(ইন্দোনেশিয়ার গল্প) ‘ভ্যান বিউরেন আর গ্রাম্য মেয়েটি’

'Van Buren and the Country Girl' (Indonesian Story)


আরোদিয়াত কার্তা মিহাবজা (Achdiat Karta Mihardja) ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম জাভায় জানানোর করেন। তিনি পেশায় ছিলেন শিক্ষাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়) ইন্দোনেশিয়ার পেরি একজন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল। রাজনীতির প্রায় বছর যাবত এ অনীহা। তাঁর উপনার ও ছোট গল্পের সংগ্রহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।



ঘটনাটা ঘটেছিল আমস্টারডামে, শরতের এক ঝড়ো সন্ধ্যায়। পথ হারিয়ে ভ্যালেরিয়াস স্ট্রিটে যাওয়ার পথটা জেনে নিতে হলো আমাকে। যে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি ইন্দোনেশীয় ভাষায় উত্তর দেয়ায় আমি হতবাক হলাম এবং আমার ‘গৌডেন এভন্ড’ সম্ভাষণের উত্তরে তিনি বললেন, 'মারডেকা' আমার 'এই পথে যেতে হবে, সাউদারা।' আমার খোঁজ করা পথটায় তিনি খুব অমায়িকভাবে আমাকে সঙ্গ দিলেন, যে স্থানটায় আমাদের দেখা তা থেকে দুটো মোড় পেরিয়েই ভ্যালেরিয়াস স্ট্রিটের দেখা পেলাম ডাচ হিসেবে লোকটি বেশ খাটো। বাতাসের ঝাপটা থেকে হ্যাটটাকে ঠিক রাখতে মাঝে মাঝে তিনি হাত দিয়ে হ্যাটটাকে নিচু করে দিচ্ছিলেন। হ্যাটটার মতো তাঁর ওভারকোটটাও পুরানো আর এলোমেলো। যদিও তাঁর মুখটা আমি ভালোভাবে দেখতে পেলাম না, তাঁর কথা বলার ধীর-স্থির ধরণ ও নরম স্বর আমাকে বুঝিয়ে দিল তিনি একজন চমৎকার লোক। মসলায়নী বিচানার হাঁটতে হাঁটতে তিনি আমাকে বললেন, বিপ্লবের সময় থেকে তিনি ইন্দোনেশিয়ায় আছেন; তিনি বিনয়ের সাথে আমাকে বাসায় যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানালেন। দেরি না করেই আমরা দিন-ক্ষণ ঠিক করে ফেললাম। তিনদিন পর, নির্ধারিত দিনের এক অপরাহ্ণে আমি তাঁর ডোর-বেলটি বাজালাম। তিনি নিজেই দরজা খুললেন আর আমরা অন্ধকারময় সিঁড়ি ভেঙে সোজা তৃতীয় তলায় উঠলাম যেখানে তিনি এমন একটি কক্ষে বাস করতেন যা অনাড়ম্বর ও একার জন্য যথেষ্ট। কক্ষটা আসলেও সাদামাটা, যে কেউই সেখানে দারিদ্রের গন্ধ পাবে- চেয়ার তিনটার বেশি নয়, একটা ড্রেসার এবং একটা ডিভান যা বোধ করি বিছানা হিসেবেও কাজ করে। সবগুলো আসবাবই পুরানো কালের। সব কিছু অগোছালো- বইগুলো ছড়ানো-ছিটানো, টেবিলের ওপর দাবার খুঁটিগুলো শেষবার খেলার পর আর সরানো হয় নি, জানালার কাছে ইজেলের ওপর একটা অসমাপ্ত চিত্রকর্ম, ব্রাশ ও রঙের টিউব ইজেলের নিচে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গালাকি যত জানাযান 'ছবি আঁকেন নাকি?' জিজ্ঞেস করলাম আমি। 'এই সময় কাটানো আর-কী।' এক কোণ থেকে একটা চেয়ার টেনে তিনি আমাকে বসতে বললেন। তাঁর ঘরের আলোয়, সেদিন সন্ধ্যায় দেখা হওয়ার সময় তাঁর সম্পর্কে আমরা ধারণা বদ্ধমূল হলো- আমার নিমন্ত্রণকারী আসলেই বন্ধুপ্রিয়; যদিও ভিন্ন ধাঁচের মানুষ তিনি। ইজেলের পাশে হেলান দেয়া একটা স্তূপ থেকে একটার পর একটা অসমাপ্ত চিত্রকর্ম নিয়ে তিনি আমাকে দেখাতে লাগলেন। চিত্রকর্মগুলোর প্রকাশশৈলী বিভিন্ন রকমের। আমার মনে হলো নিজস্ব শৈলীটা প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম না পেয়ে তিনি প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। ইজেলের ওপর অসমাপ্ত চিত্রকর্মটি পর্বতের ঢালে ধানক্ষেতের ছবি। দুমড়ানো-মুচড়ানো একটা রঙের টিউব নিতে নিতে তিনি বললেন, 'প্রিয়াঙ্গন গ্রাম।' ব্যাকুল কণ্ঠে জানালেন, প্রায়ই তিনি পশ্চিম জাভা-র সেই পাহাড়ি গ্রামটির কথা মনে করেন। 'ভবিষ্যতে কিছুদিনের জন্য ঐ গ্রামে ভ্রমণের আশা আমি কি করতে পারি? নীল ও সুউচ্চ গিডিহ্ পর্বতের ঢাল ছেয়ে থাকা চা-গাছের ঝোপের ভেতর ঘুরে বেড়াতে পারব কি? চা-পাতা তুলতে তুলতে রং-বেরঙের কিবায়াস ও বাটিক সারংস পোশাক পরা সুন্দরী ও সহজ-সরল রমণীদের উচ্ছল হাসি আবার কি শুনতে পাব? জঙ্গলের সতেজ ও ঠাণ্ডা হাওয়ায় আবার কি শ্বাস নিতে পারব?' স্পষ্টতই তিনি ভাবাবেগে ডুবে জীবন্ত স্মৃতি আর প্রবল আকাঙ্ক্ষার মিশ্রণে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। 'কেন যেতে পারবেন না? আগে থেকেই তো আর আপনি নিশ্চিত হতে পারেন না।' পা দুটো আড়াআড়ি করে খানিকটা বিষণ্ণভাবে বসে ছিলেন তিনি। 'এই সুন্দর গ্রামটিকে আমি নিজের জন্মস্থানের মতোই ভালোবাসি। হয়তো অদ্ভুত শোনাল। তবে আমি এই গ্রামটিকে অনুভব করি।' 'কী রকম?' আমি জানতে চাইলাম। 'কেবল বিস্তৃত পর্বতমালার অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য নয়- কারণ আপনি নিজেই হয়তো-বা জানেন সুইস আপ্স কতই-না অপরূপ- তবু সেগুলো প্রিয়াঙ্গন গ্রামের মতো মনোরম নয় আমার কাছে।' তিনি নিছক রসিকতা করছেন আমার সাথে, এই সন্দেহে আমি হাসলাম। 'আমি বিশ্বাস করি,' তিনি বলে চললেন, 'আমার ভালোবাসা বরং এর বাসিন্দাদের, সহজ-সরল আর বন্ধুবৎসল গ্রাম্য লোকগুলোর জন্যে। এটা এমন একটা অনুভূতি যা সবকিছুকে সুন্দর করে তোলে। উদাহরণ স্বরূপ, মরুভূমির কথাই ধরুন। এটা কি সত্য নয় যে ওসব নিঃসাড় আর একঘেয়েমিপূর্ণ এলাকাগুলো ভালাবাসা- আন্দোলিত মানুষের জন্য সৌন্দর্যের আধার হতে পারে?' 

সামনে পা মেলে দিয়ে তিনি গল্প বলে যেতে লাগলেন। জানালেন বিপ্লবের সময়ে কীভাবে তিনি ডাচ ইমপেরিয়াল আর্মি-তে সার্জেন্ট হয়েছিলেন এবং কীভাবে তাঁকে কিছুদিন জেল খাটতে হয়েছিল আর সবশেষে কীভাবে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। জেলে দেবার কারণ, তার কথামতো- কেবল স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাওয়াটা ছিল যাদের অপরাধ, সেসব লোককে গুলি করে হত্যা করা চালিয়ে যেতে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। 'সিগারেট খান,' বর্ণনায় বিরতি দিয়ে তিনি বললেন। পায়জামার পেছন পকেট থেকে একটা পাইপ নিতে নিতে তিনি বললেন, 'আমি নিজেই ওসব খাই না। কেবল প্রশ্রয় দিই।' ছাইদানির জন্যে ড্রেসারের কাছে গিয়ে গল্পটা তিনি শুরু করলেন, 'হত্যা করাটা আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, এটা ছিল জঘন্য একটা কাজ। এক সন্ধ্যায় ব্যানডাং-এর ডাগো স্ট্রিটে আমি দেখলাম কিছু সৈনিক একটা অল্প বয়েসি ছেলের সাইকেল থামাল। একেবারে কোনো কারণ ছাড়াই সৈনিকেরা ছেলেটিকে ধরে টেনে হিচড়ে রাস্তার একপ্রান্তে নিয়ে গেল এবং বৈদ্যুতিক থামের সাথে হেলান দিয়ে সোজাভাবে দাঁড়াবার নির্দেশ দিল। তারপর কোনো রকম সতর্কবাণী ছাড়াই, সৈনিকদের একজন খাপ থেকে তলোয়ার বের করল এবং এমন ভয়ংকরভাবে ছেলেটার শরীর কেটে ফেলল যে তলোয়ারটা লোহার থামে বাড়ি খেয়ে ঝনঝন শব্দে স্ফুলিঙ্গ ছড়াল। একটু ভাবুন দেখি, কোনো কারণ ছাড়াই পুরো ঘটনাটা ঘটে গেল, তাছাড়া সেই হতভাগা ছিল এমন একজনের পুত্র যে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছিল। তার প্রাণটা কয়েক মুহূর্তে উড়ে গেল এবং ঘটনাটার কথা সবাই দিব্যি ভুলে গেল।' অত্যন্ত বিরাগভরে অথচ প্রশান্তভাবে ভ্যান বিউরেন (ওটাই ছিল তাঁর নাম) তাঁর গল্পটা বললেন। গল্প বলার মাঝে মাঝে পাইপ থেকে মুখের লালা ঝেড়ে ফেলতে লাগলেন মেঝের ওপর। তখন হঠাৎ বেল বেজে উঠল। সাথে সাথে তিনি দরজার দিকে ছুটে গেলেন এবং এক মুহূর্ত পরেই এক নবাগত প্রবেশ করল। গাঢ় নীল স্যুট পরা লোকটা ইন্দোনেশীয়। ছোট-খাটো দেহ। ছোট নাক আর আধ-বোজা চোখ দুটো মনে হলো সারাক্ষণ অস্থিরভাবে ঘুরছে। আধ-মাথা টাকটা তার প্রশস্ত কপালটাকে বেঢপ উচ্চতা দিয়েছে। আর তার ভাবভঙ্গি ছিল অবিচল ও অস্বাভাবিক, যেন আরো উদ্ধত আচরণের মাধ্যমে নিজেকে সে সন্দেহ থেকে বাঁচাতে চাইছিল। লোকটা ফিসফিস করে ভ্যান বিউরেনকে কিছু একটা বলে যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই চলে গেল- আমার সাথে কোনো কুশল বিনিময় ছাড়াই। আমাকে আবার বসতে বলে, ভ্যান বিউরেন বললেন, 'লোকটা আমার পূর্বপরিচিত, দু'দিন আগেই ইন্দোনেশিয়া থেকে এসেছে। আসলে ওকে তেমন একটা পছন্দ করি না আমি।' সেদিনের পর থেকে লোকটাকে আমি ভ্যান বিউরেনের বেশকিছু অনুষ্ঠানে দেখেছি। আমি সব সময়ই ভাবতাম লোকটার হাবভাব কেন অত অদ্ভুত ও গোপনীয়। বক্তৃতার লেশ মাত্র ছিল না তার মধ্যে।


 এক অপরাহে, ভ্যান বিউবেন আমাকে তাঁর বাসায় যেতে বলেলেন- 'আমি এক বোতল শেরি জোগাড় করেছি, আপনি তো ওটা খুব পছন্দ করেন। চিত্রকর্মটি খুব ভালো তবে স্পষ্টতই ভ্যান গগের অনুকরণ। গ্লাসে শেরি চালতে ঢালতে তিনি বললেন, 'আপনি ও-জায়গাটা চেনেন?' আমি উত্তর দিলাম, 'অবশ্যই চিনি, জায়গাটা গিডিহ্ পর্বতের পেছনে বিশাল আগ্নেয়গিরি বিশিষ্ট তজিপানাস জেলায়।' 'হ্যাঁ, আমি তা খুব ভালো করেই জানি। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।' তিনি গ্লাসটা তুলে ধরলেন। 'আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি,' আমি উত্তর দিলাম। আমরা পান করলাম। 'তাহলে তো আপনি সেখানকার লোকজনকেও চেনেন?' - 'না, বাস বা কার-এ করে ব্যানডাং-এ যাওয়ার সময় আমি শুধু সেই অঞ্চলটা পেরিয়ে যেতেই পছন্দ করি। সম্ভবত আমার চেয়ে আপনিই ওদের আরো ভালো জানবেন।' 'স্বাধীনতার পর তাদের জীবন এখন কেমন কাটছে?' 'খুব ভালো,' আমি জানালাম। 'ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এজন্য,' কিন্তু এক মুহূর্তের চিন্তার পর তিনি পুনরায় জানতে চাইলেন, 'আপনি ভালো বলতে আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?' * আমি তখনই উত্তর দিলাম না আর তিনি বলে যেতে লাগলেন: 'ওখানকার কিছু লোককে আমি চিনি- তারা ক্ষুদ্র চাষী, খুবই স্বল্প আবাদী শ্রমিক এবং আর কিছু চা তোলার লোকজন। আপনি কি মনে করেন আবাদী শ্রমিকদের আয় বর্তমানে তাদের জীবিকার জন্য পর্যাপ্ত? আমি শুনেছি যে, তাদের অনেকেই অপুষ্টিতে ভুগছে। এ ধরনের সংবাদ অত্যন্ত উদ্বেগজনক।' উত্তর দেবার অবকাশ ছিল না আমার, কারণ ডোর-বেলের শব্দ আমাদের কথায় ছেদ ঘটাল। 'দুৎ, আবার কে এল,' বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন ভ্যান বিউরেন। দরজা খুলে তিনি কাউকেই ভেতরে আসতে দিলেন না। নিজেই দরজার আড়ালে চলে গেলেন। তারপর আমি তাঁর দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার পদশব্দ শুনতে পেলাম। সংক্ষিপ্ত নীরবতার পর সিঁড়ির নিচ থেকে বাগবিতণ্ডার তিক্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। নির আমি হতবাক হলাম। ব্যাপারটা কী হতে পারে? 'একেবারে নির্লজ্জ লোক, ভ্যান বিউব্রেন কক্ষে পুনঃপ্রবেশ করতে করতে বলতে লাগলেন, নৈতিকতাহীন, চরিত্রহীন, একেবারে নীতিহীন লোক একটা রতে বলতে লাগলেন, নৈতিকতানের আমি তাঁকে অনুযোগ করার সুযোগ দিলাম। এটা পরিষ্কার হলো যে তিরস্কৃত লোকটা পরিপাটি পোশাক পরা সেই ইন্দোনেশীয়টি। 'আচ্ছা, ওর মতো লোককে আপনি কী বলবেন। ওর সাথে আমার পরিচয় দক্ষিণ ব্যানটেন জেলায়। ১৯৪৭ সালে ইন্দোনেশিয়ানবরণ। বাল ওয়ারে বিরুদ্ধে আামদের


ওথাকথিত 'ফার্স্ট পুলিশ অ্যাকশন'-এর অব্যবহিত পরেই। ঠিক এক সপ্তাহ – আমি ভুলি নি - ঠিক এক সপ্তাহ আগে আমাকে জেলে ঢোকানো হয়েছিল; তিনি জনগণের জন্য করা একটা 'সার্ভিস' সম্পর্কে আমাকে বলতে এসেছিলেন।'সি গল্পটা শেষ হওয়ার পরেই কেবল আমি বুঝতে পারলাম তিনি 'সার্ভিস' শব্দটা ব্যবহার করছেন অত্যন্ত ব্যঙ্গ করে লিঃএচরী। শাখামান্য জেলার নিজে চতুলী কেকা গোটা গ্রামটাই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। আর পনেরো জন ইন্দোনেশীয় গেরিলাযোদ্ধার সব ক'জনই এরই মধ্যে দীর্ঘপথ পাড়ি দেবার পর ক্লান্ত ঘোড়ার গাড়ির মতো মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাদের ধ্বংস করে দিয়েছে ডাচ সেনাবাহিনী। বেষ্টনীটা ছিল নিখুঁত আর আক্রমণটা একেবারে অপ্রত্যাশিত। কেউই পালাতে পারে নি, গেরিলাদের সবাই বিনা প্রতিরোধে প্রাণ দিয়েছে। এটাই ছিল লোকটার 'সার্ভিস',' তিনি ইতি টানলেন তাঁর কথায়। এ কথা বলার সময় ভ্যান বিউরেন স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলেন না, লম্বা লম্বা পা ফেলে জানালার দিকে গেলেন, পাইপ দিয়ে চৌকাঠে আঘাত করলেন। আমাদের গ্লাসে আবার শেরি ঢালতে ঢালতে তিনি ড্রেসারের কাছে ফিরে গেলেন, এগিয়ে গিয়ে চেয়ারের ওপর ডান পা রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। । সামান্য বিরতির পর তিনি বললেন, 'আপনি কি জানেন, ভিন্ন উপলক্ষে আরেকবার সে বলতে আসল যে, তার 'সার্ভিস'-এর পুরস্কার হিসেবে তাকে উচ্চপদে আসীন করার প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে। তার কথাগুলো বিশ্বাস করার আগ্রহ আমি বোধ করি নি। তবে তার গল্পগুলো আমাকে অসুস্থ করে তুলল।' আর এসব কথা বলার সময় ভ্যান বিউরেন এত জোরে জোরে পাইপ টানলেন যে পাইপে তার ঠোঁটের স্পর্শই লাগল না। তু ১৩। আমি জানতে চাইলাম ঠিক কী ঘটেছে। তিনি জানালেন, 'গতকাল হঠাৎ করেই তার সাথে লেইজ্ প্লিইন (Leidse Plein)-এর কাছে ছোট একটা ক্যাফেতে দেখা। বরাবরের মতোই আপন কাজের, বিশেষ করে মহিলাদের সাথে দহরম- মহরম বিষয়ে গালগল্প করে আমাকে বিরক্ত করল। আমি এতটাই ক্ষেপে গিয়েছিলাম যে, একেবারে খোলাখুলি বলেই ফেললাম, আমার কাছে ওসব কাজের কানাকড়ি দামও নেই। স্পষ্টতই সে অপমান বোধ করল। আমার মনে হলো এখন বাসায় আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমি তার সম্পর্কে নিচু ধারণা পোষণ করলেও অন্যরা যে তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধার উপযুক্ত মনে করে, তা দেখিয়ে দেয়া। এই উদ্দেশ্যে সে জাকার্তা থেকে সবেমাত্র পাওয়া একটা টেলিগ্রাম দেখাল আমাকে। হায়, কী বিরক্তিকর ব্যাপারই-না এটা! সে এতই বিজয়োল্লাস, অহংকার আর আত্মগর্বের সাথে টেলিগ্রামটা দেখাল যে, আমি খুব অমার্জিতভাবে তাকে ঘরে ঢুকতে না দিয়ে বের করে দিলাম। “কী নিয়ে সে গর্ব করল?' জিজ্ঞাসুভাবে, আধো-আনন্দে আমি জানতে চাইলাম। 'টেলিগ্রামটা পাওয়ার কারণে সে গর্বিত। ‘কিন্তু কেন?’


সাংসদের একটা আসনে প্রার্থী মনোনয়নের খবর দিয়ে টেলিগ্রামটা পাঠিয়েছে। শ 'তাই নাকি!' 'আপনি কি খবরটা বিশ্বাস করেন?' বিস্ময়ে আমি মাথা দোলালাম। চিন্তামগ্ন অবস্থায় কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ভ্যান বিউরেন বললেন, 'আশা করা হচ্ছে এ ধরনের লোকের কারণে সৃষ্ট সব দুর্যোগ থেকে আপনার দেশকে রক্ষা করা হবে। আপনাদের জনগণের সুখের স্বার্থেই ... আর' পুনরায় চিন্তামগ্ন হয়ে তিনি যোগ করলেন, 'বিশেষ করে আমার ছোট ছেলের জন্য।' আমি অবাক হয়ে বললাম, 'আপনার ছোট ছেলে? কী বলতে চাইছেন আপনি?' 'হ্যাঁ, আমার ছোট ছেলে, আমার সন্তান।' 'তার মানে আপনি একজন পিতা?' 'হ্যাঁ, আমি ছোট জোসেফ-এর বাবা। ইউসুপ- ওখানকার লোকেরা এ-নামেই ওকে ডাকে। আশা করি ছেলেটা এখনো বেঁচে আছে।' ভ্যান বিউরেন যখন আমাদের গ্লাসে শেরি ঢালতে ড্রেসারের কাছে গেলেন, তখনও আমার ঘোর কাটে নি। তিনি বলে চললেন, 'ছেলের মায়ের নাম সিতি, মিষ্টি গ্রাম্য মেয়ে, সহজ-সরল, ভক্তিতে ধীর-স্থির ও উচ্ছল-নির্মলতা বিশিষ্ট যেমনটি পাহাড়ি অশিক্ষিত তরুণীরা হয়ে থাকে। ওর পেশা ছিল চা তোলা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। আমি ডাচ কারাগারে থাকা অবস্থায়, তাকে জনতা হত্যা করল।‘হত্যা করল?’ ‘হ্যাঁ, কুকুরের মতো হত্যা করল। জনতা গুপ্তচর ও শত্রুর সহযোগী হিসেবে আমার স্ত্রীকে কলঙ্কিত করল।’ ভ্যান বিউরেন তাঁর গ্লাস শেষ করে কিছু সময়ের জন্য ভাবনায় ডুবে রইলেন। তাঁর এই ভাবনার অর্ধেকটাই খুব সম্ভবত তিক্ত-মধুর স্মৃতির মিশ্রণের জন্যে। 'কিন্তু আসলে,' তাঁর গলার স্বর দমিত হয়েই সাথে সাথে আবার নিরাশায় ডুবে গেল, ‘রাজনীতি বা বিপ্লব সম্পর্কে এই গ্রাম্য মহিলাটি কীই-বা জানত? আমার স্ত্রী এতই সহজ-সরল ছিল যে সে 'শত্রুর সহযোগী' হতেই পারে না। তবে হ্যাঁ, আমি ভুলে যাই, সব সময়ই আমি ভুলে যাই, তার একটা সন্তান ছিল আর ও-যে ছিল আমারই সন্তান, একটা শত্রুর সন্তান ...'


Post a Comment

0 Comments