রোকেয়া ইসলাম এর গল্প ~ কচিপাতা রঙে ভালবাসা

 

The story of Rokeya Islam


ফেসবুকের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে অরণি। তৎকালীন কয়েকজন ছাত্রীর ছবি, কমেন্টগুলো পড়ে সবার মানসিকতা বুঝতে চেষ্টা করে। ইতিবাচক চিন্তার সাথে নেতিবাচক চিন্তার মানুষও আছে ওর ফেন্ডলিস্টে।

অবাক হয় না। আলো আর অন্ধকার নিয়েই তো পৃথিবী এগিয়ে চলছেে। নারীরাও এগিয়ে চলছে! এগিয়ে চলছে ভাবতে গিয়ে ভাবনাটা থমকে থাকে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে
 ১৯৭২ সালের ছবি। মেয়েগুলো তখন ভার্সিটিতে পড়ে আর ও ক্লাস নাইনে পড়ে। ওর চেয়ে পাঁচ ছ বছরের বড় তো হবেই। চুলের স্টাইল শাড়িও পিনআপ করা ব্লাউজের হাতাও কুনুইয়ের একটু উপরে অবধি। চোখে কাজল সাদাকালো ছবি বলে ঠোঁটের লিপস্টিক বোঝা যাচ্ছে না। অরণিদের সময় তো এমনই পোশাক ছিল। অরণি নিজেও এমনই পোশাকই পরতো। এখনও এমনই পোশাক ওর পরনে। অবশ্য পোশাক নিয়ে কখনও মাথা ব্যাথা আগেও  ছিলও না এখনও নেই। ওর চার ভাড়াটিয়ারাই তো চার রকমের পোশাক পড়ে, কেউ বোরখায় নিজের সর্বাঙ্গ কালো করে রাখে, কেউ বিচিত্র রঙের হিজাব পড়ে কেউ সালোয়ার-কামিজের নিজেকে স্টাইলিস্ট করে তোলে কেউ জিনস্ফ-তুয়া টিশার্ট পরে ছিমছাম থাকে। কখনও পোশাক বিষয়ে ওদের কিছু বলে না অরণি। পোশাক তো রুচির বিষয়। দেশপ্রেম ইতিহাস ঐতিহ্য আধুনিকতারও প্রকাশ থাকে পোশাকে। আবার ছবিটার দিকে তাকায়, ডানদিকের তৃতীয়জনের চেহারায় চোখ আঁটকে থাকে।  কেমন যেন চেনা লাগছে। চশমা মুছে আবার তাকায়। না মেলাতে পারেনা কারো চেহারার সাথে, তবে চেনা লাগছে খুব! কে হতে পারে! কে? কে?
ঝাপসা একটা ছবি ভেসে ওঠে মনের আয়নায়,
 নাহ! কিকরে সম্ভব! ছবিটার বয়স গুণে উনারা তো অরণি থেকে প্রায় পাঁচ বছর এগিয়ে। তাহলে! পুরানো এ্যলবাম বের করে অরণি। 

একেবারে একই স্টাইল একই চেহারা। অরণি তখন পড়তো ময়মনসিংহের মমিনুন্নেছা কলেজে। থাকতো হোস্টেল। খুব প্রিয় বান্ধবী ছিল আবিদা। ষোল-সতের বছরের একটা মেয়ে স্বজন পরিত্যাক্ত হয়ে স্বজনহীন  মমতাহীন শহরে একাকী থাকতো, খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরেছিল আবিদাকে। আবিদার পরিবারও ভালবাসতো অরণিকে।

আবিদার মাকে নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি মনে হতো। তার হাতের কোরমা পোলায়ের স্বাদ বহুদিন সতেজ ছিল জিহবায়। খালাম্মা বলে জড়িয়ে ধরতো।

আরেকটা টুকরা নেও অরণি।

না খালাম্মা আর পারব না। 

স্বাদ হয় নাই তরকারি।

কি যে কন না আপনে, খুব মজা হইছে।


খালাম্মার আদর ভুলিয়ে দিতো
  শহরের স্নেহহীন শহরের বাতাস। আবিদাদের বাসাতেই পরিচয় হয় আবিদার খালাতো ভাই হাসেমের সাথে। এক বিকেলে হাসেম ভাই অরণিকে বলে-
আমরা যেতে চাই তোমার বকুলগন্ধা শহরে রসে ভেজা চমচম খেতে চাই
 পাব তো অরণি।
কেন নয় চলুন।
দেখ আবার পিছিয়ে যেও না। সাহস আছে আমাদের নিয়ে যেতে।
তরুণী বুক জুড়ে তোলপাড় সাহস অরণির। এগিয়ে আছি, আপনারা পিছিয়ে যাবেন না তো। অরণির কন্ঠ জুড়ে নবীন সাহস।
ওরা যেতে চায় অরণির স্বপ্নময়
 শহরে। সানন্দে সম্মতি তো দিল তবে ছোট্ট একটা দ্বিধা নিজের কাছে রইলো, কি বলবে মাবাবাকে। বাবা আধুনিক মানুষ তিনি রক্ষনশীল মাকে বোঝাতে পারবে কিন্তু আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের মসৃণ  জিহ্বার চাবুক কষা জিজ্ঞাসাকে মোকাবিলা করাটা কঠিন। বাবাকে সব জানিয়ে চিঠি দেয় অরণি। বাবাও সম্মতি দিয়ে ওদের আসার তারিখ জানতে চায়। আবিদা হাসেম হাসেমের বন্ধু কাজলকে নিয়ে অরনি সন্ধ্যার মুখে ঢুকে ওদের বকুলগন্ধা জেলা শহরের বাড়িতে। ওরা হৈ হৈ করে ঘুরে বেড়ায় পুরো শহর, মজা করে অরণির মায়ের রান্না করা টেবিলের সব খাবার সাবড়ে দেয়। রাত জেগে বাগানে বসে গল্প করে। এক সকালে অরণি আবিষ্কার করে আবিদা আর হাসেম তোলপড় প্রেমে খাবি খাচ্ছে।
ধরা পড়ে গেছো বন্ধু।
এতোদিন বুঝলি বুদ্ধ। ক্লাস এইট থেকে ভালবাসি হাসেমকে। বি এ ফাইনাল ইয়ারের একটা ছেলেকে কি অবলীলায় নাম ধরে ডাকছে আবিদা। 

হাসেম ভাইও এতো ছোটবেলায় ভালবাসতো?

না ও তখন এসএসসি দিয়েছে। হাসেম বি এ পাশ করলেই বিয়ে করব আমরা।

আর লেখাপড়া?

আমি তো তোমার মত মেধাবী নই, বিয়ের পরদিন বইখাতা পুরানো কাগজ কেনে ওদের কাছে বিক্রি করে বাচ্চাকাচ্চার মা হব। লজ্জায় এতোটুকু হয়ে যায় অরণি, অথচ আবিদা কত সহজে কথাগুলো বললো। 

প্রেমের চেয়ে সত্য কিছু নেইরে অরণি। আমার সমস্ত পৃথিবী জুড়ে হাসেম। অরণি তাকিয়ে থাকে আবিদার চোখে। স্বপ্ন গলে গলে ঝরছে শ্রাবণের বারিধারার মত। অরণির চেনা পৃথিবীতে এতো সুন্দর নারী কখনও দেখেনি। কত সুখী আবিদা। অরণি ওর বাইলজি আর কেমিস্টি বইয়ের পাতায় এমন কোন সূত্র  পায়নি যা দিয়ে সমীকরণ করে এই মুখের। ফেরার আগের রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো কাজলের। উথাল পাথাল জ্বর। বাবা ডাক্তার ডেকে আনলেন, তিনদিন  তিনরাত ঝাড়া জ্বরের পর শেষ রাতেরদিকে জ্বর বাবাজির উর্ধমূখী যাত্রা থামিয়ে দেয়। আবিদা আর হাসেমের থাকার সময় পার হয়ে গেছে আগেই শুধু কাজলের জ্বরের বাড়াবড়ি আঁটকে রেখেছিল ওদের। বাবা শর্ত সাপেক্ষে ওদের যাবার অনুমতি দিলো, যেয়েই যেন কাজলের বাড়িতে খবর জানায় ওরা, ব্যাস্ততায়  চিঠি আর টেলিগ্রাম করা হয়নি। কাজল থেকে গেল, জ্বর পুরোপুরি সেরে গেলে ও একাই যাবে। 

পুরোপুরি জ্বর সারলো আরো তিনদিন পর। দুপুরে কাচকলা দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল মেখে ভাত খাচ্ছিল কাজল, তখনই গেটের কাছে রিকশা থেকে নামে কাজলের বাবা। সব শুনেছে হাসেমের কাছে অরণির বাবা মায়ের সেবাযত্নে যে তার ছেলেটি এ যাত্রা রক্ষা পেল, যতটুকু বুঝতে পেরেছিল এখানে এসে দেখলো অনেক বেশি। কিভাবে কৃতজ্ঞতা জানাবে ভাষা খুঁজে পায় না। পুত্র তো সুস্থই হয়ে গেছে কাজলের বাবাকে তখুনি ছেড়ে দিলেন না। একটাদিন ওরা থাকলো অরণিদের বাড়িতে। বিকেলে শাড়ির দোকানে গিয়ে কাজল টাংগাইল তাঁতের শাড়ি কিনে আনে, চমচম কিনে আনে।
অরণি শুধু কষ্টই দিয়ে গেলাম।
বিছানার চাদর পাল্টাতে গিয়ে চোখ তুলে তাকায় কাজলের দিকে। পাশাপাশি দুটো মায়াবী সাগরের তল খুঁজতে থাকে কাজল। 

যা দিয়ে গেলেন সেটা  এই ছোট্ট জীবনের পরম প্রাপ্তি।
অরণি শাড়িটা পছন্দ হয় তোমার। আমার খুব প্রিয় রঙ। নতুন পাতা রঙের শাড়ির প্রান্ত ছুঁয়ে আছে সোনালি পাড়।
আরে খুব সুন্দর তো। কার জন্য এটা।
তোমার জন্য।
দুপা পিছিয়ে আসে অরনি, তিরতির করে কাঁপছে ওর চোখের পাতা, বুকের রক্ত দ্রুত বইতে থাকে, অনিবার্য দ্বিধা ওকে জড়িয়ে ধরে তবে নিরিড় ভালবাসার স্বর্গীয় সূধা ছড়িয়ে পড়ে।
নেবে না! নাও।
আমি!
 
হ্যা তুমি।
কেন নেব।
হ্যা তাই তো কেন নেবে। ময়মনসিংহ আসছো যেন কবে। হ্যা আগামী সপ্তাহে, তো? ব্রহ্মপুত্রের বহমান জলের দিকে তাকিয়ে আমি জানাব তুমি কেন নেবে শাড়িটা, তখন তোমার পরনে থাকবে এই শাড়ি। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অরণি। ওর সামনে দাঁড়ানো এক প্রেমদূতের দিকে। অরণির ভেতর থেকে হৃদয় উথাল-পাতাল করে বের হচ্ছে দীর্ঘদিনের জমে থাকা
  এক নিবিড় আশা।
নাও শাড়িটা।
প্রেম বাতাসে উড়তে থাকা অরণি দাঁড়ায় কাজলের সামনে, সচেতন হয়ে পড়ে।
আজ না, শাড়িটা থাকুক আপনার কাছে, এখন বাড়ি ভরা মানুষ, কথা ওঠবে। একদিন আগে শাড়িটা দিয়ে যাবেন আমি পরে যাব ব্রহ্মপুত্রের তীরে, প্রকৃতি সাক্ষি থাকবে, কেন আমি আপনার দেয়া উপহার নেব।

এক সপ্তাহ আর ফুরায় না অরণির। কবে পরবে কচিপাতা রঙের শাড়িটা। কবে ওর হাত দুখানা ধরবে কাজল। কে আগে জানাবে ভালবাসার কথা। অরণি কিভাবে বলবে কাজল তোমাকে ভালবাসি। কি লজ্জা কি লজ্জা!!  মরি মরি!! থাক তারচেয়ে কচিপাতা সবুজ শাড়িতে ঘোমটা টেনে ডানহাতটা এগিয়ে দেবে কাজলের দিকে। যা বোঝার বুঝে নেবে কাজল। 

হোষ্টেলে এসেছে কলেজ খোলার আগেরদিন বিকেলে। কাটবে না করেও ঠেলে-ঠেলে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে, সন্ধ্যা রাতের চাকা ঠেলে দিনের দোরগোড়ায় এনেছে সময়ের গাড়ি। আবিদার দেখা নেই।
কি হলো, ওর অসুখ করলো নাকি?
 না হাসেম ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেল।

পরদিন সকালেই খুশিতে ঝলমল করতে করতে অরণির পাশে এসে বসে আবিদা। পুরো তিনটা দিন যা আনন্দে কেটেছে আবিদার। আরে শুধু কি আনন্দ প্রচন্ড ব্যস্তও ছিল। আবিদার খালাতো বোন মানে, হাসেমের বোন এই শহরের সেরা সুন্দরীর সাথে কাজলের বিয়ে হয়েছে তিনদিন আগে।
কার বিয়ে?
কাজল ভাই আর হিমু আপুর বিয়ে।
সমস্ত পৃথিবী দুলে ওঠে অরণির সামনে। আকাশ গুড়ো-গুড়ো হয়ে- চূর্ণ হয়ে পড়ে ওর শুষ্ক সাগরে। সরে যায় আবিদার সামনে থেকে একেবারে হোষ্টেলে নিজের রুমে। কেউ রুমে ছিল না। প্রাণ খুলে কাঁদে অরণি।
 কার জন্য ফিরে এলো!! 

বিকেলে একা একা বাগানে ঘুরতে ঘুরতে চোখ পড়ে গাছের শাখা থেকে বের হচ্ছে নধর বরণে নবীন পাতা। ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। দুটো নখ নিষ্ঠুর অস্ত্রের রুপ নিয়ে এগিয়ে যায় নরম পাতাগুলোর দিকে। পট পট ছিঁড়ে ফেলে কয়েকটা, আরেকটা কুশির দিকে নখসমেত হাত এগিয়ে যেতেই কানে বাজে রাগ ভৈরবী সুরে ভালবাসি ভালবাসি...
না কেউ কোথায়ও নেই অরণিকে ভালবাসার। কে বলে ভালবাসি। চারদিকে তাকিয়ে দেখে আশেপাশে কেউ নেই দূরে ছাত্রীরা সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যাস্ত। তাহলে কে বললো ভালবাসি? ওর সামনে অলকানন্দার গাছ। প্রতিটি পল্লব থেকে কুশি বের হচ্ছে। তাহলে কে বললো ভালবাসি!
 

হঠাৎ মনে পড়ে ওর কাছে একটা ক্যরোলিনের ওড়না আছে খুবই শক্ত একবারে দড়ির মত শক্ত। একবার ঠিকঠাক জায়গামত পরলে মূহুর্তেই শেষ হয়ে এই পৃথিবী। এই কঠিন পৃথিবীতে কেউ আর ওর ভালবাসি শব্দটা অলকানন্দা গাছের কুশির মত দু’নখে ছিঁড়ে ফেলতে পারবে না।

দু’হাতে দু’কান  ধরে। দৌড়ে রুমে এসে টিনের ট্রাঙ্ক খুলতেই বের হয় এ্যালবাম তার নিচে ওড়না। ওড়না বের করার জন্য টান দিতেই এ্যলবাম খুলে যায়। দোলনা আপার ছবি। হাসছে। ছবিটার নিচে তার ভার্সিটির বন্ধুদের ছবি। ওড়নার নিচে একটা ফাইল। তিনটি বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্কস পেয়ে এসএসসির দ্বার পেরিয়েছে ও। দোলনা আপার ছবি আর মার্ক সিটের তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ওড়নাটা ট্রাঙ্কের নিচের দিকে ঠেসেগুঁজে রেখে দেয়।  দোলন  আপা হাসছে ওর চোখে চোখ রেখে, ওদের পাড়ার সবচেয়ে মেধাবী মেয়ে। অরণির আইডল।

মার্ক সিটে মায়াময় হাতের পরশ রাখতেই ওর শিরদাঁড়া দিয়ে সাহসের স্রোত বইতে থাকে। ওর জন্য আছে আগামীর পৃথিবী। আছে অলকানন্দার ভালবাসি। ছবিটার দিকে তাকায় অরণি, এই ছবিটাই তো  সেদিন ওকে পথ দেখাতে বাতি উঁচু করে ধরেছিল। এ্যলবাম রেখে আলমারি খুলে বের করে নতুন একটা শাড়ি। কচিপাতা রঙের সোনালি জরি পাড় শাড়ি। আজ পরবে অরণি ওর ভালবাসা রঙের শাড়িটা...

Post a Comment

0 Comments