আলতাফ শাহনেওয়াজের অনন্য শিল্পকর্ম ‘গ্রামের লোকেরা যা বলে’ #আদ্যনাথ ঘোষ

 Altaf Shahnewaz's unique artwork 'What Villagers Say' #Adyanath Ghosh



কবিতার ভেতরে থাকে গভীর জীবনবোধ। কবি তার যাপিত জীবনের সারমেয়, ভাব-ভাবনা, অন্তর্দর্শন, সংবেদ, জ্ঞান, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি  প্রকাশ করেন শিল্পের যৌক্তিক মানদণ্ডে আর তখনই হয়ে ওঠে কবিতার গড়ন। 
শিল্পিত সত্তার তীর্থযাত্রী যাঁরা তাঁদের দায়বদ্ধতা, জীবনের অভিজ্ঞান, দার্শনিক মনোভাব, মানবিক স্ফুরণ ও সর্বোপরি মানুষ ও প্রকৃতিপাঠ মানুষের হৃদয়চেতনাকে আরও বিকশিত ও প্রতিবিম্বিত করে। কবিতা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তখনই যখন কবির আত্মপোলব্ধিজাত চেতনা, যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা, মনন জগতের শিল্প নৈপুণ্য সত্তা, শব্দ নির্বাচন, অভিজ্ঞতার দৃঢ়তা, কাঠামোশৈলী এবং পাঠকের মননজগতে এক রহস্যঘেরা ঘোর তৈরি করতে সক্ষম হয়। 

সেই আদিকালের কবি মহর্ষী ব্যাসদেব থেকে শুরু করে বর্তমানাবধি কবিগণ একই শিল্প কাব্যরসধারায় এক কাতারে শামিল হয়েছেন একথা বলা সমীচীন হবে না কারণ যার যার চিন্তা চেতনা, জীবনাভিজ্ঞতা, অনুভূতির জগৎ যেমন, সেই কবির শিল্পপ্রতিমা তেমনই। এই শিল্পজগতের তীর্থযাত্রী আলতাফ শাহনেওয়াজও এর বাইরে নন। তার ‘গ্রামের লোকেরা যা বলে’ কাব্যটি পাঠ করলে সহজ, সরল, সাবলীল ও সৌন্দর্যময়তার অন্তর্দর্শন উদ্ভাসিত হয়, পাঠকদের হৃদয় পদ্মাসনে। কবি তার ভাষার হৃদয়াবেগ কবিতার ছত্রে ছত্রে বিলিয়ে দিয়ে কবিতাকে প্রাণবন্ত ও শিল্পের দোরগোড়ায় পোঁছে দিয়েছেন যা পাঠক হৃদয়ে এক গ্রামীন লোকজ সমাজের রূপ-রস-গন্ধ ও সংসারের বিচিত্র রূপ হয়ে ধরা দেয়। 

কাব্যের প্রথম কবিতা ‘অনেক পুরোনো দিন’। পল্লী গাঁয়ের স্মৃতিকাতরতা মুখর কবিতা এটি যা অনুভূতির জগতে এক মায়ামধুর অমলিন স্মৃতি ভেসে আসে পাঠকদের অন্তর্জগতে। যেখানে পুরাতন স্পর্শে জাগরিত হয় আরও নতুনের স্পর্শ। কবি তার কবিতায় গ্রামের সেই সৌন্দর্যের কাছে ফিরে গিয়েছেন, ফিরে গিয়েছেন স্কুলের পিছনের পানাপুকুরের শান্ত জলে, সেই মায়ের চুলোয় চড়ানো গরম ভাতের গন্ধের কাছে আর জাফর স্যারের শান্ত মেয়ের মতন চুপটি করে। 

এতোসব নস্টালজিয়ার টইটুম্বুর রস কবিতায় ভরে দিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ। যেমন ধরা দিয়েছে কবি জীবনানন্দের কবিতায়। জীবনানন্দের কবিতার প্রকরণ অত্যন্ত গভীর ও গভীরজাত থেকে উত্থিত। সেখানে কবি তার অন্তর্জগত ও বহির্জগতের সম্মিলন ঘটিয়ে এক আলাদা ইমেজ তৈরি করেছেন। কবি জীবনানন্দ দাশের সার্থকতা এখানেই, যেখানে এত মধুর চিত্ররূপময় কাব্যশিল্প আর কেনো কবির শিল্পিত সত্তায় ধরা দেয়নি। কবি আলতাফ শাহনেওয়াজও প্রকরণে প্রকৃতির স্পর্শ ভরে দিতে চেয়েছেন। এই প্রকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার ’অনেক পুরোনো দিন’ কবিতার পঙক্তিতে: ‘পুরোনো দিনের কোনো কুহকি জগতে/ আছ আবার বিভ্রমে নেইও তুমি যেথা-/সেই পুরোনো দিনের সৌরতাপে, পৃথিবীর মেঘগুলো কতটা কেমন গলে যায়, আর ভাঙা বাড়ির টিনের চাল উড়ে গেলে/ বৃষ্টির ঝমঝমিয়া/বড়বড় ফোঁটাগুলো কখন কোথায় পড়বে?’ কবিতার ভেতরের গড়ন নৈপুণ্যে আলতাফ শাহনেওয়াজ অত্যন্ত দক্ষ অন্যদিকে কবিতার প্রকরণ ও প্রসঙ্গ বিবেচনায়ও তিনি এক মগ্ন ঋষি।

মানুষের জীবনে আটপৌঢ়ে সংসারের কর্মকূশলতার পুনরাবৃত্তি ঘটে, আবার সেই একই ঘটনাপ্রবাহ, একই টানাপোড়েন সামনে আসে; এইসব ঘটনাপ্রবাহ কবির কল্পনায় নিখুঁতভাবে ধরা দেয়। এরই অনন্য উদাহরণ ‘আবার বছর ঘুরে’ কবিতায়- ‘কোথা হতে উড়ে আসে আমার ভেতর/ দুর্মুখ আমিই নাকি ফটোকপি মেশিন, বেফাঁসে ফটাফট ছাপা হয়ে যাচ্ছি!/ উল্টো অক্ষর সপাটে লাথি দেখাচ্ছি- ঘা চেটে রোজকার পেটে; চাপ দাও, শ্বাস বের হয়ে যাবে ক্ষীয়মাণ রাত্রিকাল ধসে, সাইকেল হাঁকিয়ে আসবে বন্ধুদের যত প্রেম- দুধের সমান সাদা হয়ে গেছে তারা আর সুদূরেরও; মুখ দেখে চেনা যায়?’ জীবন প্রবাহে যেমন যন্ত্রণার অভিশাপ থাকে, বিষাদের ঢেউ থাকে তেমনি জীবন চলার পথে অনেক আনন্দ উৎসবও চলে। চলার পথের অনন্ত সিঁড়িতে সকলেই জীবনকে উপভোগ করতে চায় কিন্তু তমসা এসে ঢেকে দেয় জীবনের গতিপথ। তবুও আঁধারের নিচে থাকে আলোর ফোয়ারা অথচ এ জীবন আলোর ফোয়ারার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। এই অনন্ত সিঁড়ির পথে কত ভেসে আসে তারই প্রতিধ্বনি: ‘জাগ্রত শরীর নগ্ন আমার দেহের খুব ভেতরে এসেই/ আবার খানিক পরে/ লীন হয়ে যাওয়া আমার লাশের একলা অভিশাপ/ একান্তে কুড়ায়, /যেন অনেক বছর ধরে/ তারপর একাকী আমিই রাজার বাড়ির মাঝে/ নিঠুর পিয়াসী কোনো অমাবস্যা...।’ 

সন্তান মায়ের ঊর্ননাভ থেকে উৎসারিত কিন্তু মায়ের বলক দেয়া দুধের দাম কেউ কি দিতে পারে? না। মায়ের স্তন পান করেই সন্তান বড় হয়, হৃষ্টপুষ্ট হয়, সেই সন্তানের উগ্র বর্ধিষ্ণু সময় বাড়তে বাড়তে এক সময় মহীরূপে পরিণত হয়। তবু মা, মা-ই থেকে যায়। আলতাফ শাহনেওয়াজ ‘সন্তান’ কবিতায় মা- কে নিরালা পেরুবার সেতু, বলক দেয়া দুধ, রাতের গর্ভ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। কবি তার কবিতায় আলাদা ব্যঞ্জনা, আলাদা কল্পনাচিত্র, আলাদা ভাববৈচিত্র্য ব্যবহার করে চেতনার গভীরে পৌঁছে কবিতাকে আরো সুন্দর থেকে সুন্দরতর করে পাঠকদের কাছে সমর্পণ করেছেন। পাঠকসমাজ কবিতাগুলো পাঠ করে অতলান্তিক চিন্তার রহস্যে ঢুকে পড়ে এবং কবিতার ভাবচৈতন্য উদ্ধারে ঘোরের মধ্যে ঘুরপাক খায়।

আলতাফ শাহনেওয়াজের কবিতাগুলো অতি সাধারণ থেকে আরও গভীরের সৌন্দর্যে পৌঁছে নতুন এক সৌন্দর্যের আত্মদর্শনকে প্রকাশ করে যা পাঠকদেরকে নতনত্বের রহস্যের ভেতর ঠেলে দেয়। সেখানে শুধু চিন্তার রহস্যজাল। এ রহস্যজালের রহস্য ভেদ করেই কবিতার অমৃত স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। এই রহস্যঘোর সৃষ্টি করাই কবির ঋদ্ধ অন্তর্দর্শন। সেখানে উপমা, অলঙ্কার, অনুপ্রাস, মণ্ডল ও প্রতিমা নির্মাণে কবিকে ঋষি হতে হয়। আর আলতাফ শাহনেওয়াজ প্রকৃতই এক শব্দরথযাত্রার কাব্যঋষি। সেই রহস্য ঘোর সৃষ্টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কবিতায় অনন্য উচ্চারণে: ‘শেষে আসে মিশুক দাহ্যবাগান/ পাশে পাশে শৃঙ্গার শৃঙ্গার- ভেঙে খান খান কাঁদে... / চাঁদ তখন অচেনা দেহে/ আলো ফেলেছিল চাঁদে।’ কবির কবিতা প্রবাহিত হয় তার প্রাত্যহিক জীবনের সাংসারিক টানাপোড়েন, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির অন্তর্জগতের স্নায়ুর গভীর থেকে আরও গভীরে। এই অনুভবের চিন্তা ও ঘোরের জগতে এসে শব্দগুলো পাখির মতো উড়ে গিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে ঝরে পড়ে শিল্পিত সত্তায়। আর এই শিল্পই কবিতা হয়ে ওঠে। আলতাফ শাহনেওয়াজও এর ব্যতিক্রম নয়। 

আলতাফ শাহনেওয়াজ এর ‘গ্রামের লোকেরা যা বলে’ কাব্যটির প্রত্যেকটি কবিতার ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে আধুনিক সমাজের মানুষের বিষণ্নতা, সুখ-দুঃখ-আনন্দ, কর্মচাঞ্চল্য, আধুনিক মানুষের কর্মব্যস্ততা, দ্রব্যমূল্য, প্রকৃতি, সংসারের জটিলতা ইত্যাদি। নান্দনিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত উত্তরাধুনিক যুগের পাঠকসমাজ আলতাফ শাহনেওয়াজ এর কবিতা পাঠ করে স্বপ্ন ও কল্পনার মিশেলে প্রেম, নিসর্গ ও রুচির আভিজাত্য চিত্রায়নে এক আলাদা প্রতিধ্বনি খুঁজে পায়। যেমন কবিতাগুলো ফুঁটে উঠেছে এক মায়াবী আদরমাখা মোহনীয় ঘোরের মধ্যে তেমনি কবির চিন্তা চেতনার নতুন এক চৈতন্যের বহিঃপ্রকাশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সমস্ত কাব্যগ্রন্থ জুড়েই প্রেম, বিরহ, মিলন, ক্ষোভ, বিক্ষোভ, বেদনা, অসাড়তার এক অনন্য স্রোতধারা আলতাফ শাহনেওয়াজ এর কবিতার চিত্রকল্পে অতি নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। দেশপ্রেম, জাতিসত্তা, আধ্যাত্মিক চেতনার পাশাপাশি এ কাব্যে বিষণ্নতা ও ক্ষোভ স্থান পেয়েছে, এ কারণে কবিতাগুলো সমাজ গঠনে অত্যন্ত কার্যকর। অধিকাংশ কবিতা পাঠকদেরকে জীবনবোধের দিকে ও মানবিক অভিব্যক্তি সম্পন্ন জাতিসত্তা গঠনে সহায়ক। আঁধারের মধ্যেও যেন আরও এক আঁধার এসে জমা হয় নির্ঘুম রাত্রি জুড়ে। কবিতার মধ্যে যখন আলো আঁধারির সংমিশ্রন ঘটে তখন সেই কবিতার রূপকল্প বা চিত্রকল্প সুন্দর এক মায়াবী ঘোরের জাল সৃষ্টি করে। পাঠক সেখানে আলাদা অনুভবের জগতে অথবা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে ঢুকে পড়ে। এখানেই কবির সার্থকতা।

 ‘অন্ধমাদন’ কবিতায় এরূপ ভাব বিহ্বলতা ও বোধের বৈচিত্র্যতার সমন্বয় দেখা যায়। ‘তাসের শয্যায় মশারীর ছিদ্র খোলে রাত/ নির্ঘুম খুলির নিচে গেরিলার অন্ধকারে শুয়ে থাকা/ কেউ যেন আছে/ এখানে এমন অসুখী জ্বরের ঘোরে/ শুয়ে থাকা চাঁদ/ নিরুদ্বেগ, বাঁকা/- অধীরের বউয়ের চুলের বিনুনীতে নারীর মতন/ হাঁসফাঁস করে মলিন তৃষ্ণায়/ পানি খেতে এক সৌরবর্ষ ধরে ছুটে ছুটে যায়।’ আলতাফ শাহনেওয়াজ তার যাপিত জীবনাচার ও অভিজ্ঞতা কবিতার পরতে পরতে গেঁথে দিয়েছেন। তিনি মানুষ ও প্রকৃতির মোহচ্ছটায় দাঁড়িয়ে মনন ও মনস্তত্ত্বের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতায় অত্যন্ত সচেতনভাবেই কবিতায়  হাত দিয়েছেন। গভীর জীবনবোধ ও অনন্য শিল্পকর্মের চেতনালব্ধ কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ। কবিতায় তিনি সময়ের জীবনদর্শন, আবেগ ও বাস্তবতার সংমিশ্রণ, প্রান্তিক ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দুঃখকষ্ট, মানবীয় জীবনসত্তার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। চারপাশের মানুষ, জীবন সংবেদ, জীবিকা নির্বাহ, সামাজিক পরিবেশ, মনোজাগতিক চিন্তন, প্রতিবেশ, সূক্ষ্ম অনুভূতি, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ তার ‘গ্রামের লোকেরা যা বলে’ কাব্যগ্রন্থটির চিত্রকল্পে অত্যন্ত সহজ, সরল ও সাবলিলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাইতো কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ এমন সুন্দরভাবে লিখতে পারেন: ‘খুব পেটে পেটে ভাসিয়ে দিয়েছি-/ ভেসে যাচ্ছি মায়ের পেটে/ আছরে মরে,/ জন্ম নিচ্ছি খুনির অঙ্গে,/ জন্ম দ’লে গর্ব খুলে তারস্বরে!’  

Post a Comment

0 Comments