রাত জেগে এপাশ ওপাশ করছে জগলুল। দু’চোখে ঘুম জড়িয়ে এলেই লাফ দিয়ে উঠে বসছে বিছানায়। কী এক অলিক স্বপ্নে চোখ চকচক করছে। একসাথে এত্তো টাকা! জীবনে সে কোনোদিন দেখে নি। চাকরি জীবনে তো নয়ই, চাকরির আগের জীবনেও নয়। এখন অবশ্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি চাইতে ট্যাকে জোর থাকা লাগে, জোর থাকা লাগে মামা, খালুর। কিন্তু জগলুলের চাকরির সময় তার না ছিল ট্যাকের জোর, আর মামা খালুর কোন অস্তিত্বই ছিল না কোনোদিন। শুধু হাঁটুর জোরে চাকরি হয়েছিল তার। প্রথম যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটা গড়ে তোলার মনস্থির মিটিংয়ের জন্য স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বাঁশতলার ছায়ায় নিরিবিলি প্লাস্টিকের চেয়ার গোল করে বসে নানামুখী তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল, জগলুল দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলো তা। এক সময় কী মনে করে বাড়ি থেকে একটা প্লাস্টিকের রংচটা জগে কল চেপে ঠান্ডা পানি আর একটা কাঁচের গ্লাস দুবলো ঘাসে মাটি গিয়ে ঝকঝকে করে মেজে তাদের মাঝখানে নিয়ে আসে, তখন তারা ঢকঢক করে সে পানি খেয়ে তাদের শুকনো গলা ভিজিয়ে নেন। অনেকক্ষণ ধরে যার পানির পিপাসা লেগেছিল তিনি জগলুর হাতে ঠান্ডা পানির জগ দেখে বেহেশতী সরাবের মতো গোগ্রাসে পান করেন, আর যার পিপাসা ছিল না, বা পিপাসার কথা মনেও আসে নি, তারও ঠান্ডা পানি দেখে হঠাৎ করে অনেক পিপাসা অনুভূত হয়,
তিনিও শান্ত হয়ে ধীরেসুস্থে এক গ্লাস পানি পান করে শান্তিতে, স্বস্তিতে জোরে শ্বাস টেনে নেন। সেই থেকে মিটিং মানেই জগলুলের ঠান্ডা পানি, অতঃপর ধীরে ধীরে ঠান্ডা পানির সাথে গরম চায়ের কদরে জগলুলের আদর অনিবার্য হয়ে ওঠে।
একদিন স্থানীয় মাতব্বর রতন
মিয়া মিটিংয়ের মধ্যে যখন উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে বলে ওঠেন-
-এই ভোরগ্রামে কোনোদিনও কলেজ হবে না। এখানে যেদিন
কলেজ হবে, সেদিন আমার হাতের তলায় লোম গজাবে। এই বলে দিলাম- বলেই ভরা মজলিস ছেড়ে
দুমদাম করে বেরিয়ে যান তিনি।
কী জানি, একথা শুনে এইট পাস জগলুলের কী হয়! নিজের
ভেতর জিদ চেপে বসে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে একেবারে মজলিসের কাছে এসে দাঁড়ায়-
- আমি কইলাম কলেজ এই গ্রামেই অবে। আজ থেকে আমিও
আছি আপনাদের সাথে। কলেজ ঘর করার জন্যি বাঁশ, চাটাই, টিন যা লাগবি আমি একাই দেবো।
কন, কী কী লাগবি?
জগলুলের জিদ চাপা কথা শুনে মিটিংয়ে উষ্ণ গুঞ্জন ওঠে। রমিজ চাচা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে জগলুলকে
জিজ্ঞেস করে-
- কী কয় জগলুল? তোর কী আছে? তুই কনে পাবি এসব? জানিস, কী বলছিস তুই?
-জানি, জানেশুনেই কচ্চি আমি।
জগলুলের কণ্ঠ যেন জ্বলে ওঠে।
-মুক থাকতি কিসির চিন্তা। গ্রামের সবাইরে কবো, যার
যা আছে, তার কাচ তে তাই নেবো। এতো আর আমার নিজির জন্যি নিচ্চি নে, তালি আর আমার
লজ্জা কনে? চাওয়ার মতো চালি মানুষ ঠিকই দিবি।
জগলুর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে অনেকে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। নিয়ামত চাচা বলেন,
- জগলুল ঠিকই কইছে, ভালো কাজের জন্য মানুষের কাছে
চাইলেই পাওয়া যায়। দেখো না, মসজিদ, মাদ্রাসাগুলো। চেয়ে চিন্তেই তো মসজিদগুলো
বানানো হয়। একতলা, দুইতলা, তিনতলা। কতো কী...
- তা ঠিক, আমাদের জগলুল পারবে। আমরাও পারবো। এই
গ্রামে কলেজ আমরাই করবো। কলেজের নামে দেশ বিদেশে আমাদের গ্রাম পরিচিতি পাবে।
আমরাও পরিচিত হবো। অন্য গ্রামের নামে, পরিচয়ে আমরা পরিচিত হবো না।
সেইদিনই কলেজ করার পাকাপোক্ত রেজুলেশন হয়। স্থানীয়
সুধীজন, শিক্ষাবিদ, চাকুরিজীবি, সাংবাদিক, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র কেউই বাদ যায় না সে
লিষ্ট থেকে। আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবসহ মোট একশ একজনের একটা তালিকা করা হয়। তারপর শুরু
হয় কালেকশান। যার ঝাঁড়ে বাঁশ আছে তার ঝাঁড়ের বাঁশ, কারো ভুঁইয়ের শন, কারো কাছে
একবান টিন, কারো কাছে দশ বস্তা সিমেন্ট, কারো কাছে নগদ টাকা, যার দেবার মতো কিছু
নাই সে গাঁয় খেটে দেখতে দেখতে কলেজটা দাঁড় করায়। জায়গাও ঠিক করা হলো। চাকরিযোগ্য
ছেলে মেয়ে যাদের আছে, চাকরিবাবদ তারাই জমি দান করায় জায়গা জমিরও সমস্যা হলো না।
স্থানীয় মাতব্বর রতন মোল্লা, বোর্ডে চাকরিরত গোলাম মিয়া সবাই দৌড়াদৌড়ি করে বোর্ডের
কাগজ বের করে। তারপর
ভিজিটে আসেন বোর্ড ইন্সপেক্টর
আব্দুর রাজ্জাক। একসময় এফিলেশন, পাঠ অনুমোদনসহ কলেজের এমপিওভুক্তির মাধ্যমে
বেতন অনুমোদন দেওয়া হয়। জগলুল প্রথম দিন থেকেই আন্তরিকতাসহকারে চাকরি করে যাচ্ছে।
কোনোদিন কোনো ব্যাপারে তার দায়িত্বপালনে কোন ব্যত্যয় হয়নি।
প্রথম যখন চাকরিতে বেতন হয়, তখন পেতো আড়াইশ টাকা।
দীর্ঘ চল্লিশ বছর একনাগাড়ে চাকরি করার পর আজ তার বেতন দাড়িয়েছে সাড়ে বার হাজার
টাকা। আড়াইশো টাকার জায়গায় সাড়ে বার হাজার টাকা! তাও আজ টাকার সাথে পেরে ওঠে না জগলুল। তখনও মাসে
একদিন চার আনা, আট আনার কাটা ইলিশের ভাগা কিনে ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাত
খেয়েছে। কিন্তু এখন? এক কেজি মাছের দাম সাড়ে বারশো টাকা। হিসেবের খাতা থেকে কবেই
ইলিশ বাদ!
তিন তিনটে ছেলে পড়াশোনা করে। বড়টা এমএ পাশ করে বসে
আছে, ঘুষের টাকার অভাবে চাকরি হয় নি কোনো। মাসে দুই তিনবার সেজেগুজে শহরে যেয়ে
ইন্টারভিউ দিয়ে আসে। তা ওই পর্যন্তই। চাকরি আর হয় না। জগলুল জানে, দেশে কোম্পানির
চাকরির অভাব নাই। যোগ্যতা থাকলে যে কোনো চাকরি যোগাড় করাই যায়। কিন্তু দেখতে শুনতে
নায়কের মতো চেহারার তার ছেলের কোনো চাকরিই যোগাড় করার যোগ্যতা নাই। মেঝো ছেলেটা
পড়ে ওর নিজের হাতে গড়া কলেজে। সেই সুবাদে বেতন মওকুফ করে দিয়েছেন প্রিন্সিপাল
স্যার। ছোট ছেলেটা এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। সব মিলিয়ে এই দুর্মূল্যের বাজারে
হিমসিম খায়।
দিনশেষে জগলুল নিজেকে আজ পরাজিত মনে করে। সে নিজে
এইট পাশ করে নিজের যোগ্যতায় চাকরি পাবার সুখস্বপ্নে বিভোর থাকে মাঝে মাঝেই। আবার
চাকরি শেষের জীবনের কথা মনে হতেই ভাবে- এখন তো তাও মাস গেলি বেতনের নগদটাকাটা
পাচ্চি! কিন্তু আর চৌদ্দ মাস পর কী হবে? তখন তার সংসার চলবে কী করে? কোনো কিছুতেই স্বস্তি পায় না। সে
নানামুখী চেষ্টা করে। কখনো শহরে রাতজাগা নাইট ডিউটির কাজ করে, কখনো চাকরির সময়
শেষে বেলা তিনটা থেকে রাত পর্যন্ত ঘন্টা চুক্তিতে ইজিবাইক চালায়, কখনো বর্গা জমিতে
আমন, আউস, সরিষার চাষ করে। বসত ভিটের তিনপাশে লাউ, কুমড়ো, সবুজ শাক, লাল শাক,
ডাটা, ঢেড়শ এর চাষ করে। এসব করে জগলুল সময়কে ভুলে থাকে। ঘরে তার অসুস্থ পঙ্গু বউ।
নিজ হাতে রান্নাবান্না করে। কখনো অদৃষ্টের দোষ দেয়, কখনো নিজের খুশিতে নিজেই বিভোর
থাকে। জীবনের সব সাধই পূর্ণ হয়েছে তার। কিন্তু
ইদানিং নিজের করে একটা ইজিবাইক খুব চায় জগলুল। দিনশেষে নিজির ইজিবাইক চালায়ে হাজার
টাকা পকেটে নিয়ে ঘরে আসবে!
কিন্তু সেটা যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তাও সে জানে।
একটা ইজিবাইকের দাম কম করে হলেও আড়াই লক্ষ টাকা। সাড়ে বার হাজার টাকা বেতন পাওয়া
জগলুলের পক্ষে কোনোদিনও তা সম্ভব না। যার মাসে একটাকাও সঞ্চয় বলে কিছু নাই।
কিন্তু ও জানে, কিছু চাইলে, চাওয়ার মতো করে চাইলে
অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু কিভাবে? সেটা জগলুল বুঝতে পারে না। ছোটবেলায় মন দিয়ে
মক্তবে বড় হুজুরের বয়ান শুনেছে,
-“তোমাদের কারো জুতার ফিতার প্রয়োজন হলেও তাঁর কাছে
চাও। সেই তোমারে দেবে।”
আজকাল কেন যেন বড় হুজুরের দোয়ার কথাই ঘুমে,
জাগরণে, স্বপনে বারবার মনে পড়ে যায়। একান্তে, একাকি তার কাছে চায়,
- মাওলা, আমারে এটটা নতুন ইজিবাইক কিনে দাও।
ওটুকু বলেই ও ক্ষান্ত দেয়। ব্যাখ্যায় যায় না আর।
কিভাবে দিবা, কোথায় পাবা? তার আমি কী জানি। কইচি, আমারে একখান ইজিবাইক দাও। ব্যস
এই পর্যন্তই। পুরো দুনিয়াডা তো তুমারই।
সময়ের সাথে সাথে শিক্ষা ব্যাবস্থাকে আধুনিকীকরণ করাতে
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, জনবল কাঠামো, পরিচালনা পর্ষদ এর পরিচালনাসহ
নানান রকম পরিপত্র জারি হয়। নিবন্ধনের মাধ্যমে নিয়োগের প্রচলন করা হয়। এতে যেন
জগলুলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। খুব গোপনে সুপ্ত একটা লালিত ইচ্ছে ছিল এতদিন, এমপি
ছাররে হাতে পায়ে ধরে কয়েবুলে বড় ছেলেকে কলেজের
প্রফেসরের পদে ঠিকই ঢুকায় দিতি পারবানে। এরই মধ্যে স্থানীয় এমপি মহোদয় কলেজগুলোতে
সভাপতির পদে থাকতে পারবেন না বলে সরকার পরিপত্র জারি করে। জগলুল চারিদিকে
অন্ধকার দেখে। কিন্তু দিনশেষে তার চাওয়া বন্ধ নাই।
- আমারে এট্টা নতুন ইজিবাইক দাও। মাওলা।
এমপি সাহেবের পরিবর্তে কলেজের সভাপতি হয়ে আসে
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা মো. মোফাচ্ছের আলী। দিশা না পেয়ে একদিন বুকের পাটায় সাহস
নিয়ে একপা দু’পা করে ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে মোফাচ্ছেলের কাছে খুলে বলে ওর মনের কথা।
- মোফাছের আলীও খুশি। যাক, অতিসত্তর কলেজে একটা নিয়োগ দেওয়া যাবে। সভাপতি হয়ে লাভের লাভই হলো তার!
জগলুলরে আর পায় কে?
এক মুখ, দুইমুখ করে সারা গ্রাম রাষ্ট্র হয়- জগলুল
ডবল দামে তার চাকরি বেঁচে দেছে।
...........
লেখক :
ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক,
কথাসাহিত্যিক
অধ্যক্ষ,
তালবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজ,
যশোর।
0 Comments