ফরিদুল ইসলাম নির্জন এর গল্প

 

ফরিদুল ইসলাম নির্জন এর গল্প


‘জানিনা আকাশের রং এখন কেমন। সবুজ, নীল, শাদা, নাকি কালো। কতদিন আগে আকাশ দেখেছি সঠিক মনে করতে পারছি না। আজ আকাশ দেখতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে, খুউব ইচ্ছে হচ্ছে । আকাশের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলতে ইচ্ছে করছে, আকাশ তুমি কত দূর! তোমার কাছে আমি কিভাবে আসবো। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। আচ্ছা, এখন কি আকাশ সব সময় রোদ দেয়, নাকি বৃষ্টি ঝড়ায়। এখন শীতকাল। শীতের সকাল কত আনন্দের ! কত মধুর! কত মিষ্টি! ভোরের শিউলি ফুল কুড়াতে, সরিষার ফুল থেকে মৌমাছি ধরতে, আমের মকুলের সুভাস নিতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।


ভাবতেই অবাক লাগে কোথায় ছিলাম, কোথায় এসেছি, জানিনা এখন কোথায় যাব। এই চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি। আর পারছি না।

জানিনা জেলখানা কেমন। তবে এটা জানি সেখানে আমার মত এত কষ্ট সইতে হয় না। সেখানেতো রুম থেকে বের হবার জন্য একটা সময় আছে। ঘোরাঘুরির জন্য একটা এরিয়া আছে। কথা বলার জন্য মানুষ আছে। কিন্তু এখানে কেউ নেই। শুধু আমি আর আমি। আর যারা রয়েছে তারা সবাই অমানুষ। তাদের যারা মানুষ মনে করে তারা নিজেরাই অমানুষ। মাঝে মাঝে নিজেকে বিলিন করে দিতে ইচ্ছে করে; নিঃশ্বেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে হয়না এই নশ্বরে বেঁচে থাকতে। বেশ কয়েকবার নিজেকে শেষ করে দেবার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু পরিকল্পনা সফল হয়নি। বাস্তবায়ন করতে দেয়নি মানুষ নামক অমানুষগুলো। আজ যারা আমাকে এই নরকে বন্দী রেখেছে; যারা আজ আমাকে বেশ্যা, খানকি, পতিতা করে তুলেছে ঈশ্বর যেন তাদের কখনো ক্ষমা না করেন।

ছোটবেলায় জন্মের প্রারম্ভেই মার ইতি ঘটে। কষ্ট যেন সেখান থেকেই শুরু। বাবা পুনরায় বিয়ে করেন। আমি ধীরে ধীরে বড় হতে লাগি। আর সৎ মার কাছে ধীরে ধীরে শত্রু হতে থাকি। আমার সৎমা সহজ সকল কথাকে জটিল করে দেখতে শুরু করে। সহজ কোন বিষয়কে কঠিন ভাবে উপস্থাপন করত। আমাকে মারত, চড়াত, গালিগালাজসহ আরো অনেক কিছু করত। অবাক করার মত কান্ড সৎমা যাই বলত বাবা চোখ বুঝে তাই বিশ্বাস করত।

একটা সময় কষ্ট যেন আর সহ্য হচ্ছিল না। নানাবাড়ী লোকেরা আমার এই অসহনীয় জ্বালাতন থেকে মুক্তি দিতে তাদের বাড়ী নিয়ে আসে। নানাবাড়ী আসার পর নিজের একটু স্বাধীনতা ফিরে পাই।  বেশ ভালই সময় যাচ্ছিল। স্কুলে যেতাম, বাড়ী ফিরতাম, পাড়ার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম,বউছি গোল্লাছুট তিন লাফ আরো কত খেলা খেলতাম। অবাধে নদীতে সাঁতার কাটাতাম, বিলে মাছ ধরতে যেতাম, শাপলা কুড়াতাম, আরো অনেক কিছুই করতাম। যখন দশম শ্রেণীতে পড়ি। তখন যেন পাগলামিটা একটু বেড়ে যায়। দুষ্টামীতে পাকাপোক্ত হয়ে উঠি।

মামার বাড়ী পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা পারতাম, বড়ই গাছে উঠে বড়ই পারতাম, আম গাছে উঠে আম পারতাম। কাঁঠাল গাছে উঠে কাঠাল পারতেও বাদ দিতাম না। আমি হয়ে উঠি অস্বাভাবিক চষ্ণল একটি মেয়ে। গরু হাম্বা হাম্বা বললে আমিও হাম্বা হাম্বা বলে মুখ ভেংচাতাম, কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে আমি কুকুরের কাছে ছুটে যেতাম। আমিও ঘেউ ঘেউ করতাম। কোকিল টু টু করলে আমিও প্রতিধ্বনি করতাম টু টু, বিড়াল মিউ মিউ করলে আমিও মিউ মিউ করতাম। এই মুখ ভেংচাতে আমি যে কত শান্তি পেতাম, কত আনন্দ পেতাম, কত মজা পেতাম তা বোঝাতে পাচ্ছি না। নানা নানি, মামা মামি আমার এই ভেংচানো নিয়ে কত কথা বলত। আমি তাদের কোন কথাকে তোয়ক্কা করতাম না। আমি চলতাম আমার মত। আমি নিজেকে বুঝতেই দিতাম না আমার মা না ফেরার পথে, আমার বাবা থেকেও নেই।

এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ করলাম। ভালই পরীক্ষা হলো। তখন পর্যন্ত ভালবাসা, প্রেম আমার জীবনে আসেনি। এগুলোর মর্ম বুঝতে শিখিনি। বোঝার কখনো চেষ্টাও করিনি। আমি দুষ্টামী ছিলাম কিন্ত চরিত্রহীন ছিলাম না। এক বিকেলে নানা বাড়ী পুকুর পারে বসে আছি। খোলা আকাশ, খোলা হাওয়া শরীরে লাগছিল। ভালই লাগছিল। পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে নীড়ে ছুটছিল। মাঝে মাঝে বক পাখি মালা গেথে যাচ্ছে। খুব ভালোভাবে বিষয়গুলো ভাবছিলাম। আমি একটু প্রকৃতির প্রতি বেশী দরদী ছিলাম। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে আমার খুব ভাল লাগত। পুকুর পাড় দিয়ে একটা ছোট রাস্তা চলে গেছে। দেখলাম সেই রাস্তা দিয়ে রিয়াজ ভাই যাচ্ছে। সে আমাদের পাড়ারই ছেলে। ইন্টার মিডিয়েট পাশ করে এখন ঢাকায় চাকুরী করে। এর আগেও সে আমার সাথে এগিয়ে  এসে এসে কথা বলত। আমার কোন পড়ার সমস্যা হলে তার কাছে যেতাম। সে আমার কাছে আসল। তার চেহেরা আগের থেকে অনেকটাই সুন্দর হয়েছে। আমার সাথে কথা বলল, অরুণা কেমন আছো ?

জ্বি ভাল। আপনি কেমন আছেন?  কবে আসছেন?

ভাল আছি। এইতো গতকাল এসেছি। তুমিতো অনেক সুন্দরী হয়ে গেছো।

তার এই কথায় আমি বেশ লজ্জা পেলাম। দৌঁড়ে বাড়ী ফিরলাম। মামীর রুমে ঢুকে আয়নার সামনে এবার বারবার মুখ দেখতে লাগলাম। আসলে কি আমি আগে থেকে সুন্দরী হয়ে গেছি। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করলাম। হ্যাঁ সেদিন মনে হচ্ছিল আসলেই আমি অনেক সুন্দরী হয়ে গেছি। তার এই কথা আমার বেশ ভালো লাগে।

পরদিন তাকে দেখতে মন বেশ উতলা। অস্থিরতা থেকে অস্থির। বুকের মধ্যে আনছান আনছান করতে লাগে। ভিতরে একটু টুইটুই। আরো প্রশংসা শুনতে ইচ্ছে করে।

বিকেলে পুকুর পারে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা। তার জন্য বসে থাকা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আগমন। কিন্তু আসল না। মেজাজ কেমন কেমন হতে লাগল। মনের ভিতর কেমন কেমন হতে লাগল। বুঝতে বাকি রইল না যে আমি তার এক কথায় তাকে পছন্দ করে ফেলি। পরদিন আবার বিকেলে যাই। সে আসে। তার সাথে কথা হয়। আপনি ঢাকা যাবেন কবে?

ঢাকা আর একা যেতে মন চায় না! কারো জন্য মন কাঁদে কিন্তু সে কি বোঝে না?

কে সে?

অরুণা, তোমাকে আমি অনেক আগে থেকেই ভালবাসি। যদি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেও খোদার কসম আমার মৃত্যু যেন হয়। তার এই কথায় আমি ভিজে যাই। তুলা যেমনি পানিতে ঠিক তেমনিভাবে। আমিও তাকে ভালবাসি তাকে বলে দেই। আমি তার প্রতি একটু আশ্রয় খুঁজতে লাগতাম। আমি জানতাম আমার নানাবাড়ী তার পরিবারও মেনে নিবে না। কারণ আমি ছিলাম হিন্দু ঘরের মেয়ে আর সে ছিল মুসলিম। তার প্রতি দিন দিন ক্রমশ দুর্বলতা বেড়ে যায়। সেও ঢাকা যেতে চায় না। আমি তাকে অনুরোধ করে ঢাকা পাঠায়। পাড়ার তাছলিমার ফোনে তার সাথে কথা বলতাম। একটা সময় নানা বাড়ী , পাড়ার কাউকে ভাল লাগে না। ভাললাগে শুধু তাকে। তার সাথে কথা বলতেও অসাধারণ ভাল লাগে। অবাক করার মত কান্ড তাকে ছাড়া আমার অন্য কোন ভাবনা যেন দুঃখজনক, কষ্টদায়ক,পীড়াদায়ক। সে ছিল আমার নিঃশ্বাস , আমার বিশ্বাস,  আমার স্বপ্নের একমাত্র রাজপুত্র। সে আমায় ছেড়ে চলে গেলে আমার মৃত্যু হবে। আমি তাকে নিয়ে বেশ স্বপ্ন দেখতাম। কিভাবে সংসার করব। কোথায় থাকব।

সে সারাক্ষণ রঙিন ঘুরি হয়ে আমার আকাশে উড়ত। নীল প্রজাপতি হয়ে আমায় ইশারা দিত। দুজন পাখি হয়ে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে বেড়াতাম। এবার আমি স্থির করি আমি তার কাছে চলে যাব। আমার যেন এই গ্রামে থাকা অসহনীয়। তাকে জানাই সেও একই কথা বলে। সে জানায় আমাদের ভালবাসা যেহুতো কেউ মেনে নিবে না। সুতরাং আমাদের পালিয়ে বিয়ে করতে হবে। শর্ত ছিল তার আমি যেন মুসলিম হয়ে যাই। আমি মেনে নেই। অতঃপর সে বলে আমি যেন আব্দুল্লাহপুর যাই। আমি রাজি হই। বাসে টিকিট কেটে রাখি। এর আগে সে আমায় একটা ফোন দেয় যোগাযোগের জন্য।  সবাইকে রেখে তার কাছে চলে যাবার জন্য বাসে উঠি। তার সাথে কথা হয় সে আব্দুল্লাহপুর থাকবে। সে আমায় বেশ সান্তনা দেয়। আমি তার কথায় চোখ ভিজিয়ে ফেলি। তার কথায় তার প্রতি আমার আরোও বেশী ভালবাসা জন্ম হয়।

যাইহোক সেখানে গিয়ে পৌঁছানোর পর তার নম্বর বন্ধ। তার কোন খোঁজ পাচ্ছিলাম না। মনে হতে লাগল তার কিছু হলো নাতো। তার কোন সমস্যা হলো নাকি। সে কি কোন সমস্যায় পড়ছে। একই কথা বারবার প্রতিধ্বনি হতে লাগতো। একটা সময় সন্ধ্যা পার হয় তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কিন্তু তার কোন খবর নেই। এক সময় আমার চোঁখে বর্ষণ। এক সময় আমার ভিতর বাইর পুড়তে লাগল। পাশে এক মোটা মহিলা আমার দিকে বারবার তাকাতে লাগল। আমি দেখতে লাগলাম সে আমায় অনুসরণ করছে। সে আমায় কিছু বলতে চাই। মহিলাটি আমার কাছে আসল। আমাকে বলল, তুমি বর্ষা না?

না আমি অরুণা।

তোমার কোন সমস্যা। কেউ আসবে। দেখছি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছো।

তারপর তাকে অনেক কিছুই বলে ফেলি। সে এবার আমায় সান্তনা দেয়। সে বলে আমি তোমার মায়ের মতই। তুমি আমার মেয়ের মতই। সে এই কথা বলতে বলতে কান্না করতে লাগল। সে বলল, তুমি আপাতত আমার মেয়ে হিসেবে আমার বাসায় চল। পরে তাকে ফোন দিও না পেলে তোমার গ্রামের বাড়ী আমি রেখে আসব। আমি তার কথায় অনেকটাই আশান্বিত হয়ে তার সাতে তার বাড়ী ফিরলাম। অনেক বড় বাড়ী দেখি আমার মত আরোও দুয়েক জন এখানে রয়েছি। খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুয়ে আছি। রাতে ঘুমিয়ে পড়ব। আমাকে আলাদা রুমে দিল। আর বলল দরাজা লাগিওনা তোমার পাশে আমি পরে শুব। রাতে যখন আমি ঘুমিয়ে তখন দেখি কে যেন আমার শরীর ছুঁয়েছে। আমি লাফিয়ে উঠি। দেখি একটা অচেনা মানুষ আমার শরীরের উপর ছিল। তারপর আমি তার কাছে আকুতি করি। বিনয় করি আপনি কে। এখানে কেন।

কেন তুই জানিস না। তোর সাথে রাত কাটানোর জন্য টাকা দিয়েছি।

অনেক অনুরোধ। কে শোনে! কুড়ে কুড়ে খায় আমার শরীর। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সকালে উঠে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় বিছানায় পড়া। মানুষের প্রতি তখন যে কতটা ঘৃণা লাগে। তা বলতে পারব না। এভাবে প্রথম প্রথম আমি মেনে না নিলেও পরে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে। বুঝতে বাকি ছিল না আমি ভুল যায়গায় পা দিয়েছি। তারপর থেকে এই যায়গায়। আজ মারা যাব। কিছুক্ষণ পর। ঘুমের ওষুধ এনেছি কোন এক খদ্দর এর কাছে অনুরোধ করে।’ বাপন যখন এই কথা গুলো কোন ডাইরীতে পড়ে তখন আর অরুণা বেঁচে নেই। তখন অরুণোদয়ের করুণাময় অবস্থা।






Post a Comment

0 Comments