যাহার বাঁশের লাঠি হাতে খুব সকালে রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। পাড়ার লোকজন এখনো সবাই ঘুম থেকে ওঠেনি। দু-একজন যা উঠেছে তাদের ঘুমের ঘোর কাটেনি। কেউ চোখ কচলাচ্ছে। কেউ শরীলের আড়মোড়া ভাঙার জন্য দুই হাত লম্বা করে ঝাঁকি দিচ্ছে অথবা কট্ কট্ করে বিভিন্ন মাংশপেশীতে লুকিয়ে থাকা হাড়গুলো ফোটাচ্ছে।
সূর্যালো পৃথিবীতে পৌছাতে আরও সময় লাগতে পারে। যদি আকাশের অন্য প্রান্ত থেকে মেঘ ভেসে না আসে। তাহলে আলোর যেভাবে আসার কথা সেভাবে হয়তো আসতে পারে।
যাহারের হাতে বাঁশের যে লাঠি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব শক্ত এবং তা শিশুর হাতের তালুর চেয়েও মসৃণ মনোমুগ্ধকর। পাকা বাঁশে সে প্রতিদিন দু বেলা খাঁটি সরিষার তেল ডলে। কোনোদিন বিকেলে যদি ডলতে না পারে তবে রাত দশটার দিকে ডলে।
বাঁশে তেল ঘষা তার জন্মগত অভ্যাস। তার বাবা এ কাজ করতো। খুব ছোটকালে সে বাবার পাশে বসে তেল ঘষা দেখতো। এখন তার মা-বাবা নাই। কিন্তু তেল ঘষা বেঁচে আছে। মানুষ চলে গেলেও তার কর্ম ঠিকই থেকে যায়।
সে রাস্তা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দৌড়ে এসে থামল গ্রামের সবচে বড় বাঁশ বাগানের সামনে।
তারপর বাঁশদের উদ্দেশ্য করে বলল, তোর জন্য জগতে এতো মানুষ প্রতিদিন খুন হয়। তুই সব খারাপ কু কাজের গোড়া। তোকে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না।
কথা থামিয়ে সে হাতের লাঠি দিয়ে ছোটবড় কাঁচা বাঁশকে পেটাতে থাকলো। তার শরীরে যতো শক্তি আছে সব দিয়ে হাই হাই করে আঘাত করতে থাকলো গভীর মনোযোগ দিয়ে।
পাশের বাড়ির লোকজন শব্দ শুনে বের হয়ে দেখলো যাহার বাঁশ পেটাচ্ছে। সে মানুষের সমাগম দেখে আরও শক্তি দিয়ে পেটাতে থাকলো।
এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘামে ভিজে উঠলো তার দেহ। হাতের লাঠিও ভেঙে গেছে। তার ডান-বাম দুই হাতের তালুতে ফোসকা পড়ে গেলো। তবু বাঁশ পেটানো থামাচ্ছে না। এই অদ্ভুত আচরণের খবর পৌছে গেছে সমস্ত গাঁয়ে। নারী পুরুষ বৃদ্ধ শিশু সবাই এসেছে।
কেউ বলল, যাহারকে কখনো এমন করতে দেখিনি। ওর কি হয়েছে। এমন করছে কেনো?
কেউ বলল, নেশা করে এমন করছে কিনা কে জানে?
তারই একজন নিকটতম পাড়াবাসি বলল, না, ও বিড়ি-সিগারেট, পান-জর্দা কোনোটায় খায় না।
সব শেষে তার দূরের এক চাচা এসে অনুরোধ করে বলল, বাবা, তুই একটু থাম। কিছুক্ষণ দম্ নে। পরে আবার পিটাস। আগে শুনি তোর কি হয়েছে। বাঁশ দিয়ে কেনো বাঁশ পেটাচ্ছিস।
চাচার অনুরোধ শুনে বলল, বাঁশে বাঁশে বাঁশ ক্ষয়। মানুষে মানুষে মানুষ ক্ষয়। আমি বাঁশকে মানুষ কল্পনা করে পেটাচ্ছি। যেসব মানুষ মানুষকে হত্যা করে। অন্যের অধিকার কেড়ে নেয়। তাদের আমি প্রতিকি ভাবে শাসন করি। ভয় দেখায়।
তার কথা শুনে গ্রামের লোকজন বলল, ও পাগল হয়ে গেছে। আমরা সকালের কাজকর্ম ফেলে সময় নষ্ট করছি। এ তো দেখি গ্রামে এক নতুন পাগলের আবির্ভাব হয়েছে।
যাহার বাঁশ পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে বাঁশ ঝাড়ের তলায় বসে পড়লো। একজন মানুষও নেই পাশে। সবাই ফিরে গেছে বাড়িতে। ভয়ানক ক্লান্তিতে বসে থাকতে না পেরে সে শুয়ে পড়লো। ঠান্ডা মাটিতে আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে গেলো।
পাশের রাস্তা দিয়ে শত শত মানুষ যানবাহন যাচ্ছে। কিন্তু কেউই খেয়াল করছে না সে বাঁশ বাগানে মৃত মানুষের মতো পড়ে রয়েছে।
সকাল গড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো দুপুর এসে পড়বে। তারপর বিকেল সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে আসবে।
সময় গড়িয়ে খালের জলের মতো চলে যাচ্ছে তবু তার ঘুম এখনো ভাঙেনি। সূর্যের তাপের গরমে মাঠের পক্ষিদল বাঁশ বাগানে আশ্রয় নিয়ে শব্দে অস্থির করে তুলেছে। তবু যাহারের ঘুম ভাঙার কোনো খবর নাই। সে বিভোরে ঘুমাচ্ছে। একটি সাদা বক লম্বা বাঁশ থেকে নেমে তার শরীলের পাশে দাঁড়ালো।
বাঁশ বাগানের উপর দিয়ে কি যেন একটা উড়ে যাচ্ছিলো। তার বিকট শব্দে যাহারের ঘুম ভেঙে গেলো। সে উঠে দেখলো বাঁশবাগানে পড়ে রয়েছে। চৌপাশে কেনো মানুষ নেই। বাগান ভর্তি শুধু পাখি আর পাখি। সব পাখি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাকে দেখে একটও ভয় পাচ্ছে না।
তাদের ভয় পেতে না দেখে সে দাঁড়িয়ে যাহ্ বলে চিৎকার করে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার পাখি তুমুল ঝাপটে উড়ে আকাশের দিকে চলে গেলো। সে ভাঙা লাঠি ফেলে দিয়ে বাড়িতে এসে ঘর থেকে আরেকটা নতুন লাটি নিয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে থাকলো।
গ্রামের লোকজন তাকে আবার লাঠি হাতে দৌড়াতে দেখে অবাক হয়ে বলল, গ্রামের সবচে ভালো ছেলেটা পাগল হলো কিভাবে। সে স্কুলের ফাস্ট বয় ছিলো। তাকে সবচে ভদ্র নম্র নিরিহ মানুষ মনে হতো। অথচ আজকে তার কি হলো। সে বারবার লাঠি হাতে দৌড়াচ্ছে।
যাহার এবার দৌড়ে গ্রামের বাজারে এসেছে। কাঁচা বাজারের দেওয়ালে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের একটা বড় ছবি লাগানো ছিলো। সে তার ছবির উপর ধুম্ ধুম্ করে বাঁশের শক্ত লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকলো।
তার লাঠির আঘাতের শব্দ শুনে মানুষজন ছুটে এসে বলল, কি হয়েছে? তোমার কি হয়েছে? তুমি প্রেসিডেন্টকে পিটাচ্ছো কেন?
‘আমি কেনো দেশের প্রেসিডেন্টকে মারি না। মারছি শয়তানকে। তাকে শাসন করছি। যাতে তার ইশারায় আর কেনো মানুষ মারা না যায়। কোনো দেশ যেন দখল না হয়’।
তার কথা শুনে বেশীর ভাগ লোকজন হেসে বলল, এতো ভালো একটা ছেলে পাগল হলো কিভাবে? হায়রে কপাল। ওর পরিবারের লোকজন এ দুঃখ কিভাবে সহ্য করবে? অনেকে কেনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলো। সে পেটাতেই থাকলো প্রেসিডেন্টকে।
একসময় তার হাতের লাঠি ভেঙে ক্লান্ত হয়ে পাশেই বসে পড়লো। লাঠির আগাতে ওয়ালের পোষ্টার ছিড়ে ইট ভেঙে যাবার উপক্রম। কয়েকটা ইটের কোণা খুলে গেছে। সে বসে ডাঙায় উঠা মাছের মতো হাপাতে লাগলো। তার সমস্ত দেহ দিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা মানুষের মতো টপ টপ করে ঘাম ঝরে মাটি ভিজে গেলো।
একজন মাছ ব্যবসায়ী এসে বলল, কি হয়েছে ভাই? আপনার এ দুরাবস্থা কেনো?
‘শয়তান মারতে যেয়ে ঘেমে গেছি। আরও অনেক শয়তান পেটাতে হবে। প্রথমে পিটিয়েছি বাঁশ বাগানকে। তারপর পেটালাম ইউ এসের পেসিডিন্টকে। এরপর দেখি আবার কোন্ শয়তানকে পেটানো যায়’।
মাছ ব্যবসায়ী তার কথার আগা মাথা কিছু বুঝলো না।
তার উপর বিরক্ত হয়ে বলল, আমি যতটুকু জানি আপনি একজন সুস্থ মানুষ ছিলেন। আজকে হঠাৎ অসুস্থ হলেন কিভাবে।
তার কথা শুনে যাহার আগুনের গোলার মতো চোখ বড় বড় করে তাকালো। তার তাকানো দেখে মাছওয়ালা ভয়ে সটকে পড়ে পাশের চায়ের দোকানে মানুষের মধ্যে আশ্রয় নিলো।
সে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর উঠে বাজারের পুকুরে নেমে জলের উপর বাঁশ দিয়ে গম্ গম্ শব্দ করে পিটাতে থাকলো। তার জন্য কেনো লোকজন ভয়ে পানিতে নামলো না।
সে পিটাচ্ছে আর পিটাচ্ছে। থামার কেনো লক্ষণ নেই।
বাজারের সভাপতি এসে তাকে বলল, তুমি জল পেটাচ্ছো কেনো?
‘জলেই জগৎ ও মহাজগৎ সৃষ্টি। সকল প্রকার প্রাণ সৃষ্টি। তাহলে জলই অন্যায় অবিচারের সৃষ্টিকর্তা। তাই তাকে শাসন করছি। পেটাচ্ছি’।
তার কথা শুনে সভাপতি বলল, তুমি তো ভালো ছেলে। এমন পাগলামি করছো কেন? এমন করলে পাগল নামে এলাকায় পরিচিতি পেয়ে যাবে।
তবু যাহারের সেদিকে খেয়াল নাই। সে সেই কখন থেকে পানি পেটাচ্ছে এখনো থামছে না।
পুকুরের চারপাশে এলাকার শত শত মানুষ জড়ো হয়েছে। সমস্ত বাজারের মানুষের মুখে মুখে রটে গেছে যাহার পাগল হয়ে পানি পেটাচ্ছে।
কে যেনো মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে। বলছে, আমাদের এলাকায় নতুন এক ঘটনা ঘটেছে। যাহার পাগল হয়ে বাঁশ ইট পানি পেটাচ্ছে। এবং উল্টাপাল্টা কথা বলছে।
আপনারা যদি তাকে দেখতে চান বাজারের পুকুরে চলে আসেন। সে এখন পুকুরে নেমে অকেক্ষণ ধরে এ কাজ করছে।
মাইকে ঘোষণা দেবার পর আশপাশ গ্রাম থেকে নারী পুরুষ শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ ভাঙলো বাজারের পুকুরের দিকে। অল্প সময়ের মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলো। এক ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা থাকলো না।
লোকজনের আগ্রহ দেখে মনে হলো তারা ম্যাসির ডিবলিং দেখতে এসেছে। অথচ যাহারের সেদিকে খেয়াল নেই। তার খেয়াল তার কাজের দিকে। সে পুকুরে নেমে গভীর মনোযোগ দিয়ে পানি পিটিয়ে যাচ্ছে। সবাই তার কান্ড দেখে হাসাহাসি করছে। শিশু কিশোররা সবচে অবাক হচ্ছে।
তারই একজন প্রতিবেশী বলল, যাহার থামো। এটা কি পাগলমো করো। তোমার জন্য এলাকার মানুষের ডিস্টার্ব হচ্ছে। সবাই কাজ কাম রেখে পাগলামি দেখতে এসেছে।
‘আমি কি কাউকে আসতে বলেছি? কোনো এসেছে? যারা এসেছে এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার কাজ আমি করছি। শয়তান পিটানো আমার দায়িত্ব। এরপর আমি বিদেশ যাবো শয়তান পেটাতে’।
প্রতিবেশী বলল, পাগল বলে কি? বিদেশ যাবে শয়তান পেটাবে। ওকে না থামালে সবাইকে পাগল করে ছাড়বে’।
ইতিমধ্যে কয়েকশ সাংবাদিক সমাজকর্মী অনলাইনকর্মী এসে ভিডিও লাইভ করে সারা পৃথিবীতে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রচারে তারা বলছে, গ্রামে এক অদ্ভুত মানুষের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে। সে জল পিটাচ্ছে। এই প্রথম একজন মানুষ পাওয়া গেছে যে জলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
তার যুক্তি হলো জল থেকে সবকিছু সৃষ্টি। পৃথিবীতে অন্যায় অবিচার হয় জলের জন্য। তাই জলই হলো পাপের জনক। জলের কারণে মানুষের এতো অনিষ্ট। তাকে সবার আগে সংশোধন করে শাসন করতে হবে। এর আগে যুগে যুগে কালে কালে যত মানুষ এসেছে সবাই জলের কথা চিন্তা করে ভয় পেয়েছে। কিন্তু সে কোনো কিছুকে ভয় পায় না। সে নির্ভয়। অজর। অমর। অক্ষয়। এবং পরম।
জল পেটাতে পেটাতে তার মধ্যে অলৌকিক সম্মোহনি শক্তি দেখা দিলে মানুষের মহা সমাগম দেখে সে পানি পেটানো বাদ দিয়ে বলল, আপনারা আমার কাছে শপথ নিবেন। আমি যা বলবো। তাই বলবেন। আমি যা করবো তাই করবেন।
যারা এতোক্ষণ তার বিরোধিতা করছিলো তারা সবাই বলল, যি, আমরা আপনাকে আজ থেকে পাগল মনে না করে একজন বিদ্রোহী মনে করবো। আপনি জলের মতো মৌলিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে পারেন। তার মানে আপনি পৃথিবী বদলে দিতে পারবেন। আমরা আপনার ছাত্র সমতুল্য।
মানুষকে নির্মমতার যাতাকল থেকে মুক্ত করে এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাতে পারবেন। আপনিই গড়তে পারবেন শান্তির পৃথিবী। যেখানে কোনো উচু নিচু থাকবে না। সব মানুষ মননশীলতা দ্বারা প্রস্ফুটিত হয়ে সুন্দর পাপহীন হয়ে উঠবে।
কারো খাবার কেউ কেড়ে খাবে না। লুটতরাজ দখল দারিত্ব থাকবে না। কেউ পাবে কেউ পাবে না, তা হবে না, তা হবে না।
সবাই তার কথায় সত্য আশান্বিত হয়ে বলল, বলেন, বলেন, নেতা বলেন। কি শপথ নিতে হবে। কি কাজ করতে হবে। কোন্ কোন্ মতবাদকে বাদ দিয়ে আপনার মতবাদের অন্তঃকরণে সবাইকে সমর্পণ হতে হবে।
সে বলল, শুনুন, আমার কথা শুনুন। চিৎকার চেচামেচি বন্ধ করুণ।
সবাই তার কথা শুনে থেমে গেলো। মনে হচ্ছিলো বাজারের পুকুর পাড়ে কোনো মানুষ নেই। গভীর নিশুতির মতো সকল কিছু শীতন হয়ে আসলো।
সে পুকুরের পানিতে দাঁড়িয়ে বিকট প্রকট শব্দে চিৎকার করে বলতে থাকলো, আমাদের দেশে যতো গ্রামবাসী আছি সবার আত্মাকে বিশুদ্ধ করবো আজকে রাতের মধ্যেই।
সবাই সবার অন্তরের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবো এই বলে যে, আমিই আমার শিক্ষক, আমিই আমার ছাত্র। আমার ভেতরের আমিত্বকে চিরতরে হত্যা করলাম। যা আর কেনোদিন জাগবে না আপনার দেহ ভান্ডে। আজকে থেকে অন্যের কল্যাণে কাজ করবো। কারো ক্ষতি করা মানে নিজের ক্ষতি করা। নিজের দেহ মনের উপর অত্যাচার করবো না। দেহের ক্ষতি সাধন মানে দেশের ক্ষতি সাধন। নিজ দেহকে সুরক্ষিত রাখা মানে দেশ তথা সমগ্র বিশ্বকে ভালো রাখা। নিজেই নিজের কাছে কথা দিলাম চিরতরে। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জীবন গেলেও যা অক্ষুন্ন থাকবে। হয়তো দেহ যাবে কিন্তু প্রজ্ঞিতা যাবে না।
তার কথা শেষে সবাই এক বাক্যে বলল, যি সম্মানিত নেতা। আপনার কথা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। আপনি এখন ডাঙায় উঠে আসেন।
সবার অনুরোধে সে জল ছেড়ে উপরে উঠে এসে বলল, আরেকটা কথা আছে। যেটা আগামিকাল ভোরে বলবো। আজ রাতে কেউ ঘুমাবেন না। কাল সকালে সূর্যালো পৃথিবীতে পৌছানোর আগে সবাই এই বাজারে চলে আসবেন। কিন্তু শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা যাবে না। এখন আপনারা সবাই সবার বাড়িতে ফিরে যান।
তার কথা শুনে সবাই বাড়িতে চলে গেলো। সে একাই ভেজা শরীল নিয়ে বাজারের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পায়চারি করতে লাগলো।
গোধূলি, তারপর সন্ধ্যারাত, তারপর রাত বাড়তে বাড়তে গভীর নির্জনতা নেমে আসলো। সারারাত গ্রামবাসী না ঘুমিয়ে উচ্চ শব্দে সংগীত গাওয়ার মতো করে তার শেখানো প্রতিজ্ঞা পাঠ করতে থাকলো।
বাড়ি বাড়ি থেকে প্রতিজ্ঞার সুর শোনা যেতে গেলো স্পষ্টভাবে। সেও নিজের বানানো প্রতিজ্ঞা জপ করে নিজের দেহে মনে পরম শক্তি যোগান দিয়ে চলল।
দেখতে দেখতে অন্ধকার রাত পার হয়ে ভোর চলে আসলো। ভোর হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত এলাকায় যত মানুষ ছিলো, নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-কিশোর সবাই অতি শৃংঙ্খলার সাথে সৈনিকদের মতো বাজারে এসে লাইন দিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো।
সে দেরি না করে উচু মাটির ঢিবির উপর উঠে বলা শুরু করলো, আপনারা অতি গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনবেন। এবং সেই অনুযায়ী কাজ করবেন।
প্রথম কথা হচ্ছে, এখন থেকে উপস্থিত আমরা সকলে এক মানুষ। আমাদের শত শত হাত একত্রিত হয়ে দুইটা হাত হয়ে গেলো। শত শত পা একত্রিত হয়ে দুটি পায়ে পরিণত হলো। শত শত আত্মা মিলিত হয়ে একটি আত্মায় পরিণত হলো। সর্বোপরি আমরা একাকার হয়ে একটা মহৎ মহান অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হলাম।
আপনাদের উদ্দেশ্যে আমার শেষ কথা হচ্ছে, আমরা এখন এই মুহূর্তে পৃথিবীতে শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত করবো। আমি সবার আগে বাজার থেকে বেড়িয়ে রাস্তা দিয়ে শহরের দিকে হাঁটা শুরু করবো। আপনারাও সবাই তুমুল প্রাকৃতিক শক্তির মতো আমার পেছনে হাঁটতে থাকবেন। তারপর আমাদের হাঁটা দেখে বাড়ির পর বাড়ি, গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর থেকে ছোট বড় বৃদ্ধ বৃদ্ধা শিশু কিশোর সমস্ত মানুষ সে শৃঙ্খলাময় হাঁটায় অংশ গ্রহণ করবে। সেই অসীম শক্তি ডাকে কেউ ঘরে থাকতে পারবে না।
ধীরে ধীরে আমরা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক শহর থেকে অন্য শহর, এক দেশ থেকে অন্য দেশ, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশের সব জায়গায় আনাচে কানাচে যতো অন্যায় অবিচার লুন্ঠন হত্যা ষড়যন্ত্র দখলদারিত্ব ঘুষ ধর্ষণ সকল প্রকার অন্যায় ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপর অন্যায়কারীরা এসে একের পর এক আমাদের সামনে মাথা নিচু করবে। কিন্তু সাবধান কাউকে হত্যা করা কিংবা আঘাত করা যাবে না। তাদের ধরে পৃথিবীর এক প্রান্তে আলাদা দেশ তৈরি করে চরিত্র সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে।
সেই দেশের সাথে ভালো মানুষদের দেশের কোনো প্রকার সম্পর্ক থাকবে না। তবে সেই দেশে তারা মুক্তভাবে জীবন ধারণ করতে পারবে।
যারা বিশুদ্ধ হতে পারবে তারাই শুধুমাত্র মানুষ সমাজে ফিরবে। অন্যথায় মৃত্যু পর্যন্ত তাদের অমানুষদের পৃথিবীতে বসবাস করতে হবে।
আব্দুল আলিম
কথাসাহিত্যিক
0 Comments