শিকড় সন্ধানী অদ্বৈত মল্লবর্মণ: প্রসঙ্গ তিতাস একটি নদীর নাম #মানিকরতন শর্মা

Root finder Advaita Mallavarman: Context Titus is the name of a river-Manikaratan Sharma



জল-জাল-জেলে এ তিন বস্তুর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে মালো সম্প্রদায়ের জীবনবিধি। সহজিয়া তিতাসের মাঝে অদ্বৈত মালো জীবনের বাঁকসূত্র আবিষ্কার করেছেন। মালোরা জন্ম দুঃখ, কৈশোর দুঃখ, যৌবন দুঃখ, মাঝ বয়সের দুঃখ এবং বার্ধক্যের দুঃখ, এ দুঃখসমূহ অমবস্যায় তিতাসের জলের শব্দে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন। অন্যপ্রান্তে জন্মসুখ, কৈশোরের চঞ্চলানন্দ, যৌবনে মধুর মিলন রসবৈচিত্র্য, মাঝ বয়সে নিজ প্রজন্মের চাঁদমুখ দর্শন এবং বার্ধক্যে ধর্ম-কর্মে পর পারের সম্বল ভাবনা এই চিরচরিত চিত্রও এঁকেছেন তিতাসকে সঙ্গে নিয়েই।

তিতাস একটি নদীর নাম প্রথমত এবং দ্বিতীয়ত একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। কবিতা এবং উপন্যাসের ভাষা আলাদা হলেও এখানে উভয় ভাষার সার্থক সমন্বয় ঘটেছে। এরূপ সমন্বয় বাংলা সাহিত্যে বিরল। কাজেই এটিকে সার্থক একটি মহাকাব্যও বলা যায়। উচ্চ মার্গীয় জীবনমুখী কবিতার ফ্রেমে তিতাস ও মালো সম্প্রদায়ের গদ্যে জীবনদর্শন। অদ্বৈত তাঁর মনরূপ তুলিতে জলরূপ রঙ দিয়ে মালোদের এক একটি অধ্যায়ের ‘প্রাণচিত্র’ দাঁড় করেছেন।

জালের ভিতর জলের অনেক মাছ দেখে মালোর স্ফুর্তি। তাই ওরা গেয়ে ওঠে, “আগে ছিলাম ব্রাহ্মণের মাইয়া করতাম শিবের পূজা, জালূয়ার সনে কইরা প্রেম কাটি শণের সুতা-রে নছিবে এই ছিল।” প্রেমবস্তু’ মূলত জাত, কুল সম্প্রদায় এর উর্ধ্বে। তাই বাহ্যিক রূপ যৌবনের ‘কাম’ মিশ্রিত প্রেম যৌবনের ভাটার প্রান্তে দুঃখের শণ কাটাই জুটে। পদে পদে জীবনকে হারিয়ে দেয়।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অন্তর্গত মালোদের জীবনচরিত। অদ্বৈতের নিষ্কণ্টক প্রেমের আঁচড়ে প্রাণ সঞ্চার করেছেন এ নদীজলে। আর এ জলেই মালোদের প্রাণপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে অমরতা দান করেছেন তিনি। 

॥ প্রভাসখণ্ড ॥

মাঘ মাসে মালোপাড়াতে একমাত্র মাঘ মণ্ডলের ব্রত হত। কেবল কুমারীদের উৎসব পুরো মাঘ মাস তিতাসের ঘাটে প্রাতঃস্নান করেছে। মন্ত্রপাঠ করেছে সমস্বরে ‘লও লও সুরুজ ঠাকুর লও ঝুটার জল, মাপিয়া জুখিয়া দিব সপ্ত আঁজল।’ এই মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে কুমারীরা সূর্যদেবের কৃপা প্রার্থনা করেছে। যেন তাদের বিবাহ জীবন সুখ ও আনন্দঘন হয়। এব্রত উপলক্ষ্যে মাঝবয়সী ও শেষবয়সী নারীরা গীত গাইতেছে-‘সখি ঐ ত ফুরের পালঙ রইলো, কই কালাচাঁদ আইলো।’

ব্রজাঙ্গনারা নন্দসূত কৃষ্ণকে ভালবেসেছে প্রাণ সমর্পণ করেছে। নিজ আত্মসুখ বিসর্জন দিয়েছে। তাই কৃষ্ণ বিরহ তাদের নিকট মৃত্যুতুল্য, তাই তো এই গীতে কালাচাঁদ কৃষ্ণকে সখিগণ এদিক ওদিক অন্বেষণ করতে লাগল। অদ্বৈত এই গীত এর মাধ্যমে কৃষ্ণের প্রতি সখি প্রেমের গাঢ়তাকে উপস্থাপন করেছেন।

কিশোর,সুবল আর তিলকচাঁদ যখন নৌকা নিয়ে ভৈরব বন্দরে যায় সেখানে নদীর অবাধ উদার রূপ দেখতে দেখতে কিশোরের মনে অনেক গানের সুর ভেসে ওঠে। আর সে সকল গানের মাঝ হতে কিশোর একটি গান গলা ছেড়ে ধরল-
উত্তরের জমিনেরে, সোনা বন্ধু হাল চষে, লাঙ্গলে বাজিয়া উঠে খুয়া। দক্ষিণা মলয়ার বায় চান্দমুখ শুখাইয়া যায় কার ঠাঁই পাঠাইব পান গুয়া। নদীর ক্ধিসঢ়;নারা দিয়া গেল বাঁশি বাজাইয়া পরার পিরীতি মধু লাগে। কু-খেনে বাড়াইলাম পা খেয়াঘাটে নাইরে না খেয়ানীরে খাইল লঙ্কার বাঘে।

এখানে কিশোরের কৈশোর মনে কুমারী নারীর প্রতি মধুর প্রেমের আবাস সঞ্চারিত হয়েছে। তাই তো কিশোর অদ্বৈতের তিতাস পটে এক প্রেমিক পুরুষ হিসেবে চিত্রায়িত হয়েছে। ঘাটে কুমারী কন্যাদের দূর থেকে দেখতে দেখতে কিশোর আরেকটি গান ধরে- মাঝি ভাই তোর পায়ে পড়ি পার দেখিয়া ধর পাড়ি। পিছের মাঝি ডাক দিয়া কয় নৌকা লাগাও প্রেম-তলায়। হরি বল তরী খুল সাধের জোয়ার যায়। যৌবনেই প্রেমকে ধারণ করতে হয়। যার দেহ মনে ঘুন ধরেছে তার নিকট প্রেম কখনই ধরা দেয় না। প্রেমের জন্য শুদ্ধ মন চাই, গভীর হৃদয় চাই। তেমন একটি হৃদয় কিশোরের মাঝে অদ্বৈত স্থাপন করে দিলেন অত্যন্ত সুচারুভাবে।

রাতে ভাত খাওয়ার নিমন্ত্রণে তিলকের সাথে সাধুর শাস্ত্রকথা চলতে থাকে। নদীয়া নগরের প্রভু গৌরাঙ্গ অবতারের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে মহাজনের একখানা গান ধরল-আছে মানুষ গ সই, আছে মানুষ গওরচান্দের ঘরে, নিগূঢ় বৃন্দাবনে গ সই, আছে মানুষ। এক মানুষ বৈকুণ্ঠবাসী, আরেক মানুষ কালোশশী, আরেক মানুষ গ সই, দেহের মাইঝে রসের কেলি করে-নিগূঢ় বৃন্দাবনে গসাই আছে মানুষ ॥

তিলক শ্রীগুরু হতে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত। তাই কথাগুলির অর্থ কিছু কিছু বুঝল। অনেকরাত পর্যন্ত গান হল। সাধুর পাশাপাশি তিলকও তার জানা একটি গান ধরল-উঠান মাটি ঠন্ধসঢ়; ঠন্ধসঢ়; পিড়া নিল স্রোতে, গঙ্গা মইল জল-তিরাসে ব্রহ্মা মইল শীতে। সেরাত্রে কিশোর ও সুবলও গান গেয়ে সাধুর মন মুগ্ধ করল। সাধু মনে মনে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আর্শীবাদ করল,’ বৃন্দাবনের চির কিশোর তোমরা, কৃষ্ণে তোমাদের গোলকের আনন্দদান করুক। আমাকে যেমন তোমরা আনন্দ দিলে, তোমরাও তেমনি আনন্দময় হও

এসকল নিগূঢ় শাস্ত্রকথা অদ্বৈত ছোট্র বয়স হতে জ্ঞাত ছিলেন, কারণ মালোরা সেই সময়ে ছিল কৃষ্ণমন্ত্রী, তারা শ্রীগুরুর কাছ থেকে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ছিলেন। তাই বৃন্দাবনের অপ্রাকৃত লীলা কথামৃত তিনি নিখূঁতভাবে সাধু চরিত্রের মাঝে শুদ্ধভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন।

মোড়লের বাড়িতে সন্ধ্যার পর গানের আসর বসল। সে আসরে প্রথমে তিলক গান জুড়িল,“কাশীনাথ যোগিয়া তুমি নাম ধর নিরাঞ্জন, সদাই যোগাও ভূতের মন, ভূত লইয়া কর খেলন, শিঙ্গা ডম্বর কান্ধে লয়ে নাচিয়া’- অপরপক্ষের একজন আসর বুঝে একটা গানের কথা পরিবেশন করে।-এক পয়সার তেল হইলে তিন বাতি জ্বালায়। জ্বেলে বাতি সারা রাতি ব্রজের পথে চলে যায়।

শুকদেবপুরের মোড়লের এলাকায় দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে নাচ-গানের আসর জমে। সেখানে গায়কেরা দুইটি পৃথক দলে ভাগ হয়ে গান গাওয়ার জন্য তৈরি হল, এক দলের নাম রাধা, অন্য দলের নাম কৃষ্ণ। প্রথমে রাধার দল গান তুলল, 

সুখ-বসন্তকালে, ডেকোনারে
আরে কোকিল বলি তুমারে ॥
বিরহিনীর বিনে কান্ত হৃদাগ্নি হয় জ্বলন্ত,
জলে গেলে, দ্বিগুণ জ্বলে হয় নারে শান্ত।
সে-যে ত্যজে অলি কুসুমকলি রইল কি ভুলে।
এবার কৃষ্ণের দল উচু সুরে গান ধরল-
বসন্তকালে এলরে মদন-
ঘরে রয় না আমার মন ॥
বিদেশে যাহার পতি,
সেই নারীর কিবা গতি,
কতকাল থাকিবে নারী বুকে দিয়া বসন।’
রাধার দল তখন গান ধরল-
বনে বনে পুষ্প ফুটে,
মধুর লোভে অলি জুটে,
কতই কথা মনে মনে উঠে সই-
ব্যথা কার বা কাছে কই ॥
দারুণ বসন্তকালে গো,
নানাবৃক্ষে মেলে ডাল গো,
প্রবাস করে চিরকাল সে এল কই-
বসিয়া তরুর শাখে কুহু কুহু কোকিল ডাকে,
আরে সখিরে এ-এ-এ-
কৃষ্ণের দল এবার অধৈর্য হয়ে ধরল-
“ আজু শুন্ধসঢ়; ব্রজনারী,
রাজোকুমারী, তোমার যৌবনে করব আইন জারি।
হস্তে ধরে নিয়ে যাব,
হৃদকমলে বসাইব-রঙ্গিনী আয় লো-
হস্তে ধরে নিয়ে যাব, হৃদকমলে বসাইব।
বসন তুলিয়া মরাব ঐ লাল-পিচোকারী-

অদ্বৈত সে সময় মালো সম্প্রদায়ের মাঝে রাধা-কৃষ্ণের ব্রজলিলা মাধুর্য গানসমূহের ভাব মন্থন করে অত্যন্ত নিপুণতায় । এসব গান পরম্পরায় মালোদের সম্পদ ছিল এবং আদরের ধন হিসেবে তাদের নিকট সঞ্চিত ছিল। তাই তো মালোরা এই দোল পূর্ণিমার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাধা-কৃষ্ণকে পরম আরাধ্য ধন হিসেবে স্মরণ করেছেন। কিশোরদের নৌকা বাড়ি ফেরার সময় মেঘনার পাড়ে নোঙর করে। সেখানে রাতে অন্য কোনো নৌকায় মুর্শিদা বাউল গান শুনতে পায়-

এলাহির দরিয়ার মাঝে নিরাঞ্জনের খেলা,
শিল পাথর ভাসিয়া গেল শুকনায় ডুবল ভেলা।
জলের আসন জলের বসন দেইখ্যা সারাসারি,
বালুচরে নাও ঠেকাইয়া পলাইল বেপারী।

পাশেই অন্য একটি নৌকায় শোনা যাচ্ছে বারোমাসি গান-

এহী ত আষাঢ় মাসে বরিষা গম্ভীর,
আজ রাত্রি হবে চুরি লীলার মন্দির।

ঠিক তার পাশের নৌকায় শোনা যায় পুঁথি পাঠের সুর-

হাম্মক রাজার দেশেরে-
উত্তরিল শেষে রে।

এ দিকে কোনো এক নৌকায় কথার ফাঁকে ফাঁকে গান ভেসে আসছে-

আর দিন উঠেরে চন্দ্র পুবে আর পশ্চিমে।
আজোকা উঠছেরে চন্দ্র শানের বান্ধান ঘাঠে।

কিশোর, সুবল ও তিলকদের মাঝে অদ্বৈত নিজকে ছায়ামূর্তি হিসেবে প্রতিস্থাপন করে আবহমান বাংলার নদী আশ্রিত লোকজ পুঁথি, বাউলের সুর আস্বাদন করেছেন। নিজকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন মনন ও মানসে তেমনি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটিকেও বহুমাত্রিক উচ্ছতায় অধিষ্ঠান করেছেন।


॥ নয়াবসত ॥

রামপ্রসাদ বাহারুল্লা ভাই এর সাথে জারি গানের প্রসঙ্গ তুললেন। এক পর্যায়ে বর্ষীয়ান মাতাব্বর রামপ্রসাদ জারী গানের কথা বলতে গিয়ে বলেন,দুইটা গানের সুর অখনো মরমে গাঁথা হইয়া আছে-‘মনে লয় উড়িয়া যাই কারবালার ময়দানে’ আর ‘জয়নালের কান্দনে, মানে কি আর মানে রে, বিরিক্ষের পত্র ঝরে। এবার বাহারুল্লা মাতাব্বর রামপ্রসাদকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল-বাছা তুমি রথে যাইওনা, চৌদিকে কাফিরের দেশ, জহর মিলে ত পানি মিলে না। গোকর্ণ গ্রাম কেবল যে মালো সম্প্রদায় ছিল তা নয়, সে গ্রামে মুসলমান সম্প্রদায়ও ছিল। হিন্দু- মুসলমানের এক ভ্রাতৃত্ববোধের সমন্বয় ছিল এই গোকর্ণ গ্রাম। অদ্বৈত এক প্রান্তে গৌর-নিতাইর গান যেমন পরিবেশন করেছেন তেমনি জারি গানে বীররস- রুণরসের তত্ত্ব বিষয়টি তুলে ধরেছেন ভ্রাতৃত্ব চেতনায়। যে বছর ধান অধিক পরিমাণে ফলে সে বছরে কৃষককুল মনের ভেতর এক অপার আনন্দ উপভোগ করার জন্য জারি গান গেয়ে একে অপরের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করতেন। অমাবস্যায় কালীপূজায় রামপ্রসাদরা যাত্রাগানের আসর আর কবিগানের আসরও জমাত। অদ্বৈত ছিল সে সকল আনন্দের রসভোক্তা।


॥ জন্ম মৃত্যু বিবাহ ॥

জন্মটা মিলনের সৃষ্টি, বিবাহ যৌবনের সৃষ্টি আর মৃত্যু বার্ধক্যের পরিণতি। এটাই চিরাচরিত প্রকৃতির নিয়ম। আর স্বপ্নটা পুরো জীবন প্রবাহের প্রেরণা। জন্মের তের দিন পরে অশৌচ সমাপ্তি ঘটল। সে দিন পুরনারীরা এক সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে চলল, দেখ রাণী ভাগ্যমানরাণীর কোলেতে নাচে দয়াল ভগবান। নাচরে নাচরে গোপাল খাইয়া ক্ষীর ননী, নাচিলে বানাইয়া দিব হস্তের পাচনি। একবার নাচ দুইবার নাচ তিন বার নাচ দেখি, নাচিলে গড়াইয়া দিব হস্তের মোহন বাঁশি। বেপাড়ী শ্যামসুন্দর এর বিবাহ শেষে নাপিত ভাই, ‘গুরু বচন’ বলছে-

শুন শুন সভাজন শুন দিয়া মন,
শিবের বিবাহ কথা অপূর্ব কথন।
কৈলাস শিখরে শিব ধ্যানেতে আছিল,
উমার সহিতে বিয়া নারদে ঘটাইল।
শিবেরে দেখিয়া কাঁন্দে উমাদেবীর মা,
এমন বুড়ারে আমি উমা দিব না . . .
শিবেরে পাইয়া উমা হরষিত হইল,
সাঙ্গ হইল শিবের বিয়া হরি হরি বল।
ভরা আষাঢ়-এ তিতাস যেমন নতুন জলে যৌবন প্রাপ্ত হয় তেমনি মাঘ-ফাল্গুনে এ তিতাস জরা জীর্ণ হয়ে শ্রীহীন বার্ধক্যের আকার ধারণ করে। মালোদের জীবন পর্বও এ তিতাস আবর্তে আবর্তিত। তিতাস মালো সম্প্রদায়ের জীবনের অংশকলা। সূর্য যেমন তার কিরণকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না, জন্ম যেমন মৃত্যুকে পাশকাটাতে পারে না তেমনি মালোরাও এ তিতাসকে জীবন নদী হতে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। অদ্বৈত এ তিতাসের প্রাণের সাথে মালোদের প্রাণের স্পন্দন ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করেছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের শব্দানুভূতিতে।


॥ রামধনু ॥

রাত জাগার ছলে চোখে যাতে ঘুম না আসে তাই উদয়তারা শিলোক বলে, হিজল গাছে বিজল ধরে, সন্ধ্যা হইলে ভাইঙ্গা পড়ে প্রশ্ন রেখে আরো একটি শিলোক বলে,পানির তলে বিন্দাজী গাছ ঝিকিমিকি করে, ইলসা মাছে ঠোকর দিলে ঝরঝরাইয়া পড়ে? ‘আদা চাক্ধসঢ়;চাক্ধসঢ়; দুধের বর্ণ, এ শিলোক না ভাঙ্গাইলে বৃথা জন্ম। এভাবে অনেকক্ষণ শিলোক চলল। অদ্বৈত মল্লবর্মণ আমাদের আবহমান গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিলোক, পরস্তাবসমূহ উপন্যাসের বাঁকে বাঁকে উপস্থাপন করেছেন দক্ষতার সাথে। তিনি আমাদের মাঝে একটা সময়ের সংস্কৃতির মুখচিত্র অংকন করেছেন আমাদেরই পরম্পরার প্রজন্মের কাছে। সনাতন ধর্মালম্বীরা রাইকে কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির মূর্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এই রাই যখন নিদ্রাচ্ছন্ন কৃষ্ণকুঠিরে তখন তার প্রিয় বন্ধু শুক-সারী নামে দুইটি পাখি দিনের আগমনের বার্তা দেবার জন্যই রাইকে জাগার জন্য আহবান করছে-

রাই জাগো গো, আমার ধনী জাগো গো,
বৃন্দাবন বিলাসিনী, রাই জাগো গো।

সেকালে হিন্দু পাড়ায় পাড়ায় প্রায় প্রতিদিন ভোর বেলায় প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে এসে মন্দিরা বাজিয়ে রাই-এর ঘুম ভাঙ্গার গান পরিবেশন করতেন সাধুবাবাজী। অনন্ত এই গানটার বাকী অংশটাও ঠিক ঠিক মনে রেখেছে-

শুক বলে ওগো সারী কত নিদ্রা যাও,
আপনে জাগিয়া আগে বন্ধুরে জাগাও,
আমার রাই জাগো গো, আমার ধনী জাগো গো,
বৃন্দাবন বিলাসিনী, রাই জাগো গো।
অদ্বৈত অনন্ত হয়ে নিজকে সেই কালের সাক্ষী হিসেবে এই তিতাস একটি নদীর নামের ফ্রেমে সাক্ষ্য হয়ে রয়েছেন।

সেসময় বাড়িতে বাড়িতে সন্ধ্যা হলে পদ্মাপুরাণ গানের আসর বসত। আবাল- বৃদ্ধাবণিতা সকলেই মনোযোগসহ শোনত। সেরকম আসরে একদিন সাধু ও বনমালীরা মাতিয়ে গান ধরেছে-

মা যে-মতি চায় সে-মতি কর, কে তোমায় দোষে,
ঊল মা কোথায় যাই দাঁড়াইবার স্থান নাই,
আমারে দেখিয়া সাগর শোষে.
মা, আমারে দেখিয়া সাগর শোষে।

এ গানটির পর বনমালী একটি লাচারী তোলে-

সোনার বরণ দুইটি শিশু ঝল্ধসঢ়;মল ঝলমল করে গো,
আমি দেইখে এলাম ভরতের বাজারে।

এপর্যায়ে সাধুবাবাজী বলমালীকে থামিয়ে দিশা করে গান তোলার কথা বলে, বলমালী এবার তোলে-

অ ঠিক, সুমন্ত্র চইলে যায়রে, যাত্রাকালে রাম নাম।’
রামায়নের ঘুষা। তরণীসেন যুদ্ধে যাইতেছে। আচ্ছা, চলতে পারে। কত গ্রাম, কত নগর, কত হাওর, কত প্রান্তর, কত বন, কত জঙ্গল পার হইয়া চলিয়াছে বেহুলা আর নদীতে চলিয়াছে লখিন্দরের ভেলা। এবার বনমালী একটু ভাবিয়া তুলিল এ গানটি-

সাত পাঁচ পুত্র যার ভাগ্যবতী মা ;
আমি অতি অভাগিনী একা মাত্র নীলমণি,
মথুরার মোকামে গেলা, আর ত আইলা না।’

অনন্তের স্বরূপ হচ্ছে অদ্বৈত। আজ পদ্মাপুরাণের গানের আসরে অদ্বৈত সময়ের কালজয়ী মরমী দর্শক। যে কিনা মননে ও মেধায় নিজকে লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এ অমর উপন্যাসের চিরসবুজ গল্পে।

অদ্বৈত আসরে কেবল শ্রোতা হতে চাননি, এমনকি শ্রোতার যে ধর্ম গ্রহণ করা সে গ্রহণ বস্তুটিকে তিনি অত্যন্ত সযত্নে ধারণও করেছিলেন। কারণ বাঙালির যে সহস্র বছরের আত্মিক সংস্কৃতি সেটা অদ্বৈত হৃদয়ের স্পন্দনে স্থান দিয়েছিলেন। যার ফলে তাঁর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ একজন কালের দিগি¦জয়ী সুসন্তান।


॥ রাঙা নাও ॥

এ অংশে একটা নৌকা দৌঁড়ের এলাকায় যাবার সময় সারি গান গাইছে-

সকলের সকলি আছে আমার নাই গো কেউ।
আমার অন্তরে গরজি উঠে সমুদ্দুরের ঢেউ।
নদীর কিনারে গেলাম পার হইবার আশে।
নাও আছে কাণ্ডারী নাই শুধু ডিঙ্গা ভাসে।

আমাদের ভাটি অঞ্চলের নদী-দেহে যখন যৌবন আসে তখন সে অঞ্চলের নাও মানুষগণ নৌকা দৌড়ের খেলার আয়োজন করে। সে উপলক্ষ্যে দূর-দূরান্ত হতে অনেক মানুষ ছোটছোট নৌকা নিয়ে এ খেলার দর্শক হয়ে আনন্দ উপভোগ করে। আস্বাদন করে অপার সুখ। অদ্বৈত এক্ষেত্রে আমাদের কাউকে এমন আনন্দ হতে বঞ্চিত করেনি। বরং ঋণী করে রেখেছেন অনিন্দ্য ঋদ্ধ সংস্কৃতির বন্ধনে।


॥ দুরঙা প্রজাপতি ॥

অদ্বৈতের বোধের সম্মুখে পুরো মালোপাড়া মুলধারা ও নব্যধারার সংস্কৃতি এ দুইভাগে ভাগ হয়ে দুইটি বাড়িতে বিভাজন হয়েছে। কালোবরণের বাড়িতে জমেছে নব্য ধারা অর্থাৎ যাত্রাওয়ালারা আর মোহনের বাড়িতে আসর বসেছে মূল ধারা অর্থাৎ শিকড়ের সংস্কৃতি রক্ষার দৃঢ়তায়।
মোহনের দল পর্যায়ক্রমে দেহতত্ত্বের গান, বিচ্ছেদ গান, নিশিরাতে ভাইট্যাল গান, রাত পোহাবার অল্প আগে হরিবংশ গান, ভোরে ভোরগান আর সকালে গোষ্ঠগান তারপর মিলন গান গেয়ে শেষ করবে বলে দেহতত্ত্ব গান শেষ করে বিচ্ছেদ গান শুরু করে- 
ভোমর কইও গিয়া, 
কালিয়ার বিচ্ছেদে রাধার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া।
না খায় অন্ন না লয় পানি,
না বান্ধে মাথার কেশ, 
তুই শ্যামের বিহনে রাধার জাগলিনীর বেশ।

মোহনের বিরহ গানে অদ্বৈত চিত্রায়িত করেছেন মৌলিক বিরহ রসের উৎপত্তি ধামটিকে, চিত্রটি কেমন ছিল একবার দেখে নেই-আজ কৃষ্ণের মথুরায় গমন। শূন্য বৃন্দাবন, একসারে ক্রন্দন করিতেছে। পশুপাখী, গাভীবৎস, দ্বাদশবন, যমুনাপুলিন, চৌত্রিশ ক্রোশ ব্রজাঙ্গন একযোগে রোদন করিতেছে। ব্রজগোপীর চোখের জলে পথ পিছল। সে পিছল পথে রথের চাকা কতবার বসিয়া গিয়াছে। ব্রজগোপী কতবার গাহিয়াছে, “ প্রাণ মোরে নেওরে সঙ্গেতে, ব্রজনাথ রাখ রথ কালিন্দীর তটেতে। কিন্তু তবু কৃষ্ণের মথুরা যাত্রা থামে নাই। হরিবংশের গান ধরার আগে মোহন ভাইট্যাল গান শেষ করল এই গানটি গেয়ে- কালো কালো কোকিল কালো, কালো ব্রজের হরি। খঞ্জন পক্ষীর বুক কালো, চিত্ত ধরিতে না পারি। শুতিলে না আসে নিদ্রা বসিলে ঝুরে আঁখি। (আমি) শিথান বালিশ পইথান বালিশ বুকে তুইল্যা রাখি।

এবার হরিবংশ গান ধরল মোহনের দলের সেনাপতি উদয়চাঁদ-মাটির উপরে বৃক্ষের বসতি, তার উপরে ডাল, তার উপরে বগুলার বাসা, আমি জীবন ছাড়া থাকিব কতকাল। নদীর ঐ পারে কানাইয়ার বসতি, রাধিকা কেমনে জানে।
ওদিকে কালোবরণের বাড়ি হতে তখনও গান ভেসে আসছে- 
সারারাতি মালা গাঁথি মুখে চুমু খাই রে, 
চিনিরি পানা মুখখানা তোর আহা মরে-যাইরে।
দুই বাড়িতে দুই ধারার গানের রস দর্শক শ্রোতা ভেদ বুঝতে পেরে কালোবরণের বাড়ি হতে লোকজন মোহনের বাড়িতে আসতে লাগল আর এদৃশ্য দেখে উদয় চাঁদ এবার তার সেরা গান ধরল-
না ওরে বন্ধ্ধসঢ়; বন্ধ্ধসঢ়;, কি আরে বন্ধ রে,
তুই শ্যামে রাধারে-করিলি কলঙ্কিনী।
মথুরার হাটে ফুরাইল বিকিকিনি ॥
না ওরে বন্ধু-
তেল নাই সলিতা নাই, কিসে জ্বলে বাতি।
কেবা বানাইল ঘর, কেবা ঘরের পতি ॥
না ওরে বন্ধু-
উঠান মাটি ঠন্ধসঢ়;ঠন্ধসঢ়; পিড়া নিল সোতে।
গঙ্গা মইল জল-তিরাসে ব্রহ্মা মইল শীতে ॥

সেদিন মোহনের বাড়িতে মানুষের ঢল পড়ল। এতে মোহনের বুক ভরে গেল এ ভেবে যে আজও তাদের প্রাণের গান শুনতে এখনো ব্যাকুল হয় মানুষ। কিন্তু মোহনের এই বুকভরা আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। যে দিন কালোবরণের বাড়িতে বাক্সবাক্স সাজ আসিল এবং রাত্রিতে যখন সাজ পোশাক পরিয়া সত্যিকারের যাত্রা আরম্ভ হইল। মালোরা তখন সব তুলিয়া যাত্রার আসর ভরিয়া তুলিল। বালকবৃদ্ধ নারী পুরুষ কেউ বাদ রহিল না। সকলেই গেল। মাত্র দুইটি নরনারী গেল না। তারা সুবলার বউ আর মোহন। অপমানে সুবলার বউ বিছানায় পড়িয়া রহিল, আর বড় দুঃখে মোহনের দুই চোখ ফাটিয়া জল আসিতে লাগিল।

সংস্কৃতির এই খণ্ডিত চিত্রটি অদ্বৈত তাঁর হৃদয় স্পর্শে মোহনের বুকের জমিনে জন্মের মত মাটি চাপা দিল। সময় হচ্ছে একটা মানুষের পুরো জীবনের প্রধান শিক্ষক। নীরবে নীরবে আমাদের মন-মানসিকতায় জীবনপাঠের লেসন দিয়ে যায় সে। আমাদের তিতাসের অদ্বৈত সেই কালের প্রধান শিক্ষকের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। যার বুক ভরা কষ্ট মোহনের বুক হয়ে বেজে ওঠে।


॥ ভাসমান ॥

তিতাস জলে কত লক্ষ-কোটি খড়-কুটো ভেসে যায় অজানা দুরদেশে। যাদের হদিস কেউ রাখে না। একটি সময় সেই খড় কুটোগুলি বিলীন হয়ে যায় জলের স্রোতের কাছে। মালোরাও আজ সর্বস্ব হারিয়ে বিলীন। ভাসমান পর্বটিতে অদ্বৈত একটি প্রান্তিক সম্প্রদায়ের পতনের রূপটি চিত্রায়িত করেছেন বিরহরসের রূপকার হিসেবে। অদ্বৈতের নিকট ‘তিতাস’ ছিল আশ্রয় আর বিষয় ছিল ‘মালো সম্প্রদায়’ আবার একইভাবে বলা যায় ‘তিতাস’ ছিল বিষয় আর আশ্রয় ছিল ‘মালো সম্প্রদায়’। মালো আর তিতাস এক অখণ্ড অস্তিত্ব। অদ্বৈত এই দুইকে একপ্রাণে ধারণ করেছেন নান্দনিক উৎকর্ষে।


লেখক:

Post a Comment

0 Comments