাও।
ছেলে হাত ছাড়তে চায় না, বলে, আব্বু টাকা দাও বাদাম আর আইসক্রিম খাব।
বাবা পকেট থেকে টাকা বের করে হাতে দিয়ে দ্রুত চলে বাজারের দিকে। ছেলেটি ক্লাসে ঢুকে বুঝতে পারে তার অনেক দেরী হয়েছে।
স্যার তাকে দেখে বলে, তোর এত দেরী কেন?
সে পিঠের রঙিন ব্যাগটি বেঞ্চে রেখে বলে, আইসক্রিম খেতে দেরী হয়েছে। পরে বাদাম কিনতে হবে। আব্বুর কাছ থেকে লাল টাকা নিয়েছি।
তার কথা শুনে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে কেউ হাসে, কেউ হাসে না।
স্যার বলে, তোর মত ডানপিটে ক্লাসে আর একটাও নেই। একাই আমার মাথা খারাপ করে দিলি। তুই এ ক্লাস থেকে পাস করে চলে গেলে আমি বাঁচি।
বিয়ের পর শিক্ষকও সন্তানের বাবা হয়েছে। তারও ছোট বাচ্চা ছেলে আছে। সে অসহিষ্ণু বলে অন্য ছেলেমেয়ের দুষ্টামি মানতে পারে না। তবে নিজের ছেলেটা নিজের কাছে দুষ্টামি করলে তার মনে গভীর আনন্দ লাগে।
আজ ক্লাস শেষ হয়েছে অনেক আগে। শিক্ষকরাও চলে গেছে নিজের বাড়িতে। কিন্তু সেই ক্ষুদে ছাত্রটি বাড়ি ফেরেনি।
সে তার বাবার কাছ থেকে যে লাল টাকা নিয়েছিল সেটি দিয়ে ঝাল মেশানো ঘুঘনি এবং আলুর দম খেয়েছে। এখন বসে আছে স্কুলের পিছনের মাঠে আখের ক্ষেতে। আখের জঙ্গল বেশ ঘন। অনেকগুলো লম্বাটে আখ একসাথে জড় পাকানো। সেই জড়ের নিচে ক্ষুদ্র কেউ বসলে খুঁজে পেতে অনেক কষ্ট হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। সে সেখানেই নিজেকে লুকিয়েছে।
জড়ের নিচে বসে সে আখ ভেঙে মড় মড় করে চিবোচ্ছে। ভাবছে, জমির মালিক যদি দেখে ফেলে তাই চুরি করে খাচ্ছে। ওদিকে সূর্যটা ঘুরতে ঘুরতে ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে।
তার বাবা দেরী দেখে স্কুলে হাজির। স্কুল তো ফাঁকা, কেউ নেই।
বাবা এসে ডাকছে, শাকের, তুমি কোথায়? বেশ কয়েকবার ডাকলো। সে আখ ক্ষেত থেকে শুনছে কোন সাড়া দিচ্ছে না। বারবার ডাকছে।
কোন সাড়া না পেয়ে বাবা স্কুল ঘরের পিছনে এসে ডাকছে, শাকের, শাকের।
শাকের ভাবছে, তাকে ধরে ফেলতে পারে। সেজন্য সে আখ ক্ষেতের অন্য আইল দিয়ে বেরিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে।
তার বাবা পেছন থেকে বলছে, শাকের থামো, থামো, ভয় নেই, আমি তোমাকে মারবো না।
তবু শাকেরের গতিকে রোখা গেল না। শাকের দ্রুত দৌড়ে পালালো পুকুর পাড়ের মেহগনি গাছের নিচ দিয়ে বাড়ির দিকে।
(১)
রজবের বাড়ি মফস্বলে। তবে একেবারে মফস্বলও নয়। সেখানে মিশ্রণ ঘটেছে গাঁওয়ের সাথে শহরের আধুনিকতার। শহরের অত্যাধুনিক সুযোগের মধ্যে আছে ঝাকড়া দেবদারু গাছের ফাঁকে ফাঁকে নিয়ন বাতি। রাত আসলে বাতিগুলো জ্বলে ওঠে স্বাধীনতায়। আবার সম্প্রতি সাপ্লাই পানির পাইপও এসেছে। গ্রামের মত বাড়িগুলোর মধ্যে বাস করা লোকজন খুব সহজে পানি পাচ্ছে সর্বক্ষণ।
সন্ধ্যার অন্ধকার ভেঙে নিয়ন আলো ফুটলে শাকেরের মতো অনেক শিশু কিশোর মায়াবী আলোর ভিতরে ডানাওয়ালা পোকাদের তাড়া দেয়। দু একটা কদাচিৎ ধরতেও পারে। তাদের হৈ-হৈ-রৈ-রৈ-তে আবেগঘন হয়ে ওঠে বাতাস। পোক্ ধরতে গিয়ে অনেক সময় তারা গ্রাম্য গান জুড়ে দেয়। কেউ তালি বাজায়, কেউ হেলে-দুলে নাচের ভঙ্গিমায় আপন আবেগ প্রকাশ করে বলতে থাকে,
কানামাছি ভোঁ-ভোঁ
যারে পাবি তারে ছোঁ।
ছোঁ বলতে যেয়ে একে অপরকে ছোঁয়ার যুদ্ধ শুরু হয়। বারংবার সেটা জপ করতে করতে চোয়ালের পাশ বেয়ে সবারই সাদা ফেনাযুক্ত লালা নেমে আসে। ছোঁ-ছোঁ খেলোয়াড়দের মধ্যে যাদের শরীরে শক্তি বেশী তারা প্রিয় লাইন দুটোকে বিকৃত করে বলে,
কানামাছি বো-বো
যারে পাবি তারে ছোঁ।
শাকের দেখতে কালো হলেও তার পরিবার বিশ্বাস করে সে শ্যামল। কালো বলতে বাংলাদেশের মানুষ বোঝে রান্না করা কড়াইয়ের তলের মত কালো। কিন্তু সাদা দেশের লোকজন সকলে বাংলাদেশীদের কালো বলেই জানে। যাই হোক, শাকের দেখতে কালো তবু শরীরের চামড়া বসন্তের তৈলাক্ত পাতার মত লিক্লিকে চিক্চিকে।
সে কতখানি লম্বা হবে অননুমেয় কারণ এখনো কৈশোর অতিক্রম করতে পারেনি। তবে তার বাবা রজব আলী খর্বকায়। শরীরও মজবুত নয়। শাকেরের মা উচ্চতায় মধ্যমা। স্বাস্থ্যের বেলায় সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী। পাড়া প্রতিবেশীরা বিশ^াস করে শাকের তার মায়ের আকার প্রকৃতি পেয়েছে।
শাকেরের দাদী শুনে বলে, ছেলে মায়ের মত হবে এটাই স্বাভাবিক।
তার ছোট বোনটি বাড়িতে বই পড়তে শিখেছে সবেমাত্র। মাঝে মধ্যে শব্দ দেয় আঁ-আঁ-এ্যাঁ-এ্যাঁ। বোনের অপরিষ্কার আওয়াজ পরিবারের সব সদস্যকে বিরহ থেকে মুক্তির সাথে সাথে বিনোদনের ফল্গু ধারার মধ্যে অবগাহন করায়।
পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে তার বোধের জানালা এখনো অপরিষ্কার। মানুষের নামের সুন্দর-অসুন্দর আছে বুঝতে পারে না। খেলার সাথীদের মধ্যে যারা তাকে অপছন্দ করে তারা “শাক্-শাক্” বলে রাগায়। সে উত্তেজিত হয়ে আক্রমণ করতে যায়।
একদিন বিকেলে তার সহপাঠী নিরদ তাকে শাক্ বলতে বলতে বলেছিল, তুই কচু শাক্।
তোকে যারা খায় তাদের শরীর চুলকায়। শুনে শাকের নিরদের সাথে ঝগড়ায় অশ্রাব্য বুলির ব্যবহারে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিল নিরদ তার বন্ধু নয়; আর কোনদিন তার সাথে খেলতে যাবে না, স্কুলেও যাবে না।
দিন কতক ফুরানোর আগেই আবার দেখা গেল শাকের নিরদ একসাথে স্কুল থেকে ফিরছে। ফেরার পথে হাসাহাসি তামাশার গভীরে ঢুকে আনন্দ কুড়াচ্ছিল।
সেই আনন্দ অস্থায়ী ছিল। তখন তারা বুঝে উঠতে পারতো না পৃথিবীতে আনন্দ ক্ষণকালের, বেদনা চিরকালের; বেদনা শুধু চরম ও পরমই নয় তা স্থায়ী আসন গেড়ে আছে ধ্বংস এবং সৃষ্টির সাথে।
(২)
শাকেরের বাবা রজব বিস্কুট মেকার। তার নিজস্ব বিস্কুট ফ্যাক্টরী রয়েছে। সেখানে প্রধান মিস্ত্রি হিসাবে কাজ করে সে। শাকেরের মা পোক্ত গৃহিণী।
রজব যৌবনের সূচনাতে অন্যের বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন বিস্কুট তৈরির কাজ শিখেছিল। কয়েক বছর পর বড় মিস্ত্রি হওয়ায় নিজেই পৌরসভার মধ্যে জমি কিনে ফ্যাক্টরী দিয়েছে। সেই বিস্কুট ফ্যাক্টরী দিতে কোন ধার-দেনা, টেনশান, কোনটাই করতে হয়নি।
কিন্তু বাড়ির করার জমিনটুকু কিনতে রজবকে বেগে পড়তে হয়েছিল। ধার কর্য করে বউয়ের মায়ের নামের জমিটুকু বিক্রি করে কিনেছিল মফস্বলের জমি। সেখানেই রজব অনেক আগে থেকে সংসার পেতেছে। তার সংসার খারাপ আছে কেউ বলতে পারে না। বরঞ্চ তারা-তাদের প্রতিবেশীদের থেকে সচ্ছলভাবে জীবন চালায়।
রজবের মাঝারি মানের বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে বেশ কয়েকজন বিস্কুট মেকার কাজ করে। প্রতিদিন অনেক টাকার বিস্কুট হকারের মাধ্যমে মার্কেটিং হয়। তাতে লাভ হয় কখনো লসে পড়ে না।
ফ্যাক্টরীর মাঝখানে দাঁড়ানো আছে আকাশমুখী উঁচু চিমনি। চিমনির পায়ের কাছে জ্বলে লম্বা-লম্বা কাঠ। সাদাকালো ধোঁয়া চিমনির ভেতর দিয়ে উড়ে বাতাসের সাহায্যে আকাশে মিশে গেলে রজবের বুক গর্বে কেঁপে ওঠে।
মাঝে মাঝে শাকের এসে ইচ্ছে মতো গোডাউনে ঢুকে বিস্কুট খায়। ক্যাশ থেকে টাকা নেয়; জ¦লন্ত খড়ি ধরে টানে; ময়দা হাতে তুলে নাকে শোঁকে; বিচ্ছিন্ন প্রশ্নে সবাইকে অস্থির করে তোলে।
বিস্কুট ফ্যাক্টরী শাকেরের খুব ভালো লাগে। একবার সেখানে আসতে পারলে মন বাড়িতে টানে না। অনেক আবদার-আবেদন শেষ করে তাকে বাড়িতে ফেরত পাঠাতে হয়। রজব আলী শাকেরের দুষ্টুমিতে আনন্দ পায়।
শাকের যেটা চায় সেটা সে পূরণ করে সঙ্গে সঙ্গে বলে, বাবা সবই তো তোমার জন্য। রজবের কথা বুঝবার মত সামর্থ তার নেই। শাকের বোঝে খাওয়া আর টাকা; আর সে বোঝে ভালবাসা।
এসব নিয়ে কিছু স্বপ্নসহ কয়েকটি জীবন এগিয়ে চলে। তবে কেউই জানে না তাদের স্বপ্ন ভালবাসা আবেগ কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকবে।
শাকেরের জীবন সহজ সরলতায় ঢাকা। সে জগতের ঘাত-প্রতিঘাত, দ্বন্দ্ব, মিলন, দুঃখ, বিরহ কোনটাই বুঝতে পারে না। এও বুঝতে পারে না, ভবিষ্যতে এই পৃথিবীর পথে যদি জীবন এভাবে চলতে থাকে কি হবে?
তবে রজব বন্ধুদের কাছে বলে, তার একটি মাত্র ছেলে; যত টাকাই ব্যয় কিংবা অপব্যয় হোক, তাকে ডাক্তারী নয়ত এঞ্জিনিয়ারী পড়াবে। রজবও বোঝে সমাজে ডাক্তার এঞ্জিনিয়ারদের অনেক মূল্য। একজন ডাক্তার বা এঞ্জিনিয়ার মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা ইনকাম করে।
সমাজের আর দশজন মানুষকে সে দেখছে, সবাই টাকাওয়ালাকে পছন্দ করে। যার টাকা নেই তার বিরাট অ-মূল্য রয়েছে।
তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাকেরকে ডাক্তারী পড়িয়ে দ্রুত ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করবে। যদি ডাক্তারী না পড়াতে পারে, ব্যবসা শিখিয়ে ব্যবসায়ী বানাবে। প্রয়োজনে মেয়েকে ডাক্তারী পড়াবে।
তার পরিবারের সবাই রজবের মত শাকেরের জীবন প্রবাহের দিকে চেয়ে রয়েছে আকাক্সক্ষা নিয়ে; শাকের কি হবে?
সাধারণভাবে বলা যায়, সে একাডেমীর ভারি ডিগ্রি কুড়িয়ে অনেক আয়-ব্যয়ের মধ্যে ডুবে যাবে; নয়তো কতরকম পেশার নেশা তার কাছে টানবে, স্বপ্ন দেখাবে টাকার, টাকার পেছনে অনবরতো দৌড়াবে।
দৌড়াতে দৌড়াতে জীবনের ধ্বংসলীলার মধ্যে পড়ে হয়ে উঠতে পারে জীবনশিল্পী। হয়তো বা কিছুই হতে পারবে না। অতি সাধারণভাবে এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে।
(৩)
রজব বন্ধুপ্রিয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দূর-দূরান্তে যায়। কাজে ব্যস্ত থাকলেও একজন বন্ধু দন্ডায়মান থাকে তার শরীর ঘেঁষে। তারা মনের কথা মনের আনন্দে বলে আর কুটি কুটি করে হাসে। অথচ পাশে থাকা কারো বুঝবার সুযোগ থাকে না কি বলে।
রজব মাঝে মধ্যে তার ট্রাক ড্রাইভার বন্ধুর সাথে গোপনে হারিয়ে নির্জনতার শরীর মাড়িয়ে ফিরে আসে ফ্যাক্টরীতে। প্রায় দিন রাতে আড্ডায় যায়। আপন ঘরে ফেরে না। রজবের বউ প্রতীক্ষা করতে-করতে ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘুমে হাবুডুবু খায়।
রজব আঠারো বছরের দারুণ টগবগে যুবক কালে দেশের সীমান্ত এলাকায় ঘুরে ফিরতো। মনের খেয়ালে পরমানন্দে সীমান্ত ডিঙিয়ে পারাপার হত অন্য দেশ সংস্কৃতিতে। ভিনদেশীয় স্বাদ, গন্ধ, রূপ, রস তাকে পাগলপ্রায় করতো। আবেগের বশে তার কাছে মনে হত দূর ভাল।
দূরের মাঝে আনন্দের আভিজাত্য রয়েছে। তাই ভাসতে চাইতো, ডুবতে চাইতো, অপরের সন্নিকটে থেকে নিজেকে নিয়ে দূরে দূরে। তখন টাকার মায়া ছিল না, খরচ করত খামখেয়ালে।
যেখানেই অজানাকে জানতে যেত, ভুরি ভুরি রঙিন পোশাক কিনে সবার মন খুশিতে ডুবিয়ে দিত। সে পেত বাহবা। সেই বাহবা, কৃত্রিম প্রশংসা তাকে প্রশান্তি দান করত।
রজবের আড্ডাবাজী নতুন নয়। যা গড়ে উঠেছিল অপব্যয়ে অন্ধ সংস্কৃতির ডোবাজলে। তার বন্ধুরা কেউ সমাজের লোক দেখানো নিয়ম মানে না। তারা বিশ্বাস করে তাদের তৈরি করা আবেগের জগৎ। সেই জগৎ তাদের মনঃপুত। শুধু মায়াময়। যে সব মায়াবিনী মন্ত্রমুগ্ধতা তাদের আনন্দ দেয়। করে রাখে মাতালের মত বুদ।
শরতের মেঘলা দিনে থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরছে। বিকেলে রজব বিস্কুট ফ্যাক্টরীতেই বসা ছিল আবেশে। তার ট্রাকচালক বন্ধু নয়ন এসেছে। নয়ন পরেছে গেরুয়া রঙের লুঙ্গির উপর সাদাটে ফতুয়া।
নয়ন রজবকে বলছে, চলেন বাইরে যাই ভাই।
রজব নয়নের কথা শুনে ক্ষণকালও থামলো না। কাজ থেকে উঠে টিউবয়েলের পানি দিয়ে হাত মুখ ঘষে সাদা লুঙ্গির সাথে আকাশ সাদা ফতুয়া পরে কানের ভিতরে আতর মাখানো তুলা গুঁজে নিল। ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে ফতুয়ার বুকের অংশে, নাকের ছিদ্রে, আতর ছোঁয়ালো।
তারপর মৃদু হাসি দিয়ে বললো, চলো নয়ন, আর দেরী করতে চাচ্ছি না।
বিস্কুট ফ্যাক্টরী থেকে বের হবার সময় সে ক্যাশ বাক্স খুলে টাকার ছোট একটি বান্ডিল সাদা লুঙ্গির ভাঁজে গুঁজে নিল।
নয়ন আর রজব কোথায় ভেড়াবে তাদের যাত্রা তরী অন্য কেউ বুঝলো না।
রজব ফ্যাক্টরীর বাইরে বের হবার সময় অন্য বিস্কুট মেকারদের বললো, তোমরা মিলেমিশে থেকো। আসতে বিলম্ব হতে পারে।
তাদের বাহ্যিকত, পোশাকের ঢং দেখে অনুমেয় মাসিক মিলনক্ষণ আজকের পূর্ণিমা রাতে। ওদের মত দূর দেশ থেকে অনেক বন্ধু শুভানুধ্যায়ী পরস্পরের কাছাকাছি হয়ে আসর জমে উঠবে।
আজকের আসর বসেছে সুবিশাল বাঁশ বাগানের তলে। অনেক মানুষ জমায়েত হয়েছে। মেইন রাস্তা থেকে বাগানের গলি পর্যন্ত নিয়ন বাতি গাছের গায়ে টাঙিয়ে রঙিন পরিবেশ সৃষ্টি করাতে কারো বুঝবার উপক্রম নেই কি হবে।
তারা মজমায় পৌছে দেখলো একজন গুরু লম্বা চুল দাড়ি গোঁফে দাঁতমুখ ঢেকে সবার মাঝখানে মাদুরে বসে পায়ের উপর পা উঠিয়ে মেরুদ- সোজা করে আছে। যে-ই তার সম্মুখে আসছে মাথা নিচু করে তাকে সম্মান জানাতে হচ্ছে। কেউ তার সামনে মাথা নত করলে সেও দু হাত কপালে ঠেকিয়ে বলছে, ‘জয় গুরু’ ‘জয় গুরু’।
রজব আসরে পৌঁছে প্রথমেই সবার মাঝখানে বসা গেরুয়া বসনের গুরুর পায়ে হাত রেখে সবচে বড় টাকার নোট দিয়ে সেলামি জানালো।
গুরু খুশি হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মরা মাছের মত চোখ উল্টিয়ে তার মাথায় হাত রেখে বলল, ও! পাগল দয়া কর, ‘জয় গুরু’।
রজবের পেছনে দাঁড়ানো নয়ন পাশের অন্যান্য ছোট গুরুদের কদম মুচি শেষ করে বড় গুরুর পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে, পায়ের সাথে মাথা ঠেকিয়ে কান্নায় ভেসে গেলো।
বড় গুরু উঠে দাঁড়িয়ে নয়নের দুই বগলের মধ্যে হাত দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, পাগল কাঁদে না; মানুষগুরু রক্ষা করবে। সবই তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা। ‘জয় গুরু’।
এভাবে গুরু সেবা করতে অনেক রাত হয়েছে। বাঁশঝাড়ের পোকের ঝিঁঝিঁ ডাকে কানে তালা লেগে আসছে। বিদুৎ চলে গেল।
হ্যাচাকবাতি জ্বালিয়ে মৃদু আলো সৃষ্টি করা মায়াবী পরিবেশে বড় গুরু বললো, বিদ্যুৎ আসলেও লাইট জ্বালাবেন না। এখন সাঁইজির পবিত্র বাণী অর্চনা হবে।
গুরুর বাক্য শোনার পর হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোল, খোল, একতারা, দোতারা নিয়ে সুর করে গান শুরু হয়ে গেল।
কেউ হেলছে, কেউ দুলছে, কেউ চৌকোনা কাঠের টুকরার ওপর গঞ্জিকা বের করে ধারালো কাটার চালাচ্ছে।
কেউবা গঞ্জিকা কলকিতে পুরে আগুন জ্বেলে শোঁ-শোঁ করে ধুমার কু-লী বাতাসে উড়াচ্ছে।
নয়ন ও রজব খুব কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে। গঞ্জিকা ভর্তি বাঁশিটি সবার হাত ঘুরে তাদের কাছে পৌঁছানোর পর তারা বেদম টানে, গলা, দু নাকের ফুটো দিয়ে ধুয়া ছাড়ছে।
গাঁজার সাদা ধুয়ার ঘনত্বে সবার কপাল ও চোখের চামড়া গুছিয়ে আসছে। রজবের চোখ লালাকার হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে দেহের বাইরে।
নয়ন গাঁজা ভর্তি বাঁশিটি রজবের হাতে দিয়ে বলছে, ভাই ‘তামাক’ মাখানো খুব ভাল হয়েছে। কে মাখিয়েছে?
‘সবই সাঁয়ের ইচ্ছা’।
সমস্ত রাত গাঁজা সেবন করে ঘোর কাটলো সকালে। নতুন সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছার আগেই রজব ফ্যাক্টরীতে পৌঁছে সমস্ত শরীরে সরিষার তেল ডলামলা করে গোসল দিল।
এক মিস্ত্রি তাকে জিজ্ঞেস করলো, কাকা আসর কেমন জমেছিল?
‘খুব ভাল রে বাবা। তবে তামাক টানা একটু বেশী হয়েছে; বানানোও ছিল কড়া। তোমরাও যেতে পারো যদি মন চায়। গুরু ধরো, গুরু ধরো, নইলে পারে যেতে পারবে না। গুরু ছাড়া শিক্ষা নাই। মুক্তি নাই। আমার গুরু খুব ভাল। গেলে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব’।
‘যাবো বাজান, আমিও যাব। শুনেছি গুরু মুক্তিদাতা’।
(৪)
ইতিমধ্যে আরও কয়েকটা দিন সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। রজবের বাড়ি ফেরার ইচ্ছা নেই আগের মতো। সকল সময় সে মুখে মুখে দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করে অথচ এতটা দিন যাওয়ার পরও শাকের ও তার আদরের মেয়ে কেমন আছে খোঁজ নিচ্ছে না। বাড়িতে বাজার আছে কি-না কিংবা শাকেরের মা কিভাবে সময় কাটাচ্ছে এসবের কিছুই জানে না।
রজব এখন মোহগ্রস্ত হয়ে আছে, গুরুবাবা, নয়ন আর মন্ত্রের মত নেশায়। ইদানিং তার কত টাকা আয়-ব্যয়-অপব্যয় হচ্ছে সেদিকে খেয়াল কমে এসেছে।
ফ্যাক্টরীর এক কর্মচারী এসে রজবকে বলছে, চাচা, শাকের এসে আপনার জন্য কান্নাকাটি করতে ছিল। আপনি এখনই বাড়ি যান।
‘হ, আজকে বাড়িতে ফিরব। অনেকদিন বাড়ি যেতে পারি নাই। কি করব, গুরুর বাণী সবার আগে’।
রজব দেরী না করে চলল বাড়ি দিকে। বাড়ির সামনে বাঁশবাগানের সামনে পৌছা মাত্র শাকের দৌড়ে এসে রজবকে জড়িয়ে ধরে লুঙ্গির সাথে পোকার মত ঝুলে বলতে থাকল, বাবা, টাকা দাও।
‘আগে শুনি কি হয়েছে, তারপর টাকা দিচ্ছি’ ।
‘না, আগে টাকা দাও’।
রজব একটি ছোট টাকার নোট পকেট থেকে বের করে হাতে দিল।
শাকের আবার বলল, আব্বু কতদিন লাল টাকা দেওনি। এখুনি বের করো।
রজব হাসতে হাসতে অপেক্ষা ছাড়াই আবার একটি লাল টাকা ধরিয়ে দিল তার হাতে।
তারপর রজব বাড়িতে ঢুকে মেয়েকে আব্বু-আব্বু বলে ডেকে, কাছে নিয়ে আদর দিল।
ওদিকে শাকেরের মা বুঝতে পেরেছে রজব ফ্যাক্টরীতে রাতে নিয়মিত থাকে না। যে রজব বাড়িতে এসে ছেলেমেয়ের মুখ না দেখে একদিন থাকতে পারতো না অথচ আজকাল সে কতদিন পার করে ফেলে বাড়িতে আসতে। এ জন্য শাকেরের মা খুবই হতবাক এবং চিন্তিত।
তাদের ভালবাসায় বিয়ের পর ঘাটতি ছিল, তা বলা যাবে না। অন্যদের মতো তাদেরও সামাজিক নিয়ম মেনে বিয়ে হয়েছিল। তারপর থেকেই তাদের অভ্যন্তরীণ আন্তরিকতা জ্যামিতিক সরলরেখার মত সাবলীল এবং ঘনিষ্ট ছিল।
তবে সামান্য ক দিন আগ থেকে রজবের জীবনের পরিবর্তন চিন্তিত করেছে পরিবারের সবাইকে।
জগতে দেখা যায় বিন্দু থেকে ক্রমান্বয়ে সিন্ধু রচনা হয়। রজবের জীবনের সামান্য পরিবর্তন হয়তো সেরকম কোন বিন্যস্ত পরিবর্তন কিংবা সংঘটন ঘটাতে পারবে কিনা তা সঠিক করে বলা যায় না।
কয়েকদিন পর রজবকে বাড়িতে ফিরতে দেখে বৃদ্ধা মা শুক্নো লাঠি হাতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি কোতায় যাও?
শুনছি, রাতি গেলে হকালে আসো।
রজব মায়ের প্রশ্ন শুনে ছোট্ট ছেলের মত উত্তর দিল, মা, আমি গুরু ধরেছি। মনের প্রশান্তির খোঁজে গান বাজনা করি, শুনি। জীবনে তো কতকিছুই করলাম; ওপারে যাওয়া লাগবেই। তাই তত্ত্বজ্ঞান শিখছি। তোমার তো জানা, রজব কেমন ছেলে।
তার কথা মা বুঝলো না; গুরুজ্ঞান কিংবা ওপার কি?
কারণ উনার মত নিরুপায় গৃহকর্ত্রী শুধু ছেলেমেয়ে দেখাশোনা আর স্বামী ভক্তিতে মনোযোগী ছিল।
এখন অনেককিছুর পার্থক্য ঘটেছে, সময়ও ঢের গেছে। রজব মায়ের দেখানো পথে না থেকে নিজের ভাললাগার পথ বেছে নিয়েছে।
শেষে তার মা তাকে সতর্ক করে বললো, বাবা তোমার সংসার, ছেলেমেয়ে রয়েছে। খোদাতালা একা রাখেনি। সংসারে কোন অঘটন ঘটিও না। তাহলে বুকের মানিকগুলো দেখবে কে?
রজব মায়ের কথা শুনে গুরুর উপদেশ নির্দেশিকা মনে মনে ভেবে দেখছে। গুরুজ্ঞান তো এসব বলে না।
গুরু বলেছে, সংসার হল পাপের আধার। মানুষের আত্ম চৈতন্যে মুক্তি আসে। চৈতন্যের অভাবে বিনাশ হয়। সংসার, ছেলেমেয়ে তো তার জীবনতরী পার করে দিতে পারবে না।
এসব অবিচ্ছিন্ন ভাবতে ভাবতে সে মৌনতায় ডুবে যায়। তার বিশ্বাস জন্মেছে এতটা কাল যাবৎ সংসার চালাচ্ছে বিনিময়ে কি পেয়েছে। আজকে যদি মৃত্যু হয় সবকিছুই পৃথিবীতে রয়ে যাবে। চলে যাবে শুধু পাপের দেহখানা। তখন তো সংসার বিফল হবে। এই ভেবে সে শেষ সিদ্ধান্তে আস্থা রাখলো, গুরুজ্ঞান এবং গুরুতত্ত্ব সত্য পরম। যত বাধাই আসুক গুরুকে ছাড়তে পারবে না।
অনেকদিন পর রজব আজ ভাল খাবার আয়োজন করবে বাড়িতে। পিঠাপুলির সাথে প্রচলিত খাবার কোনটাই কমতি রাখবে না। সে শাকেরেকে সাথে করে বাজারে বেরিয়েছে। ইচ্ছেমতো বাজার শেষ করে বাড়িতে ফিরে ট্রাক ড্রাইভার বন্ধু নয়নকে নিমন্ত্রণ জানালো।
নয়ন দাওয়াত পেয়ে কোন কার্পণ্য ভাবলো, খাওয়া শেষ করে তো তামাক লাগবে।
তাই নয়ন রজবের বাড়িতে আসার আগ মুহুর্তে গেলো তামাকের খোঁজে। সে কয়েক পুরী তামাক যোগাড় করল বাজারের পাশের বাড়ি থেকে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। পরিচ্ছন্ন মুগ্ধ আকাশ। যে পাশেই চোখ মেলানো যাচ্ছে জোৎস্না নিজেকে উন্মুক্ত করে ফেলেছে আমাদের গ্রহটির জন্য। জোৎস্নার আলোর ভেতর সে হাঁটছে। তার জোৎস্নামাখা ছায়া আগে আগে হাঁটছে। সে চলছে রজবের বাড়ির উদ্দেশ্যে। হাতে মিষ্টির ব্যাগ, বিস্কুট, চিপসের লোভাতুর মোড়ক।
সে রজবের বাড়ির পথ ছুঁয়েই ডাকল, রজব ভাই, চলে এসেছি। রজব ডাক শুনে ছুটে এসে তার হাতের সাথে হাত মেলালো।
তারপর হাতে চুমু খেয়ে হাতটি মাথায় ঘষে বললো, সবই মালিকের ইচ্ছা! ‘জয় গুরু’।
নয়নকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে বসানো হল রজবের সাজানো সংসারের সুন্দর বসার ঘরে। শাকেরের মা তাকে দেখে কাছে আসলে রজব তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সে শাকেরের মায়ের অযাচিত প্রশংসা করছে।
তার সমৃদ্ধ কথা শুনে শাকেরের মা চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। পরিচয়, সামান্য গল্পের মধ্যে দুজনের আন্তরিকতার বীজ বপিত হতে একটু বাদ রইলো না।
রজব নয়নের প্রশংসা শুনে বলছে, মনে হচ্ছে, তোমার ভাবির সাথে অনেক আগে থেকেই পরিচয় রয়েছে।
সে রজবের কথা এড়িয়ে বললো, ভাবি খুব ভালো। আরো অতিরিক্ত কথা বলল মনে মনে ফিস ফিস করে। কি বলল রজব বুঝল না। যেগুলো প্রকাশ্যে অন্য কথার মত উচ্চস্বরে বললে রজবের সাথে সম্পর্ক থাকবে না।
তারপর শাকেরের মা খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে উঠল। নয়ন রজব ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে নরম দামী ছোফায়। শাকেরের মা নিজ হাতে রান্না করেছে নয়ন আসবে বলে।
খেতে খেতে নয়ন বলছে, এত স্বাদের খাবার অনেক দিন খেতে পারিনি। সবই মালিকের ইচ্ছা।
নয়নের কথা শুনে রজব আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে।
সাদা ঝক্ঝকে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, ঠিকই বলেছ নয়ন। তোমার ভাবি আজ এত ভাল রান্না করেছে, ওর হাত চেটে খেতে ইচ্ছে করছে।
খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ পরে তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে আম বাগানের ভেতর বসে গঞ্জিকা সেঁজে মনের তৃপ্তিতে শোঁ-শোঁ করে টানছে। বেশক্ষণ ধরে তারা এক কলকি গঞ্জিকা শেষ করে চোখ মুখ লাল করে হা-হা হি-হি করে হাসাহাসি করল। তাদের মুখে এত তৃপ্তির হাসি কেন কেউ বলতে পারে না। তারা নেশার ঘোরে মনের আনন্দে হাসছে, নাকি নেশায় যে সুখ পাচ্ছে তাতে হাসছে?
হাসির মধ্যে অদ্ভুত পরমানন্দে নয়ন বলছে, যেমন ভাবির হাতের খাবার তেমন ভাইয়ের মাখানো তামাক, সত্যিই রোমাঞ্চকর।
রজব নয়নের কথা শেষ না হতেই বলছে, তোমার ভাবির মত ভালো মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছিল বলে সোনার সংসার রচিত হয়েছে। সত্যিই আমার ভাগ্য অনেকের থেকেই ভালো।
দুজনেরই কর্মের থেকে ভাগ্যে বেশি বিশ্বাস রয়েছে। আর সব সাধারণের মত তারা কল্পশক্তি দ্বারা আজো আবিষ্কার করতে পারেনি কোনটা মানুষের জন্য সত্য। ভাগ্য নাকি কর্ম?
গঞ্জিকা সেবন শেষে আমবাগান থেকে তারা বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছেছে বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে। সেখানে পৌঁছাবার পর শরীর গরম হয়ে শ্রমিকের মত ঘামছে। শার্ট খুলে ইলেকট্রিক ফ্যান ঘুরিয়ে বাতাস লাগাচ্ছে গায়ে।
রজব তার এক কর্মচারীকে ডেকে চা-সিগারেটের জন্য বাইরে পাঠালো। কর্মচারী ফেরত আসলে চা পান করে সুবাসিত জর্দা দিয়ে দুজনে পান চিবোচ্ছে। ঠোঁট লাল করে তারা শরীর এলিয়ে দিল ফ্যাক্টরীর বিছানায়। সে রাত চলে গেলো, বাড়িতে ফেরা হল না রজবের।
নয়নও তার ড্রাইভারীতে অনিয়মিত হয়ে গেছে। ইদানিং বেশিরভাগ সময় যায় রজবের সাথে বিভিন্ন আড্ডাতে।
রজব গুরুর স্মরণে মনে মনে ঘর ছেড়েছে। সন্ধ্যার পরে সেও বাড়িতে ফেরে ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। রজব হয়তো আস্তে আস্তে ঘর একেবারেই ছাড়বে অলৌকিক পথের টানে। নিরাকারের জ্যোতিকে দেখার আশায়।
ইদানিং রজবের বাড়িতে আসা অনিয়মিত হয়েছে বলে শাকেরের ভালবাসা প্রাপ্তির ভাগ কমেছে। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে সে মায়ের কাছে আব্বুর আবদার করে। সকালে ঘুম থেকে জেগে আব্বুকে খোঁজে লাল লম্বাটে টাকার আশায়।
যখন আব্বু এবং টাকা কোনটাই পায় না মুখ ভার করে কষ্ট মনে স্কুলে যেতে ইতস্তত করে। মায়ের শাসনে স্কুলে গেলেও মুক্ত বাতাসে নিজেকে মেলাতে পারে না। স্কুলে যেয়ে দুরন্ত ডানপিটে ছেলেটি শীতলভাবে বেঞ্চে বসে আলুর দম, আইসক্রিম, বাদামওয়ালার দিকে বারংবার ফিরে চায়। মনে পড়ে যায় আব্বুর হাসিময় মুখ, তার হাত দিয়ে পকেট থেকে কিভাবে টাকা বের করে হাতে ধরিয়ে দেয়।
আব্বুর কথা ভাবতে ভাবতে তার উপর রাগে মনে মনে সংকল্প করে বলে, আব্বু আসুক, এবার অনেক টাকা নেব।
আব্বুর প্রতি শাকেরের এই অনুরাগ শিশু মনের শিশুকষ্ট হলেও ভবিষ্য জীবনের জন্য এ এক স্মৃতি ভারাতুর যন্ত্রণা। হয়তো শাকের একদিন আজকের সময় ডিঙিয়ে পরিপূর্ণ সত্তায় বিকশিত হবে। কোনোক্রমে মনে পড়ে যেতে পারে প্রাণের আব্বু তাকে অবহেলা করেছিল। সেদিন আজকের অবহেলার জন্য রজবকেই দায়ী করবে।
আজ একটি ঘটনা ঘটল শাকেরের স্কুল জীবনে। স্কুলে পৌঁছে শাকের আইসক্রিম অনুরাগে বিগড়ে উঠে দোকানদারের কাছ থেকে আইসক্রিম নিয়ে টাকা দিতে পারল না। দোকানদার অমনি ছোট ছাত্রটির নরম কোমল গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। শাকের চড় খেয়ে এ্যা-এ্যা আ-আ করে কাঁদতে কাঁদতে সোজা রাস্তা দিয়ে ডানে বামে না তাকিয়ে বাড়িতে হাজির হল।
বই খাতা কলম স্কুল ব্যাগ সবই তখনও স্কুলে। শাকেরের মা এমন দৃশ্য দেখে তার লুকানো তহবিল থেকে শাকেরকে টাকা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে দায়িত্বহীন রজবের জন্য বদ্ দোয়া করল।
তারপর মা ক্ষোভে রাগে পাশের বাড়ির একজনকে বলল, দেখেন আমার সোনার সংসারে গুরু ঢুকেছে। যে লোকটা বিয়ের পরে আমাকে ছেড়ে, ছেলেমেয়ে রেখে, কোনদিন বাইরে থাকত না; গুরু ধরে এখন সে উদাসী। গুরু নাকি তাকে ওপারে মুক্তি দেবে।
এভাবে যদি চলতেই থাকে আমার পথ আমি বেছে নেব। সময় দেবে না-তো বিয়ে করছিল কেন? ওর জানা থাকা উচিত, বউকে রাত্রেও সময় দেওয়া লাগে। নইলে বউ রাখা অত সহজ নয়।
আমি বুঝতে পারছি না চুল, দাঁড়ি, গোফে ঢাকা ওই লোকটা গুরু নাকি গরু। গুরু হলে তো অন্যের সংসারের যাতনা বোঝা উচিত। গরু বলেই ও আমাদের সংসারে আগুন লাগাচ্ছে।
অবশেষে অনেক দিন পর রজব বাড়িতে ফিরে শাকেরের মার সাথে ভাল করে কথা পর্যন্ত বলল না। শাকের ছোট বোনকে নিয়ে এদিক-ওদিক প্রজাপতির মত ছুটোছুটি করছে। ভাইয়ের সাথে বন্ধুবেশে বোনটি বে-খেয়ালে খুশিতে খেলায় মত্ত। তারা বোঝে না মানুষের যন্ত্রণা কি?
শাকের খেলা শেষ করে তার আব্বুকে দেখে কাছে এসে আহলাদিতভাবে কান্নার সাথে বলল, জানো, দোকানদার আইসক্রিমের জন্য আমাকে মেরেছে। এ কথা শুনে রজবের বুকের ভেতর কষ্টে কেঁপে উঠল। শাকেরকে কোলে তুলে সঙ্গে সঙ্গে অনেক চুমু খেল। আদর করে হাতে ধরিয়ে দিল বেশ কিছু চক্চকে ইলিশ রঙের টাকার নোট।
শাকের সেই টাকার নোটগুলো নিয়ে আদরের সুরে বলল, আব্বু, আমি আর অই দোকান থেকে আইসক্রিম কিনব না।
শাকেরের কথা শুনে রজব সাহস দিয়ে বলল, ঠিক আছে অই দোকান থেকে কিছু কিনতে হবে না।
তারপর রজব শাকেরের মাথায় ডান হাতের তালু রেখে প্যারেডরত আর্মির মত সোজা করে দাঁড়িয়ে দিল; শাকের নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকল, রজব চোখ উল্টে উর্দ্ধমুখে আকাশের দিকে চেয়ে ফিস্ফিস্ করে দোয়া পড়ে এক গ্লাস পানিতে ফুঁক দিল তিনবার। ফুঁক শেষে ডান হাতের নখগুলো গ্লাসে ডুবিয়ে শাকেরের সমস্ত শরীরে পানির ফোঁটা ছুঁড়ে মারলো এবং বললো, সবই গুরুর কৃপা! আর কেউ কিছু করতে পারবে না আমার ছেলেকে।
এ দৃশ্য দেখে শাকেরের মা রেগে যেয়ে বলল, কাছে থেকে ছেলেমেয়েকে দেখে রাখো না, পানি পড়ে গায়ে ছিটাচ্ছো। কতবড় ঠাকুর! ওসব ভ- ঠাকুরদের কপালে কোনদিন সুখ হবে না।
শাকেরের মায়ের অপমানকর আক্রমণাত্মক কথা শুনে রজব বলে উঠল, তুমি এসব বুঝবে না। ‘গুরুজ্ঞান’ পরম বস্তু। সেটা যদি বুঝতে, আমাকে প্রশংসা করতে। শাকেরের মা রজবের সাথে মুখে মুখে তুমুল তর্ক শুরু করে দিল।
রজব বিষ্ফারিত বোমার মত প্রচ- ক্ষেপে উঠার পর তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল, গুরু বলেছিল, নারী হল সৃষ্টির মূলাধার। তাকে অত্যাচার করা যাবে না। অত্যাচার করলে সৃষ্টি বিনাশ হয়ে যাবে। এই বাণী রজবের ক্রোধকে থামিয়ে সংযত করে রাখল; রাগ তো দূরের কথা, রজবের ঠোঁট ছিটকে কোন অশ্লীল কথা পর্যন্ত বাইরে এল না। সে চুপচাপ বসে রইলো। ততক্ষণে শাকেরের মা চিৎকার করে বাড়িতে লোক জড়ো করে ফেলেছে।
শাকেরের মায়ের চিৎকার এখনো থামেনি। রজব কারো সাথে কোন কথা না বলে অশান্তি বুকে করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মনের ভেতর অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে হাঁটা শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল গুরুর দরবারে।
রজব দরবারের বারান্দার সন্নিকটে স্যান্ডেল খুলে ছুটে যেয়ে গুরুর পায়ের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে নিজের মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে ফেললো।
গুরু রজবের সরল কান্না দেখে বলল, ওঠেন বাবা, ওঠেন। মনের কথা খুলে বলেন। দেলে কোন পাপ রাখবেন না। আমার কৃপায় ঠাকুরের দয়ায় সব ঠিক হয়ে যাবে।
রজব গুরুর বাক্য শুনে কান্না থামিয়ে বলল, বাবা, আমার সংসারে আগুন জ্বলে উঠেছে। শাকেরের মা আমাকে সইতে পারছে না। কি করবো?
গুরু রজবের কথা শুনে বলল, নারী হল মহাকাল। পূর্বেই কালের হাতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। এ থেকে মুক্তি দুঃসাধ্য। কাল আপনাকে বিনাশ করার ক্ষমতা রাখে।
রজব জিজ্ঞেস করলো, তাহলে কি হবে?
গুরু বললো, চিন্তা করবেন না, আপনার গুরু আছে।
দুঃখ ভুলতে রজব বেদম হারে সমস্ত দিন আড্ডা খানায় গঞ্জিকার স্বাদ নিল। দিনটা কিভাবে অতিবাহিত হল সে খেয়াল তার হল না।
ওদিকে বিস্কুট ফ্যাক্টরীর হিসাব, কর্মচারীদের দেক্ভাল সবকিছুতে ঢিলেমি অব্যবস্থাপনা শুরু হয়েছে। কত টাকা আয় হচ্ছে, ব্যয় কি রকম, আস্তে আস্তে সবকিছু রজবের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কর্মচারীরা ইচ্ছামতো তাদের অভিসন্ধি পূরণ করছে।
নয়ন কয়েকদিন রজবের সাক্ষাৎ না পেয়ে ফ্যাক্টরীতে খুঁজতে এসেছে।
কর্মচারীরা বলল, চাচা বাড়িতে। বাড়ি থেকে অনেক আগেই ফিরে আসার কথা। দেরী হচ্ছে কেন জানি না।
কর্মচারীর কথা শুনে সে ক্যাশবাক্সের পাশে বসে তাকে চা আনতে বলল। চা পান করার পর সুবাসিত জর্দা দিয়ে পান মুখের ভেতর পুরে চিবোতে থাকল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর রজবকে না আসতে দেখে উঠে ক্যাশবাক্স থেকে একটি টাকার বান্ডিল তুলে লুঙ্গির ভাঁজে গুঁজে নিল। ফ্যাক্টরী ছেড়ে যাবার সময় এক কর্মচারীকে বলে গেল, ভাই নেই, দেখে শুনে থেকো। ক্যাশ সাবধানে রেখো।
নয়ন ফ্যাক্টরী থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রজবের বাড়ির দিকে। তার হাঁটার পথ শেষ হল রজবের বাড়ির সামনে যেয়ে। রজবের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সে, রজব ভাই, রজব ভাই, বলে ডাকছে। ডাক শুনে শাকেরকে তার মা পাঠিয়েছে।
শাকের নয়নকে বলছে, আঙ্কেল মা আপনাকে ভেতরে যেতে বলছে।
সে শাকেরের কাছে জেনে নিল রজব বাড়িতে আছে কি-না। তারপর আনন্দের সাথে আসক্তিতে রজবের বাড়িতে ঢুকল। তাকে পেয়ে শাকেরের মা রজবের প্রতি মনের সমস্ত ক্ষোভ আক্ষেপ রাগ তুলে ধরলো।
নয়ন শুনে কৃত্রিম অনুরাগ পোষণ করে বললো, ভাবি, ভাববেন না। এই অধম গুরুর কৃপায় বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে শুধু মানুষের উপকার করে আসছে। কোন বিপদে পড়লে আমাকে সর্বক্ষণ পাশে পাবেন।
শাকেরের মা তার কথা শুনে খুবই খুশি হয়ে বলছে, শাকেরের বাপের হুঁশ বুদ্ধি এখন অনেক কমেছে। তোমার মত সুদর্শন বলশালী একজন পাশে থাকলে জীবনে অনেক সাহস পাব। তুমি সময় পেলেই আসবে। ডাকা যেন না লাগে। শাকেরের মা কথাগুলো বলেই নয়নের চোখের সাথে চোখ মিলিয়ে অন্তরের গোপন কথা কয়ে চললো। তখন দুজনের বুকের মধ্যে বিদ্যুতের গতিতে শক্ খেয়ে একটা কামনার ঝড় বয়ে গেল।
নয়ন স্বাভাবিক হওয়ার জন্য খুব দ্রুত আসন ছেড়ে বলে উঠল, ভাবি আজ আর নয়। আমি আসব, এই অধমকে ডাকলে নিজ দায়িত্বে ছুটে আসবো। তারপর সে বেরিয়ে গেল।
শাকেরের মা দরজার সাথে শরীর ভিড়িয়ে নয়নের পেছন থেকে চলে যাওয়া দেখছিল। সে চোখের আবডালে না যাওয়া পর্যন্ত চোখ মিলিয়ে রাখল সেদিকে। নয়ন গেলো কিন্তু কি যেন রেখে গেলো। যার জন্য শাকেরের মায়ের মন অভিসিক্ত আকাঙ্খিত।
0 Comments