“তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট”
পাগল মেহের আলির এই চিৎকার কানে
ঢুকলেও মনে ঢোকে না কারোরই। সহজাত মেষবৃত্তির গড্ডালিকা প্রবাহে ওরা তো খড়কুটো। সব
বুঝেও অবুঝ। জ্ঞানপাপী। সঠিক ম্যাপ, কম্পাস সাথে নিয়েও প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করতে
ভুলে যায়। ইচ্ছে-অনিচ্ছের ভুলভুলাইয়াতে ফেঁসে বার বার একই জায়গায় ফিরে আসে। কুরুক্ষেত্রের
চক্রব্যুহে ওরা প্রত্যেকেই এক একজন অভিমন্যু। দুচোখে অগাধ খোঁজ নিয়ে এগিয়ে চলে। কি
যে খোঁজে, নিজেই বোঝে না-
"We look
before and after,
And pine for what
is not:
Our sincerest
laughter
With some pain is
fraught;
Our sweetest songs are those that tell of saddest thought."
-Shelley (To A Skylark)
যন্ত্রণা। মধুর যন্ত্রণা। এই জিনিসটার পেছনেই পাগল গোটা দুনিয়া। খালি পায়ে
ফুটন্ত লাভার উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয় তাকে, খেতে হয় কাঁটার আঁচড়। সাপের বিষে নেশা
করে মাঝে মাঝে ভুলে থাকতে চায় সে তার যন্ত্রনাটাকে। কিন্তু বেরোতে চায় না এর বাইরে।
হয়তো বা যন্ত্রনাটাও তার কাছে নেশার মত লাগে তখন-
"My heart aches, and a drowsy numbness pains
My sense, as though of hemlock I had drunk,
Or emptied some dull opiate to the drains."
-Keats (Ode to a Nightingale)
খোঁজ তবু থামে না। থামাতে হয় না। করো ভুল। বারবার করো। কিন্তু ভুলের ভয়ে
খোঁজ থামিও না-
“দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে
রুখি,
সত্য বলে আমি তবে কোন
পথে ঢুকি?”
তাই দরজাটা খুলে রাখতেই হয়। আমাদের দেরিদা সাহেবও একই কথা বলেন তাঁর
Deconstruction Theoryতে।
এখানে তিনি ভাঙার কথা বলেছেন। প্রতিটা শব্দকে, তার অর্থকে বারবার ভাঙতে
চেয়েছেন। খুঁজতে চেয়েছেন। কিন্তু তাই বলে অকাট্য সত্যে পৌঁছতে তিনি কখনোই পারবেন না।
পৌঁছনো যায় না। রূপম ইসলামের একটা গান আছে না-
“আসলে সত্যি বলে সত্যি
কিছু নেই!”
নীতিশিক্ষার কিছু উপদেশ, যেমন- 'সদা সত্য কথা বলিবে', 'হিংসা করিবে না',
'স্বার্থপর হইবে না'- এগুলো শুধুমাত্র বইয়ের পাতা সাজানোর জন্যই। টিকে থাকার লড়াইয়ে
এগুলোকে হাতিয়ার করে কটা লোক? Luice MacNiece এর 'Prayer Before Birth' কবিতাটির কথা
মনে পড়ে যায়। গোটা কবিতা মুখরিত হয় এক অজন্মা শিশুভ্রুণের কাতর আকুতিতে-
"I am not yet born,
O hear me
Let not the
bloodsucking bat
Or the rat or the
stoat or the
Club-footed ghoul come
near me."
আসলে এই 'blood-sucking bat' কারা? তারা কি এলিয়েন? না, সমাজের এই
so-called ভদ্রলোকেরা 'blood-sucking bat' এর চেয়ে কোন অংশে কম ভয়ঙ্কর! ওরাই সমাজ বানায়।
ঘর বানায়। গাছ কাটে। এসি লাগায়। কিচেন চিমনির ধোঁয়ায় ছেয়ে ফেলে। জঞ্জালের স্তূপে ডাস্টবিন
করে তোলে গোটা দুনিয়াকে। একটা সদ্যজাত শিশুকে উপহার দেয় সেই পৃথিবী, যেখানে কোন সবুজ
ঘাস নেই, কোন আকাশছোঁয়া গাছ নেই, কোন খোলা আকাশ নেই, কোন পাখি নেই, গান নেই, আলো নেই।
আছে কেবল রক্তের গন্ধ, বারুদের গন্ধ, মাংসের গন্ধ।
প্রেমের চেয়ে ক্ষমতা বড় হয়ে ওঠে এখানে। সর্বক্ষণ চলে অধিকারের লড়াই। পৌরুষের
আস্ফালন। প্রতিষ্ঠানগুলোও সেভাবেই গড়ে ওঠে।
ধর্ম, যার অর্থ ধারণ করা, সত্যিই কি তা মানবজাতিকে ধারণ করছে? বরং পাঁচিল
তুলছে, ভেদাভেদ করছে, ভয় দেখাচ্ছে, মুখোশ পড়তে শেখাচ্ছে-
“উড়ছে আজও ধর্মধ্বজা টিকির গিঁটে, দাড়ির ঝোপে।”
-নজরুল
পৌরুষের সর্বোচ্চ আস্ফালন বোধহয় ধর্মেই প্রকাশ পায়। নারীকে তা ভোগ্যপণ্য
ছাড়া আর কিছুই ভাবতে শেখায় না। একজন শিশুকন্যা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পিতামাতার কপালে চিন্তার
ভাঁজ পড়ে। তার কুষ্ঠিবিচার হয়। না, তার নিজের জন্য নয়; তার পিতার জন্য, তার ভাইয়ের
জন্য। কি হবে একটা শিশুকন্যার কথা ভেবে? বড় হলে নিজের পরিবারের পাশে তো সে থাকবে না।
থাকবে এক সম্পূর্ণ অজানা পরিবারের পাশে। সেটাই নাকি তখন হবে তার নিজের পরিবার। আর বাবা
মা হবে পর।
ততদিন তাকে পাহারা দাও। পাহারা দাও তার সতীত্বকে। সমাজের অদৃশ্য হায়নাদের
থাবা থেকে।
সতীত্ব। Virginity। সেটা আসলে কি? সেটা কি খালি চোখে দেখা যায়? স্পর্শ করা
যায়? নাকি, সেটার অস্তিত্ব যোনির গভীরে, কেবল হাইমেন পর্দার অক্ষত থাকার মধ্যেই? কিছু
কিছু বহুগামী পুরুষও দেখেছি বিয়ের রাতে ফুলশয্যার খাটে সাদা চাদর বিছিয়ে রাখে নববধূর
সতীত্ব পরীক্ষার জন্য। সাদা চাদরে কয়েকফোঁটা রক্তের দাগই তার virginity র পাশ ফেলের
খাতায় নম্বর দেবে!
আর যদি সে নারী শৈশবে বা কৈশোরে লালসার শিকার হয়? ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার শরীরটাকে
খাবলে খেয়ে ফেলে কোন পিশাচ? শরীরময় আঁচর-কামড়ের দাগ আর ভেসে যাওয়া রক্তের স্রোতে ভাসতে
থাকা সেই মেয়ের মাথায় এই সমাজই পরিয়ে দেবে ধর্ষিতার মুকুট। 'কুলটা' উপাধিতে ভূষিত করবে
তার নব পরিচয়। আর নির্দ্বিধায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে তার ধর্ষকেরা নতুন কোন শিকারের
খোঁজে। একটা শক্ত পুরুষাঙ্গ বসিয়ে রাখবে তাকে সমস্ত কলঙ্কের উপর- আজীবন।
যুগ যুগ ধরে এটাই তো হয়ে এসেছে। পঞ্চস্বামীর গরবিনী পত্নী হয়েও দ্রৌপদীকে
ধর্ষিতা হতে হয়েছে ভরা রাজসভায়। যে পুরুষ অধিকার খাটিয়েছে সারাজীবন তার নারীত্বের উপর,
তারাও নপুংসকের আচরন করেছে সেই চরম মুহূর্তে। রাবণ কর্তৃক অপহৃত সীতাকে জ্বলতে হয়েছে
সন্দেহের গনগনে আঁচে। কুন্তিকে ছাড়তে হয়েছে তার ভালোবাসার ফল, আত্মজ কর্ণকে। গান্ধারীকে
বেঁধে রাখতে হয়েছে নিজের দুচোখ ভালোবাসার কালো কাপড়ে। আর রাধিকাকে সইতে হয়েছে আজন্ম
বিরহ। কৃষ্ণ ভুলবার পর কেই বা মনে রেখেছে তাকে?
অথচ সেই কৃষ্ণ দোর্দন্ড প্রতাপে, আভিজাত্যে, মহিমায় উপন্যাসের নায়কটি হয়ে
মাথা উঁচু করে একাধিক রাণীকে নিয়ে রাজ্যপাট সামলে গেছে। তার অসুর্যস্পর্শা সত্যভামা,
রুক্মিণী সুন্দরী পরম যত্নে, মায়ায় ঘিরে রেখেছে তার বাকি জীবনটা। রাধার কথা ভাববার
সময় সে আর পায়নি।
যে মেয়ে একটা ভুল মানুষের জন্য ঘর ছাড়ল, বর ছাড়ল, বাঁশির সুরে খালি পায়ে
কাঁটাবিছানো পথে রক্তাক্ত হল, তার কথা কোথায় আছে? বৈষ্ণব পদাবলী তো ভরে আছে কানুতে,
নিঠুর কানুতে। বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাসের ছত্রে ছত্রে সেই নিঠুরতার
আস্ফালন।
এতো গেল পুরানের কথা। এবার আসি ইতিহাসে। অষ্টাদশ শতাব্দীর নারীজীবনের আনাচে
কানাচে। সেখানেও লেগে আছে খয়েরি রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, পুড়ে যাওয়া দগদগে ঘা, বুকফাটা
তৃষ্ণা, নিদারুণ ক্ষুধা, প্রসবে প্রসবে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, যন্ত্রণায় মুখ থুবড়ে পড়া
অজস্র নারীশরীর।
দশ বছরেরও ছোট কন্যার ভাগ্যবিধানে লেখা হত ষাটোর্ধ্ব পুরুষের গলায় মালা
দেওয়া, তারপর ধর্ষিতা হওয়া, ঋতুমতী হবার আগেই বারবার। সেই গঙ্গাযাত্রী মারা গেলে তরুণ
বৈধব্য নিয়ে তার বেঁচে থাকা হয়ে উঠত দুষ্কর। তাই, সহজ সমাধান। সতীদাহের বিধান। গনগনে
আগুনে জ্বলতে হত তাকে, তীব্র অনিচ্ছা সত্বেও। আর যদি বেঁচে থাকত সে, আটক করা হত তাকে
বদ্ধ ঘরে। একাদশীর দিন অবুঝ দশমী বালিকা পিপাসায় কাতর হয়ে আটক ঘরের মাটি লেহন করতো।
ক্ষুধায় প্রাণ হত ওষ্ঠাগত। আর সংসারের পরম সুখ যদি তার কপালে লেখা থাকতো, বারবার হতে
হত সন্তানবতী। মিথ্যে গরবে হত সে গরবিনী। হয়তো বা সেই গরবের ঔদ্ধত্যেই প্রাণ ত্যাগ
করতো সে।
কিন্তু আজ একবিংশ শতক। দৃশ্যটা কি আদৌ বদলেছে? হ্যাঁ। নারীর পারিপার্শ্বিক
পাল্টেছে। আজ সে মহাকাশচারিণী হতে পেরেছে, হয়েছে ফাইটার জেটের পাইলট, বক্সিংয়ে গোল্ড
মেডেল এনেছে দেশের জন্য, আই পি এস অফিসার হয়ে দুনিয়া বদলের মশাল তুলে নিয়েছে নিজের
হাতে। কিন্তু, আলোটা এখনো পৌঁছতে পারেনি সেই গহীন কালো উপত্যকার খাঁজগুলোতে।
আজও কাজের জায়গায় কুশলতা দেখাতে গেলে তাকে হতে হয় বিদ্বেষের শিকার। কবিতা
লেখার চেষ্টা করলে বাবা বলেন, "রবীন্দ্রনাথ হবে নাকি?" গলা ছেড়ে গান গাইলে
বন্ধুরা প্যাঁক দেয়। প্রাণ খুলে হাসলে ঠাকুমা বলেন,
“কুলক্ষণা, জানিস না, মেয়েদের জোরে জোরে হাসতে নেই। লোকে কি বলবে?”
একটা অদৃশ্য মাপকাঠি দিয়ে বাঁধা আছে তার গোটা গতিপথ। তার হাঁটা, চলা, কাঁদা,
হাসা, নিজেকে ছড়িয়ে ফেলা, আবার সযত্নে গুটিয়ে নেওয়া- সবটা।
অস্তিত্ব সংকট! পুরুষের চোখে যে নারীর অস্তিত্বই নেই, তার আবার কিসের অস্তিত্ব
সংকট! বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক রুশো তাঁর 'Emile' নামক গ্রন্থে বলেছেন-
“নারীর নিজের কোন অস্তিত্ব নেই। সে হল পুরুষের ছায়ামাত্র। তার জীবনের একমাত্র
উদ্দেশ্য হল পুরুষকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেবার উপযোগী করে নিজেকে গড়ে তোলা।”
একই রকম সুর শোনা যায় বর্তমান জনৈক সাংগঠনিক নেতার কথায়,
“পুরুষ নারীর কাছে আসে সুখ পাবার জন্য, নারী পুরুষকে সুখ দেয় পেট চালানোর
জন্য।”
হায়রে নারী, হায়রে তোর পেট! যে পেটে তুই ধারণ করেছিস পুরুষকে, সেই পেটের
খিদেই তোকে ঠেলে দেয় তার কাছে! ধর্ষিতা হলে শুনতে হয়, তোরাই নাকি দায়ী নিজেদের ধর্ষণের
জন্য। স্বল্প পোশাক পরে তোরাই উত্তেজিত করিস পুরুষকে, তাই ধর্ষিত হোস। এতে পুরুষের
কোন দোষ নেই!
আচ্ছা, মহাভারতের যুগে দ্রৌপদী তো কোন স্বল্পাবাস পরেনি, তাহলে তাকে ধর্ষিতা
হতে হল কেন? সেদিন পেপারে পড়ছিলাম, একটা দেড় বছরের বাচ্ছাকে ধর্ষণ করেছে তার নিজের
কাকা। শিশুটির পোশাকেও কি তবে কোন গোলমাল ছিল? আর যে বৃদ্ধা পাগলিনীকে রুটির লোভ দেখিয়ে
ফুটপাতে গ্যাংরেপ করা হল, সেও কি একইভাবে দায়ী নিজের উপর নেমে আসা এই পাশবিকতার জন্য?
পুরুষ নারীকে ভালোবাসে, ভালোবাসে তার সমর্পনকে, সেবাকে, সওয়াকে। প্রশংসাও
করে বৈকি! সাহিত্যে তাকে মা বলে পুজো করে, কাব্যে তাকে প্রকৃতি বলে কল্পনা করে, ধর্মে
তাকে দেবী বলে আখ্যায়িত করে, কিন্তু আবার, শহরগঞ্জের কানাগলিতে ঠোঁটে রং মাখিয়ে কুপি
হাতে দাঁড় করিয়েও দেয়। কুমারীর গর্ভে বপন করে লালসার বীজ। ঠোঁটকাটা মেয়েমানুষকে দেয়
নির্বাসন কোন দ্বীপান্তরে।
আরেকটা লিঙ্গ আছে, যে লিঙ্গের অস্তিত্ব মানতে খুব কষ্ট আমাদের। ট্রেনে,
বাসে, ট্রামে, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে আকছার দেখি ওদের। তবু, দুচোখে বিরক্তির ঠুলি লাগিয়ে
করি না দেখার ভান। দুচোখে পুরু কাজল, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, চুলে উগ্র কেশতেল, আর হাতের
বিকট তালি দিয়ে ওরা আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজের উপস্থিতি প্রমাণ করার। তবু, দুটো খুচরো
পয়সা বের করার ভয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি, বা জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে প্রকৃতি প্রেমিক
হওয়ার চেষ্টা করি। ওরা খিস্তি দিলে আমরা বলি 'অসভ্য', ওরা হাসলে আমরা বলি 'নির্লজ্জ'।
তবু ওরা আসে। বিনা আমন্ত্রণে। খোল-মৃদঙ্গ বাজিয়ে আমাদের ছেলেপুলেদের মঙ্গলকামনা করে।
আর বিনিময়ে দাবি করে গ্রাসাচ্ছাদনের অর্থ। তখন আমরা দাগিয়ে দিই ওদেরকে 'লোভী' বা 'বেয়াদব'
আখ্যায়।
সত্যিই কি ওরা লোভী? ওদের দাবীটা
কি খুব বেশী? সমাজ ওদের হাতে কি আর অন্য কোন উপায় রেখেছে? যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজের
গর্ভধারিণীকেই সম্মান দিতে কুন্ঠিত হয়, তারা এক বৃহন্নলাকে স্বীকার করবে কি উপায়ে?
পরিবার ওদেরকে ঘরছাড়া করে, যে বয়সে বইখাতা, স্কুল, হোমটাস্ক জড়িয়ে থাকে
শিশুকে, সেই বয়সে কঠোর বাস্তবের কাঁটাতারে জড়িয়ে দেওয়া হয় ওদের জীবন। বঞ্চনা, অবহেলা,
অপমানের বিষ ঢেলে দেওয়া হয় ওদের শিরা-উপশিরায়। হ্যাঁ, ওরা রুক্ষ, ওরা বর্বর, ওরা অসভ্য।
কিন্তু কেন? সেটা কি আমরা কখনো মাপতে চেয়েছি?
প্রেম ওদের জীবনেও আছে। আছে কিছু চাওয়া, আর অনেকটা না পাওয়া। কিন্তু ওদের
প্রেমকেও আমরা কলুষিত করেছি। সমকামিত্বকে বলেছি নোংরামো। ভালোবাসার রামধনু রঙে মিশিয়ে
দিয়েছি ঘৃণার কালো বিষ।
এতকিছুর পরেও যেটা পড়ে থাকে, সেটা হল মানবিকতা, বোঝার ক্ষমতা, মানিয়ে নেওয়া,
এগিয়ে চলা এবং ভালো কিছু করা। করেও। এমন বহু উদাহরণ রয়েছে, ট্রান্সজেন্ডার হয়েও সমাজকে
তারা অনেক উপহার দিয়েছে।
কেউবা দিয়েছে শিক্ষার আলো, কেউ বা ন্যায়বিচার, কেউবা বিশ্বের দরবারে সৌন্দর্যের
প্রতিনিধিত্ব করেছে, কেউ বা কোলে তুলে নিয়েছে যৌনকর্মদের সন্তান-সন্ততী, এইচ-আই-ভির
বিরুদ্ধে করেছে লড়াই। চারপাশের সব পাঁচিল ভেঙেছে, ছড়িয়ে দিয়েছে মানবিকতার আলো।
পুরুষের পক্ষে এখনো বলিনি কিছু। তবে, পুরুষ-বিদ্বেষী নই। সমাজে পুরুষ মানুষের
অবদানকে উপেক্ষার ক্ষমতা নেই কারও। পুরুষ তার শক্ত পেশীতে ধরে রেখেছে অবিরত কর্মপ্রবাহ।
সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে নব নব আবিষ্কারে। বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, মানবকল্যানে রেখে গেছে
তার অবিস্মরনীয় ছাপ। রাখছেও। পুরুষ নারীর শত্রু নয়। শত্রু হল সেই ভাবনা, যা পুরুষতন্ত্রকে
জিইয়ে রাখে, সেটা স্বয়ং নারীও হতে পারে। আমরা সমতা চাই, বৈষম্য নয়। কারণ,
“শরীরের লিঙ্গ আছে, আত্মার কোন লিঙ্গ নেই।”
-স্বামী বিবেকানন্দ
আত্মার আলো খুঁজতে হলে প্রকৃতির কোলেই মাথা রাখতে হবে। কারণ, সেখানেই নিজেকে
সবথেকে বেশী করে পাওয়া যায়। ব্যস্ত দৈনন্দিনের ক্যাকোফনিতে আমাদের মনের কথাগুলো আমরা
নিজেরাই শুনতে পাইনা। কারখানার বিকট আওয়াজ বা ট্রাফিকের চিৎকার আড়াল করে রাখে ওদেরকে।
বলা হয়ে ওঠে না অনেককিছুই। অজানা থেকে যায় তা নিজের কাছেও। তাই মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তে
হয় কোন অভিযানে- দূরের কোন জঙ্গলে, পাহাড়ে বা সমুদ্রের বুকে হারিয়ে ফেলতে হয় নিজেকে।
ডুবতে হয়। খুঁজতে হয় ডুবুরির মত অন্তরের মণি-মানিক্য। সেই সবুজ বনানী, একফালি আকাশ,
বুনো ফুলের গন্ধ, মাথা উঁচু করা পাহাড়, উদ্দাম সমুদ্র প্রাণে ভরে দেয় অনেকটা বাঁচার
নেশা। নতুনভাবে দেখতে শেখায় জীবনকে-
“ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের
পথে যেতে
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে
মন মেতে,
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই
গান।
বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।”
--রবি বাবু
পাশ্চাত্য কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায়ও একই কথা ধ্বনিত হয়-
"That serene and
blessed mood,
In which affections gently
lead us on-
Until, the breath of this
corporeal frame
And even the motion of
human blood
Almost suspended, we are
laid asleep
In body, and become a
living soul."
-William Wordsworth
(‘এবং জলঘড়ি’তে পূর্বে প্রকাশিত)
0 Comments