সে থাক তার মতো করে
পৃথিবীর গড়ে তোলা তারকাঁটা ডিঙিয়ে, দূর দিগন্ত থেকে স্মিতস্বরে ডেকেছিল সে। প্রত্যুত্তরে ঈশারায় সাড়া দিয়েছিলাম; সেও প্রায় সুদীর্ঘকাল!
ক্ষীণাঙ্গী। শ্যামবর্ণা। ইশত চাপা নাক। হরিণী চোখে মায়াবী দৃষ্টি। হৃদয় ভোলানো হাসি।
ওর সর্পিলি ঘন-কালো কেশে বিলি কেটে আমি স্বর্গ খুঁজে পাই, অনাবৃত স্ফীত বুকে বুক রেখে, প্রাণের ভেতর প্রাণ খুঁজে পাই ; ওর অস্থির উচ্ছল যৌবন জোয়ারে স্নান সেরে আমি পবিত্র হই!
রূপটাকে মানুষ না ভেবে, মানুষের ছায়া ভেবেছি। হৃদয়ের বিনিময়ে, বিশ্বাসের শর্ত দিয়ে ভালোবাসার মূল্য খুঁজি। তাকে ঘিরে অহর্নিশ উৎকণ্ঠা হীন জীবনের স্বপ্ন বুনি।
তবুও কেন মন হয় আজ-
লক্ষ্যহীন হয়ে, আমি কী কুয়াশাচ্ছন্ন দুর্গম পথের দিকে এগিয়ে চলেছি?
নাকি প্রেম-ভালোবাসা মনে ভেবে-
নীশাপাওয়া উদ্ভ্রান্তর মত, ক্রমশঃই নিরুপায় মিথ্যে প্রহেলিকার পিছনে ছুটে চলেছি!
কতটা গভীরে নিয়েছে সে আমায়-
তার বুকের কতটা পাঁজর জুড়ে অবাধ ক্ষরণ?
তবুও কেন মন হয় আজ-
সে কি ভুলেগেছে আমায় ?
এত স্মৃতি, যত সংগোপন লম্হা, কিছুই কি মনে নেই তার; নাকি অভিমানে গেছে ফিরে মুছে দিয়ে পিছুটান ?
আমি স্বপনে দেখেছি তারে।
ব্রহ্মক্ষণে চোখ মেলে দেখি, বিছানায় পড়ে আছে কতক স্পর্ধিত সঙ্গম-
এ' সঙ্গ ভুলে যাওয়া যে অসহ্য যাতনাময়-
আমার পাঁজরের গভীরেই সে থাক, তার মতো করে...
নৈঃশব্দ্য
ওর তো কোন পাসপোর্ট-ভিসার প্রয়োজন হয় না। ডানা ঝাপটা দিয়ে এই বুঝি এলো কোন কপোত, ঠোঁটে করে তোমার বার্তা নিয়ে -এমনটাই ভেবে ভেবে তোমার উত্তরের অপেক্ষায় নির্বোধের মত হাপিত্যেশ নিয়ে বসে থাকি।
মনের ভেতরে, ভালোবাসার আত্মবিশ্বাসের শিখা ঘুরে বেড়ায় আর আমার যত অনুনয়, ভালোবাসার হৃদয় সিক্ত গুজারিস; তোমার নৈঃশব্দ্য'র কুয়াশায় ঢেকে যায়!
তবু জানি সম্পর্ক সেটাই- যেখানে ঝগড়া, মান-অভিমান অনেক; তথাপি কেউ কাউকে ছেড়ে যায় না। এমনই এক অলীক বিশ্বাসের প্রত্যয় জ্বলে ওঠে আমার হৃদয় থেকে স্নায়ু, স্নায়ু থেকে হৃদয় বিবরে।
মন গুমরে গুমরে বলে, ভালোবেসে আমি হেরে যাইনি, সত্যকারের ভালোবাসায় যে কষ্ট আছে; তার প্রমাণ পেয়েছি।
আমার মৃত্যুসংবাদ পেলে কোন অভিযোগ কোরো না,
বরং
মুচকি হাসি হেসে বোলো- আপদটা বিদায় নিয়েছে ...
যখন তুমি মায়ের বাসায়
তোমাকে নামধরে ডাকা নিয়ে, বরাবরই আমার প্রতি তোমার অনুযোগ থেকেছে। তুমি বাবার বাসায় চলে যাবার পর আজ হঠাৎ-ই মনে হ’ল, ‘আফ’ যেন বড্ড ধমকানো’র শব্দ, তাই ঠিক করেছি; তুমি ফিরে এলে, 'সানা' বলে ডাকবো তোমায়।
বাংলা অভিধানে সানা শব্দের অর্থ খুঁজলে, সেখানে লেখা দেখবে - সুন্দর, পবিত্র, মহান।
একান্তে তোমাকে যেভাবে আমার বুকে ভরে আদর করি, ভালোবাসি, রুপোলি তরঙ্গের মতো যৌথ আলিঙ্গনে আমরা মেতে উঠি; যেমন আমার বাহু আদিম উচ্ছ্বাসে তোমার মোহিনী শরীরটাকে জাপটে ধরে উন্মুক্ত স্তনের খাঁজ বেয়ে, তোমার বিভঙ্গে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাই; তেমনই হৃদয়ঙ্গমের পবিত্র নাম।
ভালোবেসে আমাকে কি বলে ডাকবে! তুমি বরং, আমায় অভিজাত মুসলমানের উপাধি- 'মীর্' বোলো।
তুমি এখন বড্ড আদরে মা-বাবার বাসায় বেশ আছো। জানো, এই পৃথিবীতে সে বড় ভাগ্যহীন, যার মা নেই!
সে'বার যখন তোমার সাথে বাবার বাসায় এসেছিলাম,
হঠাৎ-ই যখন ঝমঝমিয়ে মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছিল, বাইরে থেকে জলে ভেজা শরীরে আমি ছুটে এসে
উঠোনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম;
আর তোমার হৃদয়ে আমার ফিরে আসার অনুভব হতেই, ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে অলিন্দে এসে দাঁড়িয়ে, ছাদ চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির রিম-ঝিম ধারা, অঞ্জলি ভরে আমার শরীরে ছিটাতে ছিটাতে; অট্টহাসি হেসে হেসে এক অলীক আনন্দে মেতে উঠেছিলে তুমি!
মনে পড়ে তোমার?
বেশ মনে পড়ছে-
অভ্যাস মত খুব ভোরে যখন তোমার ঘুম ভেঙে যায়, তুমি তখন আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যাও পূবের জানালার দিকে। জানালা খুলতেই প্রভাতের প্রথম সূর্য তোমার গাল-কপালে চুম্বনে আদর লেপে দেয়, আর তুমি আবেশে বিহ্বল হয়ে জানালার পাশে কেদারায় বসে, সূর্যের লুকোচুরি খেলা দেখায় মেতে ওঠো। রসুইঘর থেকে মা হাঁকেন- 'খুকি, - মা, চা নিয়ে যা বেটা ...'
বেখেয়াল তুমি, জানালার বাইরে সবুজ সমারোহ'র দিকে অনিমেষ তাকিয়ে বিভোর হয়ে যাও-
কখনো দখিণদুয়ার হাট করে আঙিনার আমলকি গাছ পেরিয়ে, কাঁঠাল-জামরুল গাছের মাঝ থেকে ছোট্ট কিশোরীর মত; ছুটে বেরিয়ে পড়ো বাবার তৈরি বাগান এর দিকে-
হেসে-গেয়ে অমোঘ ছন্দে দুলতে দুলতে, এ'গাছ থেকে সে গাছের পাতা, ফল, ফুল, চড়ুই, দোয়েল, শারিকার সাথে আলাপ করে ফেরো। কখনও আম বাগানে প্রায় ভূমি ছুঁয়ে থাকা আম গাছের মোটা ডালে ঝুলে দোল খেতে খেতে, স্নিগ্ধ মধুর দখিনা হাওয়ায় সবুজ সমারোহের মাঝে নিজেকেও যেন বিলীন করে দাও।
আবার কখন সিঁড়ি বাঁধানো পুকুরঘাটে পদপ্রান্ত ডুবিয়ে জলকেলি'র আমোদে মাতো ...
পশ্চিম পাড়ার সোফানচাচা লাঙ্গল কাঁধে যেতে যেতে বলে, ‘বিটি’টো ডানপিটে হলেও বড় সুন্দর হইছে। বড্ড ছেলেমানুষ! যেন প্রকৃতিকন্যা!’
লজ্জায় তুমি থমকে দাঁড়াও, মুখ ঢেকে নাও আঁচলে।
তবে যাই বলো- গ্রামে মানুষের মাঝে যতটা ঘনিষ্টতা, যতটা প্রশান্তি; শহরে ইঁট বালি সিমেন্টের মাঝে, জন অরণ্যের ভিড়ে সেই শান্তি সুখের পরিবেশ; কোত্থাও নেই।
মা-বাপে'র বাসায় যেন ভিন্ন এক অবাধ স্বাধীনতা।
সারাদিন ছেলেমানুষের মত দৌরাত্ম্য করে, দিন শেষে মায়ের কোলে ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিয়েছো যখন;
বিছানায় আমার শরীরের ঘ্রাণ পেয়ে, এক অস্থির-আকুল'তায় ভাবতে ভাবতেই বুকের মাঝে পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে আলুলায়িত তুমি, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছো এখন ...
অথচ এখানে আমি একা, দিন কাটতে ই চায় না যেন।
তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ছে, তুমি আজ পাশে নেই, অথচ ঘরে সমস্ত কিছুতেই তোমার স্পর্শ মাখা;
প্রতিমুহূর্ত সর্বত্র তোমার দুঃসহ শূন্যতা ঘিরে রেখেছে।
কোন ভাবেই কোন কাজে মন বসাতে পারছি না। তুমি নেই বলেই, ঘরটা আরো বেশি অবিন্যস্ত হয়ে রয়েছে।
ফিরে এসে ঘরের হাল দেখে রেগে যেওনা যেন। অবশ্য তুমি রেগে গেলে, তোমাকে আরও বেশি কিউট লাগে!
আসলে, ঘরে কেবল একা পুরুষ থাকলে যা হয় ...
0 Comments