ভাবনাটা প্রশ্ন তুলে মনের ভেতর দুলে দুলে ভো নাচে। গুটিকয়েক পঁচনতোলা কিন্তু আপাত গা সহনীয় খিস্তির নহর কানের পাশে শীস্ কাটে। পঁচাগন্ধের মতো চিড়বিড় করে হামলে ধরে। এই উথাল পাথাল ঢেউয়ে সে তালকানা হয়। হরেক গলার, হরেক সুরের পঁচা শব্দ উড়ে আসে- এর মধ্যে সহনীয় মাত্রার শব্দটি ‘জাইল্যার বাচ্চা’। পায়ের রূঢ় ক্ষমতার জেদে পৌরুষথলির কোষ মুখ দিয়ে উগড়ে দেবার অথবা বংশের ঝারবাতির ঝকমকানির নিভে দেবার হুমকি উড়ে আসে।
ঘটনাটা টিটকারির বিজবিজানি তোলে। চেংটুর মাথাটা জেরবের হয়। দহের উঁচুধাপের দুধঘোলা ভুরভুরে বালিতে মালকোচামারা সরু নিতম্ব, তটস্ত আলিস্যি নিয়ে একবিঘত ডুব দেয়। গল্পের আগা-গোড়া নাই মানুষের। লাফারু টং থেকে লাফিয়ে নামে, বালি তার অবতরণের শব্দ শুষে নেয়, তার একটা দক্ষ অবতরণ-উড়ালজাহাজের মতো। বাতাসের মিহি চলাচলের সাথে, টিটকারির বিজবিজানির সাথে সে আলগোছে নিঃশব্দে যেন উড়ে এসে বসে গোঁজ হয়ে থাকা চেংটুর পাশে। ঘটনাটার দায়ে তার দায় জন্মানোর হিসাব সারে অগোচরে।
বাতাসের বিপরীতে চেংটুর হাতে স্থানান্তরিত বিড়িটার পশ্চাৎ চুম্বনে আগুন উস্কে উঠে। যেমন উস্কে ওঠে চেনাজানা মানুষের তেজ তার নির্লিপ্ততায়। ‘ই...হ কি সখ, এতো লোব ক্যা তোর। বউ ছইল নাই কাক খিলাবু।’ কি বিস্ময়! কি বিস্ময়! চেংটু, দহের ওপাড়ে ঘাস কামড়ানো গরু, তারপর দহের পানি, তারপর টিটিকারি তোলা পরিচিতজন, ইত্যাকার দৃশ্যাবলীর ঘূর্ণন বানিয়ে লাফারুর দিকে তাকায়; দেখে ঘূর্ণনের শেষে লাফারু পুরনো দাঁতের ক্ষয়া দেয়াল তুলে হাসি আঁকছে।
‘ক্যা বারে চাচমিয়া, কামডা মনে হচ্চে ঠিক হয়নি; তাই ল?’
লাফারু ভ্যাদা মাছের মতোন বেদম হাসে, বেদম মাথা নাড়ে, মাথাটা ধর থেকে খুলে আনার সাধ জাগে বোধহয়, তবু সম্মতি-অসম্মতি কিছুরই আকার পায়না তাতে। বেমক্কা উটে দাঁড়ায়, টাল খাওয়া শরীর নিয়ে উড়ালজাহাজের মতো উড়াল দেয় টং প্রাসাদে। চেংটুর একদলা শুকনা থুথু ফেলার ভান আসে মুখ থেকে। তারপর বিপরীত ঘূর্ণনে টিটকিরির মানুষ, তারপর দহের পানি, তারপর ঘাস কামড়ানো গরুর উপরে যেয়ে ঝিমধরা আকাশে চোখ আটকে রাখে। বাতাসের স্রোতের প্রতিকূলে থুথু ফেলায়, এবং তা শুকনো হওয়ায় ওষ্ঠের কার্ণিশ থেকে ঝোলে, এবং কটুকথার ধাক্কায় পেন্ডুলাম হয়।
এই শিরশিরে মাঘমাসী রাতে কারো কথার প্রবোধ তার আরোগ্যহীন ক্ষতে আরামের মলম প্রলেপ হয়না। সহসা ফাঁকতালে ঢুকেপড়া লজ্জা ও নিরাশায় চুপসে যাওয়া মুখ নির্বোধের মতো ঝুলে আসে। সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা মনে ফেরে। বিলচাপড়ি থেকে ডাকের মাছ ধরে ফেরার পথে নগদ টাকার সাথে ঠান্ডা জ্বরটা সঙ্গী করে। মনু ভাই ও কোম্পানির নাও তাকে পোটলাসমেত বাঙ্গালীর পূবে ধামাচামার কাছে নামিয়ে দিয়ে বাকি দল লেজে বেঁধে নিয়ে উজানে অন্য ডাকে ভেসে যায়। বাতাসের হু হু গায়ে বিঁধে, আসমান-জমিন উথাল পাথাল তপ্ততায়, শূন্যে ভাসা অনুভূতিতে যখন সে তার টঙ্গে ফেরে- দেখে ইহসংসারের একমাত্র আশ্রয়টিতে এক অচিন মানুষ গা ফেলেছে। দহের উপড়-জনআলয় থেকে খানিক দূরে, একাকী জীবনবাহিত করা সাহসী চেংটু তাতে ভরকায় না। ‘ক্যা বারে, এই চকিডাই হামার সম্বল বারে!’ ঘোরলাগা চোখে দেহটিকে দুইখান ঠ্যালা দিয়ে, এবং শুনতে পাক বা না পাক-জাগ্রত না মৃত- মদ্দা না মাগি, তোয়াক্কা না করে পাশে শোয়ার প্রায় সাথে সাথেই হয় ঘুমায়, নাহয় জ্ঞান হারায়।
দহের উপড় টানা বাতাসে কুয়াশার গা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভাসে। হালকা কাঁচাহলুদ রোদমাখা সকাল হালকা ঘোলাটে চিত্রকল্প বানিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গায় অথবা জ্ঞান ফেরায়। দেখে, দাঁড়ি-মোচের জঙ্গলওয়ালা এক কিম্ভূত চেহারা তার উপড় টঙ্গের চালের সাথে ঝুঁকে আছে। ‘এইডা গিল্যা খা, বা।’ খর্বাকৃতির এবং প্রায় বকরির নাদিসম চেহারার ও ঝাঁঝালো, অজ্ঞাত লোকের, অজ্ঞাত ভেষজ টোটকা গিলে-চোখের কপাট লাগিয়ে, বোধ ও নির্বোধের সীমানায় ঝুলে থাকে সে। নড়বড়ে বেড়ার ফাঁক ফুঁড়ে ধেয়ে আসা উম্মুক্ত বাতাসের গলায় কুঁই কুঁই কাৎরানি বেজে চলে। চোখবোজা চেংটুর মগজের খোঁড়লে জ্বরক্লান্তি হয়ে জোনাকি জ্বলে-নিভে। ‘এই এলাকাত আর আগের লাকান গাছ-ঘাস নাইরে বা, পাতারের লাকান বিরান হচে। একন ক্যাংকা লাগিচ্চে তোর, তোর মাও ক্যাংকা আচে?’ ধারাবাহিক প্রশ্নের ঝটকা নিয়ে, প্রত্যুত্তরে-ঝটজলদি ঘোরঘোলা চোখের জিজ্ঞাসায় দাড়ি-মোচের জংলা মানুষটাকে কষ্টে পরিচিত আদল দেয়া যায়। সম্পর্ক কোন নামে নামাঙ্কিত হবে এই ধন্দ আসে। সৎমায়ের প্রাক্তন স্বামীকে কি সম্বোধনে ফোটানো যায়?
ঔরষদাতার মৃত্যুর কাছাকাছি চেতনভ্রম ও স্মৃতিলোপাটে ইহসংসারের ভিটে ঘটি সৎমায়ের অসৎ আঁচলে গেড়ো পড়লে, চেংটু নিজেকে ভিক্ষুকের কাতারে নামিয়ে আনে। ধামাচামার ফাঁক গলে, মূল বাঙ্গালী থেকে বেড়িয়ে পূবে যমুনার দিকে বাইপাস মারা এই শাখাটির শুরুতেই পেটের মধ্যের হুক্কুদহের একপ্রান্তে তার ভাগের জমিনটুকু কিয়দাংশ ভয়ংকর ফাঁটল নিয়ে কাৎ হয়ে দিন রাত পার করে চলে। জমিনের অগ্রভাগ ঝপ করে নেমে যাওয়া দহের উদরে মজে গিয়ে তার গতরের কলেবর স্ফীত করেছে। ফলে দাবীকৃত ও কাংক্ষিল জমিনের সীমানা টানতে গেলে হাওয়ার গায়ে দাগ কেটে দেখাতে হয়।
গত ঢলের পর থেকে দহের বুকে একটা গ্রাম্য মিথ মন্থর গাম্ভীর্যে ডুবসাঁতার খেলে। বর্ষার টানা পানি পেড়িয়ে গেলে, শীত বা ফাটাগরমেও জনশ্রুতিতে তলাহীন আখ্যা পাওয়া এই দহে গামলার তলানীর মতো কালসিটে সবুজাভ জলে ভয় জমে ওঠে। সহসাই ঘাই মের ওঠে অজানা কোন জলজ, জলের স্থিরতা আধ-এক হাত বুদ্বুদ মাখিয়ে ফুলিয়ে তুললে- মানুষ তো গোবরতুচ্ছ, অবোধ ঘাসজীবী পশুরাও আটকানো খুঁটি উপরানোর তোড়জোড় করে-ভয়ে ভ্যাঁ ছাড়ে। ঠিক দুপুরে-যখন ছায়া খাঁড়া পায়ের তলায় গোল হয়ে থাকে-তখন নিয়ম করে পানির তলানী থেকে জলের ঘাই ওঠে। প্রতি বছর পলো উৎসবে ধামাচামার আবালবৃদ্ধ নেংটি খিঁচে বেশ ঘটা করে কপাল যাচাইয়ে শরীক হয়। কিন্তু ইদানিং এই তলঘাইয়ে ওঠা ঘোলাটে জলফোঁসানীর গহীনে আকৃতিটি বর্ণনার সামর্থ্য না পেলে লোকজনের ভ্রুভঙ্গি ও কপালের বলিতে প্রশ্নভয় জমে ওঠে। জ্বরনামা টিংটিঙ্গে চেংটু তলপেটের সুরসুরি খালাস দিতে জলের নিকটবর্তী খাঁড়া পাড়ের তলায় নামলে, তার চোখের হাত দশেক অদূরে জলঘাই খেয়ে বুদ্বুদের ঢেঁকুর তোলে। বুদ্বুদগুলো কেমন শ্যাওলাপঁচা রোগাগন্ধ ভেসে আনে। তখন তার ট্যাংকি খালি হয় হয় আর লুঙ্গি কোমরে গোটানো। জ্বরকষা শরীর কিংকর্তব্য আয়ত্বের আগেই ঘাইয়ের পুনরাবৃত্তি আসে। প্রকৃতির ডাক অসম্পন্ন রেখেই চেংটু ছুটে যায় টঙ্গে। তৈরা জালটা নিমিষে বাগিয়ে এনে পটুতার সাথে বুদ্বুদের উপড় ফুল তুলে ছড়িয়ে দেয় সময় ক্ষেপণ না করে। মাসখানিক আগে কালামিয়ার জাল দোমড়ানো-মোচড়ানো উঠে এলে এবং ভয়ে কালামিয়ার জ্বর-হাগা হলে আর কেউ সাহস করেনি, চেংটুও না। জ্বরঘোর কেঁটে ওঠা, ফাঁকা ফাঁপা মাথা আজ ভয় বুঝতে পায়না। খানিক সময় স্নায়ুর ভেতর দিয়ে শিরশির করে বয়ে যায়। চেংটু নিজেকে সাহসী করে তোলে, সে আসলে সাহস খেয়েই বাঁচে। নিজেকে তার দহের পাহারাদার মনে হয়। দহকে সে ভয় পায়না-জলকেও না। শুধু সমীহ করে, জলে খোয়াজ খিজির থাকে। তার চ্যালাপ্যালা থাকে। সে জাইল্যা-জাইল্যার ব্যাটা জাইল্যা। সাহস করে খোয়াজ খিজিরের চ্যালার চেহারা দেখতে চায়। চেংটু বিরিবির করে। জালটা সহসা ঝটকা খায়, দহের তল গোত্তা খেয়ে ওঠে। চেংটু রোদপোড়া লোহাপেটা হাতের তেজে জাল টেনে আনে। দহের পাড়ে দুই-চারজন চোখ ফুটবল বানিয়ে ভয় বিস্ময়ে দৃষ্টি চেংটু ও তার ছটফটানো জালে বিদ্ধ করে। জালটা মুচড়ে ওঠে, চেংটু সাহায্যের জন্য চিল্লায়, কেউ আগায় না। আধাঘন্টা লড়াই শেষে একটা লেজ দেখা যায়, লেজের শেষে একটা কালো সোনালী লম্বাটে মাথা। পানির উপড় উঠানোর পর দেখা মেলে একটা কোমড় উচ্চতার বোয়াল মাছের। লোকজন তাও কাছে আসে না। গোটা মাছটা পানি থেকে উঠে এলে খানিক বাদে নিরীহদর্শন মাছটাকে দেখে লোকজনের ভয় উবে যায়, ভয়পালানো চোখে তাদের লোভের চকচকে জল ভর করে। সহসা বেকুব লোভাতুর লোকগুলোর কথায় দহের মালিকানা দাবী স্পষ্ট হয়, যেহেতু-তাদের জমিনও দহ খেয়েছে, এবং যেহেতু-মাছ দহে পালিত হয়, সেহেতু-মাছের অংশ তারা দাবী করতেই পারে। আগবাড়ানো সিদ্ধান্ত আসে-মাথাটা জালওয়ালার, এবং জালওয়ালাই জাল মেরেছে বলে আরো বাড়তি অংশ। বাকীটা ভাগের মা। মেজাজ খিঁটখিটে চেংটু বখরার আলাপের প্রতিকথায় দীর্ঘ চেতানো না টানে। ‘ভাগ দেমো না বাল! দূর হ কুত্তারা, ছেই।’ ভাগারুরা দূর হয়, দুই একজন পাড়ায় ছোটে। এর পরের ধাপ চেংটু মনে কষে ফেলে। ফলাফল না মেলায় কানীবকের মতো মাথা গোঁজ করে বসে থাকে। রোদ পেয়ে মাছটা সেই থেকে তড়পায়।
‘ই...হ কি সখ, এতো লোব ক্যা তোর। বউ ছইল নাই কাক খিলাবু। এ জাউড়ার বাচ্চা ।’ পাড়া মাথায় নিয়ে লোকজন আসে। জাল প্যাঁচানো মাছটার সোনালি ঝকমক ঘিরে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে কাঁচা ভক্ষণ সারে, তেলতেলে ঝালচড়া সুরুয়া চাটে। কালামিয়া খাঁটাসকন্ঠে চ্যাঁচায়, ‘বোবা হচু নাকি বে?’ এমতাবস্থায় আবশ্যিকভাবে আবার লাফারুর আবতরণ ঘটে। আবালবৃদ্ধের উপস্থিত চোখ আবার কপালের ভাঁজের কাছে ত্রিনয়ন বানায়। উপস্থিতির ত্রিনয়ন অনুসরণে চেংটু ঘাড়ে মাথায় ঘুরে যায়। লাফারুর এই হুলিয়ায় উপস্থিতি ভড়কে শুকনা ঢোক গিলে কিঞ্চিৎ। চেনা-অচেনার দোলাচালে তারা গুজুরগুজুর করে। চেংটু খেয়াল করে লাফারুর হাতে স্বর্পাকৃতির-অচিন কোন বৃক্ষের ত্যাড়াব্যাকা ডাল, আগায় একটা তেল চকচকে মরাখুলি রোদে ঝকমক করে। ‘হক মওলা...’ লাফারু নাটকীয়তায় হেঁকে ওঠে। কালামিয়া লাফিয়ে হাত তিনেক পিছিয়ে বুকে একদলা থুথু দেয়। উপস্থিতিও লাফিয়ে হাত তিনেক পিছিয়ে বুকে একদলা করে থুথু দেয়। ‘হামাক চিনিস নি ভাই কালা?’ কালামিয়া চোখসরু দূরবীণ করে পুরোনো লাফারুকে ঝাকরা চুল-দাড়ির জঙ্গলা থেকে উদ্ধার করে জয়ী হবার আমোদ করে। কিন্তু গলায় তার উশখুশের কাঁটা খচখচ। তাদের জানা মহলে লাফারুর মৃত আত্মা উড়ে বেড়ায় আল্লার দরবারে। দু’একজন মঙ্গলকামী কোন ঘরোয়া আলাপে তার আত্মার বিদেহী ছায়াকে স্বর্গ সপে দেয়। লাফারুর চেংটুর পাশে ল্যাটা মেরে বসে। উপস্থিতি অনড় অবিশ্বাসে গুনে গুনে পরিমিত শ্বাস টানে ও ছাড়ে। লাঠিটার চোখা প্রান্ত বালিতে অনায়াস জোরে প্রোথিত করে ঘোষণা ছাড়ে-‘এই মাছ তোরা লিয়্যা যা।’ চেংটু চমকায়, উপস্থিতি বিস্ময়ের বড়ি খায়। হাত বাড়িয়ে চেংটুর তপ্তঘাড় ছুঁয়ে চমকানো প্রশমিত করে, পরে তা বরদানের ভঙ্গিতে তুলে ধরে গুঞ্জন থামায়। জ্ঞানদানের ভঙ্গিমায় বলে,-সত্য নামের এক দ্যাও ছিলো মহাভারতে, তার মা ও ছিলো মাছদ্যাও। মানুষের শরীর পেয়ে পরে তার রূপঠমকে পাগলা ঘোর দিয়ে এক রাজাকে বিয়ে করেছিলো। কিন্তু নিজে এক সোনামাছের লোভের টোপ গিলে তাকে বর্শাবিদ্ধ করেছিলো; কুভাগ্য বশত ওটাও ছিলো আরেক দ্যাও। মরার আগে অভিশাপ দিয়েছিলো। চেংটু কিন্তু যারপর নাই আচানক হয় লাফারুর জ্ঞানের বহর দেখে। ‘আরেকজন হামাগেরে শা সুলতান পীর, মাচের পিঠোত কইত্ত্যা লদী পার হইয়্যা মাস্তানগড় আচ্চিলো। তাই তার নাম মাইসাওয়ার। হামরা জাইল্যারা পানির পীর মানি, দ্যাও ও মানি। এই হুক্কুদও এলাকার সবাই মানে। তাই লয়, কি কইস কালা?’ কালা থতমত খায়, এদিক ওদিক তাকায় সাহায্যের আশায়। তার জিহবায় জড়তা মূঢ়তা, দুইটা শব্দ নিয়ে কেউ এগিয়ে আসলে সে নিঃশ্বাস ছাড়তে পারে। লাফারুর গভীর করে নিঃশ্বাসের সাথে মানুষের ভয় জড়তা টেনে নেয়। মনে মনে ছক টানে। এই গল্পে উপস্থিতির ধারনা জন্মেনা, গল্পটা আর কোন গল্পের ভূমিকা। মাথায় চিন্তার সুতা জট পাকিয়ে মরা গেরো বানিয়ে রাখে। চেংটু ও লাফারুর সম্পর্ক ও এই ঘটনার পাশে তাদের উপস্থিতি প্রশ্নের ঘোঁট পাকায় না। তারা মিথগল্পে ও তার হুলিয়ায় ভুলিয়া হয়ে যায়। ‘হুক্কুদহে খোয়াজ খিজিরের এক বড়মাপের চ্যালা আছে, কাল রাইতে হামাক নিন্দের ভেতর স্বপ্নাচে। কচে, তাক ঘাটালে এলাকা সাবাড় করবি। হু’ বোকা উপস্থিতিতে হুড়মুড় আলোড়ন ওঠে। লাফারুর দাড়ি বয়েসী এক হাফপ্যান্টুল পড়া চ্যাংড়া উল্টাঘুরে আরেক নিম্নবয়েসীর ঘাড়ে পড়ে। একটু বয়স বাড়তি জনেরা আলগোছে সরে যাবার অভিনয় করে। এই পরিক্রমায় কারো মনে পাত্তা পেলনা তাহলে চেংটুর কিছু হইলো না কেন? আর মাছই উঠলো কেন? উপস্থিতি কাতার ভেঙ্গে সরে যায়, বোয়াল মুখ হা করে মরে পড়ে থাকে। লাফারু ভ্যাদা মাছের মতোন বেদম হাসে, বেদম মাথা নাড়ে। চেংটুর ভাবনাটা প্রশ্ন তুলে মনের ভেতর দুলে দুলে ভো নাচে।
মিথভয়াল গল্পটা ছেড়ে দিয়ে লাফারুর উধাও হয়েছে সেই বিকেলের রোদে। চেংটুর লোকটাকে প্যাঁচাল করা বাওয়াল মনে হয়। তেড়িবেড়ি করা মাথাটা নিয়ে ভোঁ ভোঁ ঘোরে দিকহীন। দহের জলে আর কেউ শৌচকর্মেও আসে না, শুধু পাড় থেকে তলায় চেয়ে থাকে যদি কোন জলঘাইয়ের তলায় বেমক্কা কোন মাছদ্যাও দেখা যায়, অথবা যদি এক বিয়ান বেলা এসে দেখে চেংটুর টং তলায় হুড়মুড়িয়ে বেঁকে আছে, তাহলে আরেক গল্প হবে। চেংটু বাঙ্গালীতে যায়-আবার রাতে ফেরে, নিমগাছী যায়-আবার রাতে ফেরে, বিল কেশপাতার যায়-আবার সন্ধ্যায় ফেরে, দিনদিন যুগোপৎ তৃষ্ণা আর বিতৃষ্ণা গুলে বুক ভরে তোলে, আর ভাবে কতিপয় মানুষের ইচ্ছা পূরণ হোক- সে নিজেই দহের জলে বালিচাপা পড়ার আশংকা ও আকাঙ্ক্ষা করে। ‘লে বেড়ি ধরা’, -একরাতে কাঁটাদেওয়া ঠান্ডা যখন খোলা পাথার পাড় হয়ে দহে গোত্তা খেয়ে গুমগুম বাজে, বাজার ফেরত চেংটু দূরের ভিটায় তাকিয়ে সৎমায়ের কুপিবাতির লালচে আলোর ধরফরানির প্রতিফলন ঘটায় মনে, তখন শোনে দহের পানিতে অহরহ তলঘাইয়ের হুটোপুটি, আর ঠিক তখনই পরিপাটি আদলে লাফারুর হাজির হয়। মত্ত বাতাসে সাথে যুঝে জ্বলা হ্যারিকেনের আলোয় তার চোখের তারায় বিড়ির আগুনের লাল দেখা যায়। চেংটু হাত বাড়িয়ে বিড়িটা নেয়। নিরুদ্দেশ যাত্রা থেকে ফেরা লোকটা তাকে খানিক আরাম লাগায়। লোকটি মুখোমুখি বসে বিড়ির আগায় আগুন লাগিয়ে দেয়। নিচে জল তোলপাড় হয়, লাফারু চেংটুর মনযোগ আড়চোখে মেপে নিয়ে গল্প ছাড়ে-
‘একবার একটা বড় বইল মাছ পাছোনো ঊনছুড়কি বিলোত। তোর বাপ, হামি, মইষ্যাবানের আরো দুই জাইল্যা লিয়া। পোড়াদহ মেলাত তুলচিনো। তোর বাপ হামার সেই হক ট্যাকা শোধ করেনি’ গল্পের কোন ভূমিকা করে না তার বাবার প্রাক্তন বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রীর প্রাক্তন স্বামী, তার রগচটা ক্ষোভটা শান্ত ও নমনীয়ভাবে বেড়িয়ে আসে চোরাগোপ্তা দীর্ঘস্বাসের সাথে। বাইরে পাতারের হাওয়া খোলা আঁধারে জোছনা মিশতে থাকে। ‘সম্পর্ক ঢিলা মারা কিন্তুক বাবা সম্পর্ক নাই হওয়া লয়, আবার শত্রুর হওয়াও লয়। একটা গেঁড়ো পরলিই আবার টাইট হয়।’ যুৎসই শব্দের অভাবে চেংটু মাথার উপড়-নিচ দোলাতে সম্মতি ছাড়ে। পাড়ার মানুষের কাছে চাউড় হওয়া তার মৃত্যু সংবাদ তাকে পোড়ায়। যে বউ আটকে রাখতে পারেনা তার বাতেনি জ্ঞান-ধ্যান ভালোনা। শাহ আলী পীরের আস্তানায় তার দীর্ঘ বছর গুলো কোন ফাঁকতালে গেছে সে টের পায়নি। লাফারুর কথার পাশে চেংটু তার কথাগুলো সাজিয়ে তুলতে পারেনা। তাত্ত্বিক কথার ভাপে শুধু তার বন্ধনহীন মনটা উচাটন করে। লাফারু দীর্ঘশ্বাস আঁড়াল করে পানকষা দাঁতে হাসি মেখে তোলে। ‘হামি জানি ব্যাটা, মরার পরে তোর বাপের সাথে হামার হিসাব হবি; কাগজের পর কাগজ ফুরাবি।’ চোখে একটু আলাদা রকম চাহনি তুলে ধরে, চিবুকে ছড়ানো হাসি। ‘তুই তোর বাপের আরেক ভাগীদার, তার পরকাল সেই মিটাবি, কিন্তুক দুনিয়াত তার দেনা শোধ করবি কেডা! ক দেকি?’ এবার চেংটু থমকায়, গুটানো হাঁটু খুলে শরীরের বাঁধন শিথিল করে। মুখের আঠা আঠা ভাব কেটে যাবার উপক্রম হয়ে তবুও একটি শব্দ বানায় প্রশ্নের, ‘কেডা?’ জিহবার আগায় তৈয়ার রাখা উত্তরটা উগড়ে দেয় লাফারু, ‘তুই’। ভয় পাইসনা ব্যাটা, তোক ট্যাকা শোধ দিবার লাগবি না। পারলে হামি তোক আরো দেমো।’ চেংটুর চারপাশে তবুও অস্বস্তি বিছিয়ে থাকে। সহজ সাবলীল আচমকা সিদ্ধান্ত লাফারুর মুখ থেকে বের হয়ে আসে, ‘হামি তোর সৎমায়ের সাতে আবার ঘর করবার চাই ব্যাটা!’
‘করো গা।’চিন্তাহীন উত্তর করে চেংটু।
‘গেঁড়ো তো তুই।’
‘গেঁড়ো খুইল্যা দিবার পারি, হামার এই জাগাডা আর ভালো লাগে না। তোমার লাকান নিরুদ্দিশ হবার ইচ্চা হয়।’
‘হামি পথ দেখাবার পারি।’ চেংটু নির্লিপ্ত নজরে লাফারুর দিকে চেয়ে থাকে, ‘তুমি চাচমিয়া হামার জীবন বাঁচাচো, তুমি হামার বাপ।’ লাফারু চমকে ওঠে, চেংটুর চোখে নোনা গড়ায়। এগিয়ে গিয়ে চেংটুর মাথায় হাত বুলায়। ‘বাঙ্গালীর এইমুরা তোর জন্যি একটা লাও আচে। এই বাঙ্গালী থাইক্যা মইষ্যাবান লদী- তারপর পোড়াদও লদী-তারপর কইত্ত্যা লদী হইয়্যা মাস্তানগড়। পীরের মাজার তোক এক সময় জানাবি হামি ক্যা আবার ফির্যা আচ্চি, কার কাচে আচ্চি। তোর দুনিয়াবি জ্ঞান একনো হয়নি ব্যাটা।’
জড়োসড়ো হয়ে দুইজন টং ছেড়ে দহের দিকে নামে, চেংটু দূরের বাড়িটার দিকে তাকায়, টঙ্গের দিকে তাকায়। দহের পানিতে ঝটপট শব্দ বাতাস ছাপিয়ে ওঠে। পানির তলায় লুকানো খুঁটিতে টানা নাইলনের মাথায় হালকা অদ্ধকারে মাঘমাসী চাঁন্দের আলোয় বরশিবিদ্ধ এক বাঘাআইড় যুদ্ধ করে দেখা যায়। ধরাধরি জোর খাটিয়ে খুলে নাওয়ে এনে পাটাতনের সাথে বাঁধে। চেংটু বিস্মিত হয় না।
‘কাইল বাপ পোড়াদও ম্যালা, মাচটা বেঁচলে ম্যালা ট্যাকা পাবু। আর হামার বুজরুকি জাহিরের জন্যে মাচটা বিদায় করার দরকার আচে। দুনিয়াডা ছোট, তোর সাতে আবার দেকা হবার পারে।’
নাওটা তরতর করে উত্তরে ছোটে। বাঘাআইড় ঢেউয়ের তালে মাঝে মাঝে দুলুনি দেয়। মুখে বরশির ক্ষতের সাথে পুরনো একটা ক্ষত দগদগ করে। মনে হয় চাঁন্দের আলোতে খোয়াজ খিজিরের চ্যালা মৃত্যুর ক্ষণ গোনে। বাপের দেখা মৃত্যুর বিষন্নতা তার বুকে ভর করে, আর কোন মৃত্যুর ছবি দেখতে প্রস্তুত না। দড়ি খুলে বাঘাআইড় মুক্ত করে, নাওটা একপাশে কাৎচিৎ হয়, ঝপ করে বাঘাআইড় পানিতে তলায়, ‘বারে খিজির পীর, দেকিস বা’। নাওয়ের তাল সামলে উঠলে আবার লগি তুলে ধরে আসমানে দিকে, ‘আব্বা, তোমার দেনা শোধ করনো’। চোখটা চকচক করে, চুলকায়, চাঁন্দের খোলতাই হওয়া আলো বাঙ্গালীর ঢেউয়ে কেটে কেটে ভেঙ্গে যায়। বুকটা হালকা হয়ে আসা চেংটুর মনে হয় দুই হাতের পিছন থেকে তার ঐশ্বরিক ডানা গজাচ্ছে, সে উড়বার জন্য তৈরি থাকে।
নাওটা তরতর করে উত্তরে ছোটে।
0 Comments