সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
কবি, সাংবাদিক ও গবেষক ।
জন্ম: ৩০ মে ১৯৫৮, শেরপুর। স্ত্রী: অপি মাহমুদ। দুই কন্যা সন্তান অনাদি নিমগ্ন ও অর্জিতা। পিতা, আলহাজ্ব মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক, মাতা: সারা শহীদুল্লাহ। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল মূলত কবি হলেও শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করছেন। তাঁর কবিতায় গ্রাম বাংলা থেকে শুরু করে নগরায়ন, নাগরিক জীবন, জীবনের জটিলতা, প্রেম, পরবাস, পরাবাস্তব প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়। বর্তমান বাংলা কবিতার মূলধারাকে তিনি শাণিত করছেন, বাঁক ও বিবর্তনে ভূমিকা রাখছেন। কবিতায় যুক্ত করছেন নতুন টার্ম, নতুন ফর্ম। তাঁর 'তিন মিনিটের কবিতা' গ্রন্থটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি গদ্যের মতো পদ্য নিয়েও গবেষণা করেন। সেজন্য কবিতার বিষয় নিয়ে চিন্তার গভীরে প্রবেশ করেন। মানুষের মনোজগতের অন্তর্নিহিত খনিজ তুলে আনেন ডুবুরির মতো। ফলে দুলালের কবিতা হয়ে ওঠে ব্যতিক্রমধর্মী তথা স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে প্রবাসযাপন করলেও এক মুহূর্তের জন্যেও তিনি শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। বরং প্রবাস জীবনের নানা অনুষঙ্গ তাঁর কবিতাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। কখনো কখনো স্বদেশ ও বিদেশের নানা বিষয়আশয় দ্রবীভূত হয়েছে তাঁর কবিতায়; বলা যেতে পারে, তা এক ধরনের চিন্তার অনুবাদ। ছাত্রাবস্থায় দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতার জীবন শুরু। পরে দেশের বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৮০ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদান। এক সময়ের জনপ্রিয় বিটিভির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’র উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রবাসী বাঙালিদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন নিউজ এজেন্সি ‘স্বরব্যঞ্জন’, সেই সাথে ‘পাঠশালা’র প্রকাশনা। বর্তমানে তিনি সপরিবারে কানাডায় বসবাস করছেন ।দৈনিক ইত্তেফাকের কানাডাস্থ বিশেষ প্রতিনিধি এবং সাপ্তাহিক বাংলা মেইলের উপদেষ্টা সম্পাদক হিসাবে দায়িত্বরত আছেন এবং ১৯৭১’ নিয়ে গবেষণা করছেন।
২০২৩ সালে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার ।
আজ ৩০ মে ২০২৪। কবি, সাংবাদিক ও গবেষক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এর শুভ জন্মদিন । রাষ্টিয় স্বীকৃতি পাওয়ার পর এটি তার প্রথম জন্মদিন। কবি’র ৬৬তম জন্মদিন উপলক্ষে তার যাপন ও চর্চা নিয়ে বামিহাল অনলাইন শুভেচ্ছাসহ এই বিশেষ আয়োজন প্রকাশ করলো। লিখিত সাক্ষাৎকারের প্রশ্ন তৈরি করেছেন বামিহাল সম্পাদক রনি বর্মন।
লেখার শুরুটা কীভাবে ? আর সিরিয়াসলি কবে থেকে লিখতে শুরু করা?
** আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামের সঙ্গে আমার নাড়িছেঁড়া সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলো অস্থির ছিলাম। কৈশোরের সেই সময়টা খুব টালমাটাল ছিল। আমাদের বাড়ি ছিল ব্রহ্মপুত্রের ওপারে চরাঞ্চলে। একাত্তর সালে আমাদের এলাকা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অভয়ারণ্য। বয়সের কারণে যুদ্ধে যেতে পারিনি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসা যোদ্ধাদের সাহায্য করেছি, তাদের কাছে থেকে দেখেছি। তাদের অস্ত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে যুদ্ধ অনুভব করেছি। ক্লাশ ছিল না। পাড়াশোনা ছিল না। তখন মাথায় নানান বিষয়, নানান ভাবনা, নানান চিন্তা কাজ করতো। তা রোল করা খাতায় লিখতাম।
কী লিখতাম, আজ আর মনে নেই। তবে সেখান থেকেই হয়তো লেখালেখির বীজ বপন শুরু।
কেন কবিতা লেখেন? প্রেরণার কোনো জায়গা আছে কি?
** সবার মতো আমি সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারি না, সেই কাজগুলো আমি কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদ করি, ভালোবাসা প্রকাশ করি, মানুষের মঙ্গল কামনা করি। অর্থাৎ আমার ভেতরে যে আরেকটা ‘আমি’ আছে, সেটা আমি প্রকাশ করি নান্দনিকভাবে, ইতিবাচকভাবে, যা মানুষের কল্যাণে আসে। শুধুমাত্র মানুষ নয়, বৃক্ষের জন্য, পরিবেশের জন্য, প্রকৃতির জন্য আমার অনেক কিছুই বলার আছে। সেগুলো বলি বা প্রকাশ করি। অথবা ওদের কথা কবিতায় অনুবাদ করি।
কেন লেখেন? এই প্রশ্ন যতটা সহজ; উত্তর ততটা সহজ না। তবে প্রথমে নিজের ভালো লাগা থেকে লিখেছি। তারপর সামাজিক দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করি। অবশ্যই অর্জিত অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, চিন্তা-ভাবনা, জীবনের উল্টো পিঠ প্রকাশ করি। জীবনকে সাহিত্যে অনুবাদ করি।
জীবনই কবিতার অনুপ্রেরণা।
কী লিখতে এসেছিলেন? কবিতায় আপনার স্বপ্ন এবং সত্তাকে ধরতে পেরেছেন?
** আমি মূলত কবিতাকেই পেতে চেয়েছি। এখন মনে হয়- কবিতার স্বপ্ন আর কবিতার সত্তাকে মিলাতে পেরেছি। কারণ, কবিতাটা এখন আমার করতলগত।
কবিতা কি কেবলই অদৃশ্য কোনো ইশারায় ন্যস্ত কোনো শিল্প?
** মনে হয় না। তবে কবিতা এক অদ্ভূত বিষয়। যা অনেক সময় ব্যাখ্যাতীত। দৃশ্য এবং অদৃশ্যের সমন্বয়ে বাস্তব-পরাবাস্তব-অবাস্তবের নির্মাণশিল্প!
কবিতায় দশক নিয়ে আপনার কী ভাবনা?
** কবিতার দশক বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ, এতে সময় সীমার একটা ব্যাপার থাকে। যা সেই সময়ের কবিদের কার্যক্রম, ভাবনা থেকে শুরু করে নানান বিষয় ফুটে উঠে। এবং দশক থেকে পাঠকেরাও একটা ধারণা পায়। যদিও এর বিপরীতেও একাধিক যুক্তি আছে।
কবি বা লেখেককে কতটুকু রাজনীতি-সচেতন হতে হয়?
**সামাজিক দায়িত্ব পালন এবং কবিতার লেখার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু। তবে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেমন- রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, স্লোগানধর্মী লেখা, দালালি করা ইত্যাদি মারাত্মক ক্ষতিকর দিকও রয়েছে।
লেখার সন্তুষ্টি নিয়ে কোনো লেখককে কি কখনো থেমে যাওয়া উচিত? আপনার মতামত কী?
** একজন সচেতন লেখককে সব সময় আত্মসমালোচনা করা উচিত। নাক-কান খোলা রাখা উচিত। ভালো পাঠকও হওয়া দরকার। তাহলে থেমে যাবার প্রয়োজন নেই। তবে বিরাম বা বিশ্রাম নেয়া আর থেকে যাওয়া এক নয়।
কবিতার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা বা প্যাটার্ন আছে?
** শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে তো কবিতার সজ্ঞা, ছন্দ-মাত্রা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই আছে। থাকা উচিত। গানে সারেগামা সুর আছে। নৃত্যে তাল-লয় আছে। গান কি তার ব্যতিক্রম শিল্প?
ওয়েবম্যাগ কি লিটলম্যাগের পুরিপূরক হতে পারে? *আপনার মতে লিটলম্যাগের ভবিষ্যৎ কি?
** না। কখনোই না। কারণ, দুটো চরিত্র দুই ধরণের, দুই রকমের। একটি এনালগ, অন্যটি ডিজিটাল পদ্ধতি। লিটিলম্যাগ (ছোটকাগজ) আছে, থাকবে। সেখানে ওয়েবম্যাগ যুক্ত হয়েছে নতুনত্ব নিয়ে। যা প্রযুক্তির বিকাশ।
লেখা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুককে কীভাবে দেখেন ?
**লেখালেখির জন্য ফেইসবুক আংশিক উপকার আর আংশিক ক্ষতিকর। উপকার এই অর্থে- সহজে বা খুব দ্রুত পাঠাকের কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু ফেইসবুকের পাঠক প্রকৃত পাঠক নয়। অধিকাংশ ভূয়া পাঠক। তারা কবিতা না বুঝেই অকবি এবং নারী কবিদের প্রশংসা করে সর্বনাশ করে দেয়। আর যারা ডাল রান্না করতে করতে কবিতা লিখে, তারা প্রশংসায় টেপা মাছের মতো ফোলে উঠে। যেহেতু এখানে ‘এডিটর’ নেই, তাই যাচ্ছেতাই প্রকাশ করা যায়।
আপনি কি এক বসায় কবিতা লেখেন নাকি বারবার সংশোধন করেন?
** বারবার সংশোধন, সম্পাদনা করি।
বর্তমান সময়ের কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলেন। পাঠকের রুচির সাথে আপস করে কবিতা লেখা উচিত?
** কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। আগেও ছিলো। আগামীতেও থাকবে। তবে কবিতা পড়তে হলে অগ্রসর পাঠক হওয়া বাঞ্চনীয়।
পাঠকের রুচির সাথে আপস করে কবিতা লেখা কখনোই উচিত না। যদিও অনেক সময় বিষয় ভিত্তিক কবিতা লিখতে হয়। সেটা পাঠকের সাথে আপোষ করে না। বিষয়কে গুরুত্ব বা মর্যাদা দিয়ে।
কবির স্বাধীনতা কবিতাকে কীভাবে প্রভাবিত করে?
**তার কবিতায়, উপস্থাপনায়।
সাহিত্যের বিশ্বাস আর ধর্মের বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য বা দ্বন্দ্ব কোথায়?
**এক হিসেবে আকাশ-পাতাল তফাত। আরেক হিসেবে সমান্তরাল। সমান্তলার এই জন্যই যে, সাহিত্যের বিশ্বাস আর ধর্মের বিশ্বাস দুটোই কাল্পনিক। যদিও জীবনের সাথে যুক্ত।
আপনার প্রিয় লেখক কারা?
**অনেকেই। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে শুধু একটি নাম- সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল।
এখন কোন বইটা পড়ছেন?
**কানাডার প্রধান মন্ত্রি জাস্টিন ট্টুডর প্রাক্তন স্ত্রী সোফির বায়োগ্রাফি- Closer Together.
এ সময়ের কোন কোন কবির কবিতা আপনাকে ভাবায়, থমকে দেয় ?
**যারা ভালো লিখেন, যারা কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেন, যাদের কবিতায় ভাবনার বিষয় থাকে;
তাদের কবিতা খুঁজে খুঁজে পড়ি। এদের মধ্যে অনেক নতুন প্রজন্মের কবিই বেশি।
0 Comments