সুইসাইড নোট~ লতিফ জোয়ার্দার এর গল্প

Suicide Note ~ Story by Latif Jowardar


শেষবার যখন তার প্রেমে পড়েছিলাম তখন আমার বয়স বিয়াল্লিশ বছর। আর যার প্রেমে পড়েছিলাম সে ততটা সুন্দরীও ছিলো না। শরীরের রঙের কথা নাই বললাম। একটু বয়স বাড়ার কারণে হয়তো শরীরটা মুটিয়ে গিয়েছিলো তার। তার টেবিলে রঙ ফর্সাকারী ক্রীমের নানা বর্ণিল উৎসব চলতো। তবে কেন কী কারণে তার প্রতি আমার এই ভালোলাগা। কেন কী কারণে তার প্রতি আমার এই ভালোবাসা! এই ভাবনাগুলো কখনও কোনোদিন ছিলো না আমার। তবে তার কবিতার মত চোখে যুবকপাড়ার যুবকেরা ঘুরে বেড়াতো। শান্ত শ্যামল গ্রামের মত তার চুলে অন্ধকার নেমে আসে। আমি হয়তো তার জলপুকুরে ভেসে বেড়াতে চেয়েছি। এতকিছু, এতসব কারুকার্যময় জীবনের ওলিগিলি ভিতর। আমি হেঁটে যাই। একজন বর্ণার প্রেমে পড়ি। অতঃপর আমি এক প্রকার ভেবেই নিয়েছিলাম, এ সবই আমার পাগলামী। তাই তার কাছে থেকেও দূরে থেকেছি বারবার। হয়তো সে বিষয়টা বুঝেছিল। তাই তার সকল ব্যাকুলতা সকল অনুভবে ছিলাম আমি। কিন্তু আমার এই ভালোলাগা কখনও তার কাছে প্রকাশ করেনি আমি। আমি আমার মনের বিরুদ্ধে তাকে দূরে রাখতে চেয়েছি বারবার। কিন্তু আমাদের অভিমানগুলোর স্থায়িত্ব খুব কম সময়ের ছিলো। সে দ্রুত আমায় মেনেজ করে ফেলতো আবারও। হয়তো আমার জন্যেও তার বুকের ভিতরে রক্তক্ষরণ ছিলো। হয়তো আমার জন্য তার বুকে মায়াবী কোনো একরাত লুকিয়ে কেঁদেছিলো একদিন।

এখন আমার বয়স পঞ্চাশ। আর বর্ণার বয়স বিয়াল্লিশ। বর্ণা তার প্রকৃত নাম নয়। গল্পের প্রয়োজনে এই নামটিই মনে করুন তার আসল নাম। অথবা পাঠক ইচ্ছে করলে অন্য যে কোনো নামেও তাকে ডাকতে পারেন। যে কোনো নামে তাকে পাঠ করতে পারেন। আমাদের ছোট্ট এই জীবনের জন্য আট বছর দীর্ঘ সময়। এই আট বছরে অসংখ্যবার তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। ফোনে কথা হয়েছে। একসাথে আমরা দীর্ঘ পথের ক্লান্তি ঠোঁটে মেখে ফুলের পরাগ ভেবে ভুল করেছি। কখনও অভিমানে দূরে থেকেছি। আবার কখনও সেই অভিমানগুলো দু'পায়ে মাড়িয়ে কাছে এসেছি আমরা। একটা মায়ার পথ তৈরি করে সেই পথে বারবার হেঁটেছি আমরা। জাগতিক সব কোলাহলে নিজেদের ছোট ছোট দুঃখ কষ্টগলো নিজেদের করে তুলেছি আবার। সেই বর্ণাকে কোনো ভাবেই কোনো কারণে দূরে রাখতে পারিনি কখনও আমি। আমার গল্প, কবিতা, উপন্যাসের চরিত্র হয়ে আমার কাছে সব সময় থেকেছে বর্ণা। বারবার আমার হাতে হাত রেখে আমার হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছে বর্ণা।

পাঠক হয়তো আমাদের এই প্রেমকে পরকীয়া বলবেন। কারণ সংসার সীমান্তে আমি এক দীর্ঘযাত্রী। আমার ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে। আমার বয়স বাড়ছে। কারো কারো কাছে আমাদের এই প্রেম অসামাজিক কর্মকাণ্ডের বাইরে কিছু নয়। বছর দুই হলো বর্ণারও বিয়ে হয়ে গেছে। এক প্রকার সংসারী হয়ে উঠেছে বর্ণা। তারপরও মধ্যরাতে স্বামীকে ঘুমিয়ে রেখে ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেতে ওঠে বর্ণা। কখনও বাথরুমে ফিসফিস করে না পাওয়ার বহু বর্ণিল ব্যর্থতার গান বেঁজে ওঠে তার কণ্ঠে । আমি আমার বর্তমান ভুলে যাই। বর্ণা ভুলে যায় সামাজিক জগৎ সংসারের দায়। সে বিশ্বময় তার বুকের সব অন্ধকার ছড়িয়ে দিতে চায়। আর আমি আমার কবিতার খাতায় একটা দীর্ঘ কবিতার ব্যঞ্জনায় আমার মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেই। আমার সামনে আমাদের বয়স কোনো প্রতিবন্ধতা হয়ে দাঁড়ায় না। আমরা মধুর মুগ্ধ আলিঙ্গনের আশায় বিশ্বসংসার তছনছ করি প্রতিদিন। 

একটা বেসরকারি সংস্থার চাকরি করে বর্ণা। সপ্তাহের ছয়দিন অফিস তার। আর আমার অফুরন্ত অবসর। বিশ্ব বাউণ্ডুলে বললে কম বলা হবে আমাকে। বাবার রেখে যাওয়া জায়গা জমিগুলোর তদারকি করে আমার বউ। রাতদিন সংসার, ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার একটা নিজস্ব জগৎ আছে । মাঝে মাঝে মনে হয়, তার সে জগতে আমার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। আমি আমার কবিতার সংসারে থেকে পরকীয়া করি। মাঝে মধ্যে পাঁচ পেগ মদের বুদবুদের মধ্যে নিজেকে হারাই। আমার নিমগ্ন দুঃখ কষ্টের দিনে হাত ধরাধরি করে যে আমার কাছে এসেছিল। তাকে আমি প্রতিদিন ঠকাই! প্রতিদিন তাকে বঞ্চিত করি। আর এই জন্যে তার কোনো দুঃখবোধ দেখিনা কখনও আমি। কখনও আমার মনে হয়, মেয়েদের জীবন কী এমনি হয়? সব মধু ঢেলে দিয়ে সংসারে একদিন কীট হয়ে মরে যায়। অবশেষে আমার সেই মানুষটাও একদিন জেনে যায় বর্ণার কথা।

সেদিন থেকে প্রতিদিন অশান্তি নামক এক কীটের সাথে দেখা হয় আমার। আমাদের এতদিনের মধুর সম্পর্কের মাঝে আরশোলা হেঁটে বেড়ায়। নষ্ট হয়ে যায় সকল স্বাভাবিক দিনাচার। আমার স্ত্রীও আর আগের মত সংসারে মনোযোগী হতে পারে না। আমাদের আলোচনার একটাই বিষয়বস্তু হয়ে যায় বর্ণা। এমন হলো যে, তাকে আমি কাছেও টানতে পারিনা। আবার আমি দূরেও সড়াতে পারি না। এখন আমাদের অগোছালো সংসার। এলোমেলো সবকিছু। গরু ছাগল হাঁস মুরগীগুলো অযত্নে অবহেলায় মরতে বসেছে ইদানীং। কিন্তু সেদিকে তার অথবা আমার কোনো খেয়াল নেই। জমিগুলো লিজ দেওয়া হয়েছে মাত্র। কিন্তু সেই টাকায় আমার কোনো অধিকার নেই। আর সে কারণেই সুঁতোয় আমার টান পড়েছিল। তাই তখন আমি ঘর সংসার থেকে দূরে দূরে থাকি। যখন ঘরে ফিরি, তখন তার সাথে আমার দূরত্বের দেওয়াল দেখতে পাই। বর্ণাকেও আর আগের মত কাছে টানতে পারিনা। পরকীয়া প্রেমগুলো মনে হয় এমনই হয়। কোনো নোটিশ ছাড়াই দূরে সরে যাওয়া। কেউ কেউ কখনও কোনোদিন কারণটাও জানতে পারে না। কী কারণে দুজন হয়ে যায় দুই ভবনের বাসিন্দা, কেউ জানে না! কেউ বুঝে না। 

একসাথে থাকলেও মাঝে মাঝে আমাদের বিছানা আলাদা হয়ে যায়। মধ্যরাতে পাশের রুমে গিয়ে ঘুমাতো সে। অতঃপর আমার চোখে আর ঘুম আসতো না। জীবনের মানে ভুলে যেতাম আমি। কখনও মনে হতো জগৎ সংসারের বাইরে কোথাও চলে যাই আমি। জানি আমাকে কোনোদিন খুঁজবেনা কেউ। সবাই ভালো থাকুক সংসারে। ভালো থাকুক জ্যোৎস্না রাত। ভালো থাকুক আকাশের তারা। বারান্দার টপগুলো ভালো থাকুক। গ্রীল বেয়ে জড়িয়ে থাকা মাধবীলতার গাছটাও ভালো থাকুক। আর ভালো থাকুক ঘরের আরশোলা, টিকটিকি। এভাবেই জীবনের সকল যাতনার সাথে মিশে থাকি আমি। বর্ণারা হারিয়ে যাক জীবন থেকে। না হয় এ সংসারে আমি খুব কম দামী।   

যে মানুষটার আমার বিরুদ্ধে কোনোদিন কোনো অভিযোগ ছিলো না। বাদবাকি জীবনে থাকারও কথা ছিলো না। অথচ গল্পের বাদবাকি অংশে এসে পাঠক আমাকে ফাঁসির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন জানি। সেখানে বর্ণা মলিন হয়ে যাবে। আমার বউ হয়ে উঠবে চিরচেনা নির্যাতিত বাংলার নারীচিত্র। তার জন্য কেউ কেউ চোখের জলে ভাসবেন। বর্ণাকেও ক্ষমা করে দিবেন আশা করি। আর আমার মুখে থুতু ছিটাবেন। আপনারা সবাই জেগে উঠবেন আবার। ফেসবুকে ভাইরাল করবেন আমাকে। আমার এত এত প্রেমের কবিতার জন্য। আমার অসাধারণ বেশকিছু গল্পের জন্য আমাকে যেমন ক্ষমা করবেন না আপনারা কেউ। আর দেশের প্রচলিত আইনে যতদিন আমার ফাঁসি কার্যকর না হচ্ছে! ততদিন আপনারা থামবেন না। কারণ আমার বউ। যার জন্য আপনারা সঠিক কাজটিই করেছেন। কিন্তু আমার ভুল শুধরানোর সময় কেউ দেয়নি আমাকে। হয়তো বর্ণাকেও সাথে পাবেন আপনারা। কারণ এক মধ্যরাতে আমার পাশের রুমে ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করলো আমার বউ। এখন আপনারাই বলুন, আমার মৃত্যুদণ্ডটা কীভাবে প্রত্যাশা করেন আপনারা? 


লতিফ জোয়ার্দার এর আরো লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

Post a Comment

0 Comments