গল্প ।। শেফালির অপমৃত্যু ।। ~সোমা ঘোষ মণিকা

 

Story. Shefali's death. ~Soma Ghosh Manika


ভোরে ফুল কুড়াতে ওপাড়ে বিসু দত্তদের বাগানবাড়িতে গিয়েছিল শেফু।এই  কাঁচাবয়সী জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ মেয়েটি কলমিডগার মতোই মৃদু জীবনানন্দে কারনে-অকারনে দোল খায়। দোল খেয়ে খেয়ে অনির্বচনীয় আনন্দে খেই হারিয়ে ফেলে। শেফুর জীবন খাতার হালখাতা এখনো হয়নি। পুকুরের শান্ত জলে একটা মা পাতিহাঁস ৬/৭ টা ছানা নিয়ে নিশ্চিন্তমনে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। পুকুরটা বেশি বড় না হলেও এর গভীরতা অনেক। জিয়ল মাছও আছে প্রচুর। চৈত্রের টানে কই, শিং, মাগুর, পাকারুই  কাদা থেকে হাত দিয়েই ধরা যায়। একটা ছোট পুকুর, পালাং এ সবজির বাগান, দুইটা ঘর নিয়ে শেফালিদের ভিটা-বাড়ি। জমিজমা বলতে এইটুকুই।খুব জোরে একটা ঢেকুর তুলে, গনেশ ঘটক বহুব্যবহারে জীর্ণ কালো রংএর ছাতাটি বগল দাবা করে, শেফালিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।ভাদ্র মাস। সকালের বৃষ্টিতে চারপাশে ঘুমোট একটা হাওয়া। নন্দীদের পুকুরপাড়ে গনেশের সাথে চোখাচোখি হয় শেফালির। শেফালির বয়স ১৫ কি ১৬ বছর। আধুনিককালে এ বয়সটা কৈশরের খাতায় জমা পড়লেও, অজপাড়াগাঁয়ে দরিদ্র কৃষকের অসুন্দরী ১৬ বছর বয়সী কন্যা।, পিতা ও গ্রাম্যসমাজের দায়। গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো অনাদরের বেড়ে উঠছে শেফু।কালো হলেও শরীরের ভাজে, ভাজে এক অদ্ভুত মোহনীয় সৌন্দর্য। এই মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলেই দুই পক্ষ থেকেই আখের গোছানো যাবে, এই অভিসন্ধি নিয়েই এসেছিল গণেশ বাড়ুই। গনেশকে দেখে, শেফালি ভূত দেখার মতো চমকে যায়। কুৎসিত দাঁতাল এক হাসি হাসে গণেশ, দাঁত পরিষ্কার না করতে করতে,বহু বছরের পানের পিকের লালচে রঙে গণেশের দাঁতের পাটি, বিজয়া দশমীর অসুরের দাঁতের মতো দেখায়। গনেশ, শেফুকে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে,  ক্ষেতের আইল ধরে অদৃশ্য হয়ে যায়। গণেশ পাকালোক, সে রতন চেনে।

আশ্বিনের ২৫ তারিখ, মানিক মাঝির সাথে অনাড়ম্বরভাবে বিয়ে হয় সদ্য যৌবনের দ্বারপ্রান্তে প্রজ্জ্বলিত যৌবন-প্রদীপ শেফালির।

আশ্বিনের আকাশ সাদা মেঘে চকচক করছে। তাড়াতাড়ি নতুনবৌকে নিয়ে স্টীমারে চড়ে মানিক। মানিক পেশায় মাঝি, জলের সাথে জীবনের যে মিতালি সেখানে মানিক শুধুই একটা মাধ্যম। মানিককে নদী যেভাবে টানে, শেফালির অনা-আরোপিত  যৌবন সেভাবে টানতে পারবে হয়তো কিন্তু নদীর জল যেভাবে বেঁধে রেখেছে সেভাবে বাঁধতে পারবে কিনা, এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। শেফু গ্রাম্যকিশোরী, নিজের গ্রামের বাহিরে বের হওয়া আর দ্বিতীয়বার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া,  তার কাছে একই। শেফুর কাছে এ এক অন্য পৃথিবী। এক অচেনা পৃথিবী, যে পৃথিবীর আকাশ, মাটি, জল, বায়ূ সব এক, ভিন্ন শুধু মানুষের সাথে তার সম্পর্ক। শেফালীকে নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে দিয়ে, কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে বিড়ি ফুঁকে মানিক মাঝি। শেফু পাথরের মত স্হির হয়ে স্টীমারে পাটাতনে বসে থাকে। ভোঁ ভোঁ শব্দে মাতিয়ে, ছুটে চলে স্টীমার।এই শব্দের স্রোতে ভেসে যায় পুরোনো জীবনের গানের সুর। মানিক দুইএকবার শেফালীর সাথে সখ্যতা গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে, আবার বিড়ি টানায় মন দেয়।  
মানিক মাঝির বয়স ৩৬/৩৭, বাধাঁনো শরীর, অক্লান্ত পরিশ্রমে চর্বিহীন দেহটা যেন এক বিশাল শাল কাঠের  কালো তক্তা।
 ঘরের বাহিরে, লোকজনের কোলাহল, শেষরাতের প্রদীপের আলোর মতোই ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে। শেফালি ঘরে একা বসে আছে, ঘরে আসবাব বলতে শুধু একটা বড় কাঁঠাল কাঠের পুরোনো মজবুত চৌকি।জানালার পাশে একটা কাঠের আলনা।একটা বড় টেবিল, টেবিলের উপর একটা নতুন ও আরেকটা পুরনো দাঁত ভাঙ্গা চিরুনি।একটা তিব্বত স্নোর অর্ধ ব্যবহৃত কৌটা, সরিষা ও নারিকেল তেলের ছোটবড় ২ টা শিশি। টেবিল থেকে একটু উপরে ঘরের বেড়ায় একটা দৈর্ঘ্যে প্রস্হে দেড় ফুটের পুরোনো আয়না টাঙ্গানো। শেফালিদের বাড়িতে কোনদিন   আয়না ছিলো না।একবার নন্দীদের বাড়ির পেছনে একটা ভাঙ্গা আয়নার টুকরা খুঁজে পায়,  ঐটাতেই মুখ দেখার কাজ সেরে নিতো শেফালি, যদিও পুরোমুখ কখনো দেখতে যেতোনা  আয়নায়।রাত একটু গভীর হয়ে এলে, মানিক ঘরে ঢুকে, দরজা টেনে দেয়। শেফালি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। পরদিন ভোরে নদীতে যায় মানিক , ফেরে অনেক রাতে। মানিক খুব শান্ত মেজাজের ছেলে,  কথা বলে মেপে মেপে। আজ মানিকের সাথে শেফালির নতুন জীবনের ৩ মাস, মানিক কথা  কম বললেও শেফালির সাথে উঁচু স্বরে কথা বলেনা।শেফালী গর্ভবতী, মানিক আদর যত্ন তেমন না করলেও অনাদরও করে না। সকালে নৌকা নিয়ে গঞ্জে যায় মানিক। আজ তিনদিন, মানিকের বাড়ি ফেরার কোন নাম নাই। নতুন পোয়াতি শেফালী, বাড়ির উপর আর কোন পুরুষ মানুষও নাই। পাঁচদিন পর,এক ভ্যান-গাড়িতে করে মানিকের দলিত- মথিত অর্থ মৃত দেহটা কয়েকজন লোক এসে শেফালীর কাছে দিয়ে যায়। শেফালির মুখে টু শব্দটি নেই, চোখ দুটো দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে। সদ্য তরুনী শেফু। আর্থিক অবস্হা কোনভাবেই ভালো না। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এর উপর অসুস্হ স্বামী। দিন দিন মানিকের শরীরের অবস্হা আরো খারাপ হতে থাকে। এদিকে শেফালির কোল জুড়েও এক পুত্র সন্তান এলো।ঘরের জমানো টাকা, দুইটা দুধেল ছাগল,ডজনখানেক হাঁস, মুরগী সব , মানিকের চিকিৎসার পিছনে খরচ হয়। তবুও মানিকের কোমরের হাড় জোড়া নেয় না। 
দিন যায় দিন আসে, শেফুর সুদিন আসে না। 
লোকের বাড়িতে কাজ করে শেফালি,  অনেক পুরুষই হাঁটা পথে, শেফালির মজবুত শরীরটা আড়চোখে চেখে নেয়। ইদানীং মানিকও খিটখিটে হয়ে গেছে, জল দিতে দেরি হলেই শেফালির উপর চড়ে বসে।শেফালির ছেলের নাম মন্টু, মন্টুর বয়স এখন ২ বছর, যতই দিন যাচ্ছে মানিকের  শরীরের অবস্হা  ততই খারাপ হচ্ছে,সাথে সাথে মেজাজও। অন্যদিকে শেফালির শরীরে যৌবন যেন প্রতি মুহূর্তে বন্যার জল যেমন বেড়ী বাঁধ ভেঙে লোকালয়, জীবন বিপন্ন করার হুমকি দিয়ে যায়, তেমনি বাঁধ ভাঙ্গার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বিয়ের সেই প্রথম তিন মাস,  এরপর পুরুষের স্পর্শ, স্বপ্নেও অনুভব করেনি শেফালি। কাজ করতে করতে কাহিল, শেফু বাড়ি ফিরে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

 দত্ত বাড়ির বড় ছেলে আশিষ কোলকাতা প্রেসিডেন্সিতে  পড়ে, পূজোর ছুটিতে বাড়ি এসেছে। সারাক্ষণ বাড়ির ভেতরই ঘুরঘুর করে, শেফুকেই এই বাড়ির সব কাজ করতে হয়। অন্দর- বাহিরের সব কাজ। তাই  বাড়ির কাজ করতে করতে দুই একবার,শেফালির সাথে চোখাচোখি হয় আশিষের। উচ্ছ্বসিত তরুণ আশিষ, মাথাভরা কালো কুচকুচে চুল। জীম করা পেশীবহুল শরীর। দৈহিক ক্ষুধা আছে এমন সব নারীর ক্ষুধাটাকে নাড়িয়ে দিতে তার উপস্থিতিই যথেষ্ট । সেদিন হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো, উঠোনে শুকতে দেয়া মরিচ, হলুদ তুলতে তুলতে শেফালি একেবারে ভিজে চুপসে যায়। জানালা দিয়ে আশিষ, উঠোনে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ তার চোখ  যায় শেফালির উপর। সারারাত এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসে না, আশিষের।  কয়েকদিন পর, আশিষ এলো মানিকের ঘরে যদিও শেফালি সেসময়টাতে বাড়ি ছিল না। মানিকের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে, মানিকের হাতে ১০০ টাকার একটা কচকচে নোট গুঁজে দেয় আশিষ।  শেফালি না থাকলে প্রতিদিনই বাড়ি আসে যাওয়ার আগে ১০০ করে টাকা দিয়ে যায়। না আজ আশিষ, খালি হাতে যাবে না, যেমন করেই হোক, চুক্তিটা পাকা করতেই হবে।শেফালি বাড়ি ফিরে, তাড়াতাড়ি ভাত চড়ায় চুলাতে। রান্না শেষে ছেলেকে কোলে নিয়ে মানিকের সাথে খেতে বসে শেফু। অনেক দিনপর শেফালির সাথে প্রাণ খুলে কথা বলছে মানিক। শেফুর মনটা অজানা এক ভালো লাগায় হালকা হয়ে যায়।
 
মানিক: বৌ ও বৌ হুনতাছোস, আমি কইতাছিলাম, আমি তো মনয়, আর হাঁটতে চলতে পারমু না। তয় কইছিলাম কি, আঙ্গোর বাড়ির সামনে একটা টঙ্গ দিলে ক্যামুন অয়?
শেফালি: ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দোকান দিবা? ট্যাহা পাইবা কই?
মানিক: ট্যাহা পামু, একজন দিবো কইছে, অহন যদি তুই  যদি খালি ঢং না করস। তাইলেই অইবো। ( বলেই সিন্ধুঘোটকের মত কুতকুত চোখে শেফুর দিকে তাকায় মানিক।)
শেফালি : ঢং কিয়ের ঢং? কি কইবার চাইতাছুইন?
এবার কোন ভণিতা না করে, মানিক সরাসরি বলে ফেলে, 
মানিক: দত্ত বাড়ির বড় পোলা, আশিষ বাবু তোরে চায়। একরাতেরই তো কাম।তুই ঢং করিস না।
শেফালি: (সাপের ছোবল খেলে মানুষ যেমন একই সাথে বিষ ও দূর্বলতার মিশ্রণে চমকে উঠে, শেফুর অবস্হাও তেমন হয়। ঘৃণায় ভরে উঠে শেফুর মন।)

 অহন দেহি শইলের লগে লগে তোমার মনডার  মধ্যেও পঁচন ধরছে। ঘেন্না লাগে আমার,  তোমার লাইগ্যা কিনা করছি, পরের বাড়ি ঝিয়ের কাম করতাছি,  ভগবানের দোহাই লাগি, আমারে মাফ কইরা দেও, আমি তোমার লাইগ্যা সব করাম, এইডা পারতাম না।

মানিক: ( ঘুঙাতে ঘুঙাতে)চুপ কর্ বেঢহা ছিনাল  মাগি কোনহানগার। সতী অইছোস। বেশ্যা মাগী কোনহানকার।  আমি মনে করস কিছু বুঝি না? সারাদিন বাইরে রং ঢং করস, ব্যাডা মাইনসের লগে ফূর্তি কইরা বেড়াস। অহন আমার সামনে সতী হাজস, কালী মাগি বাইর অ বাইর অ আমার ঘর থইন।

পরের দিন শেফালি আর দত্ত বাড়ি যায়নি।
বিকাল থেকেই থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে।মানিক সারাদিনমান খিস্তী করেই চলছে। রাত ৮ টায় আশিষ আসে, মানিকের হাতে ২৫ হাজার টাকার বান্ডেল গুঁজে দেয়। টাকার গন্ধ মানিককে পাগল করে দেয়, এই টাকা দিয়ে মানিক মাঝি স্বপ্ন কিনবে, মুক্তি কিনবে। আর বছরের পর বছর চৌকিতে বসে কাটাতে হবে না তাকে। মানিক জানে পুরুষের হাতে টাকা থাকলে মেলা বৌ জুটে। মানিক আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে, আশিষ হিংস্র হায়েনার মতো খুবলে খুবলে খায় শেফালির শরীর। ভোরে আশিষ যখন বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়, আশিষের পায়ে ধরে, শেফালি।

 শেফালি: বাবু আমারে আপফের লগে কইলকাতা লইয়্যা যাইবান?
আশিষ: কোলকাতায়? কোলকাতায় তুই কি করবি?
শেফালি: ক্যান কাল রাইতে আফনের লগে যা করলাম, ভগবানের দোহাই লাগি বাবু, আমারে লইয়্যা যাইন।

আশিষ শেফালিকে কোলকাতার লালবাজারে ২ লক্ষ টাকায় বেচে দেয়। পিছনে পড়ে থাকে শেফালির অকৃতজ্ঞ স্বামী, যার দেয়া মানসিক যন্ত্রনা এই লালবাজারের লাল নীল আলোর রশ্মিকেও হার মানায়।

আজ ১২ বছরটির কেটে গেল।  এখন গ্রামের কারোরই আর শেফুর কথা তেমন মনে পড়ে না। যারা শেফালীকে চেনে তারা ঘৃনায় উচ্চারণ করে তার নাম। যে স্ত্রী নিজের পঙ্গু স্বামীকে ফেলে  যৌবনের রঙরস উৎযাপন করার জন্য পরপুরুষের হাত ধরে, রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। সেই নারী কুলটা, রাক্ষসী, এভাবেই গ্রামের পরিচিত মহল শেফুকে স্মরণ করে। শেফু শুধু এক জঘন্য নারী নয়, এক নির্মম নিষ্ঠুর মা। 

সকালে খবরের কাগজে বেড়িয়েছে, কোলকাতার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আশিষবাবুর ঝুলন্ত লাশ মিলে তারই বেডরুমের সিলিং ফ্যানে। ধারনা করা হয় এটা আত্মহত্যা নয় খুন।লালবাজারে আজও সবজির মতো দরদামে বিক্রি হচ্ছে কোন না কোন শেফু।

Post a Comment

1 Comments

  1. অনেক সুন্দর একটা গল্প

    ReplyDelete