আশপাশের ঘরবাড়ি গাছের ডালপালা এখনো কাঁপছে। কিছুক্ষণ আগে বিস্ময়কর কিছু ঘটে গেছে। মানুষ জড়ো হচ্ছে। কোলাহল হবে। কেউ কোন মন্তব্য না করে ভীরু মনে ফ্যাল-ফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে।
গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে ছুটে এসে ময়া বলছে, প্রবল প্রকট শব্দ শুনে ছুটে এলাম। এমন শব্দ কোনদিন শুনিনি। কে করল আজগুবি শব্দ। শব্দের পর মেঘগুলো আগের মতো উড়ছে। বাতাস দুলতে-দুলতে চুলে আলতো ধাক্কা লাগিয়ে ফিরে যাচ্ছে। পাশের নদীতে যেরকম জলধারা চলছিল- চলছে। পাখিদের সুর বাতাস বয়ে নিয়ে আসছে সবুজের স্তুপ থেকে। আকাশের উপরের আকাশে গ্রহ নক্ষত্র ঘুরছিল, এখনো মহানন্দে ঘুরছে। সব-তো ঠিকই আছে। সবার মনে প্রশ্ন একটাই, অদ্ভুত, বিকট, প্রকট আশ্চর্য শব্দ কিসের।
ময়া অবাক হয়ে কারো কাছে কোন উত্তর না পেয়ে মরমী আত্মার কাছে যেয়ে বলল, আপনি অদেখা আজগুবি খবর জানেন। যে সংবাদ কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সে সব সংবাদ খুব সহজে বলতে পারেন।
আত্মা বলল, না, এটা আপনার ভুল ধারণা। এসবের কিছুই পারি না।
আত্মার কথা ময়া বিশ্বাস করল না।
ময়া হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের বাড়িতে ফিরে যেয়ে বলল, ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনলাম। আত্মা নিজের দোষ স্বীকার করছে না। কিসের শব্দ জানার জন্য কত অনুরোধ করলাম। তবু সে নির্বিকার।
ময়া হতাশ হয়ে ফিরে গেলেও আত্মার কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আত্মা ময়ার অস্থিরতা দেখে ভাবছে, সামান্য শব্দেই তোমরা ভয় পেয়ে মানুষ জড়ো করে, ছুটাছুটি করো। যেদিন পৃথিবী ধ্বংস হবে। পাহাড় উপড়ে, সমুদ্রের পানি ফুলে উঠবে। মাটি ফুঁড়ে আগুন চলে আসবে। সেদিন তোমাদের কি অবস্থা হবে।
ময়া বাড়িতে ফিরে আসা মাত্র বাঁধ ভাঙা জলের মত পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে মানুষ আসতে থাকল। ময়ার প্রতিবেশী খয়া বলল, অঝোর বৃষ্টির দিনে বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর শব্দ শুনেছি। মেঘেদের কড়-কড়, গুম-গুম, গুরুম হুংকারে মায়ের শ্রান্তিময় শাড়ির আঁচলের নিচে ডুবেছি। কিন্তু এমন অবাক করা বিকট শব্দ কোনোদিন শুনিনি। ভোরের দোয়েলের শিষের শব্দ, বসন্তে পক্ষিদের সুমধুর গায়কী, চৈত্রের জোৎস্না রাতে সবুজ ধানমাঠের আইলে বসে পতঙ্গের ডাক, ছোট ঝোপের অন্তরালে লুকাতে যাওয়া ডাহুকের নরম পায়ের আঘাতে জলের ছলাৎ-ছলাৎ আনন্দদায়ী আওয়াজ শুনেছি।
আমার পূর্বপুরুষরা বলত, তারাও জীবনভর অনেক শব্দ শুনেছে। সেই সমস্ত শব্দের সহজ বর্ণনা কত ভালো লাগত। তবে আজকে, মহাকালের যাত্রাপথে কি এক শব্দ শুনলাম যার অপরিচিত আওয়াজ আগে কেউ কোনোদিন শুনতে পায়নি। পিঁপড়ার সারির মতো দলভুক্ত হয়ে মানুষ এখনো আসছে। কেউ আসছে হেঁটে, কেউ দৌড়ে, কেউ গাড়িতে, আবার কেউ ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে-কচলাতে আসছে। এসে এক জায়গায় জলের মতো জমা হচ্ছে। সবাই একই কথা বলছে, এমন ভয়ঙ্কর উদ্ভট বিদ্ঘুটে প্রবল প্রকট শব্দ কোনোকালে শুনিনি।
একজন আগন্তুক চিৎকার করে সবার উদ্দেশ্য বলল, কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া শব্দের বর্ণনা কে ভালো দিতে পারবেন?
তার কথা শুনে মা বলল, আমি বাড়িতে ছিলাম। শুনলাম শব্দের আঘাতে এখানে অনেক মানুষ মারা গেছে। এজন্য পরিবারের কাজ ফেলে ছুটে এসেছি। তবে আমার চেয়ে আরও ভালো বলতে পারবে এক প্রতিবেশী। সে আরেকজন প্রতিবেশীর কাছে আগেই শুনেছিল গগণবিদারী প্রকট বিকট শব্দের কথা।
উনার কথা শুনে আগত সবাই বলল, বলেন কী?
ময়া না আসা পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না।
ভোর থেকে লোকজন জমা হচ্ছে। সকাল পেরিয়ে যাচ্ছে। মানুষের ভীড় বেড়েই চলেছে। সমগ্র পৃথিবীতে শব্দের কথা শব্দময় হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে মানুষ আসতে শুরু করেছে। হাজার হাজার লক্ষ রকমের মানুষ আসার কথা শুনে শাকেরী বলল, পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে মানুষ আসছে। আমরা তাদের জন্য অপেক্ষা করি। তারা আসলে হয়তো জানা যাবে কেন অদ্ভুত শব্দ হয়েছে।
এরই মধ্যে আফ্রিকার তানজানিয়া থেকে শাকেরের মরমী আত্মার কাছে ফোনকল এল।
বলল- আমি হাশেম কান্দা বলছি। শুনেছি আপনাদের দ্যাশে বিকট শব্দ হয়েছে। শুনলাম সমস্ত পৃথিবী থেকে মানুষ জড় হচ্ছে। সেজন্য আমার পরিবারসহ রওনা হয়েছি, কেউ বাড়িতে যাবেন না।
হাশেমের কথা শুনে লোকজন সমস্বরে চিৎকার করে বলছে, সে যদি তানজানিয়া থেকে আসতে পারে। আমাদের এখানে অপেক্ষা করা উচিত।
মরমী আত্মার অতি ভালবাসার বউ ধানমাঠের ধারে সবজিবাগানে কাজ করছিল। তার হাতে কাস্তে। দেহে হালকা কাঁচা মাটি লেগে আছে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে একজন প্রকৃত কৃষাণী। শাকেরের আত্মা তাকে আসতে দেখে দৌড়ে যেয়ে বলছে- তুমিও এসে পড়লে।
শাকেরের বউ বলল- না এসে কী করব। সমস্ত গেরামে সাজ-সাজ রব পড়ে গ্যাছে। আর একটু পড়ে দেখবা এই জাগায় মানুষের ঘনিষ্ঠ ভিড়ে কি ঘটে।
এখনও সকাল শেষ হয়নি। আমার ধারণা সূর্য্যি মামা মাথার উপরে আসার আগেই পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এখানে পৌঁছে যাবে। চীন জাপান মালয়েশিয়া থাইল্যান্ডে, একটা মানুষও ঘরে নেই।
বৃদ্ধ শিশু যুবক-যুবতী রওনা হয়েছে বুলেট ট্রেনে। ট্রেনগুলো ছুটে আসছে শব্দের চেয়ে কয়েক গুণ দ্রুতগতিতে।
গ্রামের উত্তর পাড়ার এক বন্ধু বলছে- আমি বাড়িতে যাচ্ছি মাটির কলসে জল ভরে আনতে। আফ্রিকান হাশেম আসার পর যেন জলে কষ্ট না পায়। আফ্রিকা হলো মরুভূমিময় শুষ্ক এলাকা। শুনেছি সেখানে খাবার জলের অনেক অভাব থাকে।
আস্তে আস্তে মানুষের ভিড় আরো বাড়তে থাকলো।
যেই আসছে জিজ্ঞেস করছে- শুনলাম বিকট শব্দ হয়েছে। আমাদের অবশ্যই জানতে হবে এত ভয়ংঙ্কর শব্দ কেন হলো। পশ্চিম আকাশে মেঘ করে এল। অল্প সময়ের মধ্যে মেঘগুলো ঘনীভূত হয়ে টলমল করতে থাকলো জল নিয়ে। জড়ো হওয়া মানুষগুলো মেঘের কালো ভয়ংঙ্কর রুপ দেখে চিৎকার করে বলতে থাকলো- মেঘের ভাব ভালো নয়। আমরা বৃষ্টিতে ভিজতে চাই না। এদেশীয় মেঘের জল শরীরে সহ্য হবে না। এটি বৃষ্টিময় একটা দেশ। বৃষ্টির সাথে শিলাবৃষ্টিও হয় মাঝে মাঝে। মানুষের চিৎকার চেচামেচির সঙ্গে আকাশের মেঘ আরও ঘন হতে থাকল। প্রচণ্ড তুলকালাম বাতাস এসে মেঘকে ঝাঁকুনি দিল। উড়ন্ত মেঘমল্লারা শিশুর হাতের ঘুড়ির মতো অসহায়ভাবে আকাশের এদিক সেদিক দাপাদাপি শুরু করলো।
মেঘের এলোমেলো ভাব দেখে মরমী আত্মা মৃদু হাসতে-হাসতে মাঠের দিকে যাচ্ছে। তার চলে যাওয়া দেখে ভারতের তামিলনাড়ো এলাকা থেকে আগত কৈলাশ বলছে- ওগো আত্মা আপনি আমাদের ফেলে চলে যাচ্ছেন কেন? আমরা-তো মেঘ দেখে ভয়ে কাঁপছি। কালো ঘন রাক্ষুসে মেঘ দেখে আপনার ভয় করছে না? একা-একা ধান মাঠে যাচ্ছেন।
কৈলাশের কথা শুনে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না, মিচকি হেসে চলে গ্যালো ধানমাঠে। মাঠের গভীরে যেয়ে উঁচু টিলার মতো জাগায় বেগুন ক্ষেতের ভেতর থেকে আত্মা পেছন ফিরে বোঝার চেষ্টা করছে আনুমানিক কত মানুষ জমা হয়েছে। তার কাছে মনে হলো- সে মানুষের মহাসাগর দেখছে। যেমন করে নদী, সাগর, খাল, বিলের জল গিয়ে এক সাগরে জমা হয়। আস্তে-আস্তে মেঘের তর্জনগর্জন বাড়াতে মানুষ এদিক-সেদিক ছুটতে থাকলো। ধানগাছ গুলো বাতাসের প্রবল দাপটে কাদার নরম শরীরে প্রায় শুয়ে পড়ছিল। পরম আত্মা মেঘের চঞ্চলতা দেখে অবাক হল।
খোলা বাতাস শ শ শব্দে ছুটে এসে তাকে বলল- ও আত্মা। বাঁচাও, বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও। কালো ভয়ার্ত মেঘ সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে। আত্মা শুধু হাসলো, কথা বলল না। প্রাণ ভরে দেখতে থাকল মানুষের নির্বুদ্ধিতা। তারপর ধানের জমিতে নেমে আবারও মনোযোগ দিল আগাছা পরিষ্কারে। কাজ শেষ করে বিকেলের দিকে সে বাড়িতে ফিরছে। হাঁটছে আর ভাবছে সারাদিন বাড়িতে যেতে পারেনি। সকালে তার বউকে দেখেছিল প্রকট শব্দের কথা শুনে ছুটতে।
0 Comments