মাহমুদ কামাল এর দশটি কবিতা

Ten poems of Mahmud Kamal


রান্নাঘর


প্রকৃত প্রস্তাবে ওটি অনূদিত এক রান্নাঘর

প্রাকৃতিক রান্নাঘর

গরম তেলের মাঝে অনায়াসে ডিম ভেঙে দিলে

তখন থাকে না কোনও সৃজন-কৌশল

ভাতের বলক-ধ্বনি ঢেউ হয়ে যদি নেচে ওঠে

রান্নাঘর তখন পার্থিব।

সাদা কবুতর আনন্দ ভ্রমণ ব্যাপি যেভাবে চঞ্চল

ইলিশের স্বাদুগন্ধে ক্ষুধার্ত উদর

সেভাবে গ্রহণ করে উপাদেয় খাদ্যবস্তুকণা

পটু শোলমাছ চোখের আড়াল হয়ে

লুকোয় সেখানে

প্রকৃত প্রস্তাবে ওটি অনূদিত এক রান্নাঘর

সেখানে আজন্ম-ব্যাপি সদা ব্যস্ত পাচক পুরুষ।





পিতা-মাতা বৃক্ষ নিজেই


রক্ত যদি পিতৃপরিচয়

তবে সে সঠিক সুতো নয়।

লাবণ্যের কচিপাতা মৃত

সে রূপ বাইরে প্রকাশিত।

খুলে পড়ে অস্থি মজ্জা হাড়

ব্যবধান অসম পাহাড়।

যদি সূর্য ধীরোদাত্ত হয়

তবে ঘটে চাঁদের প্রণয়।

তবু চাঁদ পরাধীনতায়

নিজেকেই কুরে কুরে খায়।

রক্ত যদি পিতৃপরিচয়

আলোছায়া তখন বিস্ময়।

গাছে ফুল গাছে বিকশিত

পরিচয় সেভাবেই বিবৃত।

বৃক্ষের পিতা-মাতা নেই


পিতা-মাতা বৃক্ষ নিজেই।





কাল সকালে রোজ সকালে


কী ঘটেছে কাল সকালে শরীর ব্যেপে

অল্প কিছু হাওয়া ছিল গাছের ডালে

সেই ডালে কি পাখি ছিল? অন্তরালে

লেপ্টে থাকা রৌদ্র ছিল ঈষদুষ্ণ

আর ছিল কী? চঞ্চলতায় পুলক এলো।

কী ঘটেছে কাল সকালে ভোর সকালে

বিমূর্ত ওই এক মুহূর্ত মূর্ত হয়ে

বেঁচে থাকার মন্ত্র জোগায় ত্রিপঞ্চাশে

কী ঘটেছে কাল সকালে শরীর ব্যেপে

কাল সকালে কাল সকালে রোজ সকালে।




সকলে বলুন ভাই আমিন আমিন


আমার সংসার নেই থেকে যাবো তোর গৃহকোণে

সামাজিক লোকাচার পাশে রেখে খেলি কানামাছি

আষ্টেপৃষ্টে তোকে বেঁধে রাখি পরস্ত্রী আমার

জরুরি তৈজসপত্র এলোমেলো করি খুশিমতো

অপরোক্ষ খাঁচা খুলে করি তোকে কখনো আদর

প্রেমিকের আবরণে খেয়ে ফেলি তোর সব ননি

আয়ান ঘোষের সাথে শারীরিক আজন্ম বিরোধ

রয়েছে বলেই আমি রাধা প্রেমে তোর কাছে আসি

অনিকেত বলে তাতে ক্ষতি নেই হাতে আছে বাঁশি

আমি বেয়ে উঠি তোর পয়মন্ত গাছের শাখায়

ধর্মকে অধর্ম করি অধর্মকে করি অধ্যাদেশ

জলপাই রঙের কাছে সব নীতি করি পরাভূত

নিজেই নিজেকে করি আলোকিত হই চারুশীল

জনারণ্যে প্রকাশিত আমি তবু মনোমুগ্ধকর।

তুই দ্বিচারিণী বলে আমি নই দ্বিতীয় পুরুষ

পুকুরে সাঁতার কাটি সারাদিন আমি হংসদূত

পাড়ে এসে পালকের টুপ ঝেড়ে ফের সামাজিক

অবিষাদ হতে গিয়ে বিষদের তীক্ষè ফলা থেকে

যতই উঠুক ঝড় অশত্থের নেই কোনও ভয়

কাগজের মণ্ড তুই অবিশুদ্ধ গোপন দলিল

সোঁদাগন্ধ মাটি তোকে রতিময় বানাই রমণী

তেজোদীপ্ত মুঠো থেকে বের করি নতুন কাবিন

সকলে বলুন ভাই তারস্বরে আমিন আমিন।





প্রতিবিম্বের পৃথক চেহারা দেখে


আমাকে এখন আমিই হত্যা করি

জীবনের কাছে অনূদিত করি মায়া

উদ্যত ছুরি উড়ে এসে বুকে বিঁধে

যেহেতু বিষাদ মানবিকতার ছলে

বিপরীত আলো ছড়িয়ে দেখায় ভুল

আমিও তখন যুক্তির পাশে গিয়ে

নিজেকে মিলাই প্রতীতির প্রতিযোগে

প্রতিবিম্বের পৃথক চেহারা দেখে

এই জীবনের হিসেব-নিকেশ কষে

আমাকে তখন আমিই হত্যা করি

পড়ে থাকে দেহ তার পাশে আমি বসে

অবশেষে ভুল একটি একটি করে

মৃতদেহ থেকে কাজলরেখার মতো

সূঁচ খুলে নিয়ে নিজেকে মুক্ত করি

জড়ো করি ভুল নিদাঘ অমার রাতে

অতিদ্রুত প্রাণ ফিরে পেয়ে যথারীতি

গতানুগতিক পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে

আমাকেই আমি আবার হত্যা করি।





পুঁজ জমতে জমতে পুঁজি


পুঁজ জমতে জমতে পুঁজি হয়ে গেল

এ পুঁজির বিকাশ হলো সুশীল দাদনে

আমরা কি এখনো মানুষ?

চোখে কালো চশমা নেই,তবু

আমাদের সকল কিছুই কালো হচ্ছে কেন?

পুঁজ দ্রুত খাচ্ছে শুষে করোটি-সংযোগ

সময়কে হত্যা করে খুনি ঘোরে

সামাজিকতায়।

কালোমেঘ ঢেকেছে রোদ্দুর

রাত ভ্রম হয়।

এইসব ঘটতে ঘটতে সাহসের পরাজিত মুখ

দেখে উৎফুল্ল শিহরিত সকল নির্ভর।

পুঁজের গন্ধ ঢাকতে পুঁজির বিকাশ আজ

নতুন আঙ্গিকে সুশীল দাদনে।






আমি উজান তুমি উল্টেরথে


তুমি চাইছো পুনর্বিবেচনা

আমি ছুঁড়ছি অন্ধকারে ঢিল

যাদব বাবুর দুর্নিরীক্ষ হিসেব

তোমার আমার কিভাবে হয় মিল।

তুমি দিনের আলোয় সমর্পিত


আমি রাতের তারা হতে চাই

হন্তারকও মুখ মুচকে হাসে

প্রতুল সময় ঘাড় মটকে খাই

তুমি যখন মকরকান্তি ব্যেপে

আমি তখন কর্কটেরই পথে

পৃষ্ঠপোষক আমজনতার ঢেউ

আমি উজান তুমি উল্টোরথে

তুমি চাইছো পুনর্বিবেচনা

আমি ছুঁড়ছি অন্ধকারে ঢিল

অমিল নিয়ে তত্ত্ব বিচলিত

কিন্তু বাক্য পেলো অন্তমিল।

এসো তবে দু’দিক থেকেই নাচি

পঁচা সাবান দিয়ে কাপড় কাচি।





বরষার পদাবলী


বরষার মতো গতিবেগ দিন চঞ্চল

জীবনে রয়েছে জানি অগণ্য ভ্রান্তি

বর্জ্যপ্রতিম আছে যতো গ্লানি মর্মে

রেখেছি কাঁচের শোকেসে বিষাদ সাজিয়ে

এবার শুদ্ধ হয়ে যাবো ঠিক বর্ষায়

কালো মেঘ যদি গতিময় তবু বিঘ্ন

আকাশ তখন অন্ধ বন্ধ জানালা

নোনা সমুদ্র চোখের গভীরে দৃপ্ত

অশ্রু শুষেছে বিপ্রলম্ভ সাহারা

ভরা বর্ষায় চলেছে স্টিমার শরীরে

হাঁটুজলে প্রেম উথাল পাথাল বিভ্রাট

বিবস্ত্র নদী দু’পাশে প্রেমিক প্রেমিকা

জমে থাকা গ্লানি ধুয়ে নেবে বলে ভ্রান্তি

উদোম নদীর অতিথিরা স্বরবৃত্ত

এসো প্রেম এসো মনের মাধুরী মিশিয়ে

ভরা বরষার আবহমানের সূত্রে।





শ্যমলী হাঁটুজল


নগরী কোলাহল শান্ত চুপি গ্রাম

বৃষ্টি থই থই কৃষক দিশেহারা

বৃষ্টি বর্ষায় হাঁসের জলকেলি

আকাশে মেঘ ওড়ে পাখিরা ঘরে ফেরে

এমতাবস্থায় কিশোরী শ্যামলিমা

উঠিয়ে পরিধেয় নামে সে হাঁটুজলে

কিশোরী কথা বলে হাতের শৃঙ্খলে

হাঁসেরা বাড়ি ফেরে তখনো দুই হাত

নামেনি যথারীতি মেয়েটি চঞ্চল


দূরের গাড়ি থেকে বিমূঢ় দুই চোখ

শ্যামলী হাঁটুজলে প্রেরণা উচ্ছাস

দৃশ্য সরে যায় গাড়ির গতিবেগে

সঙ্গে নিয়ে ফেরে শ্যামলী হাঁটুজল।




সত্য ও মিথ্যা


তোমাকে জেনেছি সত্য

দীর্ঘদিন

আজ প্রমাণিত হলো

মিথ্যে।

তোমাকে জেনেছি মিথ্যা

দীর্ঘদিন

আজ প্রমাণিত হলো

সত্য।

সত্য ও মিথ্যার সংজ্ঞা

কে দিয়েছিলেন?

এখন তাকেই আমি

খুঁজছি।




__________________________________________________________




মাহমুদ কামাল 

সত্তর দশকের অন্যতম কবি। কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ। সম্পাদক ও সংগঠক হিসেবে তাঁর পরিচিতি বিশ্বজুড়ে, বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে। প্রকৃত নাম আবু হেনা মোস্তফা কামাল। জন্ম: ২৩ অক্টোবর ১৯৫৭ সালে, পিতা মো. আব্দুস সালাম, মাতা দেলোয়ারা বেগম।

মাহমুদ কামালের উল্লেক্ষযোগ্য গ্রন্থসমূহ; 
কাব্যগ্রন্থ : পরকীয়া (১৩৯২, তৃতীয় প্রকাশ ১৯৯৭) ; কবিতার মত কিছু কথা (১৯৮৭) ; শব্দেরা কখনো মানতে চায় না ছন্দাছন্দ (১৯৯০); স্বপ্নের রাজকন্যা (১৯৯৮) ; বিরামচিহ্ন (১৯৯৯) ; দ্বিতীয় জীবন (২০০১) ; বিকেলের সকল চড়ুই (২০০৩); বালক বয়সে (২০০৪) ; মেঘেরা কোথায় যায় (২০০৫) ; মুহূর্তের কবিতা (২০০৬); কাব্যসমগ্র (২০০৮) ; বাকিটুকু অদ্ভুত আঁধার (২০১০) ; মুখোশের ভেতরে মুখোশ (২০১২); নির্বাচিত কবিতা (২০১৫) বদলে যায় পথের প্রকৃতি (২০১৪) ; আসে যায় মাঝখানে সামান্য সময় (২০১৭) ; যাবো না তবু যাই (২০২০)।
গল্পগ্রন্থ : গৃহপরিচারিকার গৃহভৃত্য (১৯৯১) ; এলাচিপুরের সেই লোক (২০১৪) ; নির্বাচিত গল্প ( ২০১৯ )। 
উপন্যাস : স্বপ্ন বৃত্তান্ত অথবা জীবনের লক্ষ্য (২০০৭)। 
প্রবন্ধ : চলমান রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০০৫) ; মুক্ত চিন্তার বিবিধ বিবেচনা (২০১৩); গদ্য কতিপয় (২০১৮) ; 
ভ্রমণ : দেশের বাড়ি পাশের বাড়ি (২০০৬)। 
স্মৃতি কথা : ২৬. জীবনের ভিতরে মৃত্যু (২০১১)।



Post a Comment

0 Comments