ছন্দা দাম এর ‘ঠিকানা বিহীন’ ও অন্যান্য পাঁচটি কবিতা

 

Chanda Dam's 'Thikana Beyhin' and five other poems


মা... বেশি কিছু বলব না আজ

তোমাকে দেখতাম সবার পরে খেতে,সবার পরে ঘুমাতে ,
আব্দারটাও শুনিনি কোনদিন ক্ষীণ হয়ে আসা কণ্ঠে,
তবু তুমি লড়ে যেতে সকাল থেকে,ঝরে যেতে রাত পর্যন্ত,তবু বুঝতে দিতে না,
তুমি তাই নাইটিংগেল আমার প্রদীপ জ্বেলে জেগে থাকা ক্ষতদের ঘুম পাড়াতে।

তোমাকে দেখতাম পরিপাটি রান্নায়, পরিচ্ছন্ন ঘরকন্নায়,
কুরুশের কাটা, অথবা উলের সখ্যতায় 
নিখুঁত কাব্য লিখে যেতে সোয়েটারে অথবা মাফলারের সোজা উল্টায়, 
এখনো চিৎকার করে কাঁদতে চেয়ে... মা বলে ডাক দিলে...
বুকের বাঁদিকের রান্নাঘর জ্বালানো চুলার কাছ থেকে জবাব আসে...
কাঁদিস না আমি আছি তো,

এখনো অভিমান করে লুকিয়ে চোখের জল ফেলতে চেয়ে
আকুল বুকের মাঝখানটায়...
 তোমার হলুদ মাখা আঁচলের গন্ধ আসে মা,
শুনো মা আমি একা হই না,হই না কাহিল, কখনো ভেঙে পড়ি না,
তবে ভালোবাসি যাকিছুকেই তার মাঝে খুঁজে পাই তোমার মুখের আদল,
এইখানটায় তুমি আমায় করে রেখেছো দূর্বল মা আমার,
এইখানটায় তুমি আমার মানুষ করে রেখেছো মা আমার,

এইখানটায় তুমি মাতা ধরিত্রীর মতোই অসহায়,
হয়তো আমি ও তাই, বুকে জাপটে ধরা মাটির ঢেলাটাকেও
ছুড়ে ফেলতে শেখাওনি,
  এভাবেই ভালোবাসতে শিখিয়েছ তুমি আমায়।।





শুধু তোমার জন্য 

একমুঠো মাতাল ইচ্ছেকে কথা শুনিয়ে তোমার কাছে পাঠিয়েছিলাম,
বলেছিলাম- পোষ মানাও, এ  শুধু তোমার জন্য,

একটা অগোছালো কবিতার বুকে জুঁই ফুল আর
গোধূলির সুবাস মাখিয়ে তোমায় পাঠিয়েছিলাম,
বলেছিলাম...পাঠালাম,হাত বাড়িয়ে দাও...
এ শুধু তোমার জন্য

একটা আস্ত উদভ্রান্ত নদীকে বুকে জাপটে ধরে তোমার
ঠিকানায় পাঠিয়েছিলাম,
বলেছিলাম...বন্যা আসবে কিন্তু...সামলে নিও...
এ শুধু তোমার জন্য,

তুমি আলগোছে পাঞ্জাবির বুকপকেটে রাখা চিরকুটে 
এদের ভাঁজ করে রেখে দিলে ঘুম পাড়িয়ে,
                 দেখো কি অনাসৃষ্টি হয়ে গেলো!!!
ইচ্ছেরা যে আর ঘরছাড়া ঘুড়ির মতো ভোকাট্টা হয়না !
অগোছালো কবিতারা আর কলমের ঠোঁট ছুঁয়ে উদাস হয়না
উদভ্রান্ত নদী যে তার নৃত্যের বোল ভুলে থমকে  আছে গেয়ো ঘাটে!!

কেন করলে এমন বলবে আমায়???
কেন নিয়মভাঙা আলুথালু মনটাকে হিসেবী দাবার ঘুঁটিতে বন্দী করলে... 
তার চৌষট্টি ঘরের মধ্যেই!!

সে যে আর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বলতে পারছে না...
শোনো.....আমি যে  সব পারি....শুধু তোমার জন্য !!





নিয়তি 

হাতের মুঠোয় একটা আকাশ
বুকের খাঁজে সোঁদা মাটি,
আমার ভেতর আস্ত শহর
আমি তবু একাই হাঁটি।

কেন যে মনটা শিশুর মতন
বায়না করার সাধ জাগে,
আমার উঠোন,পুকুর ঘাটে 
স্মৃতিরা হাতছানিতে ডাকে।

আকাশে আঁধার ঘনিয়ে এলে
ঝমঝমিয়ে নামলে বারিষ,
হলুদ মাখা আঁচল ডাকে...
"ঘরে আয়, কোথায় থাকিস!!

মানুষগুলো আপনমনে
ক্ষতে মাখায় মায়ার মলম,
আপন পরের সমীকরণটা
ভুল হয়ে যায় বেমালুম।

জীবন তুমি মরিচিকা যেন
যত এগোই হারায় অস্তিত্ব,
মাটিতে মেশে সকল অহং
হারিয়ে যায় সব আমিত্ব।

সন্ধেবেলায় মঞ্চে প্রদীপ...
দরজায় কেউ যেন প্রতিক্ষায়,
হিসেব নিকেষ লাভ ক্ষতি যা...
চোখের পলকে সবই হারায়।।




বাঁচিয়ে তুলবে আমায়

আমার ভীষন প্রিয় ফুলটি তোমায় উপহার দিলাম,
তুমি বললে- না এই বুনো ফুলটি আমি ভালোবাসি না, গোলাপ আমার প্রিয়।
আমার প্রিয়তম পাখিটিকে তোমায় হাতে সপে দিলাম,
তুমি বললে- এর পালক আমার পছন্দ নয়, 
আমি ঐ সোনালী ডানার পাখি ভালোবাসা।
আমি আমার প্রিয় পাহাড়ি ঝোরাটিকে অঞ্জলী ভরে যায় উপহার দিলাম তোমায়,
তুমি বললে- না এতো শীর্ণকায় ঝোরা পছন্দ নয় আমার,
আমি ওই উচ্ছল ঝরণাটাকে ভীষণ ভালোবাসি,
আমি বুকের বাঁদিকটা চিঁড়ে জীবন্ত হৃদয়টা তোমায় সঁপে দিলাম,
তুমি বললে- না না এই হৃদয়ের এমন প্রাণস্পন্দন আমায় টানে না, 
আমার প্রাণোচ্ছ্বল হৃদয় সবচেয়ে বেশি প্রিয়।

আমি তোমার দিকে তাকিয়ে রইলাম....
          কি বলি ,কি দিই, কি বোঝাই তোমায়!!
আমার স্তব্ধ নিস্পন্দ চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লো,
আমি যে কখন পাথর হয়ে গেলাম,নিজেই জানি না!!
আমার পাথর হৃদয়টা যে বাঁচতে ভুলে গেছে !!
তোমার কাছে  মৃতসঞ্জিবনী আছে?
বাঁচিয়ে তুলবে তুমি আমায়?? 
বোলো???




ঠিকানা বিহীন 

হেটে যাই নিদ্রাহীন পায়ে...
কোথায়,কোন ঠিকানায়,
কোন গভীর নিবিড় ছায়াদার অশ্বত্থের ছায়ায়?

জিড়োবার স্থান পাবো কি?
পাবো কি চিরশান্তি,চির প্রাণের আরাম?
চলছি অবিরাম, অবিশ্রাম,অনন্ত পথের দিকে।

ডাকহরকরাকে জানিও না , আবিষ্কার করতে 
চেও না আমার গন্তব্য,
সে জানাবে কি করে?সেও তো কালের চুপচাপ ঠোঁটের.. 
নিরব কথাগুলোকে কাঁধে বয়ে ফিরছে অত যুগ থেকে।

কতো ঠিকানা খোঁজার দায়িত্ব তার মাথায়,
কত করুণ পরিস্থিতি তার ভাবো!!
নিজের ঠিকানা কবে খুঁজবে সে?
কিছু অর্থহীন শুকিয়ে যাওয়া কথার ফুলেদের সাজি নিয়ে সে ফিরছে!!

যদি কোনদিন ঠিকানা খুঁজে পায়,
হয়তো দেখবে সেই ঠিকানার মানুষটি বদলে গেছে!
ভেবে দেখো একবার!!!
**************************




ছন্দা দাম
করিমগঞ্জ, আসাম

Post a Comment

0 Comments