সোমা ঘোষ মনিকার গল্প ~ প্রতিবেশীর অপমৃত্যু

Soma Ghosh Monika's Story ~ Neighbor's Immortality


আমি অতুল্যপ্রসাদ রায়, আমার জন্ম বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায়। আমার পিতা হরকিশোরপ্রসাদ রায়, স্হানীয় স্কুলে গণিতের শিক্ষক ছিলেন, বাবা গত হয়েছেন সে হবে ১৩ বছর। এখন আমার ৬৯ চলে, চাকরী থেকে অবসরের অনেক আগেই মাথার চুল গুলো অবসর নিয়ে নিয়েছে।মুখের দু,তিনটে দাঁতও তুলে ফেলেছি। চোখের জ্যোতিও কমে এসেছে তবে বাতের ব্যথা, বদ হজম আমার শরীরটাকে কখনোই একা থাকতে দেয় না তবুও আজকাল নিজেকে বড় একা একা লাগে, বড় ছেলেটি ডাক্তার ঢাকাতেই থাকে, সেখানেই প্র্যাকটিস করে। মেজো ছেলে খুলনায় আছে, প্রাণী সম্পদ অফিসার হিসেবে। ছোটটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির লেকচারার। আমার সহধর্মিণী নিয়তিবালা দেবী, সে নেই এখন আর, শ্বাসকষ্ট ছিল সেই জন্ম থেকেই, তার উপর হার্টের ব্যামো, তাই চাপ সইতে না পেরে চলে গেলো। আমার একটি মাত্র মেয়ে সুনয়না রায় সেন, বিয়ে দিলেম তা হবে ৬ বছর, স্বামী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, এ হলো আমার পরিবার রায় পরিবার।

আমার কথা বলার জন্যেই আজ নড়েচড়ে বসা। তবে শুরু করি, আমার অমল শৈশব দিয়েই, আমি শৈশবে ডানপিটে ছিলাম খুব, বেপরোয়াও বলা যায়। এই প্রতিবেশীর আম বাগানে হামলা তো ঐ প্রতিবেশীর লিচু বাগান সাফ করা এই হলো আমাদের হুলোবেড়াল দলের কাজ। বন্ধুরা কজন মিলে কোন এক প্রতিবেশীর পাকা কলার ছড়ি সাবাড় করে ফেলা। একবার হলো কি, ডাঙ গুলি খেলছি সব বন্ধুরা মিলে, এমন সময় গুলি ছুটে এক প্রতিবেশীর কপালে লাগলো, আর যায় কোথায়, সঙ্গে সঙ্গে কপাল ফেটে ফিনকী দিয়ে রক্ত ছুটছে, গাল গড়িয়ে রক্তে বেচারার জামা পর্যন্ত মাখামাখি। না সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য, আমাদের জেল জরিমানা হয়নি, যা হলো ডাঙগুলিটা পুকুরের জলে বিসর্জন আর সন্ধ্যেবেলা মায়ের হাতে রামকেলানী খাওয়া। পৌষপার্বণে সকালে, বিকালে, দুপুরে এর বাড়ি ওর বাড়িতে পিঠা, পায়েশ খেয়ে পেট ঢোলের মতো ফুলিয়ে বড় গাছের নিচে বসে পরিকল্পনা করা, কার গাছের বেল বড় হচ্ছে, কার বাগানের বড়ইগুলো পেকে একেবারে টুপটুপ করছে। একবার বাবা স্কুলের কি কাজে সদরে গিয়েছেন, তখন যোগাযোগের ক্ষেত্রে  গরুর গাড়ির চল ছিলো, তো স্বাভাবিকভাবেই বাবা সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরতে পারেননি। রাত আনুমানিক ১ টা হবে, শেয়াল ডাকা শুরু করেছে । এমন সময় আমার পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে বমি আর পাতলা পায়খানা, মা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন, মা কাঁদতে কাঁদতে দিশেহারা,  সেই সময় আমার ছোট ভাই অমলপ্রসাদ, চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো  মা তখন দিশেহারা তাই বাঁধাও দিলেন না। মিনিট দুয়েকের মধ্যে নিধুকাকা, রবি দাদা, জামাল চাচা, মনিরমা কাকী, সুরেশের ঠাকুরমা সবাই চলে এলেন, হারিকেন হাতে। তখন ডায়রিয়ার তেমন কোন চিকিৎসা গ্রামে প্রচলিত ছিলো না, বেশির ভাগ সময়ই মানুষকে মরতে হতো ডায়রিয়ায় ডিহাইড্রেশন এবং শরীর লবণ-শূন্য  হয়ে। গোপাল জেঠু একটু পর এলেন তার মহিষের গাড়িটি নিয়ে, কিছুদিন আগে উনারই বড় ছেলের কপাল ফাটিয়ে ছিলাম, আমি ডাঙগুলি মেরে। আমাকে পাজাকোলা করে মহিষের গাড়িতে শুয়ে দিলেন। গাড়িতে মাও উঠে বসে সেই সাথে মনিরমা কাকী, যার সাধের কামরাঙা গাছের কামরাঙা গুলো একটিও আমার জন্য কখনো পাকতে পারেনি। নিধুকাকা, জামাল চাচা, সবাই চললেন, আমার সাথে সদরে, আমার চোখ দুটো বুজে আসছে। ধীরে ধীরে ক্লান্ত শরীরে ঘুম ঝেঁপে এলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল কেমন করে রবিদার নাটাইটা ভেঙ্গে দিয়েছিলাম। হারুগোপালের এঁড়ে বাছুরটাকে কেমন করে বাঁধন খুলে দিতাম, যার জন্য হারুগোপালের হাতে কম কান মলা খাইনি।কানে ভেসে এলো, মেজখোঁড়ীর চিৎকার। কখন সদরে পৌঁছেছি মনে নেই। চোখ খুলে দেখি, বাবা হাসপাতালের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার হাতে স্যালাইন খুলে গ্লুকোজ দেয়া হয়েছে। মা, মাথার পাশে বসে আছেন, জানালা দিয়ে দেখলাম জামাল চাচা,নিধুকাকা,রবিদা, মনিরমা কাকী সবাই বারান্দায়। সুস্হ হয়ে দুদিন পর বাড়ি ফিরলাম।বাড়ি ফিরে শুনি, মেজখোঁড়ীমা যিনি আমাকে দিনে শতবার শাপশাপান্ত করতেন, তিনি আমার দীর্ঘায়ু কামনা করে মাকালীর নিকট জোড়াপাঁঠা বলি মানসিক করেছেন।সুরেশের ঠাকুরমা, যাকে তিনবার করে ছুঁয়ে দিতাম বলে, তিনবারই পুকুরের জলে গঙ্গা গঙ্গা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্নান করতেন, আমাকে হতচ্ছাড়া বলে গালি দিতেন, সেই তিনিই আমাদের বাড়িতে সেই যে আমার খবর পেয়ে রাত্রে এসেছিলেন, এখনো বাড়ি ফেরেনি, উনার গোপাল ঠাকুর আজ তিন দিন ধরে না খেয়ে আছে।গোপাল ঠাকুরকে না খাইয়ে আমার জন্য দুধের সন্দেশ আঁচলে করে বেঁধে এনেছেন।আজ বহুকাল হলো বাবার সাথে সাথে গোপাল জেঠু, জামাল চাচা,, নিধূকাকা সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। রবিদার সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়, উনি এখন কানেও খানিকটা কম শুনেন। তো এই ছিলো আমাদের প্রতিবেশী আমাদের আত্মার আত্মীয়। এখন আমার বড়ছেলের কথা বলি, গত ফেব্রুয়ারিতে বড় ছেলের বাসায় এসেছি ছেলে, ছেলেবৌ দুজনই ডাক্তার, সেই সকালে বের হয়, রাতে ফিরে মাঝে মাঝে ফিরেও না, ঘরে তাদের একটি মাত্র সন্তান, টোটন, টোটনের বয়স ৯ বছর, ইংলিশ স্কুলে পড়ে।একদিন বিকালে টোটনকে নিয়ে বেড়িয়েছি, লনে হাঁটছি, এমন সময় টোটনের বয়সী এক ছেলেকে দেখি, লনের এককোনায় চুপচাপ বসে আছে, আমি হাতের ইশারায় কাছে ডাকি, ছেলেটি কাছে আসে, অনেক কথা হয়, টোটনসোনা সম বয়সী ছেলেটিকে পেয়ে ভীষণ খুশি। তারা দুজনে বল খেলছে, আমি খেয়াল করলাম, টোটনের চেয়ে ছেলেটির শারীরিক শক্তি বেশি।খেলা শেষে আমারা রুমে ফিরে এলাম। রাতে সবাই একসঙ্গে  বসে খাচ্ছি এমন সময়, এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ কানে এলো, জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম, দেখি আমাদের বিল্ডিং এর সামনেই এসে থেমেছে। ছেলেকে জিঙ্গেস করলাম, কিরে কার কি হলো তুই কি কিছু জানিস? ছেলে খানিকটা অবাক হলো মনে হলো, বললো, বাবা কি যে বলো না তুমি! আমি কেমন করে জানবো? আমার কি অতো সময় আছে? আমি তো কাউকে চিনিই না এখানকার । আমি ভূত দেখার মতো বিস্মিত নেত্রে আমার ছেলের দিকে তাকিয়ে আছি, ছেলে আপন মনে ডিনার সারছে।  সেদিন রাতে আমার একেবারেই ঘুম হলো না। সকালে লনে অনেকের কাছে জিঙ্গেস করলাম, কেউ বলতে পারলেন না, এ্যাম্বুলেন্স কার জন্য এসেছে। সবাই নাকি বিজি, কেউ কেউ আমার এই উপযাচিত হয়ে কথা বলায় বিরক্তও হয়েছে। নিজে দারোয়ানকে জিঙ্গেস করলাম, সেও বলতে পারেনি, অবশেষে আমার চাপাচাপিতে রেজিস্টারে এন্ট্রি দেখে বলল, ২ নাম্বার বিল্ডিং এর সি ব্লকের এ/২ নাম্বার ফ্ল্যাটের রশিদ সাহেবকে এ্যাম্বুলেন্স করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আজ টোটনের জন্মদিন, কয়কজন বেশ ভদ্রস্থ লোকজন এলেন, হাতে দামী গিফটের প্যাকেট, তাদের সাথে তেমন কোন ছোট, ছোট বাচ্চা দেখলাম না। জানালা দিয়ে নিচে চোখ পড়লো। দেখলাম সেদিনকার সেই ছোট বাচ্চা ছেলেটি, লনে একা দাঁড়িয়ে আছে, একবার ভাবলাম ডেকে উপরে নিয়ে আসি টোটনসোনা হয়তো খুশি হবে, কিন্তু সাহস পেলাম না, এতো আমাদের অজপাড়াগাঁ নয়, যে চাইলেই এক চাঁটাইয়ে ৫/৬ জনকে বসিয়ে পিঠা,পায়েস খেতে দিতে পারবো, এ যে শহর, আধুনিকার ছোঁয়ায়, আন্তরিকতা, মমতা, মায়া, সৌহার্দ দম বন্ধ হয়ে মরে গেছে হবে হয়তো, কোন কালে।যাই হোক আমাকে টোটনের জন্মদিনে যে খাবারের প্লেটটি দিয়েছিল, সেটি নিয়ে গোপনে নিচে নেমে ছেলেটিকে নিজ হাতে খাওয়ালাম।।আসার সময় দেখলাম, নিচে একটি লাশবাহী গাড়ী, বুঝতে কষ্ট হলো না,  হয়তো এ গাড়ীতেই শুয়ে আছে রশিদ সাহেবের নিথর দেহ। না আশে, পাশে স্বজনদের ভীর নেই, আহাজারি নেই। কোন প্রতিবেশীর উদ্বেগ নেই, ঘরে ফিরে এলাম।এসে দেখি, আমার ছেলে তার গেস্টদের সাথে তার সাফল্যের গল্পে মশগুল,  একবার ভাবলাম ছেলের কানে কানে বলি,, রশীদ সাহেবের মৃত্যু সংবাদটা।কিন্তু নাহ,  ভিতর থেকে কোন সাড়া এলো না, হয়তো বা টোটনের মা ও গেস্টরা বিরক্তই হবেন। বুকের ভিতরটা এজ অজানা কষ্টে কচকচ করছে, না এ কোন রশিদ সাহেবের মৃত্যু নয়, এ অত্যাধুনিক সমাজের প্রতিবেশীর অপমৃত্যু, এ এমন এক অপমৃত্যু যা এখনি ঠেকাতে হবে, নয়তো ধ্বংসের আর দেরী নেই। হঠাৎ বৌমার ওয়াসরুম থেকে খুব জোরে তার চিৎকার শোনা গেলো। সবাই সে শব্দ শুনে বৌমায়ের রুমের দিকে ছুটে।


Neighbor's Immortality


Post a Comment

0 Comments