শামীম আহমেদ এর গল্প ~ বৈকল্যের আলো-আঁধার

Shamim Ahmed ~ the light and darkness of weakness



(তারপরে, মনোটোনাস ইমারতি ধূসরতার ফাঁক গলে জেগে থাকা সবুজের আধিক্যে মুষল রোদের প্রলেপ পড়ে।শহরের একাংশে মজা দেয়ালের পাশে, সুয়ারেজের কালসিটে- হলদেটে ভাগার ঘেঁষে মাথা উঁচিয়ে রাখে প্রমাণ সাইজ বৃক্ষ ও তাদের অনুজদের স্থাণু ল্যান্ডস্কেপ-  কম্পমান বিনত শাখা ও কান্ড চুইয়ে নামে আলোর ফলা। পাশাপাশি দাঁড়ানো বিভিন্ন প্রজন্মের ঊর্ধ্বমুখী ইমারতগুলি কালো গন্ধ, কালো কাকের কর্কশতা ও রোদ বাতাসে দোল খায়। স্মৃতিগুচ্ছের ব্যাতিচারে গাছবয়েসী, বয়:বৃদ্ধ - শহরে নির্বাসিত একক মানুষের দীর্ঘশ্বাসেরা দীর্ঘ স্পষ্টতর হয়। নেতানো, নিস্তেজ, সর্পিল সময় পোক্ত খোলসের ভিতর গুটিয়ে আনে আবয়ব। যাতনার পীড়ন মেখে ভাগ হয় একজন মা বয়েসী অথবা একজন ছেলে বয়েসী মানব বৃক্ষ। একক সত্ত্বা নিয়ে দ্বৈতের অনুনাদ যেন অহেতুক মোড়  ঘুরে শহরে বিলাপ করে ....।)

ক.
উত্তীর্ণ সন্ধ্যা সেই ছেলেটির চারপাশে খলবলিয়ে কোলাহল করে। সাঁ সাঁ করে বেজে ওঠে জাপানি টয়োটার ছান্দসিক হাইকু। পায়ের তলা গুমগুম করে, ঝিনঝিন করে। ছেলেটি-রফিক, শফিক, কুদ্দুস কিংবা মফিজ- ফুঁ করে দলা থুথু বিসর্জন দেয় হাওয়ার গায়ে- পাখা গজিয়ে ছোট্ট চড়ুই ভাসে যেন- অথবা যেন তার মুখ থেকে ক্ষুধা মিশ্রিত রূপান্তরের পাখি উড়েছে- ফিনিক্স অথবা বাণেশ্বর। এখন ভাসে- এই নাঙ্গা ফুটওভার ব্রিজের সীমান্ত থেকে। আর তারপর ঠিক নিয়তির মতো থপ করে পড়ে কোন লাল, সাদা অথবা অন্য কোন মনোটোনাস রঙ্গা বিলাসী গাড়ির গায়ে। ছেলেটি বালখিল্য হাততালি মারতে চায়। যেনবা লক্কর-ঝক্কর চামরা ওঠা, কঙ্কাল দ্যাখানো জনযানে পড়লে থুথুজন্ম বৃথা হতো। গা- গতরে ঘামক্লান্ত বাতাস খুঁনসুটি করে। ফুটওভার ব্রিজটা আঁধারে ভেজে অথবা অফিস ফেরত ছেলেটির সাথে রাতের ডেরায় ফেরে- ছেলেটি ব্রিজটার হাত ধরে থাকে অথবা ব্রিজটা ছেলেটির। ছেলেটি ঘরে ফিরতে চায়- কিন্তু ঘর তাকে টানে না- সন্ধ্যাটা তাকে টেনে রাখে। ছেলেটি-রফিক, শফিক, কুদ্দুস কিংবা মফিজ।

আর, মা ঝিম ধরে, তবুও মা ঝিম ধরে। আর চোখের আল ভেঙ্গে খসখসে গালের অমসৃণ জমিন বেয়ে নোনা আবেগ চিবুকে গড়ায়- নিঃশব্দ ও একাকী। মাঝে মাঝে চোখের আল শক্ত প্রতিদ্বন্দ¦ী ঠেকলে জল আটকে স্বচ্ছ টইটুম্বুর-টলমলে ঝিলমিল করে। যেন দীঘি একটা- অথবা দহ বা ঝিল- না হলে, বৃক্ষ আড়ালে উঁকি দেওয়া তৃণাচ্ছাদিত জলডোবা। তবু, মা কান্না করে অস্পষ্ট মিহি মিহি- তারপর খুনখুনে- আর, তারপর- বিদীর্ণ করে। লোহা, ইট সিমেন্ট কাঠামোর এই আধা চিলেছাদের উচ্চতা থেকে দেয়ালে আবদ্ধ শহরের তাচ্ছিল্যে নুয়ে থাকা ক্ষুদ্রবন সম টুকরো বাগান দেখে গ্রিল খাঁচায় ঠেস দিয়ে। মার চোখে বাগানের মনোটোনাস কালচে সবুজ আঁধারের ন্যাচারাল প্রতিফলন হয়। যেন চনমনিয়ে বাড়ে একটি তিতকুটে নিশিন্দা অথবা একটি যাতনার হেমলক। সাথে বাড়ে সর্বগ্রাসী অতৃপ্তি। দুই পায়ে বয়সের ভার, আধা মনোবিকৃতি বা মনোবৈকল্য আর ব্যাথার কিটকিটে দংশন চোখে নিয়ে কোন ব্যস্ত সমস্ত চলমান দুপুরে শ্যাওলা গন্ধি ব্যালকনিতে মা ছায়ার খেলা দেখে। কালচে সবুজ ছোপ ছোপ আধাঁর আর রোদ ফালির মতো তীর্যক আলোর সাথে মিতালী করে ছুটে বেড়ানো গুটিকয় পাখির সাথে নির্বাক ভাব-সম্প্রসারণ করে। আর দেখে রোদ ও ছায়া অদ্ভূত জানোয়ারের মতো মরচে মাখা গ্রিলখাঁচা ও ম্লান মেঝেতে হাত পা ছড়ায়, আবার গুটিতে নেয়।

সাপ্তাহিক ছুটির থির বিকালে তবু  অফিসে আধা বেলা হিসাব বিজ্ঞান গুতিয়ে রোদ মাখা- ঘামের চিড়বিড়ে ভেজা কামড় পিঠে নিয়ে ছেলে বাড়ি ফেরে। ভাস্কর্যের  অসারতা নিয়ে মা ঝুল বারান্দা থেকে মুখ তুলে তাকায়। মা’র মুখে ফালি রোদের ফলা বিদ্ধ হয়ে থাকে। মার মুখে বিষন্নতার কালো ছায়া ফণা তোলে, চোখের নিচে মরা নদীর ফসিলের মতো কান্নার সরল মানচিত্র শুয়ে আছে। মা মানচিত্র মোছে না- মা কথা বলে না- মা যেন কথা বলেনি কোনদিন অথবা আর কথা বলবেনা। বয়েসী ঘরঘরে কলতান করা সিলিং ফ্যান ছাদের উষ্ণ আতপ আদর টেনে এনে অকাতরে ঘরে বিছায়। ফ্যাকাসে চটা দেয়াল, অগোছালো কাপড়, ততোধিক অগোছালো ঘটি-বাটি সিদ্ধ হয়- অবুঝ অগোছালো মায়ের মতো।
- ভাত খাইছেন মা! মা অলস অনিচ্ছায় স্লো মোসনে মুখ ফেরায়। তার ঠোঁটজোড়া পরস্পর সাঁটানো। মা কথা বলে না- মা যেন কথা বলেনি কোনদিন অথবা আর কথা বলবেনা।
ভাতের হাড়ির এলুমিনিয়াম ঝকঝকে মুখব্যাদান করে– ঠন্ঠন্ বাজে। খেয়ালে আসে-গতকাল পত্রিকাওয়ালারা বলেছিলো- ওমুক, ওমুক ও তমুক জায়গায় উন্নয়ন ঠ্যালায় গ্যাস ছুটির দিনের মতো আধাবেলা ছুটিতে থাকবে। সুতরাং, নাগরিকগণ আধাবেলা না খেয়ে থাকবেন অথবা আধাপেটা খাবেন। সেলস্ কর্মী বউটা বোধ হয় সকালে হাড়ির পাছায় আগুন দিতে পারেনি- ফলে ছেলেটি দ্বিতীয়ার্ধের এই বিকালে পাতিলের তলানীতে এক হাঁটু জলে চুবিয়ে কয়েক মুষ্টি চাউল ফুটতে দেয়, লাল ডিম ভাজা আর ডাল পাঁচফোড়নে বাগাড় দিতে গিয়ে ঘর তাতিয়ে ঝাঁঝিয়ে তোলে। মা নির্বাক ভাবহীন চোখে খালি দেখে যায়। তার দৃষ্টিতে দেয়াল ভেদ করে নিরুদ্দেশ সুদূরে হারানোর প্রতিচ্ছবি। আধা চিলেছাদের ঘরে অনিচ্ছা ক্ষুধায় ডালমাখা ভাত তালুতে ওঠে- মা বিষম খায়। মা’র বুঝি মৃত স্বামীর কথা মনে হয়- অথবা পাড় ধ্বসা মাটির পতন ঢেউ তুলে আসে!
- বাবা, ঘর আমার দম আটকায় রাকে, আমারে বাড়িত থুইয়্যা আয় ... । মা ক্ষণিক কথা বলে অসহায় চুপ মেরে যায়, ছুঁড়ে দেয়া বিমূঢ় কথা অথই ভঙ্গিমায় বুঝি ফিরে আনতে চায়। মূর্খ মা জানেনা কথারা ফেরে না। আবার চোখে আঁধার নামে, আবার মা’র বুঝি মনে পড়ে তার আর বাড়ি নাই। তার প্রাক্তন উঠানে থই থই যমুনা  রামলীলা করে।

খ.
তাই, মা’র অসুখ করে- বিরামহীন অসুখ শরীরে মনে গুজগুজ করে। মনের মধ্যে ঘূর্ণি দেয় কুল ছাপানো উথাল পাথাল জলঘোলা যমুনা। আর মৃত স্বামী। মা’র মন থেকে বিষকাঁটা সরানো- চোখের স্মৃতিভষ্মের সুদূর ধূসরতা কাটানোর অভিপ্রায়ে- রিকসার টুংটুং সঙ্গীত আর নাগরিক ক্যাঁচালের তোর ফুঁড়ে মা’কে নিয়ে যায় শাহবাগে দশ টাকার চিকিৎসায়। নাগরিক ক্যাঁচালে বিদ্ধ হয়ে মা’র মাথা ভার হয়- রোগওয়ালা দীর্ঘ লাইন দেখে ভরকে আসে। দীর্ঘ পা ব্যাথা অস্বস্তির  অপেক্ষার পর নম্বরের ডাক এলে ডাক্তার তুচ্ছ কীট দর্শন করে ঈশ্বরের মতো ঔদ্ধত্যে খস খস করে অসুস্থতা লেখে, আর ঘুমবড়ির তবক দেয়। স্মৃতিভারাক্রান্ত যাতনাকে লুলাবি শোনায়।
- মা’র ঘুম হয় না, মা কথা কয় না, মা সাড়া দেয় না- ডাক্তার স্যার! সরল বর্ণনায় ছেলেটির কাচুমাচু বিষাদ নড়েচড়ে।
- যার সমস্যা তাকে বলতে দিন! ডাক্তারে ঈশ্বর চড়ে বসে। ডাক্তারের ক্লিন সেভড্ মুখ, ঘষা চশমার ভিতরে বড় চোখ মায়ের দিকে নির্বিকার তুচ্ছ দৃষ্টিতে তাকায়। মা ডাক্তারের ত্যাছড়া দৃষ্টি অনুবাদের সমর্থ রাখে না।
তাই- মা কথা বলে না- মা যেন কথা বলেনি কোনদিন অথবা আর কথা বলবেনা।

এরপর, শাহবাগ রোড কোমর ঘুরে খাঁচাবন্দী জন্তু-জানোয়ারের শোরগোলে ঢুকে পরে। কিঁচ কিঁচ- কিচির মিচিরে মা আপ্লুত হয়। যেন একটা বনজ বা জলজ ঘ্রাণ শোঁকে ভোঁতা নাক বাড়িয়ে। জায়গাটা চিনে রাখতে চায়- রিকসা থেকে শরীর পিছলাতে চায়, ছেলেটি বোঝে- তাই রিকসার কোল খালি করে বাহারি রঙ্গা দোকানের সামনে পা থামায়। তার নিরুদ্দেশ সুদূরে হারানো অথবা ব্যাথার কিটকিটে দংশিত চোখে বিস্ময় থকবক করে। এতো রঙচঙ্গা পাখি আর মাছ মাথার জট খানিক থিতিয়ে দেয়। ছেলেটির ভালো লাগে। মা দেখুক- চোখ খুলে দেখুক। শহরের তো কিছুই দেখেনি! শহর তো অচেনা থাকে।
- এইগুলান কি খাওয়া যায়? অবুঝ বেহাল জিজ্ঞাসা আচমকা আসে।
- না, মা, মান্ষে পোষে। উত্তরে ছেলেটির মায়া মাখানো।
- বাপরে! মাচ পোষ্ মানে! তার কথায় বিস্ময় আর জিজ্ঞাসা মিলিত সুরে ঝরে। কে বলে, তার মাথায় খেয়ালের জট সকাল বিকাল নাচে!
- খোলাহাটির বাড়ির নামাত যমুনা আচিলো, যমুনা মাচ পুষত। আচিলো, একন আর নাই- তাই না বাপ?
মা যেন পড়া মুখস্ত বলে। যেন অনভ্যস্ত কথা সাজিয়ে অভীষ্ট ছবি বানায়। ছেলেটির আবার ভয় করে- আবার ঝপ করে খোলসে ঢুকবে। কিন্তু মা এ যাত্রায় টিকে থাকে। টিকে থাকার ইচ্ছে প্রস্তাব পেশ করে। স্মৃতি আর বিস্মৃতিগুলো পোষ মানানোর মতো করে পাখি পোষার ইচ্ছে প্রস্তাব পেশ করে। গ্রাম্যতা মাখা মা শহুরে ডেরায় এসে কখনো কোন ইচ্ছে প্রকাশ করেনি।
শীর্ণ ও দৈন্যদশার ছেলেটির ততোধিক বেহাল মানিব্যাগ তবু খুশিমনে মা’র খুশির তোড় বাড়াতে, একটি সিঙ্গেল প্যারাকিটে পেট উজাড় বিনিয়োগ করে। মা তো, তাই না!

গ.
সিঙ্গেল ক’হাজারি বেতনের ছেলেটি তার বহু বহু দূরের পড়ো পড়ো কোন সম্পর্কের, বাপ বয়েসী ভাইয়ের এই পড়ো পড়ো চামড়া ওঠা ইমারতের আধা চিলেছাদ আঁকড়ে থাকে। অকেজো আসবাব বৈধ দখলদারিত্ব বজায় রাখে বাকি আধা অংশে। তার পেটের ভেতর হাত আটেক ফাঁপা জায়গা ঘুরপাক খায়- রাতে ছেলেটির মতো- অথবা ভোরে বউয়ের মতো- আর বেহিসেবি মার মতো। তাই সে রাত নামলে নাম পাল্টে কেয়ারটেকার হয়। বন্ধ ঘরগুলোর তালার আয়ু টেনে দেখে, ভারাটিয়াদের তবিয়তের গৎ শোনে। নিচ তলার গোডাউনের চাঁট গাইয়া মালিকের চটি বইয়ের উচ্চ সংস্করণের গুচ্ছ গল্প শোনে। আবার, দূরদেশে থাকা বাপ বয়েসী ভাইয়ের তহবিলে ভারাটিয়ার মাসোহারা জমায়। আর নিজের তহবিলে ভরে তোলে ক্লান্তি আর অনিশ্চয়তা। চোখের কণীনিকা আর বুকের খাঁচায় ঈর্ষাবোধ কিলবিল করে। চওড়া দীর্ঘশ্বাসের ছকে পড়ে বর্তমান উড়ে গিয়ে ভবিষ্যত হয়ে যায় এলোমেলো। পাশাপাশি জন্মানো নবীন ইমারতগুলো এই বিবর্ণ বিষাদবর্ণ আর্দ্র গন্ধভরা দেয়ালের বুড়ো ইমারতকে ভেঙ্গচি কাটে- তার উচ্চতাকে অবমাননা করে, গায়ের রঙকে নাক সিটকে উচ্চতায় মাথা তোলে। সারাদিন না ঘুমানো মা ঘুমবটিকার তবকে- আধা ঘুমে, আধা চিলেছাদের এক প্রকোষ্ঠের ঘরের দুই প্রান্তের দুই বিছানার একটিতে দু:স্বপ্নের কামড়ে রাতভর ছিঁড়ে ছিঁড়ে আসে। বউ ঘুম জাগরণে ছটফটায়, সে অকেজো আসবাবের কোলে সস্তা বিড়ির আগুন উস্কায়। আলো ছায়া জনৈক অলৈকিক অস্তিত্ত্ব নিয়ে নড়ে চড়ে। শরীর থেকে কামের খোলস খুলে পড়েছে অথবা বিমূর্ত নিস্ক্রিয়তায় লজ্জাবতীর মতো হাত গুটিয়ে রাখে। একমাত্র আলোদাতা ঘোলাটে বাল্বটি নিভিয়ে বউয়ের কাছে চটির উত্তাপে জমানো উষ্ণতা ঢালতে গেলে, বিছানার লটঘট শব্দে মার ঘুম কাটে। মুখের মধ্যে তবক দেয়া ঘুমের জড়ানো কথার ক্লান্ত লুটোপুটি নিয়ে মা সরব অস্তিত্ত্ব জানায়।
- ও বাপ, আলোডা জ্বালা? আলো জ্বেলে এলোমেলো বিব্রত ছেলেটি দেখে কাঁচুমাচু মা হলদে-কালো আলো ছায়া নিয়ে তিরিতির কাঁপে।

তাদের নির্ঘুম রাত সকালে আড়মোড়া ভেঙ্গে হা মেলে বে-সামাল শুয়ে থাকে- তস্য গলিতে, রাস্তার কৌণিক মোড়ে, নগর কাঠামোতে। শুঁয়ো পোকার মতো চেনা রাস্তার অচেনা আলো আঁধারিতে গুটিকয় আদম রাস্তার ঘুম ভাঙ্গায়। রাত প্রহরার ক্লান্তি নিয়ে, রাতের কড়কড়ে ঠান্ডা ভাতের ডিবাটা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে সেলস্ গার্ল বউ পথ মাপে। সূর্য ধীরে ধীরে তেতে উঠে ছেলেটির ভাবনার জাল গলিয়ে ফেলে। ভাগাভাগি করে রাখা ভাত প্লেটে নির্জীব শুয়ে গলাধ:করণের প্রতীক্ষায়। ভোরে ঘুমানো মা’র মাথার কাছের ঝুল বারান্দায় জবুথবু একাকি প্যারাকিট মার প্রতিচ্ছায়া হয়ে ঢুল খায়।
নিয়ত নিয়তির মতো, মাল্টি পারপাস অফিসে হিসাব বিজ্ঞান গুতানো ছেলেটির পা জোড়া দিন শুরুর ম্যারাথনে শামিল হয়।
নিয়ত নিয়তির মতো, আধা স্মৃতিবৈকল্য আক্রান্ত মা’র নিরাপত্তার পাহারায় অনড় থাকে মাঝারি আকারের আধা কর্মক্ষম বুড়ো তালা।
ফলে, ঘুম বিভোর মা কার্যত কয়েদীর রূপ পায়।

ঘ.
উত্তীর্ণ সন্ধ্যার খলবলানো কোলাহল পেড়িয়ে ছেলেটি সিঁড়ির পিঠে শ্রমভারি পায়ের অলসতা রাখে। বাইরের ল্যাম্পপোষ্টের ধূলোট হলদেটে আলো অন্ধকার সিঁড়িতে ন্যাতানো। তালার ঘুম ভাঙ্গিয়ে ভেতরে ঢোকে। মূল দরোজা খোলা। গ্রিলের দরোজার প্রতিবন্ধকতার এপাশ থেকে ঘরের আঁধার দেখা যায়। মা কি এইদিকে এসেছিলো? তার ভাবনা হয়। ঝুলবারান্দায় দাঁড়ানো মায়ের একাকী কথন আরো বৃদ্ধ শোনায়। মা বুঝি পাখির সাথে কথা বলে। বাতি জ্বলে উঠলে মা ঘুরে তাকায়- মুখে রোগা অপুষ্ট হাসি। চোখের কোনায় ফুলের মতো ছলছলে ছায়ার ফণা ফোটে।
- আন্দারে কি করো, মা? কাঠ শুকনো গলায় অবশিষ্ট থুথু মাখিয়ে জিজ্ঞাসাটা বাতাসে মেশে। মা আশরীর মোচড় মেরে থামে জিজ্ঞাসাটার গোড়ায়।
- তোর বাপ আইচিলো, পাখিডা দেইকা দুইডা ড্যানার আপসোচ্ করইলো। তার উড়ার সাদ জাগচে। মার কন্ঠস্বর ফের অন্যরকম, ঘোরানো, কাটা কাটা- কন্ঠের ভয় সারা ঘরে নিথর জমে ওঠে। ছেলেটি ত্যাছড়া তাকিয়ে দেখে খাঁচার শক্ত শূন্যতা তার দৃষ্টিকে তামাশা করে।
- আব্বা আর নাই মা! পাখি ছাড়ছো ক্যা?
- ছাড়ি নাই, বাপ! ঐ দ্যাক, বাগানের বড় গাচটার আগায় খেলে। গাম্ভীর্যের বাকল ভেঙ্গে মা বেড়িয়ে আসে। ছেলেটি তাকিয়ে দেখে বাগানের গাছগুলি কতিপয় আলোর জ্যামিতিক রেখা নিয়ে আঁধারের আধিক্যে অজ্ঞাত আবয়ব বানায়। আলাদা হয় না।
- খাঁচাত ওর দম খাটো হয়- খাঁচাত অর হাঁসফাস হয় বাপ- আমার মতো। বিস্ময়ে ছেলেটির ভেতর গুটিয়ে যায়। মা’র অসাড় মাথা কর্মক্ষম হয়ে যেন দার্শনিক বাণ ছোঁড়ে। মা যে ছেলেকে শান্ত শিহরিত বিমূঢ় ফলা মেরে আরাম পায় তা মা’র বোধে আসে না। অপারগতার কাছে পরাজয় দাখিল হয় ছেলেটির,- মা বোঝে না। নিজেকে পাখি রূপান্তরে মা মিহি করে অপার্থিব হাসে।

তারপর, রোদের পিঠে রোদ- ছায়ার বুকে ছায়া মিশেয়ে দিন রাত আলগোছে আপনা আপনি সূত্রধরে গড়িয়ে পড়ে। মা নিঃসঙ্গতায় ভুগে সময়ের হাতে সঁপে যায় নিজে। আঁধারের সীমিত যে রূপ- নগরের যে অদেখা আলো শব্দহীন ছন্দে নাচে- তার দেখা হয়ে ওঠেনি। সেই অদেখা রূপের প্রত্যাশা করে সে অস্থির হয়ে। খাঁচা ঘরের ভিতর তার কল্পিত খাঁচায় পাখিজন্ম হয়।
ফলে, অবধারিত ডানা গজানোর বেগ আসে।
ফলে, কোন এক থিতানো বিকেলে বৃদ্ধ তালার সাথে বৃদ্ধার এবড়ো খেবড়ো দাগপড়া হাতের অলিখিত সন্ধি হয়ে যায়।

ঙ.
-ও মা, ও পাগলী মা রে ...
ছেলেটি কান্নায় ফুলে ওঠে- ছেলেটি জমাট কষ্টে জম্পেশ ফুলে ওঠে। ঘুরে ঘুরে রাস্তা, গলিতে, তস্য গলিতে, অচেনা মানুষী ভীড়ে উদ্ভ্রান্ত কান্না করে।
ছেলেটি-রফিক, শফিক, কুদ্দুস কিংবা মফিজ- নাকি অন্য কেউ, তাতে কারো কিছু আসে যায় না।


শামীম আহমেদ এর গল্প ‘মাঘীচাঁন্দের উড়াল’ পড়ুতে এখানে ক্লিক করুন


Post a Comment

0 Comments