মুহাম্মদ ফজলুল হক এর গল্প ‘বারবনিতা’

 

Muhammad Fazlul Haque's story 'Barbanita'


 

দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করে রশ্মি। না করে উপায় কি? দিন রাতের অধিকাংশ সময় পুরুষদের ভালোবাসে সে। তার ভালোবাসায় অদ্ভুদ মায়া। যে মায়ায় আবিষ্ট থাকে সব পুরুষ। রশ্মিকে চাই! রশ্মিকে চাই! যেন রশ্মি তাদেরই। রশ্মিও পারে বটে। মোহনীয় রূপ, মায়াবী চাহনী, ব্যতিক্রম কেশ বিন্যাস, কোমল ব্যবহারের মাধ্যমে সব আবদার রক্ষার অসামান্য কৌশল অন্যদের নিকট থেকে তাকে আলাদা করেছে। রশ্মির মাঝে আছে অনন্য সমন্বয় স্নেহে মাতা, সেবায় দাসী, শয্যায় বেশ্যা। গোসল করতে সময় নিলেও গোসল না করে কারো শয্যায় যায় না রশ্মি। ভিআইপি খদ্দের  অপেক্ষা করলেও ভ্রুক্ষেপ নেই। মন যখন চায় তখনই সময় দেয়। সেই সময়ে থাকে অফুরান ভালবাসা। মুগ্ধতায় ভরা সীমাহীন প্রাপ্তি। কাশফুলের মত নরম স্পর্শের সিগ্ধ আবেশ। ভালোবাসার সকল রূপ। সঙ্গীর কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণে অসাধারণ পটুত্ব তাকে আরো মোহনীয় করে তুলে। কামকলা লীলাময় কারুকার্যতায় স্বর্গীয় সিগ্ধতায় ভরে উঠে সময়। পুরুষ মাত্রই তার যাদুকলায় আবদ্ধ।

 

খদ্দের সন্তুষ্টিতে পটু হলেও রশ্নির জীবনের করুণ কাহিনি কেউ জানে না। কেউ উপলব্ধি করে না তার মহত্ব। সবার চাই রশ্নিকে তার শরীরকে। রশ্মির জীবনের বাহ্যিক রঙিন প্রলেপের আড়ালে আছে কষ্টকর জীবন। রশ্মির জীবনে ভালোবাসার মায়া তার খদ্দেরদের আনন্দের উৎস হলেও নিজের জন্য সেই মায়া কখনো ছিল না। আধুনিক সভ্যতার অন্তরালে সে লুকিয়ে রেখেছে দুঃখ ও তীব্র শূন্যতাকে।

 

রশ্মির মুগ্ধকর রূপের পেছনে লুকানো গভীর দুঃখবোধ। যে স্বপ্ন দেখত মুক্তির। সেই রশ্মি অনেক আগেই মুছে গেছে সময়ের নিয়মে সমাজের প্রয়োজন ও বাস্তবতার চাপে। আজকের রশ্মি সম্পূর্ণ নতুন মানুষ যার রূপে হাসিতে কৌশলে বন্দি অসংখ্য মানুষ। মুক্তি নেই নিজের ।

রশ্মি যতই কৌশলী আর দক্ষ হয়ে উঠুক না কেন রাত শেষে যখন একা হয়, চারপাশের সব শব্দ থেমে যায় তখন তার অন্তরআত্মা কেঁদে ওঠে। নিরব কান্না অন্তরের গভীরে বাঁধা পড়ে যায়। জীবন তাকে অদ্ভুত খেলায় জড়িয়েছে। যেখানে  সবার মাঝে থেকেও নিজের জন্য একা। অন্যদের চাহিদা মেটাতে মেটাতে নিজের আত্মার কাছে সে জিম্মি।

রশ্মি থামে না। এটাই তার জীবনযাত্রা। সে জানে একদিন হারিয়ে যাবে। কেউ মনে রাখবে না। তার মায়াবী অস্তিত্ব হয়তো কারো অন্তরকে স্পর্শ করেছে। হয়তো কেউ আসেনি তাকে বোঝার জন্য। দুঃখকে অনুভব করার জন্য। তবু তার অনুচ্চারিত কষ্ট বেদনা ও নিঃসঙ্গতার কাহিনি বাতাসে ভেসে বেড়াবে। রশ্মি আরও একবার গোসল শেষে মুছে ফেলে নীরব কান্না। মুখে আনে চিরচেনা মায়াবী হাসি। রাতের আঁধারে ফিরে যায় চিরায়ত পথের দিকে।

রশ্মির জীবন জুড়ে রয়েছে পরস্পর বিরোধী আকাঙ্ক্ষা ও নিদারুণ বঞ্চনার গল্প। মাতৃত্বের কোমল অনুভূতির জন্য মন ব্যাকুল। শিশুর স্পর্শ ভালোবাসা ও স্নেহের জন্য গভীর তৃষ্ণা। স্বপ্ন ছিল কারো সঙ্গিনী হওয়ার। নিজ সন্তানের মমতায় ভরা কোলে মাথা রাখার। জীবনের পথে আসা প্রতিটি পুরুষ শুধু রশ্মির শরীরের দিকে তাকিয়েছে। তার আত্মা মনের আকুতি কারো নজরে পড়েনি। রশ্মি চেষ্টা করে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে। মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য পুরুষকে ভালোবাসার ইচ্ছে বুকে জমা হলেও সে জানে তার কাছে সবাই এসে কেবলই নেয়। কাউকে দেওয়ার অধিকার তার নেই। সে সবাইকে কাছে টেনে অভ্যস্ত হাতে নতুন কলাকৌশল রপ্ত করে। সে চায় অন্তত কিছুটা প্রশান্তি দিতে যদিও নিজের অর্জন সম্ভব হয় না।

যতই সে দক্ষ হয়ে উঠুক ভেতরের শূন্যতা তা পূর্ণ হয় না। প্রতিটি রাত যেন এক যুদ্ধ। ভালোবাসার নামে খদ্দেদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও নিজের অনুভূতি সযত্নে আটকে রাখে। অনেক সময় ভাবতে বসে কেন এই খেলার মধ্যে তাকে পড়তে হলো। কেন জীবনের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা কেবলই বিভ্রম হয়ে রইল?

রশ্মির জীবনে ভালোবাসা ও পূর্ণতা অধরাই থেকে যায়। তবু সঙ্গীদের আনন্দ দিতে চায়। যে পুরুষরা তাকে কাছে পেতে আসে তাদের চাহিদা মেটাতে তাদের সুখের অনুভূতি প্রকাশে সে নিজের অভ্যন্তরের মায়া ও ভালোবাসার ছোঁয়া যোগ করে। গভীর রাতে মানুষ আনন্দ নিয়ে চলে গেলে রশ্মি অনুভব করে জীবনের সত্যিকারের অভাব।

রশ্মি সমাজের চোখে পতিতা হলেও তার ভেতর রয়েছে অনন্য মহত্ব। সে নিজের সুখের জন্য বেঁচে থাকে না। যাদের কাছে সে যায় তাদের জীবনে শান্তি ও প্রশান্তি এনে দেয়। রশ্মির জীবনের সত্যিকার সৌন্দর্য এই সে সবার প্রতি সহানুভূতিশীল। সবার চাহিদা পূরণ করে। তাদের জন্য নিজের সময় আবেগ এবং যত্ন নিবেদন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। তার নিকট আসা অনেক মানুষ সমাজে মর্যাদা পায় না। ঘরে বাইরে অতৃপ্তি নিয়ে বসবাস করে। মায়া হয় তাদের জন্য সুখের সাগরে বাস করেও তাদের দুঃখবোধ কমে না। যারা অপূর্ণ ও একাকী তারাই বেশি আসে। রশ্মি তাদের জন্য আশ্রয় হয়ে উঠে। সে যেন ভুলের সাগর। সেখানে সব ভ্রম অতলে ডুবিয়ে শুদ্ধ হয়ে ফিরে যাবে সবাই। কাছে আসা মানুষ তার সান্নিধ্যে সময় কাটিয়ে তাদের মনোবেদনা ভুলে যায়। এখানেই শান্তি খোঁজে সে।

রশ্মির মহত্ব তার ক্ষমা ও সহনশীলতায়। সে জানে মানুষ তার পেশাকে অবজ্ঞা করে। সম্মান করে না তবু কাউকে ঘৃণা করে না। মানুষকে তার জীবনের কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে। সে কাউকে বিচার করে না। সবাইকে নিজের মতো করে গ্রহণ করে। রশ্মি জানে অনেকেই সুখে বেঁচে থাকে। কিছু মানুষের জীবন নানা সমস্যায় আচ্ছন্ন। সে নিজেকে সেইসব মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হিসেবে দেখে আনন্দ অনুভব করে। জীবনকে তাদের কল্যাণে উৎসর্গ করে সুখী হয়।

রশ্মি জানে তার ভূমিকা অনেকের জীবনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সে সমাজের বাঁধাধরা নিয়মে চলে না। মানুষের মনোবেদনার ভার লাঘব করার জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখে। ভেতরে এমন মমতা কাজ করে যা দিয়ে তার কাছে আসা প্রতিটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে পরিপূর্ণ করে।

রশ্মি নিজকে সেবিকা ভাবে। সেবা দিয়ে উপেক্ষিত অবহেলিত মানুষের মানসিক শান্তি নিশ্চিত করে। তার জীবনের উদ্দেশ্য স্বর্গীয় ভালোবাসার প্রকাশ। যেখানে কোনো শর্ত নেই কোনো প্রত্যাশা নেই। জীবন যেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। যা কেবল দিতে জানে প্রত্যাশা করে না। তাকে অনেকেই চায় সে নিজে কারো হতে পারে না। এই চিন্তা তাকে মাঝে মাঝে বিষণ্ণ করে। রাতে আকাশে পানে তাকালে মনে হয় বিস্তীর্ণ মহাবিশ্বের কোথাও নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। তারার সাথে কথা বলে মুক্তির আনন্দ অনুভব করে।

রশ্মির সুখের জায়গা হলো গোসলের মুহূর্ত। গোসলের সময় সবকিছু ভুলে নিজের জন্য বাঁচে। প্রতিক্ষণের ক্লান্তি আর অবাঞ্ছিত ছোঁয়া ধুয়েমুছে দেয়। ঠান্ডা পানির পরশে অবসাদ ও ক্লান্তি মুছে যায়। নতুন শক্তি ফিরে পায়। গোসলের সময়টুকু তাকে এমন শান্তি দেয় যা অন্য কারো কাছে খুঁজে পায় না। সমাজের বিচারে তার জীবন যতই সংকীর্ণ হোক না কেন নিজের একান্ত জায়গায় সে মুক্তি খুঁজে পায়। এটাই বেঁচে থাকার অবলম্বন। জীবনের বাহ্যিক গ্লানি ও অবজ্ঞার বিপরীতে ছোটখাটো উপভোগে আত্মাকে শান্তি দিয়ে নিজের মতো গড়ে তোলে।

সমাজ তাকে বেশ্যা হিসেবে চিনলেও তার আত্মার স্নিগ্ধতা সহানুভূতি মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তাকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা করে তোলে। নিজের প্রতি যে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য সে প্রতিনিয়ত সহ্য করে তা তাকে কঠোর করে তোলার বদলে আরও মানবিক করে তোলে। মানুষকে সান্ত্বনা দিতে চায় শান্তির মুহূর্ত উপহার দিতে চায়। নিজের ইচ্ছা স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারে না। সমাজ তাকে শুধু শরীরের জন্য মূল্যায়ন করে। মনের গভীরতা বা ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করে না। এত কষ্ট আর বঞ্চনার পরও রশ্মি কাউকে ঘৃণা করে না। তার নিকট আসা মানুষের মুখোষ উম্মোচন না করে নিজের মত গ্রহণ করে। মনের গহীনের মমতা ও সহানুভূতির শক্তি খুঁজে নিয়ে আত্মা শুদ্ধ করে বিড়বিড় করে বলে-

অন্ধকার পুঁজি করে ফেরি করি আলো

জীবন নামের সময়ে নেই কোন ভালো।

Post a Comment

0 Comments