আবু হেনা মোস্তফা কামালের সাহিত্যচর্চা ও শিল্পীমানস #কুমার দীপ

 

Abu Hena Mustafa Kamal's literary practice and artist


সাহিত্যবিচারে সাহিত্যিকের জীবন ও শিল্পীমানস বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। শিল্পীর মানস যেমন তাঁর জীবন ও কর্ম পরিক্রমা দ্বারা প্রভাবিত হয় তেমনি তার প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তাঁর শিল্পকর্মে। আধুনিক সাহিত্য সমালোচনা তাই সাহিত্যিকের জীবন ও শিল্পীমানস আলোচনাকে আবশ্যক মনে করে এবং এটা শিল্পীর সৃষ্টিভাণ্ডারে প্রবেশের দ্বার খুলে দেয়। আবু হেনা মোস্তাফা কামালের (১৯৩৬-১৯৮৯) সাহিত্যবিচারের ক্ষেত্রেও তাঁর জীবন ও শিল্পিমানসের অনুসন্ধান অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

১৯৩৬ সালের ১৩ই মার্চ পৃথিবীর আলো দেখেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। আবু হেনা মোস্তফা কামালের স্কুল জীবন তথা শৈশব কৈশোর কাটে পাবনাতেই, এক নির্মল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। পাবনা শহর তখন ছিলো শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান। শাহজাহান আলী রাজনীতির অঙ্গনে যেমন, সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তেমনি তৎকালীন বামপন্থী ধারার পথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। প্রখ্যাত বামপন্থী অধ্যাপক কবি অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৭) (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন ১৯৫২ সাল পর্যন্ত) ছিলেন শাহজাহান আলীর বাড়ির নিয়মিত অতিথিদের অন্যতম। আবু হেনার মাতা খালেকুন্নেসা গান গাইতে জানতেন। আবু হেনা নিজেও সাহিত্য-সঙ্গীত ও চিত্রকলায় দারুণ আগ্রহী ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এসময় ভীষণ গান শুনতাম। পড়তামও। দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছবি আঁকতাম।’  এই সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির মধ্যেই তিনি পড়ে ফেলেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রসহ আরো অনেকেরই সাহিত্যভাণ্ডার। খুব পড়ার কারণেই শৈশব ও কৈশোরে প্রায় ছিলেন ঘরকুনো, নির্বান্ধব। অন্য একটি রচনায় তিনি বলেছেন, ‘অতিশয় মুখরোচক সুখাদ্যের মতো বিচিত্র সব গল্পের বই আমাকে এমনভাবে টানতো যে, সকল দৈহিক পীড়ন ও মানসিক লাঞ্ছনা তৎক্ষণাৎ বেমালুম ভুলে যেতাম। আক্ষরিক অর্থেই কিছু গিলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম ভোজ্যের ওপরে।’  প্রকৃত প্রস্তাবে, বই-ই ছিলো কিশোর আবু হেনা মোস্তফা কামালের যথার্থ বন্ধু; বাঙলাদেশের অগণিত কিশোরদের মতো খেলার মাঠ কিংবা মাঠ তাড়ানো বন্ধুদল নয়।

১৯৫২ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেধা তালিকায় ত্রয়োদশ স্থান নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করে পাবনা শহরে ও আত্মীয় স্বজনদের কাছে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগসহ বোর্ড মেধাতালিকায় সপ্তম স্থান অধিকার করে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। আর ১৯৬৬-৬৯ সময় পরিসরে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দি বেঙ্গলি প্রেস এ্যান্ড লিটারেরি রাইটিং’ (১৮১৮-১৮৩১) বিষয়ে লাভ করেন পিএইচ.ডি ডিগ্রি। কমনওয়েলথ বৃত্তির তালিকায় তিনি ছিলেন সর্বশীর্ষে এবং ছাত্রাবস্থাতেই পেয়েছিলেন মেধাবিত্বের বহু স্বীকৃতি।

আবু হেনা মোস্তফা কামালের কর্ম জীবনের শুরুটা সুখের হয়নি। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভগ্নিপতি কে.জি. মুস্তফা জানাচ্ছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সমাপ্তির পর আবু হেনা আরেক দুনিয়ার মুখোমুখি। অবাক বিস্ময়ে সে দেখতে পেলো, তার গুণগ্রাহী যারা, তাদের চেয়ে তার প্রতি ঈর্ষান্বিতদের ক্ষমতা অনেক বেশি। তার ফলে, ছাত্রজীবনের গৌরবোজ্জ্বল রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকুরি হলো না। তাকে পড়াতে হয়েছে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে, চাঁপাই নবাবগঞ্জের এক কলেজে।  উল্লেখ্য, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে লিভ ভ্যাকান্সিতে মাত্র দু’মাস চাকরি করে আবু হেনা মোস্তফা কামাল বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কাছে- এর চেয়ে গ্রহণযোগ্য পেশা আর কিছু নেই। এরপর পাবনার এডরুক লাইব্রেরির জনসংযোগ কর্মকর্তার অফার ছেড়ে দিয়ে তাঁর মনে হয়, যেন ‘শরতের মেঘের মতো হাল্কা হয়ে’ গেছেন। তারপর চাঁপাই নবাবগঞ্জ কলেজে দু’মাস দশ দিন শিক্ষকতা করে ১৯৬০ সালের ১৫ই নভেম্বর যোগ দেন রাজশাহী কলেজে। ১৯৬২ সালে জনসংযোগ পরিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (১৫ই মার্চ ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত)। অস্থায়ী লেকচারার হিসেবে ১৯৬৩ সালের ১৬ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান। অতঃপর অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১) ও অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম এর প্রচেষ্টায় স্থায়ী চাকরির আমন্ত্রণ পেয়ে ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার পদে যোগ দেন। এই চাকরিটা তাঁর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ, এই পদ না পেলে তার পক্ষে সংসার ফেলে বিনা বেতনে ছুটি নেয়ে লন্ডনে কমনওয়েলথ স্কলারশিপে ডক্টরেট করতে যাওয়া (১৯৬৭) সম্ভবপর ছিল না। উল্লেখ্য, ছাত্র জীবনেই, অনার্স পাশ করার পূর্বে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বি.এ. ক্লাসের ছাত্রী হালিমা খাতুনকে বিয়ে করেন আবু হেনা মোস্তাফা কামাল। 

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রফেসর টি. ডব্লিউ ক্লার্কের অধীনে ডক্টরেট করে ফিরে এসে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে উন্নীত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের ন্যায় আবু হেনা মোস্তফা কামালও নিরাপদ আবাসের খোঁজে পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে যান। গ্রামাঞ্চলে পাক বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন। এবং তাঁকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। তিনি ছিলেন রাজশাহী বেতারের সাহিত্য ও বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানের উপস্থাপক, স্ক্রিপ্ট লেখক, গীতিকার এবং অত্র অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অন্যান্যদের মতো তাঁকে রেডিওতে স্ক্রিপ্ট লিখতে বাধ্য করে।  ফলে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে স্বাধীন বাঙলাদেশে তাঁকে পাকিস্তানিদের সহযোগী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলে এবং এক পর্যায়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তিনি যে তা ছিলেন না, সংসারের মায়ায় ও জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাধ্যত দু’একটি রেডিও অনুষ্ঠান করেছিলেন পাকিস্তানিদের সমর্থনমূলক, সেই সত্যতার প্রমাণ পরবর্তীতে পাওয়া যায়।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলীর ভূমিকায় ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে হত্যা করে এবং কয়েকজনকে অমানুষিক অত্যাচার করে। তারা আবু হেনা মোস্তফা কামালকে ধরে নিয়ে যায় এবং রাজশাহী বেতার কেন্দ্র থেকে তাদের পক্ষে কথিকা লিখতে ও পড়তে বাধ্য করে। (“ভূমিকা”, ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী’)।  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ জানাচ্ছেন,  ‘একাত্তরে মানসিক নির্যাতনের উদ্দেশ্যে হেনাকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কুঠুরির পাশে বন্দী করে রেখেছিল পাকিস্তানীরা। তাকে প্রতিদিন প্রতিরাত শুনতে হত নির্মমভাবে নিগৃহীত বন্দীদের অন্তিম আর্তচিৎকার। হেনাকে তারপর নিয়ে যাওয়া হত রেডিও পাকিস্তানের স্টুডিওতে পাকিস্তানীদের পক্ষে কথিকা প্রচারের জন্যে। এ করার পরিবর্তে মৃত্যুকে বেছে নিতে পারে নি বলে মুক্তিযুদ্ধের পর হেনাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়।’ (“ আবু হেনা মোস্তফা কামাল”, ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্মারকগ্রন্থ’)। 

আর আবু হেনা মোস্তফা কামালের এক সময়কার ছাত্র, পরবর্তীতে সহকর্মী প্রফেসর সারোয়ার জাহান (১৯৪৪-২০০০) তাঁর স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন যুদ্ধোত্তরকালে আবু হেনা মোস্তফা কামালেরই দেওয়া সেই ভয়ঙ্কর রাতের বর্ণনা, ‘জোয়ানরা তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে এক জায়গায় বসিয়ে রেখেছে, একটু পরেই উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার সামনে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে, তিনি নিশ্চিত বুঝেছেন তার পরেই তাঁকে গুলি করে অজ্ঞাত কোনো জায়গায় মাটি চাপা দেওয়া হবে, যেমন ভাবে অন্য অনেক শিক্ষক, ছাত্র, সাধারণ মানুষের  মৃতদেহ প্রতিদিন মাটির নিচে চলে যাচ্ছে। তিনি জোয়ানদের অনুমতি নিয়ে টয়লেটে গেলেন। শেষবারের মতো আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলেন না। অনেকক্ষণ বাল্বের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন--- এরপর আর কোনোদিন আলো দেখবেন না। একে একে মনে পড়তে লাগলো শৈশবের কথা, কৈশোরের কথা, যৌবনের কথা। একে একে এলেন বাবা-মা, ভাই-বোন। এলো সেই মেয়েটি যাকে ভালেবেসেছিলেন, যে বড়ো দুর্দিনে স্ত্রী-হয়ে এসেছিলো, যাকে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারেন নি। সন্তানেরা এলো। বন্ধুদের মুখ ভেসে উঠলো, শক্রদের কথা মনে হলো। ছাত্র-ছাত্রীরা এলো ভিড় করে। আয়নার সামনে নিজের মুখে হাত বুলালেন--- আয়নায় এই মুখ আর কোনোদিন দেখবেন না।’ (সারোয়ার জাহান, “আমার শিক্ষক”, ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্মারকগ্রন্থ’)। বস্তুত, ভয়ঙ্করতম এক পরিস্থিতিতে প্রাণের দায়ে এবং সংসার-স্বজনদের মুখ মনে করে কিছুটা নমনীয় তিনি হয়েছিলেন এবং সেই নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে বেজাতিক সামরিক সরকার তাঁকে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াস চালায়। এটা ছিলো তাঁর জীবনের একটি প্রধান ক্ষত। এই ক্ষতকে কাজে লাগিয়ে আত্মস্বার্থচরিতার্থের প্রয়োজনে স্বাধীনতাত্তোরকালে তাঁকে ‘কোলাবোরেটর’ বিশেষণে চিহ্নিত করবার প্রয়াস চালান আবু হেনা মোস্তফা কামালেরই জনৈক সহকর্মী ও কতিপয় চেনা মানুষ। সমসাময়িক কালে এই অভিযোগ তাঁর অন্তরঙ্গ অনেকেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু যে মানুষ রবীন্দ্রনাথ-নজরুলে নিবেদিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের যে কোনো বিষয় পড়াতে পারতেন, যিনি বাঙলা সাহিত্যের অন্যতম সফল কবি প্রাবন্ধিক, বাঙলার মাটি-জলে, সমাজ-সংস্কৃতিতে যাঁর অস্তিত্ব প্রগাঢ় প্রোথিত, তিনি যে অমন বর্বরদের দোসর হতে পারেন না তা প্রমাণ মিলেছিলো অচিরেই। মানুষের ধারণা যে অমূলক তা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা নাজিম মাহমুদ তাঁর বইয়ে লিখে জানিয়েছেন। 

যা হোক, ছাত্রলীগের আন্দোলনের মুখে এবং খান সারওয়ার মুরশিদ ও স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক শুভানুধ্যায়ী জ্ঞানীজনের হস্তক্ষেপে ৩ জুন ১৯৭৩ সালে ২৯শে মে - ৩রা জুন) আবু হেনা মোস্তফা কামালের কারামুক্তি ঘটে। তবে একাত্তেরের ওই ঈষৎ অবচ্যূতির অকপট স্বীকৃতি, সীমাহীন অনুশোচনা, স্বদেশপ্রেম নিঃসৃত আত্মধিক্কারের অন্তর্¯র্শী প্রমাণ পাওয়া যায় আবু হেনা মোস্তফা কামালেরই লেখা ৮-৯-৮৮ ইংরেজি (বৃহস্পতিবার) তারিখের ব্যক্তিগত জর্নালে, 

একাত্তর সালে আমি কোথাও পালাতে পারিনি। ষাট দশকের মধ্যভাগ থেকেই পাকিস্তানী শাসনের ঔপনিবেশিক চেহারা আমার কাছে অস্পষ্ট ছিলো না। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি এদের ইসলামী লেবাসের নিচে কী জঘন্য বর্বর জন্তু লুকিয়ে আছে। (“নিজের নির্জনে”, ‘কথাসমগ্র’)

পাকবাহিনীর হত্যার রাজ্যে, রাজাকারদের অস্ত্রের মুখে, তখন কেউ কাউকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে পারছে না তখন অধ্যাপক হেনার মনে হয়েছিল, ‘সবাই সমান বিপন্ন এবং চূড়ান্ত পরিণামের জন্যে প্রস্তুত। কোনোদিন এই অবরুদ্ধ দেশ মুক্ত হবে, আবার সহজ মানুষের মতো পদ্মার বাঁধের ওপরে দাঁড়িয়ে দেখবো অপরূপ সূর্যাস্ত, কখনো ভাবিনি।’ (“নিজের নির্জনে”, ‘কথাসমগ্র’)। তাঁর অকপট আত্মস্বীকৃতি-

আমি যে খুব অকিঞ্চিৎকর মানুষ, সে বিষয়ে অতীতে আমার মনে কোনো দ্বিধা ছিলোনা, এখনো নেই। কিন্তু ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্যে কখনো কোনো অন্যায় করিনি এই অহঙ্কারটুকু সব সময় আমার ছিল। অপ্রিয় সত্য ভাষণের জন্যে শাস্তি পেয়েছি অনেক বার, তবু কখনো চাটুকারিতা করিনি। অসত্যের দাসত্ব করিনি, কিন্তু সেই অহঙ্কার শেষ পর্যন্ত অটুট রাখতে পারিনি একাত্তরে। (“নিজের নির্জনে”, ‘কথাসমগ্র’)

তাঁকে ধরে নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিলো। কনসেন্ট্রশন ক্যাম্প থেকে ফিরে আসার দুদিন পর সেনাবাহিনীর লিয়াজোঁ অফিসার সৈয়দ মতিউর রহমান তাঁকে বলেছিল, ‘ ÔIf you want to remain saf and alive. You will have to do same radio programmes for us. (“নিজের নির্জনে”, ‘কথাসমগ্র’)। সৈয়দ মতিউরের সেই হাসিতে স্পষ্ট মৃত্যুর হুমকি দেখেছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। ভুগেছিলেন সম্মতি-অসম্মতির প্রবল দ্বন্দ্বে। বুঝেছিলেন তাঁর মতো উচ্চাভিলাষহীন মানুষ ওই পশুদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। তাই তাঁর অন্তর্নিহিত অনুশোচনা,

কেবল বেঁচে থাকার জন্যেই সেদিন পাকিস্তানী রেডিওতে অনুষ্ঠান করতে সম্মত  হয়েছিলাম।  কিন্তু আমি কি সত্যি বেঁচেছিলাম সেদিন ? স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে প্রতিদিন দুর্বিষহ আত্মগদ্বানিতে আমি কি দগ্ধ হইনি। (“নিজের নির্জনে”, ‘কথাসমগ্র’)। 

সেদিনের এই বেঁচে থাকা সত্যই জরুরি ছিলো। কিন্তু তারপরও এই প্রশ্ন ও ধিক্কারে বারবার পর্যুদস্ত হয়েছে আবু হেনা মোস্তফা কামালের মন। কেননা, স্বাধীনাত্তোরকালে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে গৌরবে ভরে উঠেছে তাঁর বুক, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ (১৯৮৬) পড়ে চোখের পাতা ভিজে এসেছে বার বার, মনে হয়েছে, ‘রুমীর মতো বাচ্চা ছেলে যা পেরেছিলো আমি কেন তা পারিনি? কিংবা জাহানারা ইমাম নিজে ভালোবাসায় ব্যাকুল হয়ে স্বামী ও সন্তান বিলিয়ে দিলেন দেশের পায়ে, তার এক কণা আগুন আমার বুকে কেন জ্বলে উঠলো না?’২৭

আবু হেনা মোস্তফা কামালের এই অনুশোচনা ও আত্মধিক্কার আরো তীব্র হয়েছে, মৃত্যু যখন সত্যি সত্যি-ই কড়া নেড়েছে তাঁর দরজায়। লিখেছেন-  

সেই তো মৃত্যু এসে দরজায় টোকা দিলো। এখন আর কোনো অজুহাতই টিকবে না।..... যেতে হবেই। অথচ কী কীটপতঙ্গের মতো এই যাওয়া ! ১৯৭২ থেকে ১৯৮৮; এই অতিরিক্ত সতেরো বছর বেঁচে থেকে যা পেয়েছি, এখন মনে হয়, একাত্তরের মৃত্যু তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি সম্মানজনক ছিলো। (“নিজের নির্জনে”, ‘কথাসমগ্র’)। 

এইভাবে একাত্তর আবু হেনা মোস্তফা কামালের জীবনের একটা ক্ষত হয়ে রইলো। রাজশাহী হয়ে থাকলো সেই ক্ষতের উৎসক্ষেত্র। তাই কারামুক্তির পর একদিন বলেছিলেন, ‘রাজশাহীতে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দশটি বছর অপচয় করলাম।’ এই অপচয়ের অসহ্যতা থেকে বাঁচতে এক সময় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে প্রয়োজনে ঢাকায় ফিল্মে গান লিখে, পত্র-পত্রিকায় লিখে জীবন ধারণ করতে পারবেন কিনা এ-চিন্তাও করেছিলেন। অতঃপর, বন্ধু-অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজলের আগ্রহে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে যোগ দেন ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এখানে নভেম্বর ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত থাকাকালে প্রফেসর হয়েছেন, পুনরায় প্রবল উদ্দীপনায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন এবং তাঁর প্রথম কাব্য ‘আপন যৌবন বৈরী’ (১৯৭৪)-সহ একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এখানে থাকতেই। চট্টগ্রামের উৎসবমুখর জীবন সম্পর্কে তিনি নিজেই তাঁর ‘স্মৃতি সম্পর্কিত কথায়’ লিখেছেন, রাজশাহীতে যদি আমার মৃত্যু হয়ে থাকে তবে চাটগাঁয়ে ঘটেছে পুনরুত্থান, পুনরুজ্জীবন। এরপর প্রবেশ করেছেন কাক্সিক্ষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ০১লা নভেম্বর ১৯৭৮ থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এই অধ্যাপনাকালীন সময়েই, ১৯৮৪ সালে শিল্পকলা একাডেমির এবং ১৯৮৬ সালে (১১ই মার্চ) বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। শিল্পকলা একাডেমিতে থাকাকালীন বাঙলাদেশ সাংস্কৃতিক দলের নেতা হয়ে তিনি একাধিকবার বিদেশ সফর করেছেন। আর বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর নেতৃত্বেই প্রবর্তিত হয়েছে ‘জীবনী গ্রন্থমালা’ সিরিজ, রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘স্মৃতি’ ৭১” সিরিজ, আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ (প্রথম খণ্ড, ১৯৮৭), জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (জ.১৯২৮), আনিসুজ্জামান (জ.১৯৩৭) ও আবু হেনা মোস্তফা কামাল সম্পাদিত “বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, গ্রন্থপ্রকাশনাসহ যাবতীয় ব্যাপারে তিনি সবার উপরে গুরুত্ব দিয়েছিলেন জাতীয় স্বার্থকে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালীন সময়েই ১৯৮৯ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমির শোকসভার গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল,
বিশিষ্ট কবি, প্রবন্ধকার, সমালোচক, গবেষক, গীতিকার, শিক্ষাবিদ.....। বাংলা      সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষা জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের মৃত্যুতে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও ভাষা সাহিত্যচর্চার জগতে দুর্ভাগ্যজনক ও অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হলো। (“স্মৃতি সম্পর্কিত কথা”, এটি তাঁর অপ্রকাশিত ডায়েরি।)

আবু হেনা মোস্তফা কামালের সৃজনশীলতার যা আমরা আজো বহন করে চলেছি তা হলো তাঁর কবিতা প্রবন্ধ, গবেষণা ও গান। ১৯৫২ সাল থেকে মৃত্যুকাল অবধি প্রায় চার দশক ধরে অগনিত কবিতা লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগই পত্র-পত্রিকার পাতাতেই ছড়িয়ে আছে, হয়তো হারিয়ে গেছে। গ্রন্থিত কবিতার সংখ্যা মাত্র ১২৫। কাব্য- ৩। কবিতা চর্চার দু’দশকেরও বেশি বয়সে, ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আপন যৌবন বৈরী’। প্রকাশ করেছে ঢাকার বর্ণমিছিল প্রকাশনী, প্রচ্ছদ এঁকেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। আবিদ হুসেনকে উৎসর্গিত এই কবিতাগ্রন্থ সম্বন্ধে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন, ‘কাঁচা হাতের মক্শো করা কবিতার সংকলন নয় তাঁর প্রথম কবিতা পুস্তক। এ গ্রন্থের যে কোনো পংক্তি পাঠ করলেই বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করতে হয়, এ কবি বাংলা কবিতার ভাষা বিবর্তন সম্পর্কে অনুপুঙ্খ জ্ঞাত ও দক্ষ।’ (“সুন্দরের স্থপতি ও প্রস্তুতি”, ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্মারকগ্রন্থ’)। বস্তুত, গ্রন্থকার হওয়ার আগেই আবু হেনা মোস্তফা কামাল যে কবি হিসেবে যথেষ্ট পরিণত ছিলেন তাঁর প্রমাণ ‘আপন যৌবন বৈরী’। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ (মোট গ্রন্থের পঞ্চম) ‘যেহেতু জন্মান্ধ’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। প্রথম কাব্যের দশ বছর পর। উৎসর্গ-বন্ধু আসাফউদ্দৌলাহকে। উল্লেখ্য, ‘যেহেতু জন্মন্ধ’র আগেই ১৯৭৫ সালে প্রস্তুতকৃত ‘তোমার সম্মতি চাই’৩৫ পাণ্ডুলিপিরই পরিবর্তিত রূপ ‘যেহেতু জন্মান্ধ’। যেহেতু জন্মান্ধে প্রেম ও রোম্যান্টিকতার পাশাপাশি স্ব-কাল ও স্ব-সমাজের বৈরীতার প্রতি অভিমানহত হয়েছেন আবু হেনা মোন্তফা কামাল। ‘আক্রান্ত গজল’ আবু হেনা মোস্তফা কামালের তৃতীয় ও শেষ কবিতাগ্রন্থ। প্রকাশকাল জুলাই ১৯৮৮। উৎসর্গ-হুমায়ূন আহমেদকে। ‘আক্রান্ত গজল’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘এতোকাল তাঁর কবিতায় তরঙ্গিত হয়েছে অপাপবিদ্ধের গান। এখন সেখানে দেখা দিয়েছে অভিজ্ঞতাসৃষ্ট গাঢ় বাণীবন্ধ। এখনো সে গান জীবনপ্রেমী কিন্তু সে এখন জীবনাভিজ্ঞানে ধনী । এখানে তাঁর করধৃত গোলাপে কণ্ঠবিদ্ধ একফোঁটা রক্ত ফুটে উঠেছে চুনির মতো।’ (“আক্রান্ত গজল : আবু হেনা মোস্তফা কামাল”, ‘বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা’)।

বস্তুত, ‘আক্রন্ত গজল’-এ আবু হেনা মোস্তফা কামাল আগের মতোই রোম্যান্টিক হলেও আনন্দ ও বেদনামাখা জীবন ও মৃত্যুভাবনায় আক্রান্ত। এবং পূর্বোক্ত কাব্যদ্বয় থেকে আরো উন্নীত। কবি আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘আক্রান্ত গজল’ পড়ে কলকাতার ‘আজকাল’ পত্রিকায় ‘দূর যাত্রার পারানি’ (উক্ত গ্রন্থের একটি কবিতার নামানুসারে) শিরোনামে লেখা হয়েছিল, ‘এপার বাংলা থেকেই এখন থেকে আমাদের নিরন্তর প্রতীক্ষা থাকবে কবির চতুর্থ কাব্য গ্রন্থের জন্য।’ (অলক চট্টোপাধ্যায়, উদ্ধৃত, ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী’)।  কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও চতুর্থ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়নি; এমনকি মৃত্যুর পরেও। ১৪টি কবিতা নিয়ে প্রস্তুতকৃত সূচিপত্রটির পযায়ক্রমিক রূপ এরকম-৩৯ ১. শুডবাই মধুদা (সংবাদ) ২. যৌগপত্য (ইত্তেফাক) ৩. ফিরে আসার পর (ইত্তেফাক ) ৪. মা আমার মা (সংবাদ) ৫. যতোই বয়স বাড়ে (বিচিত্রা) ৬. গ্রীষ্মের ফলের মতো (ঘরে-বাইরে) ৭. গল্পের সবুজ উপত্যকা ৮. আমার অন্তর্গত ক্ষত (আনন্দ পত্র) ৯. শোকার্ত স্বদেশে আমি (ফসল) ১০. দশবছরের আগের একদিন (কবিকণ্ঠ) ১১. ভেতরের ঘুমন্ত মানুষ (ইত্তেফাক) ১২. যেহেতু নজরবন্দী (সংবাদ) ১৩. ঋণ (দৈনিক বাংলা) ১৪. সবিনয় নিবেদন (কবিকণ্ঠ)। উল্লিখিত ১৪টি কবিতার মধ্যে ৩, ৫, ১৩ ও ১৪ সংখ্যক কবিতা ছাড়া সবগুলো এবং তার সাথে আরো ১৮টি অগ্রস্থিত কবিতা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল’ স্মারকগ্রন্থে। এছাড়া তাঁর নিজের সম্পাদনায় (মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর সাথে যৌথভাবে) ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘পূর্ব বাংলার কবিতা,৪১ নামক কবিতা সংকলনে অন্তর্ভূক্ত ২৯ জন কবির মধ্যে আবু হেনা মোস্তফা কামালও ছিলেন। অন্যদিকে রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘আধুনিক কবিতা’ (১৯৭১) নামক সংকলনে (১৯৪৭-১৯৭০) অন্তর্ভূক্ত হয়েছে আবু হেনা মোস্তফা কামালের ৬টি কবিতা। 

আবু হেনা মোস্তফা কামাল তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য বিষয়ক প্রাবন্ধিক ও সমালোচক। তাঁর গদ্যের হাত অত্যন্ত যেমন পাণ্ডিত্যপূর্ণ, তেমনি স্বাচ্ছন্দ্য ভাষানির্ভর। প্রকাশিত সাহিত্য-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ গ্রন্থের সংখ্যা ২। গ্রন্থ’ভূক্ত প্রবন্ধের সংখ্যা ১৯। প্রথম প্রবন্ধ-পুস্তক ‘শিল্পীর রূপান্তর’ এর প্রকাশকাল নভেম্বর ১৯৭৫। উৎসর্গ- ‘আমার অবিস্মরণীয় শিক্ষক --মুনীর চৌধুরী শ্রদ্ধাস্পদেষু। প্রবন্ধ সংখ্যা ৮।  দ্বিতীয় প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কথা ও কবিতা’র প্রকাশকাল মার্চ ১৯৮১। উৎসর্গ- বেগম সিদ্দিকা জামান ও আনিসুজ্জামান। আরো অনেক সমালোচনামূলক প্রবন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। এগুলোর মধ্য থেকে ১৪ টি প্রবন্ধ নিয়ে ‘নির্বাচিত অগ্রন্থিত’ শিরোনামে গ্রন্থিত হয়েছে ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্মারকগ্রন্থে’। এগুলোর ৪টি-সহ আরো ১৯টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ সংকলিত হয়েছে সময় প্রকাশন প্রকাশিত ‘কথা সমগ্র’-তে। 

আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রবন্ধ সমন্ধে সমসাময়িক আরেক সমালোচক অধ্যাপক সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘কবি পরিচয়ে বিশেষভাবে চিহ্নিত হলেও তিনি সুতীক্ষ্ণ সমালোচনাবৃত্তির অধিকারী। তাঁর “শিল্পীর রূপান্তর” (১৯৭৫) এবং “কথা ও কবিতা” (১৯৮১) নামক গ্রন্থ দু’টিতে তাঁর সমালোচনা প্রতিভার অভ্রান্ত স্বাক্ষর রয়েছে। (“বাংলাদেশের সাহিত্য : সমালোচনা সাহিত্য”, ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’ )। এছাড়া The Bengli Press and literary Writing ১৮১৮-৩১ হলো আবু হেনা মোস্তফা কামালের পিএইচ.ডি. গবেষণার গ্রন্থরূপ। অনুবাদ করেছিলেন এ্যান টেরী হোয়াই-এর ‘জর্জ ওয়াশিংটন কার্ভার। আবু হেনা মোস্তফা কামালের সম্পাদিত গ্রন্থ হলো-  পূর্ব বাংলার কবিতা (মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর সাথে যৌথভবে ) ও কলিকাতা কমলালয়। তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত আবু হেনা মোস্তফা কামালের গানের বই আমি সাগরের নীল।  
আবু হেনা মোস্তফা কামাল তাঁর জীবদ্দশাতেই লাভ করেছিলেন অনেক সুনাম ও সম্মান, পেয়েছিলেন বেশ কিছু পুরস্কার। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আপন যৌবন বৈরী’র (১৯৭৪) জন্য ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত হয় ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’(১৯৭৫), সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৮৬ সালে যশোর সুহৃদ সাহিত্যগোষ্ঠী তাঁকে ‘সুহৃদ সাহিত্য স্বর্ণপদক’ প্রদান করে। তাঁর অসামান্য সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৭ সালে দেয়া হয় ‘একুশে পদক’। এরপর ‘আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ স্বর্ণপদক’ পান ১৯৮৯ সালে। অতঃপর তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৯১ সালে প্রদান করা হয় ‘সাদত আলী আকন্দ স্মৃতি পুরস্কার’। সম্প্রতি কবি জসীমউদ্দীনের উপর মূল্যবান গবেষণাকর্মের জন্যে গত ০৯ই জানুয়ারি ২০০৩ এ আবু হেনা মোস্তফা কামালকে (সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুগ্মভাবে) দেওয়া হয়েছে জসীমউদ্দীন গবেষণা পুরস্কার ২০০৩।

শিল্পীমানস
কোনো শিল্পীর শিল্পকে বিচার করতে হলে প্রথমেই অনিবার্য হয়ে ওঠে ওই শিল্পীর শিল্পীমানস ও তার প্রকৃতি নির্দেশ করা। আর এ-কাজের সদর দরজা খুলে দেয় ওই শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন ও তাঁর সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি। সেই প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখেই আমরা  ইতোমধ্যে আবু হেনা মোস্তফা কামালের জীবন ও তাঁর সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার অতিসংক্ষেপে শিল্পীর মানস প্রক্রিয়াকে প্রতিচিহ্নিত করবার চেষ্টা করবো। বস্তুত, আবু হেনা মোস্তফা কামালের শিল্পীমানস আবহমান বাঙলার বহু বছরের রাজনীতি, সমাজনীতি, এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুস্পষ্ট প্রভাব থেকেই প্রস্ফুটিত। তাঁর কবিতায়, গানের কিংবা অন্য যে কোনো রচনায় ‘মানবপ্রেম স্বদেশপ্রেম ও রোম্যান্টিক ভাবোচ্ছ্বাসের অন্তর্লীন অনুভূতির মধ্যে হাজার বছরের ঐতিহ্য-ইতিহাসের উত্তাধিকারের সংশ্লেষ আমাদের এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তিনি বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিচ্যূত কোনো শিল্পী নন, বরং বাঙালি সংস্কৃতিরই ধারক ও বাহক। একটু পিছনের থেকেই পথটা অনুসরণ করা যাক। 

রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রতিভা থেকে অন্যপথ ধারণের প্রথম প্রত্যক্ষতা এসেছিলো কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) মধ্যে। তাঁর “বিদ্রোহী” শুরুতেই সাড়া জাগিয়েছিল পাঠকের মনে। ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, 
.... সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙলো।...রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি। ...এই যে নজরুল, রবিতাপের চরম সময়ে রাবীন্দ্রিক বন্ধন ছিঁড়ে বেরোলেন, বলতে গেলে অসাধ্য সাধন করলেন, এটাও খুব সহজেই ঘটেছিল, এর পিছনে সাধনা কোনো ইতিহাস নেই, কতগুলো আকস্মিক কারণে সম্ভব হয়েছেল এটা।... কোনোরকম সাহিত্যক প্রস্তুতি না নিয়েও শুধু আপন স্বভাবের জোরেই রবীন্দ্রনাথ থেকে পালাতে পারলেন তিনি, বাংলা কবিতায় নতুন রক্ত আনতে পারলেন।... যে আকাক্সক্ষা তিনি জাগালেন তার তৃপ্তির জন্য চাঞ্চল্য জেগে উঠলো নানা দিকে,... বাংলা সাহিত্যে মোড় ফেরার ঘণ্টা বাজলো। 

মোড় ফেরার এই ঘণ্টাধ্বনি শুনেই বিশ-শতকের তিরিশের দশকের এক ঝাঁক তরুণ কবি দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রদ্রোহ। এবং এঁদেরই প্রচেষ্টায় বাঙলা কবিতা কেবল তার আন্তরপ্রকৃতিতেই পরিবর্তন আনলো না, সমসাময়িক বিশ্বকবিতার সঙ্গে একই সারিতে ঘুরে দাঁড়ালো। জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০৬-১৯৮৭), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), প্রমুখ তিরিশি আধুনিকদের হাতে বাঙলা কবিতার যে বৈশিষ্ট্য দাঁড়ালো সেগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো-                     

এক. নগর কেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাত।                                                            
দুই.  বর্তমান জীবনের ক্লান্তি ও নৈরাশ্যবোধ। 
তিন. আত্মবিরোধ ও অনিকেত (roottess)  মনোভাব। 
চার.  মার্কসীয় দর্শনের, বিশেষত সাম্যবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে নতুন সমাজ  সৃষ্টির   আশা। 
পাঁচ. ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের প্রভাব। 
ছয়. প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধে সংশয় এবং তৎসঞ্জাত অনিশ্চয়তার উদ্বেগ। 
সাত. দেহজ কামনা-বাসনা ও তৎপ্রসূত অনুভূতিকে স্বীকার করা এবং প্রেমের শরীরীরূপকে প্রত্যক্ষ করা। 
আট. ঈশ্বর এবং প্রথাগত নীতিধর্মে অবিশ্বাস। 
নয়. ভাষা সম্পর্কে সকল প্রকার শুচিবায়ুতা পরিহার। 
দশ. ছন্দ অলঙ্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রে গদ্য ও গদ্যভাষা উপযোগী ছন্দ-অলঙ্কারের প্রয়োগ, ইত্যাদি।

এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যপ্রসূত তিরিশের ফসলের সোনালি সফলতার উপর ভিত্তি করে এলো চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের কবিতা। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের কবিরা প্রাথমিকভাবে প্রায় সকলেই তিরিশি পদ্ধতিতেই প্রতিফলিত করেছেন তাঁদের কাব্য সাধনাকে। অবশ্য পঞ্চাশের দশকেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো তিরিশি আধুনিকতার সফল উত্তরাধিকার, যা অনিবার্য আত্মস্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। পূর্ববাঙলার কবিতার এই আত্মস্বাতন্ত্র্যের মূলে ছিলো ১৯৪৭ সালের দেশভাগ তথা বাঙলার মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। বস্তুত, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণেই ‘বাঙলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম এতো সংঘবদ্ধভাবে সাহিত্য চর্চায় নামে বাঙালি মুসলমান। পটভূমিতেই উল্লিখিত হয়েছে যে এই পর্বে বাঙলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতিতে স্পষ্টত,  দু’টো ধারা পরিলক্ষিত হয়। এর একটি আরবি-ফারসি শব্দের ব্যাপকতা ও তথাকথিত ইসলামি চিত্রকল্পের ব্যাবহার, অন্যটি আবহমান বাঙলার সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐতিহ্যের প্রতিফলন। এই দ্বিতীয় ধারার সাহিত্যিকদের মধ্যে আবার দু’টো ধারা পরিলক্ষিত হয়, একটি-আরবি-ফারসি শব্দের ব্যপকতা ও তথাকথিত ইসলামি চিত্রকল্পের ব্যবহার, অন্যটি আবহমান বাঙলার সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐতিহ্যের প্রতিফলন। এই দ্বিতীয় ধারার সাহিত্যিকদের মধ্যেও আবার দু’টো উপধারা লক্ষ্যযোগ্য। প্রথমত, উদার মানবতাবাদী ধারা ; যাঁদের অন্বিষ্ট শ্রেণীদ্বন্দ্বের অন্তর্গত টানা-পোড়েনের মধ্যে একটা নিরাপদ শিল্পবৃত্ত রচনা। দ্বিতীয়ত, মার্কসবাদী আদর্শ ও তথ্যচিন্তায় উদ্বুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করা।৫৪ প্রথমোক্ত ধারার কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আজীজুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, আবুবক্কর সিদ্দিক, শহীদ কাদরী, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় ধারায় ছিলেন, আবদুল গণি হাজারি, হাসান হাফিজুর রহমান, আহমদ রফিক, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ। 
অতএব, আবু হেনা মোস্তফা কামালের শিল্পীমানসের মূল সূত্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায় :

এক. আবহমান বাঙলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যচেতনা                                                                দুই. শ্রেণী দ্বন্দ্বের টানা-পোড়েনে আক্রান্ত উদার মানবতাবাদী অথচ নিরাপদ শিল্পবৃত্ত রচনা।

এই দুই মূলসূত্রের সাথে অনিবার্যভাবে সংযুক্ত হয়েছিলো তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং স্বদেশের সমসাময়িক সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পটভূমির প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। ব্যক্তি জীবনের বৈচিত্র্য যেমন তার অনেক রচনার রসদ জুগিয়েছে, তেমনি তাঁর জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ঘটনা, বিশেষত ১৯৫২ এর ভাষা আন্দেলন ও ১৯৭১ এর মুক্তিসংগ্রাম তাঁর বেশ কিছু কবিতা ও গদ্যের প্রগাঢ় প্রেরণা হয়ে উঠেছে। 

আর সবশেষে আবু হেনা মোস্তফা কামালের শিল্পিমানসের যেটাকে তাঁর একান্ত নিজস্ব উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করতেই হয় তা হলো তাঁর আপদমস্তক রোম্যান্টিকতা। বস্তুত, রোম্যান্টিকতা পুরো আধুনিক কবিতারই নিজস্বিক উত্তরাধিকার। এবং এই উত্তরাধিকারজাত শিল্পী মানসতা থেকে তিনি উচ্চারণ করেন___

...হতে চাইনা এ সবের কিছুই ঈশ্বর
অন্তত অন্তিম শ্লোকে হতে পারি যদি অস্থির কবির কণ্ঠস্বর।
[“বিকল্প”/আপন যৌবন বৈরী”]





Kumar Deep







কুমার দীপ

Post a Comment

0 Comments