কুশল ভৌমিক এর গুচ্ছকবিতা



আদিগন্ত ফসলের কবিতা 



আমার ঠাকুরদা একজন কৃষক ছিলেন

মাটিগন্ধা হাতে তিনি শস্য ফলাতেন

ধানের কাছে হৃৎপিণ্ড সমর্পণ করে

তিনি শিশুর সারল্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন

প্রতিটি ধান তখন কবিতা হয়ে উঠতো

আদিগন্ত মাঠ তখন কবিতার খাতা।



আমার ঠাকুরদার মতো অমন কবি হয়ে উঠতে

আমি কাউকে দেখিনি

তিনি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের চেয়েও

অনেক বড় কবি ছিলেন

এমনকি সেক্সপিয়রের সনেটগুলোকেও

আমার কাছে ঠাকুরদার ফসলের চাইতে

বড় কবিতা মনে হয়নি

ঘাম শরীরে তিনি যখন লাঙ্গল চষতেন

মনে হতো এক্ষুনি জন্ম নেবে

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোনো কবিতা।



অগ্রহায়নে তিনি তার সোনালি কবিতাগুলো

নিজ কাঁধে বয়ে এনে ঠাকুমার হাতে তুলে দিতেন

ঠাকুমা পরমযত্নে কবিতাগুলোর গন্ধ শুঁকতেন

স্পর্শ করতেন,রৌদ্র মাখিয়ে রেখে দিতেন

গোলাঘরের নান্দনিক মলাটে

আমাদের গোটা বাড়িটাই তখন হয়ে উঠতো

অনিন্দ্য সুন্দর এক কবিতার বই।



আমার ঠাকুরদা শস্যগন্ধা কবি ছিলেন

আমি তার অযোগ্য দৌহিত্র

দিন রাত শব্দের জট আঁকি

গ্রন্থের কাছে করি আত্মসমর্পণ

প্রাজ্ঞ বিজ্ঞের কাছে ছুটে যাই

কবিতা লেখার গোপন রহস্য জানতে

অথচ আমার ঠাকুরদা শুধুমাত্র ঘাম,মাটি

আর লাঙল দিয়ে

কত সহজেই লিখতে পারতেন

আদিগন্ত ফসলের অমর কবিতা।





খুন 



চলো, আমরা দুজন মিলে

খুন করে ফেলি

আমাদের সীমাহীন ব্যস্ততাগুলো 

অকারণ দম্ভ

দূরত্বের দীর্ঘশ্বাস আর

সূচ হয়ে ঢুকে পড়া

তৃতীয়পক্ষের অনাবশ্যক আস্ফালন

যেহেতু খুন করার জন্য

আমাদের  মজুদ আছে

ভালোবাসার মতো

একটি ধারালো অস্ত্র।



এসো প্রকাশ্যে খুন করে

আমরা একে অপরের কাছে

আত্মসমর্পণ করি।



তারপর ---

আমাদের সাজা হোক

একই ছাদের তলায়

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।









জন্মদাগ



ছেলেবেলায় একদিন

ডান উরুর মাঝখানে একটা কালচে দাগ আবিস্কার করলাম

মা জানালেন এ আমার জন্মদাগ।

সেই থেকে বহুদিন আমি একাকী বহন করেছি

জন্মদাগের রহস্য

হঠাৎ জন্মদাগটি আমার কাছে ভীষণ অসহ্য

আর বিরক্তিকর মনে হতে লাগলো

প্রতিদিন স্নানের সময় সাবান দিয়ে সজোরে ঘষে

আমি জন্মদাগটি উঠিয়ে ফেলতে চাইতাম

মা খুব হাসতেন আর বলতেন--

"লাভ নেই খোকা, জন্মদাগ কোনোদিন ওঠে না"।



মা নেই,বাবা নেই -অনেক গুলো বছর

বাবার আঙুলের স্পর্শ

মায়ের দেয়া চুমুর দাগ

সদুল্যাপুর গ্রাম,ধলেশ্বরী নদী,শৈশবের রঙ ছড়ানো  ভিটেমাটি আর ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর

শরীর জুড়ে লেগে থাকা অন্ধকারের মতো

'তুমি' নামক একটি দুঃখ

আজও লেপ্টে আছে আমার শরীরে।



হে দুঃখ জাগানিয়া

তুমিও কি জন্মদাগ?









দৃশ্যের শরীর 



মৃত্যুর প্রয়োজনে জন্ম নেয়া মানুষ

জন্মের প্রয়োজনে মৃত্যুকে ভুলে যায়

জন্ম এবং মৃত্যু

মাঝে অদৃশ্য দেয়াল

কেউ ছুঁতে পারে, কেউ পারে না

ডিং ডং ঘন্টা বাজে সময়ের

কেউ শুনতে পায়, কেউ পায় না

ঘন্টাবাদকের তাতে কী আসে যায়।



সব মৃত্যুর রঙ এক

সব মৃতদেহ সাদা

তবুও

কেউ পায় অগ্নিস্নান

কেউ মৃত্তিকায় ধরে রাখে সবটুকু জল।



জীবন মন্ত্রপূত রঙিন দৃশ্যের নাম

মৃত্যুর কথা ভুলিয়ে দেয়।







 জিজ্ঞাসা



সম্পর্কের সুতো বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে

ভাই একদিন ভাইরাস হয়ে যায়

ক্রমাগত হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে

মিথ্যা যেমন হয়ে যায় মিথ।



তবুও জলের ধর্ম মেনে

আমরা ভাসি-ডুবি

সম্পর্কের ঘনত্ব মাপি জলের নিয়মে।



আর্কিমিডিস, আপনার কি জানা আছে

সম্পর্ক ডুবে গেলে

কেন আর ভেসে ওঠে না কোনো দিন? 

Post a Comment

0 Comments