নিষাদ নয়ন-এর ‘আমাদের বহির্মহল’ ও অন্যান্য পাঁচটি কবিতা

Nishad Nayan's 'Our outer space' and five other poems


আমাদের বহির্মহল


বেঁচে আছি, স্মৃতি আর স্বপ্ন-জড়ানো সামিয়ানার ছায়ায়

তবুও অসংখ্য উপদ্রুত স্বপ্নের ভিতর দিয়ে একঝাঁক

বুনোহাঁস উড়ে যায়- ‘সতত ডানার মানুষ’ হয়ে বারবার

আমাদের কেজো দিনগুলো বেশুমার ছুটছে আর ছুটছে

কতসব ব্যর্থ চিৎকারের নিচে চাপা পড়ে থাকে- হৃদিতল

আমাদের শরীরের দোকান খুলে বসে থাকার অহর্নিশ

বারবার চাঁদমুখী রাতের অপেক্ষায় ঘোর লাগা জোছনায়

ধোঁয়াশার মাঠ থেকে ছুটে যাচ্ছি শহরের ইশারার মতো

এইসব আত্মতাড়িত প্রেম ছাপিয়ে যেতে যেতে, ক্ষয় নিয়ে

ঢুকে পড়ছি জিরাফ-জিজ্ঞাসায়, অথচ চোখের কোণজুড়ে

না-ঘুমানো ঘুম লেগে থাকে, মনের প্রান্তরে ভিড় বাড়ছে,

যেন ডুবে আছি মানুষের কুয়াশায়, অন্তর্দাহে এক বহির্মহল

নির্মাণে-ভাসানে, কেবলই বহুল বীজ ছড়িয়ে-রুইয়ে দিই

তাড়িত আত্মনিনাদ, বিস্মরণের কাছে বাঁচতে শিখি অনুদিন

এ-পিচ্ছিল সময়ে ক্ষয়িত হাড়ের কাছে ক্যাকটাস ফুল ফোঁটে,

বেদনারা ফোঁড়ার মতো বিষকাঁটার পাশে হাসে প্রতিভাসে...





মেঘের তাঁবু


হয়তো একদিন আমরা জন্মেছিলাম অচেনা অর্কিড

বনের ভিতর

আর বেড়ে উঠেছিলাম উন্মন মজা পুকুরের জলজ

কচুরিপানার মধ্যে

অথচ এখন সে-ই আমরাই গাঢ় জীবনের ভিতর ঝুলে

আছি অজস্র হ্যাঙ্গারে

মনে হবে, উড়ছি ফুরফুরে পাকনায় চড়ে, কেবলই

দৃশ্যের মতো উড্ডীন

কতদিন অতলান্ত অন্ধকারে ডুবে গেছি সানুদেশের গভীরে,

ডুবে গেছি প্রদোষে

বস্তুত, আমাদের বিষণ্ন নৌকা, গলুইয়ের মতো বয়ে যায়

গোধূলিতে জলের ফোঁড় এঁকে

বিগত বসন্তের উজ্জয়িনীতে জলের ফোয়ারা ওড়ে, স্বপ্নের

ডানা মেলে মুহূর্তের মাঠে

কীভাবে স্মৃতির স্ট্রেচারে শুয়ে আছি দীর্ঘদিন, অন্তরিন

সূর্যাস্তের মতো একান্তে

ফেলে আসা বিকেলবেলার মতো আমাদের শরীরজ নুইয়ে

পড়ে সন্ধে তমসের দিকে

আর ছড়িয়ে পড়ে আত্মদোসর, রক্তকেশর থেকে উপচে

পড়ে ফুলের মাতাল ঘ্রাণ

ভিতর-বাইর থেকে আলাদা আলাদা আঙুলগুচ্ছের নৈঃসঙ্গ

ভেঙে দেয় কীটের কলোরব

তবুও, মেঘের তাঁবু উজ্জ্বল উষ্ণীষ নিয়ে বয়ে যায় নিরবধি,

হৃদয়ে জড়ানো মাফলারের মতো...




দূরের জংশন


অতঃপর সন্ধ্যায়, ধূসর বিকেলের বিড়ালগুলো নিঃসাড়ে

ঘুরে বেড়ায়, তাদের কোথাও বাধা-বিপত্তি নেই জেনে

সীমাহীন গতিবিধির মধ্যে, তারা শুধু নিজেকেই স্বয়ম্ভু

ডিঙিয়ে যেতে থাকে, প্রতিবেশী আঙিনার মতো লাফিয়ে


লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পার করে অসংখ্য রাত্রিকাঁথা

কতসব নিঝুম-নীরব পরিবেদনা পড়ে থাকা বর্ধিত বারান্দায়

ছাদের কার্নিশ বেয়ে স্বপ্নের ভিতর দিয়ে অভিগমন পেরিয়ে

যায় সীমান্তে, শরীরহীন অন্ধকারে রেডিয়ামের মতো তীক্ষè,

আলোময় চোখ দিয়ে দীর্ঘ কুয়াশার চাদর টপকে অনায়াসে

ঢুকে পড়ে হলুদ হাসপাতালের করিডোরে, সব কুয়াশা কী

শীতের তাঁবু, নাকি আমাদের দূরের কোণে জনহীন জংশন

মনে হয়, গভীর মোমঘর থেকে গলে যাওয়া জোছনা রাতের

আছোড় লাগা, পাখির ঝরে পড়া পালকেরা, যেন কথার

করতলে শুয়ে থাকে বর্ণবিহীন, কথাদের বিষাদে সুরতহাল,

উজ্জ্বল মিনার জাগে হেমন্তের রাতে, কালান্তরের সাপ ছোবল

মারে চাঁদের গায়ে, সালতামামির বরফ গুঁড়োর মতো ওড়ে

তব্ধুসঢ়;ও নাবিক, স্বপ্নের বাজারজুড়ে ওড়ে ঘুমের বন্দর, অজস্র

সামিয়ানার নিচে ঘুমিয়ে থাকে সুখচর-বালিয়াড়ি চৌচির...





অবিরাম এরিয়েল


এই শব্দ, এই ভিড় আর এই ধাবনের ভেতর

যেন ত্রিবেনীর ঘাট; এ-তো প্রাকার জীবন

অনহ অথবা সুখময় জুড়ে আছে করোটির

মন্দির, নাভি থেকে উঠে আসা নিঃশ^াসকে

মনে হয় চিৎকৃত, অধিকিন্তু শেকড়হীন খঞ্জর

প্রবাহে, জীবন ঘেষে ঘেষে চলে রঙিন কল্লোল

আলোয়ান থেকে এক-একটা দিন খসে যায়,


যেন যযাতির প্রহরের জন্ম-মৃত্যু; বিষণ্ন কালের

ধূলিতে মিলে-মিশে খসে যায় আয়ুর মেদ

শ^সিত-শ^াস পেণ্ডুলামের দুলুনিতে হিসেব

কষতে কষতে আক্রান্ত হই দীর্ঘতর কুয়াশায়

এ যেন জীবন অথবা পানশালার প্রতীক

সপ্রতিভ বাঙ্ধসঢ়;ময় হয়ে ওঠে আলোর ছায়াতলে

নিরন্তর বিস্মৃত হই, ছাপ রেখে ছাপ ফেলে

মুছে দিই কালের ধুলোয় থেকে অন্য কেউ

এসে মুছে দিয়ে যায়; কেবলই অবতীর্ণ

ভুবনডাঙ্গায়, পথে-প্রান্তরে হেঁটে হেঁটে

ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ফসিল, অ-পরিতৃপ্ত

ডাহুকের ডাক, মানুষিক জোছনার মতো বিভা

যেন রাত্রির কুহকাহত কল্প-নগরের গল্প

ক্রমশ হেঁটে হেঁটে চলে যাই, চলে যাচ্ছি

বহুদূর, মনে হয় ডুব দিয়ে ডুবতে থাকি

জোছনামগ্ন মাঠের ভিতর, কীভাবে লুকিয়ে

আছি সৈকতে-জীবনে, ভাঁজ-ভাঙা ভাঁজে

ঘুমিয়ে আছি জমাট বাঁধা চিঠিযুগের মতো...





রেশমজাল অথবা ভাঙা পাঁচিল


দূর-অতীত স্বপ্নের মতোই তড়িৎ আবাহে বয়ে যায়

শিরায় শিরায়, তুমি কিংবা আমি শুধুই ছায়া-শরীর

এখন আমরা মানুষ নই, কেবলই মানুষিক শিউলি

ফুলের ঘ্রাণ মাখানো; ভাসমান ছায়া-কঙ্কালের স্থিতি

আমরা মানুষ নয়, মানুষের অগণন ছায়া ভালোবাসি

মুখ দিয়ে ঘিরে রাখে কঙ্কালের অদ্ভুত কালো অভিমান

দূর-অবিচ্ছিন্ন অতীত থেকেই ছড়িয়ে পড়ে দুঃস্বপ্ন

মৃত্যু দূতের ছায়ার মতোই নেমে আসে আমাদের কাছে

এভাবে গভীর কালো কালনেমি মাটির দেয়ালে জুড়ে

এঁকে রেখে যায় অদৃশ্য অন্যঘর, স্মৃতির সহচরী সম্মোহন

Post a Comment

0 Comments