বাগেরহাট পি সি কলেজে তথা প্রফুল্লচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের সাহিত্য-সংস্কৃতির উদার জমিনে যে আমি বেড়ে উঠছিলাম, তার মনের কোণে একটু একটু করে জন্ম নিল লেখকসত্তা। বিশেষত সেই ছেলেবেলায় নাটক আমাকে প্ররোচিত করেছিল নানা ভাবে। তাই হয়তো আমার প্রথম রচিত সাহিত্যকৃতি ছিল নাটক ‘চলো দরগায় যাই’। বলা আবশ্যক আমার পিতা মরহুম মুহম্মদ গোলাম রসূল ছিলেন এই কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। আমার পিতার বিমল মিত্র আর মায়ের আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বইয়ের ভিড়ে এবং সেসবের চলচ্চিত্রয়ানের খবর বাবা-মায়ের মুখে শুনে নাটকনামক সাহিত্যের চরিত্রগুলোর সংলাপ আমাকে আকৃষ্ট করে খুব। সেই ছেলেবেলাতেই নবাব সিরাজউদ্দৌলার একক অভিনয় আমি করেছি বহুবার। ‘সাজাহান’ নাটকের মুখ্য চরিত্র তথা শাহজাহান আজও আমাকে মোহাবিষ্ট করে রাখে। গত শতাব্দীর সাতের দশকের শেষ ধাপ, তখনও আমাদের বাড়িতে বইয়ের আলমিরা হয়নি। আট-দশটি ট্রাঙ্কের ভেতরে বাবা-মায়ের বিমল মিত্র আর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মুখোমুখি বসে। আমার ওই বালক বয়সে সেসব সাবাড় করেছি অন্ধের মতো। প্রথম পড়ি ক্লাস ফাইভে বিমল মিত্রের ‘কেউ নায়ক কেউ নায়িকা’। আজ তার কিছুই মনে নেই, শুধু বইয়ের নামটি ধারণ করেছি মনেপ্রাণে। আর এসব পড়তে পড়তেই নারী চরিত্র বর্জিত নাটক লিখে বন্ধুদের নিয়ে তা মঞ্চস্থ করা নেশায় পরিণত হয়েছিল। বাড়ির বারান্দার এক কোণে চৌকি ফেলে,
কখনো মায়ের শাড়ি দিয়ে আবার কখনো বিছানার চাদর দিয়ে পর্দা বানিয়ে চলতো অনুষ্ঠান- কৌতুক, আবৃত্তি, সংবাদ পাঠ এবং নাটক। একবার এক সংবাদ পাঠ লিখে দিলেন পি সি কলেজের মুসলিম হোস্টেলের ছাত্র সম্ভবত ‘বাদশা ভাই’ (নামটা সঠিক করে মনে নেই) এবং সংবাদ পাঠকের নাম দিলেন ‘মোস্তফা বেন্টিঙ্ক চক্রবর্তী’। উল্লেখ্য, আমার ডাকনাম ‘বেন্টিঙ্ক’। বাবা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, তদুপরি ইতিহাস তাঁর প্রিয় বিষয়। এই ভারতবর্ষের শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ছিলেন তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তাই তাঁর নাম অনুসারে আমার নাম তিনি রাখলেন ‘বেন্টিঙ্ক’। এ নামেই আমার জন্মশহর বাগেরহাটের মানুষ আমাকে চেনে, জানে, ডাকে। আর তাই আমার স্মৃতির পাতায় আজও অক্ষয় হয়ে আছে ‘মোস্তফা বেন্টিংক চক্রবর্তী’। যা হোক প্রতিটি নাটক ছিল আমার লেখা এবং নারী বর্জিত। অনেক নাটকের ভেতরে দুটি নাটকের কথা এখন মনে পড়ে শুধু। একটি হচ্ছে কয়েক বন্ধুর গহীন জঙ্গলে প্রাক্তন রাজ-রাজড়ার ধনসম্পত্তি অনুসন্ধান এবং সবশেষে ওই ধনদৌলতের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বন্ধুদের ভিতরেই বিবাদ ও আপসরফা। যদিও নাটকটির নাম সঠিক করে এখন আর মনে নেই। অন্যটি হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নাটক ‘স্বাধীনতার জন্যে’। যেখানে আমি একজন রাজাকারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। এবং আমার চারজন পুত্র সন্তান ছিল যারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর রাজাকার যখন তার সন্তানদের কাছে ক্ষমা চায়, কিন্তু সন্তানরা কেউ তাকে ক্ষমা করতে চায় না। তখন ওই
রাজাকার নিজেই আত্মহত্যা করে। মনে আছে আমার রাজাকারের অভিনয় সবার কাছেই প্রশংসিত হয়েছিল। এ সময় সম্ভবত আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তখন আমরা পি সি কলেজের নন্দিত পুকুর সুখসরোবরের সামনের কোয়ার্টারটিতে উঠে এসেছি। আমরা মাঝের কোয়ার্টারটিতে থাকতাম। আমাদের একপাশে থাকতেন রসায়নের অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন, অন্যপাশে থাকতেন দর্শনের অধ্যাপক একরামুল হক। আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির ভেতরের উঠোন বেশ বড়ো এবং অনেক জায়গা নিয়েই ছিল। সেখানে আমাদের অনেক ধরনের সবজি খেত করা হতো। ওই উঠোনের এক পাশে মাটিলেপা দাওয়া এবং গোলপাতা ও বাঁশঘেরা একটি ঘর ছিল। ওটিকে আমরা ক্লাব রূপে গড়ে তুললাম। প্রতিদিন বিকালে সমবয়সি কলেজ শিক্ষকদের ছেলেমেয়রা সেখানে জড়ো হতাম। কেরাম, লুডু, কবিতা আবৃত্তি- এসব চলতো। নিজেদের লেখা গল্প কবিতার আদানপ্রদান চলতো। এই ক্লাবের আঙিনায়ও একদিন অনেকটা মেলার মতো করে উৎসবের আয়োজন করা হলো। সেখানে আমাদের মা-খালা-চাচিরও সহযোগিতাসহ অংশ নিলেন। সম্ভবত সেটিই ছিল আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির শেষ উৎসব। এরপরই আমার স্কুল জীবন শেষ করে কলেজ জীবনে পদার্পণ করি। আর ততদিনে কলেজের সরকারিকরণের মর্মভেদী দাগ গাঢ় হতে শুরু করে। অমোঘ নিয়মে বদলি হতে থাকেন আমাদের পিতারা। জীবন ও জীবিকা আমাদের বাস্তুচ্যুতি ঘটায়। আমরা হারিয়ে ফেলি এক পয়সার লজেঞ্চুস জীবন। বন্ধুদের গাঢ় মুখ ধূসর থেকে ধূসরতর হতে থাকে।
২.
আমার সাহিত্যকৃতির পেছনে আমার পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহ যেমন প্রেরণা যুগিয়েছে, তেমনই তাকে আরও প্রনোদনা-উৎসাহ দিয়েছেন বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার পথিকৃৎ কবি ও ব্রাত্যজনের অমলিন কথাশিল্পী আবুবকর সিদ্দিক। এই মানুষটিকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি ছেলেবেলা থেকে। প্রথম জীবনে
বর্তমান বাগেরহাটের সরকারি প্রফুল্লচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে আমার পিতার সহকর্মী ছিলেন তিনি। তারও আগে পাঁচের দশকে আব্বা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়তে এলেন, থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তথা আজকের এস এম হলে। তখন আবুবকর সিদ্দিক বাংলা বিভাগের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র। আমার পিতার ২/৩ বছরের সিনিয়র। ওই এস এম হলেই তাঁদের পরিচয়, সাক্ষাৎ। পরবর্তীতে চাকরিসূত্রে, সহকর্মী
হিশেবে সে সম্পর্ক রূপ নেয় বন্ধুত্বে- গাঢ়, অন্তরঙ্গ, হরিহর আত্মা। পরিবারের সাংস্কৃতিক আবহ, আধুনিক কাব্যধারার অন্যতম কবি আবুবকর সিদ্দিকের যাতায়াত আমাকে ওই বালকবয়সে কবি হওয়ার পথে ডেকে নেয়। কী মোহন বাঁশি ছিল সেটি! জানি না, কিন্তু তখনও আবুবকর সিদ্দিকের একখানাই কাব্য ধবল দুধের স্বরগ্রাম না বুঝেই পড়ে চলতাম অহোরাত্র। তবে এটা বুঝেছি পারিবারিক বন্ধু তিনি। তখন তিনি রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ে বাংলার অধ্যাপক। জন্মসূত্রে বাগেরহাটের মানুষ। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের বৈটপুরে। যখনই বাগেরহাটে আসতেন, প্রায়ই সময় আমাদের বাড়িতে রাত্রিযাপন করতেন। সে রাতে দুই বন্ধু- আব্বা ও সিদ্দিক চাচা (চাচা বলেই ডাকতাম) সাংসারিক জীবন থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্য, বিশ্ব সাহিত্যকে নামিয়ে আনতেন দুজনের শয়ন-শিয়রে। বালক আমি চুপচাপ বসে বসে শুনতাম, আর নিজেকে গড়ে নিতাম। আমি লিখি জেনে একবার তিনি আমার জন্যে কিছু ছড়া লিখে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমার লেখা কবিতা শুনে তিনি বললেন, “চাচু, তুমি তো বড়োদের কবিতা লেখ। আমি যে ছড়া লিখে নিয়ে এসেছি।” আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার কবিতা বিনিময়। এরপর তাঁর উৎসাহ, উপদেশ; আব্বার সঙ্গে সাহিত্য-সংলাপ, বিশ্ব সহিত্য সম্বন্ধে জানা ইত্যাদি আমাকে আমারই অজান্তে কবি করে তুলেছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন আমার ‘মা’, ‘ট্রেন’সহ আরও কিছু কবিতা আবুবকর সিদ্দিক নিয়ে গেলেন এবং তাঁরই হাত দিয়ে রাজশাহীর তৎকালীন দৈনিক বার্তা, ছোটদের পত্রিকা ঢাকা থেকে প্রকাশিত নবারুণ ও কিশোর কথা’য় প্রথম প্রকাশ পায়। আব্বা তখন খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজে। আব্বার কলেজের ঠিকানায় সিদ্দিক চাচা পাঠালেন। সেই প্রথম কাগজে ছাপার অক্ষরে নিজের নাম, নিজের লেখা দেখে যে আনন্দ, সেই অনুভূতি প্রকাশ করার নয়। লেখকমাত্রেই তা সবাই অনুধাবন করতে পারেন। এ ভাবেই আবুবকর সিদ্দিক হয়ে উঠলেন আমার সাহিত্যিক জীবনের অনুষঙ্গ।
পরবর্তীতে আর আব্বা নয়, আমাকেই তিনি তাঁর প্রকাশিত প্রতিটি নতুন বই পোস্ট করে পাঠাতেন। তাঁর আনেক লেখাই তখন আমার জন্যে বোধগম্য ছিল না। তবু প্রিয় মানুষের বই অন্য আনন্দ বয়ে আনতো। আব্বা বলতেন, “সিদ্দিক ভাই, তিরিশের সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং জীবনানন্দ দাশের সংমিশ্রণ। তাঁর কবিতার ধার বাংলাদেশে বোঝার মতো সমালোচক গড়ে ওঠেনি। যেমন- সব এমএ পাশই রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে
পারে না।” তাই বুঝি বাংলাদেশের সাহিত্যে যেভাবে তাঁকে নিয়ে আলোচনা হবার কথা ছিল, তা হয়নি। তাঁর উইট, ধী-শক্তি বোঝার ক্ষমতা কার আছে? আবুবকর সিদ্দিক- আপাদমস্তক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটির সাহিত্যকৃতির বোধ ও বোধিকে ছুঁয়ে দেখার সক্ষমতা তৈরি হয়নি এই পাঠককুলের। আবার তিনি নিজেকে বাজারচলতি করেননি কখনো। সে স্পর্ধাও নেই আজকের মিডিয়াবাজদের।
৩.
পরবর্তীতে আমি যখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তে এলাম তখনও সাহিত্যবিষয়ক আমাকে লেখা আবুবকর সিদ্দিকের চিঠি আমাকে দিগনির্দেশনা দিত। আরও পরে তিনি যখন অবসর জীবনে কিছুদিনের জন্যে ঢাকায় বসবাস করা শুরু করেন। তখন তাঁর কারণেই আমাদের অনেক মহীরুহ সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা হয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, রফিক আজাদ, আল মুজাহিদী, শিহাব সরকার, সৈয়দ হায়দার, নাসির আহমেদ ফারুক মাহমুদ প্রমুখ। এ-সময় কবিতার পাশাপাশি আমি তখন গদ্য লিখছি বেশ। সেসব কবিতাবিষয়ক গদ্যের অধিকাংশই কালি ও কলমে প্রকাশিত হতে থাকে। ওই সময় পর্ব থেকে আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে ধীরে ধীরে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্যার তখন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি। এই সময় কালি ও কলমে লেখা বাংলাদেশের কবিতাবিষয়ক গদ্যগুলোকে নিয়ে আমার প্রথম গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় বলাকা প্রকাশন থেকে ২০০৯-এ ‘এই বদ্বীপের কবিতাকৃতি’। বইটি আমি আনিসুজ্জামান স্যারকে উৎসর্গ করি। আর এই বইটির জন্যে ২০১১ সালে শহীদ ইকবাল সম্পাদিত ছোটকাগজ চিহ্ন’র যুগপূর্তি উৎসবে আমাকে ‘চিহ্নসম্মাননা’ প্রদান করা হয়। স্যারের সঙ্গে আমার শেষাবধি পারিবারিক সম্পর্ক রূপলাভ করে।
২০২০ সালে করোনা যখন বাংলাদেশসহ বিশ^ব্যাপী জেঁকে বসেছে। ওই বছরের ৬ এপ্রিল আমার মা পরলোকে যাত্রা করেন। ওই দুঃসময়ে আমি মাগুরা গ্রুপের ‘বাংলাদেশের খবর’-এ সম্পাদকীয় পাতার দায়িত্বে ছিলাম। তখন কাগজটিও বন্ধ করা হলো। কর্মীরা অঘোষিত ছাঁটাইয়ের ভেতরে বেকার দিনযাপন করতে লাগলো। আমি মায়ের মৃত্যুর কারণে মাগুরাতে অবস্থান করছি। বাবার সঙ্গে আমি সপরিবারে শেষবারের মতো ৪/৫ মাস কাটালাম। মাগুরাতে থাকতেই আনিসুজ্জামান স্যারের মৃত্যু সংবাদ আমাকে আরও নিঃসঙ্গ করে দিল। ১৪ মে অলস দুপুরে স্যারের মৃত্যু খবরটি আমাকে জানায় অনুজ প্রিয়ভাজন কবি
তুষার প্রসূন। রুদ্ধশ্বাস কয়েকটি দিন ধরে কি গোটা জাতি এই মর্মান্তিক খবরের জন্য অপেক্ষা করেছিল? মায়ের শোক না কাটাতেই আনিসুজ্জামান স্যারের মৃত্যুসংবাদ আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে গেল। ঢাকার বাইরে অবস্থান করায় স্যারের শেষ যাত্রায় থাকতে না পারার বেদনা আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার আমার এ অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আপনার অন্তিম মুহূর্তে আপনি যাদেরকে স্মরণ করবার চেষ্টা করেছেন, তাদের একজন আমিও ছিলাম। নতুবা আপনার মৃত্যুদিনের ভোররাতে সস্ত্রীক আপনার বাসায় আমার গমন, আপনার দর্শন- এমন স্বপ্ন অলক্ষে থেকে বিধাতা কেন আমাকে দেখাবেন? কথা শেষ করে আমরা বেরিয়ে এসেছি। আপনি তখনও অসুস্থ। বাথরুমে গেলেন। সদর দরজা খোলা। আমি বাইরের সড়কে স্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে রেখে আবার ফেরত এলাম। বলছি, স্যার দরজা খোলা। আপনি বেরিয়ে এসে বললেন, ‘মামুন তুমি যাও, আমি দরজা বন্ধ করছি’। পার্থিব জীবনের সব যোগাযোগ আপনি ছিন্ন করলেন ওই দরজা বন্ধের ভেতর দিয়ে। ওপারে যে দরজা খুলেছেন, সেখানে কি আপনার সান্নিধ্য পাওয়ার লোভে আমাদের অতৃপ্ত আত্মার চাহনি টের পান? কালিদাসের মেঘদূতকে সাথী করে আমাদের জন্য আপনার আশীর্বাদলিপি পাঠাতে হবে স্যার। আপনাকে ছাড়া নশ্বর পৃথিবীতে আমরা যে বড়ো অসহায় আজ।
৪.
রাজধানী ঢাকায় আমার সাহিত্যক্ষেত্র প্রস্তুতির যাত্রালগ্নে সাতের দশকের তিনজন শ্রদ্ধাভাজন কবির সঙ্গে এক বিনি সুতার মালায় রচিত বন্ধন তৈরি হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সে বন্ধন শ্রদ্ধা আর প্রীতির অমলিন কথাকাব্য হয়ে ওঠে। তারা হলেন কবি সৈয়দ হায়দার, কবি নাসির আহমেদ এবং কবি শিহাব সরকার। লেখলেখির সূত্র ধরে এই তিন শ্রদ্ধাভাজন কবির সঙ্গে যে স্নেহ আর শ্রদ্ধার বন্ধন তৈরি হয়েছিল তা আজও অম্লান। যদিও নাসির ভাইয়ের সঙ্গে এখন আর সে-ভাবে কথা হয়ে ওঠে না। কিন্তু তাঁর সাহিত্যকীর্তি আমি লক্ষ করি। কবি নাসির আহমেদ যখন দৈনিক জনকণ্ঠের সাহিত্যপাতা দেখতেন, তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তিনি আমার কবিতাকে ভালোবেসেই সহৃদয়তার সঙ্গে ছেপেছেন জনকণ্ঠের সাময়িকীতে। অনেক গদ্যও তিনি ছেপেছেন। অনেক সময় আমার লেখার নেতিবাচক সমালোচনাও করেছেন- একজন নবীন লেখককে ইতিবাচক অর্থেই গড়ে তুলতে। তাঁর শিক্ষকসুলভ আচরণ আজ আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আমার মনে হয়, আমাদের দৈনিকের সাহিত্যপাতার সার্থক সাহিত্য সম্পাদক হিশেবে সর্বশেষ নামটি উচ্চারিত হবে কবি নাসির আহমেদের। কেননা আজকের দৈনিকের সাহিত্যপাতার সম্পাদকগণ গোষ্ঠীপ্রীতির বলয়ে আবদ্ধ।
নাসির ভাই জনকণ্ঠ ছেড়ে যাবার পর তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কম হতে থাকে। এরও পরে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দিলে আমাদের যোগসূত্র কদাচিৎ মুঠোফোনে ছাড়া আর হয়ে ওঠেনি। আমার চতুর্থ কবিতাগ্রন্থ এ আলোআঁধার আমার-এর অধিকাংশ কবিতাই জনকণ্ঠে প্রকাশিত। আর এই কাব্যটি আমি উৎসর্গ করেছিলাম আমার তিন প্রিয় মানুষ কবি নাসির আহমেদ, কবি শিহাব সরকার ও কবি সৈয়দ হায়দারকে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আমি কবি শিহাব সরকারের কবিতার অনুরক্ত ছিলাম বরাবরই।
আমি যখন একাধারে কবিতাবিষয়ক গদ্য লিখে চলেছি। সেই সময় ‘বাংলাদেশের আধুনিক কবিতায় নস্ট্যালজিয়া’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল কালি ও কলম পত্রিকায়। সেখানে কবি শিহাব সরকারের বেশকিছু কবিতার উদ্ধৃতি ছিল। আমার তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ ‘আদর্শলিপি: পুনর্লিখন’-এর কাজে পুরানো ঢাকায় ইমন প্রকাশনীতে কাজ করছিলাম। এমন সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। অপরপ্রান্ত থেকে কথা বললেন কবি শিহাব সরকার। সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ। জানালেন কবি আববকর সিদ্দিকের কাছ থেকে আমার নম্বর নিয়েছেন তিনি। ধন্যবাদ জানালেন ‘বাংলাদেশের আধুনিক কবিতায় নস্ট্যালজিয়া’ গদ্যে তাঁর কবিতার উদ্ধৃতির জন্যে। মিতবাক এই লোকটির সঙ্গে পরবর্তীতে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে মোহাম্মদপুরে কবি সৈয়দ হায়দারের বাসায় এক মধ্যাহ্ন আড্ডায়। এর অন্তরালে যোগসূত্র হিশাবে কাজ করেছেন বরাবরের মতো কবি ও কথাকার আবুবকর সিদ্দিক। আমার অফিস তখন মোহাম্মদপুরেই। কাজ করি কোস্টাল ফিশারফোক কমিউনিটি নেটওয়ার্কে (কফকন)। তখন শিহাব ভাইয়ের ‘শিহাব সরকারের কবিতা’ নামে কবিতাসমগ্র বেরিয়েছে। তাঁর একটি কপি শিহাব ভাই আমাকে উপহার দিলেন। ধীরে ধীরে শিহাব ভাইযের সঙ্গে সম্পর্কটা গাঢ় হলো। এরও কারণ বোধহয় তিনিও আমার মতো মিতবাক এবং অন্তরালের মানুষ।
শিহাব সরকার কবি হিশাবে যেমন শুদ্ধাচারী, তেমনই মানুষ হিশেবেও তিনি শুদ্ধতার প্রতীক। বর্তমানে তিনি আরও নিভৃতপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাঁর তারুণ্যদীপ্ত মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে পূর্বার অকস্মাৎ প্রয়াণ শিহাব ভাইকে ভেতরে ভেতরে ক্ষয় করে দিয়েছে। তারপরও মাঝে মাঝে শিহাব ভাইকে ঘর থেকে বের করে আনার প্রয়াস চলে। আমার ‘লেখমালা’র এক সাহিত্য সম্মাননা অনুষ্ঠানে তাঁকে অতিথি করে এনেছিলাম। শিহাব ভাই এতটাই আমাকে স্নেহ দিয়েছেন যে, ২০০৮ সালের ২৭ মার্চ অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘আমার দেশ’-এ আমার কবিতাপ্রসঙ্গে সম্পাদকীয় পাতায় কলাম লিখেছিলেন ‘তারুণ্যদীপ্ত কবিতা’ রোনামে। মেয়ে হারানোর ক্ষত কোনোদিনই পুরবে না জানি। তবু শিহাব ভাইয়ের জন্য প্রার্থনা তিনি দাঁড়াতে শিখুন নতুন করে। প্রথম হাঁটার মতো দৃপ্ত চরণে আমাদের কবিতার ভুবনে চিহ্ন রেখে যাবেন আরও কিছুকাল, সেই বিশ্বাস রাখি। কিন্তু কবি সৈয়দ হায়দার? শাদা মনের নির্লোভ, নিরঅহংকার মানুষটি আমাকে একটু বেশিই প্রীতির বন্ধনে বেঁধে ফেলেছিলেন। হতে পারে, তিনি আমার পিতার ছাত্র ছিলেন বলে শিক্ষকের সন্তানকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিয়েছিলেন! আমৃত্যু তিনি আমার কবিতার মুগ্ধ পাঠক হয়ে থেকেছেন। এটি ছিল আমার জন্যে এক পরম পাওয়া। অথচ কাউকে কিছু না জানিয়ে অকস্মাৎ তার প্রস্থান আমি মেনে নিতে পারিনি। এমন তো হবার কথা ছিল না। বহুবার তাঁর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের বাসায় আমি গিয়েছি। আবুবকর সিদ্দিক, শিহাব সরকার আর আমি বেশ কয়েকবার তাঁর বাসায় অড্ডা জমিয়েছি। সেসব আজ স্মৃতি। “চিকিৎসক ও চণ্ডাল/কসাই ও জল্লাদ/রোজ মৃত্যুর এতো মুখ দেখে কি ক্লান্ত নন?/তারাও কি মৃত্যুমুখে পতিত হন না?/ক্রন্দনের কী প্রতিকার?/আল্লা’র কাছে মৃত্যু জরুরী চিকিৎসক কী ছার!” হ্যাঁ, সৈয়দ হায়দারের এই কবিতার মতোই তিনি সত্য। সৃষ্টিকর্তার কাছে মৃত্যুই জরুরি, চিকিৎসক সেখানে নিরুপায়। কিন্তু এভাবে কেন? কাউকে কিছু না জানিয়ে, না জানতে দিয়ে আপনি চলে যাবেন? অথচ আপনি ভাল করেই জানতেন আপনার স্নেহ, মমতা আমার আরও অনেক দিন প্রয়োজন ছিল।২০০১ সালে আমাদের প্রথম পরিচয়। ২০০১-এ পুঠিয়া সাহিত্য পরিষদের বার্ষিক সম্মেলনে কবি সৈয়দ হায়দার, আবুবকর সিদ্দিক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, প্রাবন্ধিক রফিকুল্লাহ খান এবং আমি ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম রাজশাহীর পুঠিয়ায়। যাত্রাপথে পাশাপাশি আসনে বসে নানাবিধ আলাপচারিতায় আমাদের সম্পর্কটিকে বেঁধেছিলাম হৃদয়ের বন্ধনে। সেই থেকে শুরু। কবির মোহাম্মদপুরের বাসায় কতবার গিয়েছি আমি! অথচ তিনি একটুও জানতে দেননি যে তিনি দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত। পাছে তাঁর স্বজনেরা, এই আমরা তাঁকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করি। হাসপাতালের রোগশয্যা থেকেও তো তিনি আমাদের জানতে দেননি। জানি না কী তাঁর এত অভিমান? যে কারণে এত নীরবতা? কবি সৈয়দ হায়দার একুশের বইমেলায় বাংলা একাডেমিতে আসতেন না খুব একটা।তাঁকে ডেকেও আনা যেত না। অথচ সেই তিনি কেবল ভালোবাসার টানে আমার তৃতীয় কবিতার বই আদর্শলিপি : পুনর্লিখন-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে চলে এসেছিলেন সবার আগে। সে-বারই প্রথম আমার সহধর্মিণীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ওইএকটিবেলার পরিচয়ে আমার স্ত্রীও কবির ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন, ধন্য হয়েছেন। তাই যখন আমরা কবির মৃত্যুসংবাদ জানতে পারি, তখন তিনি সকল মায়া ছিন্ন করে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরে শায়িত। আমার ভেতরে ভাঙচূর হচ্ছে, বুকে ব্যথা অনুভব করছি, আর আমার স্ত্রী আঁচলে মুখ ঢাকছেন। একেই বুঝি নিয়তি বলে?
২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে পুঠিয়া সাহিত্য পরিষদের বার্ষিক সম্মেলনে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলাম শ্রদ্ধেয় রফিকউল্লাহ খান, কবিসৈয়দ হায়দার ও আমি। ঐ অনুষ্ঠানে আমি বিশ্ব কবিতা, বাংলা কবিতা ও বাংলাদেশের কবিতা এবং সৎ ও মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি বিষয়ে যে বক্তব্য রেখেছিলাম, তার ভূয়সী প্রশংসা প্রায়ই করতেন তিনি। এমনকি যত্রতত্র যে কোনো সাহিত্যের আড্ডায় ঐ প্রসঙ্গের তিনি অবতারণা করতেন অকুণ্ঠ চিত্তে। এই সহৃদয়বান মানুষটির প্রয়াণে আমি আমার সাহিত্যাবাসের একজন শুভাকাক্সক্ষীকে হারিয়েছি।
সৈয়দ হায়দারকে উৎসর্গীকৃত আমার চতুর্থ কবিতার বই এ আলোআঁধার আমার (২০০৮) কবিকে দিতে তাঁর বাসায় যাই। বইটি হাতে নিয়ে কবির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমাকে রীতিমত লজ্জিত ও বিব্রত করে তোলে। আমি ভাবতে থাকি আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষের বিনয় লোক দেখানো। কিন্তু কবি সৈয়দ হায়দার? মানুষের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার কখনো লোক দেখানো ছিল না। আর তাই তাঁকে ‘মাটি ও মানুষের’ কবি বললে বোধহয় বেশি বলা হবে না।
আমার কোনো লেখা যখনই তিনি কাগজে পড়তেন, খুব উৎফুল্ল হতেন। ফোনের আলাপচারিতায় তিনি প্রায়ই বলতেন “খুব তো লিখছো কবি।” উত্তরে যদি বলতাম ‘আপনাদের মতো কিছু হয় না তো’। কবি বলতেন “আরে আমি আবার লেখক নাকি। তোমরা হলে প্রকৃত লেখক। আমি তো তোমাদের সঙ্গে তাল দিয়ে যাচ্ছি মাত্র, তোমাদের অনেক পড়াশোনা।” আমি জানি এটিও ছিল একজন খাঁটি মানুষের সহৃদয়তা। কবি সৈয়দ হায়দার বাংলাদেশ বেতারে সাপ্তাািহক একটি সাহিত্য অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। যেখানে আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলোর সাপ্তাহিক সাহিত্যপাতার লেখাগুলো নিয়ে একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া চলতো। আমার কোনো লেখা প্রকাশ হলেই কবি তা নিয়ে ঐ অনুষ্ঠানে আলোচনা করতেন। তিনি আমাকে জানাতেনও সে কথা। একজন লেখক হিশেবে বলবো, কবি সৈয়দ হায়দার শুধু একজন বড়ো মনের মানুষই ছিলেন না, আমার একজন ভক্ত-অনুরাগী পাঠকও ছিলেন।
“আমি বারবার প্রেমকে একঘ’রে করতে চেয়েছি/কিন্তু প্রেম জনপ্রিয় নেতার মতো মালা পরতে অভ্যস্ত/এখন প্রেমকে বিশ্বাস হয় না। ...একার প্রেমের দিন শেষ/প্রেমের কাছে মন গচ্ছিত রাখা যায় না” (গদ্য প্রেম/নেহাই)। তথাকথিত আধুনিক পৃথিবীর ‘গদ্য প্রেম’ দেখে আপনি যেমন হতচকিত, যার কাছে নিজের মনটাকেও গচ্ছিত রাখা সম্ভব হয়নি। ঠিক তেমনি আপনার প্রস্থানে আমিও আর প্রেম যেন খুঁজে পাই না। আপনার সমুদ্রের মতো বিশাল মনের কাছে আমার ক্ষুদ্র প্রেম বাঁধা পরেছিল। আপনার ঐ বিরাট মনের কাছে আমার মতন আরও কতজন বাঁধা? এই নিরাহংকার মানুষটি সকল প্রকার লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে সারাজীবন সাহিত্যের সেবা করে গেছেন। আর তাঁর গাছপালা কবিতাগ্রন্থ আজও আমাদের নিরাময় করে তোলে। বিশ্ব-প্রকৃতির বর্তমান তালমাতাল অবস্থার ভিতরে তাঁর ঐ কাব্য বিপর্যস্ত সামাজিক, প্রাকৃতিক, মানবিক পরিবেশ ও প্রতিবেশেও এই জগত- মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে যাবে আরও কিছুকাল।
৫.
এই সময়টাই ছিল আমার লেখার উৎকৃষ্ট সময়। ১৯৯৮-এ প্রথম কবিতাগ্রন্থ সাবিত্রীর জানালা খোলা এবং ২০০১-এ দ্বিতীয় কাব্য কুহকের প্রত্নলিপি প্রকাশের পর দীর্ঘ বিরতি আমার কবিতার বই প্রকাশের ক্ষেত্রে। ২০০২ সালে বিয়ের আগে পর্যন্ত জীবনকে সুস্থিরতা দানে ঝড়ঝাপটা কম যায়নি। সেসব রেখাপাত করেছে কুহকের প্রত্নলিপি কাব্যে। এরপর পেশাগত ক্ষেত্রে আহামরি কিছু না ঘটলেও, জীবনচাকা গড়িয়ে চলেছে তার স্বভাবজাত ভঙিমায়। তাই দীর্ঘ বিরতি শেষে ২০০৭ ও ২০০৮, পর পর দু’বছরে আমার দুটি কাব্য আদর্শলিপি : পুনর্লিখন এবং এ আলোআঁধার আমার আলোর মুখ দেখলো। আদর্শলিপি : পুনর্লিখন কবিতাগ্রন্থের সৃষ্টির অলক্ষে ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটক ‘আকাশ ভরা মেঘ’। ওই নাটকে একজন পুঁজিপতি পিতা অবলোকন করেন তার একমাত্র ছেলের বিপথগামিতা। পিতার অর্থবৈভব ছেলের ভালো লাগে না। পিতার উপার্জনের ক্ষেত্রটিকে ঘৃণা করতে থাকে পুত্র। ক্রমশ সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। পিতা বিষয়টি বুঝতে পেরে ছেলেকে ফেরানোর চেষ্টা করেন। পিতা বলেন, “(হুবহু সংলাপ মনে নেই) আয় আমরা আবার আদর্শলিপি পড়ি। নিজেদের জীবনকে নতুন করে শুরু করি”। অর্থাৎ আদর্শলিপি পাঠের ভেতর দিয়ে এর যথার্থ উপলব্ধি, মূল্যবোধ সৃষ্টি, নীতিবোধ জাগ্রত করার কথা বলা হচ্ছে। আদর্শলিপির যথাযথ শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিশুর ইতিবাচক মানসগঠন তৈরির যে প্রেক্ষাপট, তাকে ধরা হয়েছে ‘আকাশ ভরা মেঘ’ নাটকের উক্ত সংলাপের ভেতর দিয়ে। আর এই বিষয়টিকে ধারণ করে গড়ে উঠেছে আমার তৃতীয় কাব্য আদর্শলিপি : পুনর্লিখন যা ২০০৭ সালে ইমন প্রকাশনী থেকে বের হয়। আদর্শলিপি : পুনর্লিখন উৎসর্গ করি আমার প্রাণের মানুষ, প্রিয় কবি ও কথাকার আবুবকর সিদ্দিককে। অন্যদিকে এ আলোআঁধার আমার কাব্যের মূল বৈশিষ্ট্য মানুষের পার্থিব ও জৈবিক সংসারবৃত্তের কথকতা। এর কবিতাগুলোর ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ পাবেন পাঠকেরা। কিন্তু এই পার্থিব ও জৈবিক সংসারবৃত্তের ইতিবৃত্ত এবং তার সারবত্তা খুঁজে দেখার প্রয়াস ছিল। এ কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় জীবনবোধের নান্দনিকতা ভিন্ন মাত্রিক দ্যোতনা পেয়েছে। বস্তুজগতের যাপিত জীবনের দৃশ্যমান আলো-অন্ধকার ব্যক্তিক জীবনবোধে ঝড় তোলে, তারই কিছু স্বাক্ষর এ কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। বস্তুত পার্থিব ঘরসংসারে সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে মানুষের গন্তব্যও কখনো কখনো অস্থির হয়ে ওঠে। তাতে কখনো উপলব্ধি এসে মেশে, কখনো বিভ্রম।
সেই প্রাতঃস্বিকতায় জগতসংসারের সব প্রাসঙ্গিক ভাবনাগুলো একসুরে গেঁথে তোলার প্রচেষ্টা ছিল। এই কবিতাগ্রন্থের কবিতাগুলো মাননিক ও মানবিক পরিবেশ থেকে উত্থিত, হৃদয়জাত। কিন্তু এ মনোবীজ ব্যক্তিগত বিষয় নয়, তা পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান। সেই সামগ্রিকতাকে ধারণ করার চেষ্টা করেছি মাত্র। সবথেকে বড় কথা এ কাব্যের কবিতাগুলোতে ইমেজের ব্যবহার সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়েছিল। এ আলোআঁধার আমার কাব্যটির উৎসর্গপত্রে লেখা হয়েছিল : শিহাব সরকার, নাসির আহমেদ, সৈয়দ হায়দার যাঁদের স্নেহঋণ আমার সাহিত্যবাসের পাথেয় আমার কবিতাবাসে বাংলাদেশের বিশিষ্ট উক্ত তিন কবির ভূমিকার কথা ইতিপূর্বে বলেছি। শুধু বলবো, ২০০৮ সালের ২৭ মার্চ শিহাব ভাই আমার কবিতা নিয়ে দীর্ঘ এক কলাম লিখলেন অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক আমার দেশ’ কবিতার সম্পাদকীয় পাতায় ‘তারুণ্যদীপ্ত কবিতা’ শিরোনামে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “কবিতার নামে অপ্রয়োজনীয় হৈ-হট্টগোল এবং নগ্ন আত্মপ্রচারের বিভিন্ন কায়দাবাজির আত্মঘাতী পথ ছেড়ে বাংলাদেশের একদল কবিতাগ্রস্ত তরুণ সব দশকে কাব্য চর্চা করে আসছেন। মামুন মুস্তাফাকে এদের অন্যতম পুরোধা কবি হিসেবে আমি মানি নির্দ্বিধায়। ...এ যুগের যে কোনো সময়সচেতন এবং সতত সৃজনশীল কবির মতো মামুনের মেজাজ এবং বাকভঙ্গি প্রতীকী। বেশকিছু কবিতায় তিনি বিশুদ্ধ সিম্বলিস্ট এবং অনায়াসে ঢুকে পড়েন পরাবাস্তবতার ভুবনে। ...”
আমাকে নিয়ে কবি শিহাব সরকারের এই লেখা প্রকাশের পর প্রয়াত শ্রদ্ধেয় কবি সমুদ্র গুপ্ত আমাকে বলেছিলেন, “বুঝেছিস মামুন, শিহাব লিখেছে। তার মানে তোর সম্ভাবনাকে সে দেখতে পেয়েছে। শিহাবের কথাকে আমরা মূল্য দেই। সুতরাং শিহাবের কথার যথার্থতা তোকে প্রমাণ করতে হবে। মনে রাখিস আমার এ কথা।” আজ সমুদ্র দা’ও নেই। কিন্তু তাঁর ওই কথা আজও আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
তবে পরবর্তী পর্যায়ের কয়েকটি বইয়ের প্রসঙ্গ অবধারিত ভাবে বলা উচিত বলে মনে করি। কীভাবে লিখলাম শনিবার ও হাওয়া ঘুড়ি! জীবনের এক গার্হস্থ্য সময়ের টান। সংসারের ক্ষুণ্নিবৃত্তিতে পথ চলি আমরা সবাই। চলছি স্ত্রী ও আমি। তখন তিনি দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার, পরবর্তীতে তিনটি শাখার ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি কোস্টাল ফিশারফোক কমিউনিটি (কফকন) নামক এনজিওতে কাজ করি। আমার প্রথম সন্তান ওয়াসিল বিল্লাহর জন্ম। তাকে দেখাশোনার জন্যে আমার শ্যালিকা রীতা চলে এলো আমার বাসায়। আমার ছোট ছেলে আরিজ বিল্লাহ হওয়া পর্যন্ত প্রায় ৪/৫ বছর রীতা আমাদের কাছেই ছিল। বিএ পাশ করেছে সে। এরপর আমরাই তাকে বিয়ে দিলাম। তখন তার স্বামীও ব্র্যাক ব্যাংকের অফিসার। ওরা বাসা নিল মোহাম্মদপুরে। কিন্তু ওই যে চার/পাঁচ বছর আমাদের যৌথ জীবনযাত্রা, তার চলচ্ছবি আমার কাব্য শনিবার ও হাওয়া ঘুড়ি। কাব্যের তিনটি ভাগ- আদি পর্ব, মধ্য পর্ব ও অন্ত্য পর্ব; এর ভেতরে সংসারজীবনের উত্থানপতন বর্ণিত হয়েছে ইংরেজি রোমান্টিক যুগের পার্সি বিশী শেলী’র ‘স্কাইলার্ক’ কাব্যের অনুসরণে। ঘোর লাগা সময়, ঘুনে খাওয়া সমাজ বাস্তবতার পাশাপাশি পরিবার, যৌথ জীবনের টানাপোড়েন আর বিচ্ছেদের সুন্দরতম বলিরেখায় এ কাব্যের কবিতা-নির্মাণ। শনিবার ও হাওয়া ঘুড়ি মূলত পার্থিব সংসারযাত্রায় একজন ব্যক্তিমানুষের মনোজলোকে ঘটে যাওয়া আর্থ-সামাজিক বিবর্তনগুলোর সারনির্যাস। এর কবিতাগুলোয় সংকেত ও চিত্রকল্পের আড়ালে উঁকি দেয় পারিপার্শ্বিকতা, যেখানে নিজস্ব বোধ ও অনুভূতির সঙ্গে মিলেমিশে গড়ে ওঠে সমাজনির্ণিত পরিবেশ ও প্রতিবেশের সামষ্টিক সংকট। আর তখনই মানবমনের ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ও অসহায় রক্তক্ষরণের দলিল হয়ে ওঠে এর কবিতাগুলো। দীর্ঘ সংসারযাত্রা আশা-স্বপ্নভঙ্গের ছাইভস্ম, তার ভেতরের যে অনুরণন, পরবর্তীতে ব্যক্তির অন্তিম মনোজলোকে ঘটে এক অদ্ভুত দার্শনিকতার মেরুকরণ। জীবনের জটিল বিন্যাসে জর্জরিত ব্যক্তিসত্তার ক্লেশ-নৈরাশ্য ও এক ধরনের দার্শনিক অন্তর্মুখীনতা আমার শনিবার ও হাওয়া ঘুড়ি কাব্যের মূল সুর।
অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যের কিছু কালজয়ী গল্প-উপন্যাসের নারী চরিত্রের কাঁটাছেড়া আমার শিখাসীমন্তিনী কাব্য। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা থেকে আবুল বাশারের ফুলবউ পর্যন্ত যে কয়টি নারী চরিত্র এ কাব্যে বর্ণিত হয়েছে, তাদের মধ্যে মানবমনের জাগরণ আমি দেখতে পেয়েছি। যেখানে তারা সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। আদিকাল হতে এই পৃথিবীতে দুহিতা, দয়িতা আর জননী রূপে নারীর আত্মপ্রকাশ।
জগতসংসারের আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট, আশা-নিরাশার দোলাচলে ঐ ত্রিবেণী সঙ্গমে নারী কখনো প্রেমাসক্ত, স্নেহপরায়ন আবার কখনো রুদ্র, বিপ্লবী, ভয়ংকরী। তবুও সংসারযাত্রার বন্ধুর পথে নারীই হয়ে ওঠে ‘সর্বংসহা’। বাংলা কথাসাহিত্যের এমন কিছু কালজয়ী নারী চরিত্রের ভেতরবাহির শিখাসীমন্তিনী কাব্যের পঙক্তিমালায় ঠাঁই করে নিয়েছে। বলা যায় শিখাসীমন্তিনী নারীর সৃষ্টিশীলতার বহুমাত্রিকতাকে ওইসব নারী চরিত্রগুলোর স্রষ্টাদের চিন্তাজগতের সঙ্গে আমার কবিসত্তার সমীকরণ ঘটেছে। আর একাত্তরের এলিজি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বর্ণনা করছে সত্যভাষণের অগ্নিকুণ্ডলীর মধ্যদিয়ে। একাত্তরের এলিজি প্রথমা প্রকাশিত ‘একাত্তরের চিঠি’ অবলম্বনে রচিত শোকগাথা। যুদ্ধদিনের ভয়ংকর বন্ধুর পথযাত্রা আর পেছনে ফেলে আসা আত্মীয়স্বজনের জন্য হাহাকার- এসব কিছুর এক নির্ভেজাল দিনলিপি কবিতার দ্রাঘিমায় মর্মমূলে আঘাত হানে একাত্তরের এলিজি। আমার সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি মাহবুব কবির একাত্তরের এলিজি সম্পর্কে বলেন, “সেই রক্তাক্ত সময়ে রণাঙ্গন থেকে লিখিত অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার চিঠিতে নিহিত জীবনবৈচিত্র্য, তার সংঘর্ষ ও গতি, প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতা, সংক্ষোভ ও যন্ত্রণা এবং সর্বোপরি তার সীমাবদ্ধতা বা সম্ভাবনার সমন্বিত পরিচর্যায় উদ্বেলিত মামুন মুস্তাফার সপ্তম কবিতাগ্রন্থ একাত্তরের এলিজি। ...কবির সময়কালের একজন হিসেবে বলবো এটি আমাদের জন্য একদিকে আনন্দের, অন্যদিকে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের এক অনস্বীকার্য ইতিহাস।” জীবনভর লিখতে চেয়েছিলাম কবিশ্রেষ্ঠ শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কবিতাগ্রন্থের মতো একটি স্বদেশবন্দনামূলক কাব্য। অবশেষে ‘একাত্তরের চিঠি’র মধ্য দিয়ে ৪২টি চিঠির কাব্যিক রূপ আমার একাত্তরের এলিজি।
২০১৮ সালে প্রকাশিত হলো কফিনকাব্য। মৃত্যুদর্শনমূলক এ কাব্যে মৃত্যুকে নতুন ভাবে দেখা অথবা চেনা। কসাই, খুনি থেকে শুরু করে বিচারক, নর্তকী, ঢুলি, মাঝি, মুচি, গোরখোদক, জ্যোতিষবিদ- সমাজের এমন সব নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের চোখে মৃত্যুকে চেখে নিতে চেয়েছি ভাবদর্শনের অন্য লোকে। ‘কসাইয়ের চাপাতির নিচে মাংসের দলা’ অথবা ‘জুতা সেলাইয়ের ভেতরে জেগে থাকে অনুকাব্য’ কিংবা ‘জল্লাদের দড়ির নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল কেউ কেউ’- এমন সব বাক্যের তোড়ে মৃত্যু সমীচীন হয়ে ধরা দিয়েছে আমার মনোজলোকে। আমার বন্ধু প্রাবন্ধিক শহীদ ইকবাল আমার এসব কাব্যের সমালোচনায় ‘বিষ্ণু দে থেকে মামুন মুস্তাফা’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন : “মামুন মুস্তাফা নিজেকে মেলে ধরেছেন শিখাসীমন্তিনী থেকে অন্য এক লয়ে। সেটি তিনি খুঁজে নিয়েছেন, আলাদা রঙে। পঠনের ধারাবিবরণীতে আমি মনে করি এটি দ্বিতীয়পাঠ। বিষয় : গোলাপ সুন্দরী বা সাহেব বিবি গোলাম ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অনিন্দ্য পাঠ-সংবেদ। নির্ভার হয়ে এসব কাব্যে ফুটে উঠেছে কুসুমকান্তি লোভনরূপ। ফুটন্ত গোলাপকুসুম যেন। বেশ আনন্দদায়ক। পুনঃপাঠ এতো নিবিড় ও নিমগ্নপ্রবণ হতে পারে, এই কবিতাগুলোই তার প্রমাণ। ঠিক সেইটিই পৌঁছেছে একাত্তরের এলিজিতে। এই দুটি কাব্য কবিকে অন্য উচ্চতা দিয়েছে।”
২০১৮ থেকে ২০২৩, দীর্ঘ পাঁচ বছরের ব্যবধানে প্রকাশিত হয় আমার মৌলিক ১২তম কাব্য ‘যাপনকথা’। আমি আমার প্রতিটি কাব্যের উত্তরণে বিষয়-প্রকরণে স্বতন্ত্র হতে চেয়েছি। আর আমার কবিতায় মুখ্য হয়ে উঠেছেন ব্যক্তি। তার স্বকাল সঙ্কটকে ধারণ করতে চেয়েছি একজন ব্যক্তি মানসের চারিত্র্যে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত ‘যাপনকথা’ও তার ব্যতিক্রম নয়। মূলত করোনাক্রান্ত সময়ে আমার নিজস্ব আশ্রয়ে ভাঙচুর, অভাজন মানুষের শেকড়চ্যুতি, অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনীতির ফাঁসকল- এসব বিবিধ বিষয় মনোজলোকে আঘাত হানে ভিন্ন দার্শনিকতায়। ‘যাপনকথা’ সেই সুর বহন করে। বইটি উৎসর্গ করেছি আমার অনেক প্রিয় কবি তো বটেই, বাংলাদেশের কবিতায় ভিন্ন কণ্ঠস্বর কবি, অধ্যাপক ময়ুখ চৌধুরীকে।
তবে নস্টালজিয়া অনেক ক্ষেত্রেই আমার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। আমি স্বীকার করছি তা অনেক সময় পাঠকের কাছে একঘেয়ে মনে হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তি যেখানে মুখ্য, সেখানে নস্টালজিয়া সহজাত। আবার মৃত্যু-দার্শনিকতা ভর করেছে আমার কবিতায় অনেকখানি। বস্তুত এ কয়েকটি বিষয় আমার কবিতার স্বাতন্ত্রিকতা প্রমাণ করতে যথেষ্ট। জানি না তা কতখানি ছুঁয়ে যাবে পাঠককে। অবশ্য আমি মনে করি সে দায়ভারও কবির নয়।
একথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কবিতার অধিবাস। সৃষ্টিশীল মানুষ তার মৌলিকত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। কবি হিশেবে আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তাই আমার কবিতার পশ্চাতেও কাজ করেছে মৌলিকত্ব। সুতরাং প্রচলিত রীতিনীতি, আচার-প্রথা, বিশ্বাসকে অস্বীকার করে নয় বরং এগুলোর হাজার বছরের ঐতিহ্যকে সাক্ষী করেই গড়ে উঠেছে আমার কবিতা। সর্বোপরি ব্যক্তি আবেগ, উত্তাপ, অনুভূতি-বোধ থেকে কবিতা জন্ম নিলেও সৃষ্টিশীল কবিতা চিরকাল মুক্ত মানবতার সপক্ষে, আমি মনে করি আমার কবিতাও তা থেকে ব্যতিক্রম নয়। এ এক আরোগ্য হাসপাতাল। আমার কবিতা নিয়ে এই আমার জবানবন্দি।
৬.
এ কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি আজ, যে, পেশা আমার কি হবে জানা ছিল না; কিন্তু কবি আমাকে হতে হবে, সেই স্বপ্নজাল ছিল আমার দুই চোখে। দক্ষিণের জেলা শহর বাগেরহাটের লোনা বাতাস আর লোনা জলের হাহাকার ছিল আমার শরীরে। দড়াটানার শান্ত ঢেউ মনের গহীনে। সারি সারি নারকেল, সুপারি আর তাল গাছের নিচে দুরন্ত বিকেল আমার পায়ে পায়ে ফেরে। সেই মুখরতাগুলো উঠে এলো আমার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলে বসে যে কবিতা লিখেছি- তা কি কবিতা? নিজেকে গড়ে নিতে বিভিন্ন সাহিত্য আসরে যাচ্ছি, মুখর সাহিত্যসংগঠন করছি, প্রতিটি একুশের বইমেলায় প্রিয় কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গেপরিচয় ও সংস্পর্শে আসছি। এ-সময়েই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সরদার ফজলুর করিম আমার ভেতরের লেখক সত্তাকে পূর্ণতা দিচ্ছেন। আর এ ভাবেই গত শতকের মধ্য নয়ের দশকে জাতীয় কাগজগুলোতে নতুন একটি কবিনাম উঠে এলো ‘মামুন মুস্তাফা’। কিন্তু এই ‘মামুন মুস্তাফা’কে বিশাল অথচ স্বার্থান্বেসী মহানগরীর বুকে অস্তিÍত্ব রক্ষায় একদিকে যেমন জীবন-জীবিকার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে, তেমনি সাহিত্যের বন্ধুর পথে গোষ্ঠীবদ্ধতার বাইরে একাকী, নিঃসঙ্গ হয়ে উঠে আসতে হয়েছে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে। বাবামার খুব ইচ্ছা ছিল একমাত্র ছেলে হিশেবে একটি সরকারি চাকরির। আমারও তো কম বাসনা ছিল না! কিন্তু বিধি বাম।
বিসিএসসহ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগসংক্রান্ত যে কোনো চাকরির ইন্টারভিউ পর্যন্ত গেলেও শেষ পর্যন্ত শিকে ছিঁড়ে না। সেই হতাশার ভেতরে যেভাবে এগুনোর কথা ছিল সাহিত্যসম্ভারে, সেখানেও ভাটা পড়ে, পিছিয়ে পড়ি আমার সমকালীন কবি-লেখকদের থেকে। অবশেষে স্বল্প বেতনের একটি এনজিওর চাকরির ভেতর দিয়ে জীবিকার আপাত সমাধান মিললেও মহানগরীরর জীবনযাপনে তা ছিল সামান্যই।
তবু সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রেখে কখনো এনজিওর চাকরি, কখনো সাংবাদিকতা, কখনো কোনো প্রকাশনীর জেনারেল ম্যানেজার হয়ে জীবিকা ও লেখালেখি চালিয়ে গেছি। যেখানে আমার সহধর্মিণীর সহযোগিতা-সহমর্মিতা অনেক বড়ো ভরসা হয়ে পাশে ছিল। তাই তো পেশাগত ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে আপস করতে পারিনি বিধায় আজ আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে অবসর জীবন বেছে নিতে সাহস পেয়েছি। আর বর্তমানে কখনো কোনো প্রকাশনীর বই সম্পাদনা করা, কখনো বিভিন্ন এনজিওর মিডিয়া এডভোকেসি করে দেয়া, আবার কখনো শিল্পকলা ও বাংলা একাডেমির জন্য লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি আমার সম্পাদিত ছোটকাগজ লেখমালাকে প্রকাশনীতে উন্নীত করার ক্ষুদ্র চেষ্টা চালাচ্ছি।
তবে সবক্ষেত্রেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার স্ত্রী, আমার কাঁধের পাশে তাঁর নির্ভরতার শ্বাস রেখে। আর বাবামায়ের শেষ জীবনে তাঁদেরকে দেখার পরিবর্তে আমৃত্যু তাঁরাই আমাকে দেখে গেছেন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, মফস্বল শহর বাগেরহাটের তৎকালীন প্রফুল্লচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আমার কচি বয়সের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় গোটা বাগেরহাট শহরে উন্মাদনা কাজ করতো, বাঁধভাঙা স্রোত দেখা দিত সেদিন কলেজের মাঠ ঘিরে।
আমার পিতার ধারাভাষ্য মানুষের মুখে মুখে ফিরতো তখন। ওই কচি বয়সে আমার সঙ্গে আব্বার কবিতা ও কবিদের নিয়ে আলোচনা এবং কলেজের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল- আমার ভেতরে জন্ম দিল সাহিত্য রসবোধ। কলেজের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, বার্ষিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়ও ছোটদের কোনো অনুষ্ঠানে আমার কবিতা পাঠ অথবা নাটকে ছোটদের চরিত্রে আমার অভিনয় ছিল নিয়মিত। এ সবই আমাকে কবিতা ও নাটকের প্রতি আকৃষ্ট করে ধীরে ধীরে।
আমার সাহিত্য রচনার প্রেক্ষাপট শুরু হতে থাকে তখন থেকেই। আর তাকে পেছন থেকে গড়ে তোলেন কবি ও কথাকার আবুবকর সিদ্দিক। সুতরাং লেখক হওয়া ছাড়া আমার কোনো গত্যন্তর ছিল না।
আজ তাই চোখের সামনে দেখি ‘কলেজ রোডের জার্নাল’-এ শৈশবের ধূসরতার ভেতরে কে সেই মগ্ন যুবক হেঁটে যায় তানপুরার প্রতিটি তারে ঝংকার তুলে? কিন্তু এই যাত্রা শেষে আমিও দাঁড়াতে চাই কলেজ রোডের পাশে বাতিজ্বলা লাইটপোস্টের নিচে। উপলব্ধি করতে চাই নতুন শিশুর মতো জন্মজননীর চিবুক, পিতার নির্ভরতার হাত ছুঁয়ে দেখতে চাই, একমাত্র সহোদরার অপত্য স্নেহছায়া অঙ্গে মেখ নিতে চাই। আরও চাই
স্ত্রীর অনুরাগমিশ্রিত ভালোবাসায় সিক্ত হতে। সন্তানদ্বয়ের সততার বিশ্বাসটুকু বুঝে নিতে। যে কলেজ রোড আমাকে আজ এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে, তার ফেলে আসা পথের চূর্ণ নুড়িটুকু দিয়ে আমারও কবরের সমাধিফলকে লেখা হোক : নেউল রাত্রির চোখে তবু ভোর বুনি জেনে যাই, গৃহ- এক অসমাপ্ত পাঠশালা।
0 Comments