লতিফ জোয়ার্দার এর গল্প

 



ফোন নম্বরটি অপরিচিত । অথচ আজ একটানা আমার ফোনটি বেজেই চলেছে। এমন তো অনেক দিন হয়েছে, ফোন ব্যাক করতেই। অপর প্রান্ত থেকে বলছে, কামাল ভাই আজ বয়লার মুরগির দাম কত। অথবা রফিক কোথায় আছো, একবার আমার বাড়ির সামনে রিক্সাটা নিয়ে এসো তো । তোমার চাচীকে নিয়ে একবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। নইলে কেউ আবার বলছে, আবুলের বাপ, বাড়ি ফেরার সময় একটা কমলা সুতা নিয়ে এসো কিন্তু। খুবই জরুরি, নইলে কিন্তু নতুন জামাটা আজ আর  তৈরি করতে পারবো না। এসব কারণে আর অপরিচিত কোনো নম্বর থেকে ফোন এলে আর ধরা হয় না। কিন্তু হঠাৎ আজ মনে হলো ফোনটা ধরা উচিৎ ছিলো আমার । সপ্তমবারের মত ফোন হাতে নিতেই ফোনটা কেটে গেল। টেলিটক নম্বর। সাধারণত এমন নম্বর থেকে আমার খুব কম ফোন আসে। হয়তো সরকারি সংস্থা বলে সেবার মান তেমন নয় বলেই, টেলিটক সীম আমরা খুবই কম ব্যবহার করি।

অতঃপর দীর্ঘ সময় পর আরো একবার ফোন এলো। তবে সেই নম্বর থেকে নয়। হ্যালো বলতেই, অপর  প্রাপ্ত থেকে তেতিয়ে উঠলো, বলি আর কয়দিন ছোট বউয়ের কাছে থাকবে তুমি ? আমার তো চামড়া ঝুলে পড়েছে মনে হয়। নইলে আমি মনে হয়, আর আগের মত সুখও দিতে পারি না তোমায়। এবার বাড়ি আসো বলছি, কত সুখ লাগে আমি দেখপোনে। আমি কিছু বলার আগেই অপর প্রান্ত থেকে ফোনটা কেটে গেল। ইচ্ছে হলো ফোন ব্যাক করে দু'চার কথা শুনিয়ে দেই। এসব কাণ্ড জ্ঞানহীন মহিলাদের হুশ থাকে না কোথায় ফোন করেছে সে। কার কাছে ফোন করেছে সে! কিন্তু আমার এসব হয় না। তারচেয়ে কিছু সময়ের জন্য ফোনটা বন্ধ করে রাখি। পাওনাদারের ভয়ে যেমন মানুষ ফোন বন্ধ রাখে । তেমনি করে আমিও ফোন বন্ধ রাখবো আজ। নইলে এসব মানুষদের সাথে আর কিছুতেই পারা যাবে না। যতসব আউল ফাউল লোকের ফোন আসতেই থাকবে। আসতেই থাকবে।

কিন্তু খুব বেশি সময় ফোন বন্ধ করে থাকতে পারি না। বউ এসে কানের কাছে প্যানোর প্যানোর শুরু করে দেয়। কি ব্যাপার ইদানীং দেখছি বাড়িতে এসেই ফোন বন্ধ করে রাখো তুমি? কয়দিন গেলে ছেলে-মেয়ে দুটির বিয়ে দিতে হবে। আর উনার এখানে সেখানে ঘাসুর ঘুসুর গেলো না। আরে এভাবে কথা বলে টাকা নষ্ট না করে মানুষটাকে একবারে ঘরে এনে তুললেই তো আমি এক প্রকার রেহাই পাই। সংসারে খাটতে খাটতেই আমার সোনার দেহ মাটি হয়ে গেল। আজ এক মাসের মধ্যে আমার মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখেছো! মুখটা আমার কি ছিরির হইছে? মানুষটা আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে! একদমে বলেই চলে। এসব কথার উত্তর দিলেই সে মনে করবে! আমি সব মিথ্যে করে বলছি। রাতদিন আমি শুধু মেয়ে-মানুষের সাথেই কথা বলি এখনও। বারবার আজ থেকে সেই পনের বছর আগের কথা তুলে আমাকে নাজেহাল করবে। আরে আমি তো তখন সবেমাত্র নতুন ফোন কিনেছি । নুতন ফোন কেনার পর কার না কথা বলতে ইচ্ছে। আর আমিও তখন এর ওর সাথে এখানে সেখান দিনে দুই চারবার কথা বলে ঘামে ভেজা উপার্জনের টাকা পানিতে ফেলি। আর সেই ভাবেই নাজনীনের সাথে আমার কথা বলা শুরু। আমার লেখা প্রথম বই পড়ে ভালো লেগেছিলো বলেই তো সে আমায় ফোন করতো নাজনীন। আরো কতজনও ফোন দিতো তখন। কত রকম ভাবে কত কথা বলতো। তাদের নিয়ে তো কোনো কথা বলোনি তুমি? আর নাজনীন তো অন্যকিছু বলতো না। প্রেম ভাব ভালোবাসার কথা বলতো না।  নিজের গল্প, নিজের সংসারের গল্প বলতো প্রতিদিন। তার একমাত্র সন্তানের গল্প করতো। একদিন এভাবেই কথা বলতে বলতে আমাদের অভ্যাসে পরিণত হলো। একদিন কথা না বললে তার যেমন ভালো লাগতো না। আমার ঠিক তেমনি হলো। কেমন যেন লাগতো। মনে হতো আমার শরীরে কোথায় যেন কী হয়েছে। কথা বলতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করছি কতদিন আমরা ।

মনে পড়ে একদিন আমরা ভালোবেসে শঙ্খচিল হয়ে আকাশে উড়েছিলাম। মনে হতো,আমাদের বাড়ি থেকে চল্লিশ কিলো পথ পেরিয়ে প্রতিদিন দেখা করি তার সাথে। নির্মোহ আর্কষণে বিলিন হতে চেয়েছিলাম বলেই ছোট ছোট বাক্য দিয়ে কাব্য রচনার সাধ জেগেছিল আমাদের মনে। একজন লাইলী,একজন রাধা, একজন শিরি অথবা একজন পার্বতীর মত নাজনীনও ভালোবেসে বিশ্বসংসারে নতুন ইতিহাস গড়তে চেয়েছিলো। আমিও পরকীয়া প্রেমের ক্ষুধায় অনাবিল বেঁচে থাকার চেয়ে তার জন্য মরে গিয়ে ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছিলাম। এভাবেই আমাদের দিন শেষে রাত্রির মুগ্ধতায় বুকের গভীরে জেগে উঠতো কাছে পাবার প্রবল ইচ্ছেগুলো। সেই নাজনীনের ক্ষত এবুকে এখনও আছে। এখনও তার কথা মনে হলে বুকের আগুনে পুড়ে যায় বিশ্বসংসার। এখন অনাবিল বেঁচে থাকার কষ্টের ভিতর একচল্লিশটি লাল গোলাপের স্বপ্ন দেখি আমি। দেখি আমরা হাত ধরাধরি করে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছি। এক গ্রহ থেকে ছুটে যাচ্ছি আরেক গ্রহে। এসবই হয়তো আমার অলিক কল্পনার ফসিল।

আমাদের এ প্রেম বড়  প্রেম কিনা জানিনা। আর প্রেমের কোনো অংকও জানা ছিলো না আমার। কারণে অকারণে আমি যে তার জন্য মৃত্যুর কফিন হতে পারি। তা নাজনীন বেশ বুঝতো। আর বুঝতো বলেই আমার সব আবেগ আমার সব উচ্ছ্বাসগুলো সে শরাব মনে করে গিলে খেতো। তবে নাজনীনের জন্য ভালোই হয়েছে। একবার মরার চেয়ে সংসারে বারবার মরছে সে। বুকের আগুনে দগ্ধ হয়েছে প্রতিদিন। স্বামীর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে প্রতিদিন। আমাকেও সন্দেহের আগুনে পনের বছর ধরে পুড়তে হচ্ছে এখনও। কারণ বেশি পাগলামি কারো জন্যই ভালো হয়না কখনও। আমিও যেমন জানতাম। নাজনীনও জানতো। কোন আগুনে পুড়ছি আমরা। কিন্তু ভালোবাসলে বুঝি এমনি হয়। লাজ লজ্জা হারিয়ে মানুষ বাউলের একতারা হয়ে যায়। যেখানে সেখানে বেঁজে ওঠে। আমার মনে হয় প্রেম এমনই, কাউকে না কাউকে না বলে থাকা যায় না। আমরাও তেমনি বন্ধু ভেবে মাঝে একজনকে বলে ভুল করেছিলাম। তাই একদিন নাজনীনকেও ধরা খেতে হয়েছিলো স্বামীর কাছে, সংসারে কাছে। এই এক জীবনে তার জন্য লোকাল থানায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ লিখেছিলো নাজনীনের পরিবার। কারণ তার স্বামী হাবিব জানতো, এখন এছাড়া তার সামনে আর কোনো রাস্তাই খোলা নেই।

 শেষমেষ নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আজ আমাকে ঘর থেকে বেরুতে হলো। এখন এ অবস্থায় বাড়ি থাকলে আমার তার কথা শুনতে শুনতে দিন যাবে। একটা হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে ঘর থেকে বের হই আমি। লোকে  যেন আমাকে বুড়ো হিমু বলে ডাকে। ঘর থেকে রেবুনোর পর, যেতে যেতে আমরা মনে হয় সেই নাজনীনের কথা। যার জন্য, তার ও আমার পাগলামির কথাগলো এখনো ইথারে ভেসে বেড়ায়। মনে পড়ে, এই আমি এক সময় জীবিত নাজনীনকে আমার উপন্যাসে মেরে ফেলেছিলাম। আমিও বেঁচে থাকতে সুইসাইড করেছিলাম তখন। এসবকে আর পাগলামি ছাড়া কী বলা যেতে পারে। নাজনীনের সেই কথার মতো, জানো দ্বীপ আমার এখন আর এজীবন অর্থহীন মনে হয় না। শুধুমাত্র তোমার জন্য। জানো তুমি, মানুষটা সারাদিনে একটুও সময় দিতো না আমায়। সেই সকাল বেলায় তার মুদিদোকানের পথে বের হয়ে যেত। আর ফিরতো রাত্রিবেলায় যখন দশটা বাজে। এসেই তাড়াহুড়ো। গোসল খাওয়া দাওয়া করেই বিছানায়। মনে হতো আমার কোনো দাম নেই তার কাছে। আমার ইচ্ছের কোনো দাম নেই তার কাছে । কতভাবে সেজেগুজে তার জন্য বসে থেকেছি কতদিন আমি। অথচ মনে হতো তার কোনো শখ আহ্লাদ কিছুই নেই। আবার কখনও এমন হতো, বলা নেই কওয়া নেই আমাকে নগ্ন করেই, পশুর মত জৈবিকতায় মতে উঠতো। অথচ আমি ব্যথায় কুঁকড়ে যাই। ভালোবেসে ফতুর হতে গিয়ে অসহ্য যন্ত্রণার সঙ্গী হই। অথচ তার কী সুখ! মনে হতো ভারতবর্ষ জয় করেছে সে। অতঃপর সে আমায় বলতো, তুমি সুখ পাওনি নাজনীন ! এ কথার কী উত্তর দিবো তাকে আমি!

আমি আজ আবার কিছু সময়ের জন্য বাড়ি থেকে, বন্ধু আড্ডা থেকে দূরে যেতে থাকি। যেতে যেতে সকালবেলার সেই অচেনাফোন নম্বরের কথা মনে হয় আমার। অজানেÍই কল ব্যাক করি । ফোনের অপর প্রান্তে ভরাট এক অচেনা পুরুষ কণ্ঠ। মনে হয়না এর আগে তার সাথে আমার কোনোদিন কোনো কথা হয়েছিল। হঠাৎ আমার কানে বাজতে থাকে, আমি হাবিবুর রহমান হাবিব। নিবাস;বাঘা, রাজশাহী। এক কথায় আপনার চিরচেনা নাজনীনের স্বামী হাবিব। একদিন আপনি আপনার উপন্যাস - যে মন ছোঁয়া যায় না-"র চরিত্রের  প্রয়োজনে রোড এক্সিডেন্টে মেরে ফেলেছিলেন যে নাজনীনকে। মনে পড়ে? সেই নাজনীন! আজ ভোরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিডনি জনিত রোগে মারা গ্যাছে । আর কোনো কিছুই শুনতে পাইনি আমি। অতঃপর কিছু কান্নার শব্দ ফিরে আসে আমার কাছে। মনে হয় খুব নিকট থেকে কেউ যেন কাঁদছে ।



লতিফ জোয়ার্দার

কবি, কথাসাহিত্যিক  ও ছোটকাগজ সম্পাদক

Post a Comment

0 Comments