মইন্না তালুকদার ।। নুসরাত সুলতানা’র আত্মস্মৃতি

Mainna Talukdar. Autobiography of Nusrat Sultana


আমার মায়েরা ছিলেন চার বোন এক ভাই। চার বোনের ভেতর আমার মা মেঝ। আর ভাইবোনের ভেতর তৃতীয়।  আম্মুর বড় বোন মানে বড় খালাম্মাকে তাদের খালাতো ভাই তেলপড়া দিয়ে পটিয়ে বিয়ে করেছিলেন। বড় খালাম্মা ছিলেন পরম সুন্দরী। গায়ের রঙ একেবারে সবরি কলার খোসার মতো হলুদ। একেবারে খাঁড়া, চিকন নাক, পাতলা ঠোঁট। তেমনি ছিলেন খুব নরোম স্বভাবের অধিকারী। বড় খালুও ছিলেন বেশ নম্র-ভদ্র। এই দম্পতির চার ছেলেমেয়ে। দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে। খালাম্মা এবং খালু কেউই ছেলেমেয়েকে তেমন মারধর করতে পারতেন না। খালাম্মার ছোট ছেলের নাম রুবেল। আদর করে ময়না ডাকতে ডাকতে একসময় হয়ে গেল মইন্না।

বড় খালাম্মাদের বাড়ি ছোট বেলায় আমরা খুব যেতাম। ওরাও আসতো। কীর্তনখোলা নদী নৌকায় পাড় হয়ে বেড়াতে যেতে খুব আনন্দ হত। রুবেল একবার আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসলো। আম্মু সকালে ভুনা খিচুড়ি আর মুরগীর মাংস রান্না করলেন। আমরা খেতে বসেছি। এমন সময় ফাতেমা আসলো আমাদের ঘরে। ফাতেমা আব্বুর চাচাতো ভাই রহিম কাক্কুর মেয়ে। তো রুবেল দেখলো যে- আম্মু এখন ফাতেমাকেও খিচুড়ি মুরগীর মাংস খেতে দেবে। ওর আশঙ্কা হল- ওর ভাগে কম পড়ে যেতে পারে। এই মইন্না তালুকদার ফাতেমাকে বল্ল- ফাতেমা তুমি অই মুরহাডা লড়াইতে লড়াইতে ঘরে চইল্লা যাও আফু। আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। ফাতেমাও হেসে হুস হুস করে মুরগীটা তাড়িয়ে দিল। রুবেল বলল- কাম সারছে! যাইবে না, খাইয়াই যাইবে।

বড় খালুজান চরমোনাই পীরের মুরিদ হলেন। মইন্না তালুকদারকে দেয়া হল মাদ্রাসায়। এক ছুটিতে খালুজানের পরম আদরের পুত্র বাড়ি এলো। খালু তাকে নতুন একটা লুঙ্গি কিনে দিলেন। সেই লুঙ্গি খালাম্মা ধুয়ে রোদে শুকাতে দিলেন।  একটা মুরগী লুঙ্গির ওপর উঠে মল ত্যাগ করল। গোসল করতে গিয়ে খালুজান দেখলেন লুঙ্গির ওপরের দিকে অনেকটা গোল করে কাটা। খালুজান জিজ্ঞেস করলেন - অ কী মইন্না তোর লুঙ্গি এহাইনদা কাডা ক্যা? রুবেল বলল- মুরগী পায়খানা করছে হেইপেন্নে বেলেড দিয়া গোল কইররা কাইট্টা হালাইছি। খালুজান বললেন - তুই এহানে খাড়া। তোরে মারমু, আমি লাডি আনতে যাই।

এক সন্ধ্যায় আম্মু আমাদের নাশতা দিয়ে পড়তে বসিয়ে পাশের ফুপাম্মাদের ঘরে গেলেন গল্প করতে। আম্মু প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ছয় ছেলেমেয়ে, চাকরি তাছাড়া আমাদের নিজস্ব কৃষি ছিল। এতকিছু সামলে  তাই সহজে কারো ঘরে যেতে পারতেন না। সেদিন গেলেন। আব্বু স্কুলের জন্য বিস্কুটের টিন এনে রেখেছেন। আমরা সবাই পড়ি আর অই টিনের দিকে তাকাই। হঠাৎ দাদা বলল যে - আমি তোমাগো অই বিস্কুট খাওয়াইতে পারি। তোমরা খাবা? সেদিনও রুবেল বেড়াতে এসেছিল। ও পট করে বলল- আমনেহর সাওস থাকলে খাওয়ান তো খোকন ভাইয়া। আমরাও বললাম - পাললে খাওয়াও তো দাদা। যেই কথা, সেই কাজ। দাদা বিস্কিটের টিন ভেঙে আমাদের খাওয়ালো। কিছুক্ষণ পর আম্মু এসে তাকিয়ে দেখল- বিস্কুটের টিন খোলা। আম্মু কিছু না বলে- জানালা আটকাতে শুরু করলেন। দুইটা জানালা খোলা থাকতে দাদা বলে- মারবে আম্মো। সব লাফ দিয়া বাইরে যা। রুবেল ও গেলো। আমরা আব্বুর অপেক্ষা করতে লাগলাম। রুবেল মাঝে মাঝে ঘরে গিয়ে দেখে আসে- আম্মুর মেজাজ কেমন। সেই রাতে আব্বু বাড়ি আসতে আসতে বারোটা বেজে গিয়েছিল। এসে আম্মুকে বলে- আমার মাইয়া-পোলা কই? আম্মু বলেন- সব বাইরে। ছ্যাচা দেতে লইছেলাম। বিস্কুটের টিন খোলছে। পিডা বানাইয়া খাওয়াইয়া সুমার মায়ের লগে কতা কইতে গ্যাছেলাম ইট্টু। আব্বু বলে- হেইপেন্নে তুমি আমার পোলাপান খেদাইয়া দেবা? বিস্কুট আমি ইস্কুলে কিইন্না দিমু। আব্বু এসে আমাদের ঘরে নিয়ে যান।

শেষ আরেকটা ঘটনা বলি এই বিখ্যাত মইন্না তালুকদারের। রুবেল তখন চরকাউয়া আলিয়া মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। খুব শীত পড়েছে সেবার। জানুয়ারি মাস। রুবেলের বড় বোন বীথি আপা জিজ্ঞেস করেন- রুবেল সাড়ে সাতটা বাজে। তুই এহনো উইট্টা ফজরের নামাজ পললি না? খালুজান ধমক দিয়ে বলেন- ছেমরি ফাও কতা কইস না। মইন্না দেহি কোন বেইন্নাকালে নামাজ পড়ছে! বীথি আপা বলেন- আহারে আব্বা! আমনেহ বোজলেন না! ও ল্যাপের মইদ্দে হুইয়া হুইয়া তাকবীর, তাহরীমা, রুকু, সেজদা এসব দেছে। আমনেরে হুনাইছে যে ও নামাজ পড়ছে। ও তো ঘুমদাই ওডেনায়। খালু বিষ্ময়ে বিমুঢ় হয়ে রইলেন। 

আমাদের শৈশবের এক অনিন্দ্য আনন্দ পূর্ণ অধ্যায় মইন্না তালুকদার। স্মৃতির প্রশান্ত জলাশয়ে সে এক জ্বলজ্বলে মুক্তো।


লেখক: নুসরাত সুলতানা 
কবি ও কথাসাহিত্যিক

Post a Comment

0 Comments