ফাতেমা ইয়াসমিন ।। গল্প ।। বিধানের ধর্ম উৎসব

Fatima Yasmin. Story. Law festival


সাথী ও সুমন দুই  ভাই বোন। ওরা দুই জন ৫ম শ্রেনীতে পড়ালেখা করে। সাথী ও সুমনের ক্লাসে পড়তো বিধান। বিধান সাথী ও সুমনের ভালো বন্ধু। ওরা তিন জন এক সাথে পড়াশোনা করতো, খেলা ধুলা করতো, সব কিছু মিলে মিশে করতো। কোন সময় ঝগড়া মারামারি করতো না। খুব ভালো ছিলো ওদের জুটি। বিধানের বাড়ি ছিলো সাথী ও সুমনের গ্রামের পাশের গ্রামে। পাশাপাশি গ্রাম হওয়ায়  সবসময় যাতায়াত সহজেই করতে পারতো তারা।

বিধান ছিলো হিন্দু ধর্মের। সাথী ও সুমন মুসলমান। কিন্তু তাদের তিন জনের মধ্যে ধর্মের কোন ভেদাভেদ ছিলো না। কিন্তু বিধানের বাবা-মা কখোন সাথীদের বাড়িতে আসে না। ঈদ বা কোন ধর্মীয়  উৎসবে আসেনি। সাথী, সুমনের ঈদের আনন্দে বিধান শরিক হতো। আর বিধানের পূজা পার্বণের উৎসবে সাথী সুমন। বেশ আনন্দে দিন কাটাতো তাদের তিন জনের বন্ধুত্বের মাধ্যে।

বিধানের  বাবা-মা ছিলো গোরা ধর্মভিরু। বিধানকেও বলে এখন বড় হচ্ছো মুসলমানদের সাথে মিশো কিন্তু ধর্মীয় উৎসবে যাবে না। বিধান বলে না তা কেনো সাথী ও সুমনের বাবা-মা তো এমন বলে না। আমরা সবাই মানুষ, বাংলাদেশের নাগরিক। সবার সাথে মিলে মিশে বসবাস করতে চাই।

একদিন গ্রামের একজন প্রবীনব্যক্তি, মসজিদে আজান দেন, এবং ছোট ছেলে মেয়েদের আরবি পড়ান। নাম তার চেরাগআলী। সাথীর বাবাকে ডেকে বললেন - শোনো তোমার দুই জন ছেলে মেয়ে, তারা সবসময় হিন্দু পাড়ায় উঠাবসা করে, তাদের বাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে, হিন্দুধর্মের সাথে মুসলমান ধর্মের যাতায়াত নাজায়েজ। তুমি একটা বিষয় ভেবে দেখো তো হিন্দুদের কখোনও  দেখেছো মুসলমানদের ঈদের দিন মুসলমানদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে? তোমাকে কিন্তু গ্রামের মানুষ ঠেক দিবে। আর তুমি মসজিদে নামাজ পড়তে, প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে।

সাথীর বাবা তো ভয়ে গা কাঁপা শুরু হলো; বলছেন- মুন্সি সাহেব ওরা বাচ্চা... ছেলেপেলে মানুষ, ওরা ধর্মের কি বোঝে তবুও আমি বলে দিবো যেনো না মিশে। বলে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলেন। সাথীর মা সাথীর মা বলে ডাকছেন, সাথীর বাবা। সাথীর মা বললেন, কি হয়েছে? আমাকে ডাকছেন? সাথীর বাবা বললেন ছেলে মেয়েদের আর হিন্দু পাড়ায় যেতে দিও না। বিধান কেও বলে দিও আমাদের বাড়ি না আসতে। গ্রামের মানুষ পছন্দ করছে না হিন্দুদের সাথে মেলামেশা। সাথীর মা বললেন ডেকে বাচ্চাদের বিধানের সাথে না মিশতে আর তাদের বাড়িতে না যেতে। সাথী সুমন মন খারাপ করে ঘরে চলে গেলো। 

পর দিন সাথী সুমন গেলো। স্কুলে যেতেই বিধান ডাকছে সাথী সুমনের সামনে এসে দাঁড়াল বিধান। বলতে লাগলো- সামনে সপ্তাহে পূজা শুরু হবে। এবার পূজার প্রথম দিন থেকেই তোরা আমার বাড়িতে থাকবি। মা বলেছে। অনেক মজা হবে। কিরে তোরা খুশি হোসনি? কথা বলছিস না যে? চুপ করে আছিস যে? সাথী ও সুমন মাথা নিচু করে চোখের পানি পড়ছে আর বলছে... বিধান আমরা আর তোর সাথে মিশবো না। বাবা মা নিষেধ করছেন। হিন্দু ধর্মের সাথে মুসলমাদের উঠা বসা, খাওয়া নাজায়েজ। বিধান ও কান্না শুরু করলো পিছন ফিরে সামনে চলে গেলে ক্লাসে। 

বিধানের সাথে  ক্লাসে কেউ ঠিক ভাবে কথা বলে না।

এভাবে কয়েক দিন চলতে থাকে। একদিন ক্লাসে শিক্ষক দেখলেন পিছনের লাইনে বিধান একা ক্লাস করছে।শিক্ষক বললেন  কি ব্যাপার বিধান তুমি একা পিছনে কেনো? সামনে এসে বসো। সবাই এক সাথে বলে উঠলো না না, ও হিন্দু ওর সাথে বসলে আমাদের বাবা মা মারবে। আর বাবাদের মসজিদে নামাজ পড়তে দিবে না। শিক্ষক বললেন, থামো তোমরা! এ সমস্ত বাজে কথা কে বলেছে? আমাদের এই দেশ সকল মানুষের স্বাধীন ভাবে চলাফেরা ও মত বিনিময়ের অধিকার আছে। সকল ধর্মের উৎসব পালন করার অধিকার আছে। সকল ধর্মের প্রতি সম্মান জানানো দেশের প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। 

বিকেলে স্কুল শেষে প্রধান শিক্ষক সাথী ও সুমনদের বাড়িতে গেলেন এবং বাবা মাকে ডেকে বোঝালেন। সাথীর বাবা বললে, স্যার আমার মতে গ্রামের সকল অভিভাবকদের নিয়ে একটা মিটিং ডাকলে ভালো হতো। আর সেখানে গ্রামের মাতামুরুব্বি, মসজিদের ইমাম উপস্থিত করলে, বিষয়টা ভালো করে বোঝালে ভালো হতো।

পর দিন স্কুল মাঠে অভিভাবক সভার আয়োজন করা হলো। সেখানে হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান ধর্মের সকলের উপস্থিত থাকবে।গন্যমান্য, ইমাম-শিক্ষক সহ সকলে উপস্থিত। বিধানের বাবা মা ও সাথীদের বাবা মাকে ও উপস্থিত হলেন।

প্রধান শিক্ষক বললেন, শুনুন আমার প্রিয় গ্রামবাসি- আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এ দেশকে আমরা দুইবার স্বাধীন করেছি। হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে। সেখানে লাল রক্তের মাঝে কি কোন হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান নাম লিখা ছিলো? সবাই দেশের জন্য বুক পেতে দিয়েছিলাম। তখন কি হিন্দু, মুসলমান খৃষ্টান ভেদাভেদ ছিলো? কি বলেন সবাই? তবে কেনো আজ হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান ধর্মালম্বীরা স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে পারবে না?

সবাই বলে উঠলো আমাদের ভুল হয়ে গেছে। এমন আর হবে না। আমরা স্বাধীন, আমরা সবার সুখে দুঃখে মিশে থাকবো। বাংলাদেশ সকল  ধর্মের অবদান আছে, সব ধর্মের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।

যার যার ধর্ম তার তার পালন করার অধিকার আছে ।কিন্তু উৎসব সবার জন্য। 

তারিখ -১১/৮/২০২৪

Post a Comment

0 Comments