অর্ধেন্দু শর্মা’র কবিতা

অর্ধেন্দু শর্মা’র কবিতা




দা-বটির ক্রোধাগ্নি


কখনো অযত্নে কখনো সযত্নে

তাকে লালন করেছিল সে

একাত্তরে

হাঁটি হাঁটি পা করে অন্ধকার নেমে এলো

ভয়ানক বোয়াল মাছের চোখ পড়ল

বধূর নরম মাটি অকস্মাৎ কেঁপে উঠল

তারপর

খড়ের গাদায় লুকিয়ে থাকা বটি-দা’র শরীর

হঠাৎ জেগে উঠল

মুহূর্তে কাটা পড়ল বোয়াল মাছের পেটি




আলমারির আড়ালে


একদিন

শিউলি ফুলের নুয়ে পড়া ডালের উঠুনে

কালো বিভৎস ছায়া নেমে এলো

দলে দলে দানবীয় পিঁপড়ের মতো

বাড়ির চারপাশে গন্ধ শুঁকে

খোকাকে ধরে নিয়ে গেল তারা

সেই থেকে

নেপতিনের গন্ধ সেঁটে ছিল আলমিরায়

আঁচলের ভাঁজে শুয়ে আছে খোকার ইংলিশ পেন্ট




কোণা ব্যাঙের আত্মকথন


দিবসটি যতই স্যাঁতস্যাঁতে হোক কিংবা

পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরুক অসমতার শিকল

আমার ঘুম কাতুড়ে চোখে দেখেছি

রাতের মধ্য ও শেষ ভাগ

দেখেছি হাঁটছে কতগুলো বিষণ্ন দেহ

এইসব দেখে দেখে

আমার হলদে রঙের কষ্টরাও দেখেছি উড়ছে

আমার দুমড়ানো-মুচড়ানো কান্নারাও

রাতের গভীরতায় হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে

কিন্তু মনের পরিপ্রশ্নগুলো কেবলই বলে ওঠে

মানুষ কি ভাগ করে নেয় অশ্রুর গভীরতা

তবু

অমেদ উচ্ছ্বাস আর মনমরা কষ্ট যতই উড়ুক না কেন

এই ঘরটায় আমি মাঝেমধ্যে ফুলেল গন্ধ শুঁকি




মোমালয়ে অচেনা মুখ


কিছু আলো স্বরূপকে ঢেকে রাখে

কিছু আবছায়া শরীর উন্মোচনে

ছুঁয়ে দেয় যাপিত আকাঙ্খা

কখনো অযত্নে লালিত দুখ

কখনো মৌন কোঠায় জমানো শোক

নিরবে পুড়ে যাওয়া মোমের মুখ

প্রিয় ঘরটায় নিঝুম অন্ধকার কেবলই হেঁটে বেড়ায়

আমি মোমাশ্রয়ে মোমের সাথে জ্বলতে থাকি

অনতিদূর গলে গলে মাটিতে মিশে যাই

সকাল হতে হতে

কারোর হিংস্র নখে কিংবা কারো বা

রুক্ষ ঝাড়ুর খুচায় নর্দমায় হারিয়ে যাই

সকল মোমালয়ে সময়ের চেনা মুখও অচেনা লাগে




সুতোয় ঝুলানো স্তনাবেশ


অমৃতময় এই স্তনে শুঁকেছি

অখিল মমতার গন্ধ

দেখেছি আঁচলের ফুটোয় ঈশ্বরের হাসি

এই স্তনে পেয়েছি প্রিয়ার অনিন্দ্য বিষ্ময়

অখিলাত্মার বিমূর্ত অবয়ব

ঈশ্বর রমণীর শরীরে ছড়িয়ে আছে বলেই

এখানে সকালে বসে বাৎসল্যের পাখি

দুপুরে ভীড় করে ধূসর ভ্রমর




ধুপঘ্রাণে ধ্যান


সমুদ্রের বুকে শঙ্খ যতই বেড়ে ওঠুক কিংবা

দুলিয়ে নিক প্রাণের স্পন্দন

তাঁর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আজো বেজে ওঠে হৃদকমলে

বিগলিত মন অপার বিনম্রে শুঁকে নেয় ধুপঘ্রাণ

ধ্যানের কুণ্ডলী পাকিয়ে কেবল ভালোবাসা খোঁজে

কিন্তু সকল ধুপঘ্রাণে অমঙ্গল ফেরারী হয় না

সেঁটে থাকে জীবন বাঁকে শোকের অনিয়ন্ত্রিত ধ্বনি




দেয়ালের গা-গতর


আমি কোনো বিকার শূন্য দেয়াল নই

নই নিষ্প্রভ নিশীথের কোনো খাস জমি

আমার শরীরটা ধপধপে শাদা ছিল একদিন

আজ মেঘ রঙের দুর্বিষহ শ্বাস লেগে আছে

আমার গা-গতরে যখন তখন ঋষিছন্দ লেখা হয়

আঁকা হয় নারীর কাঁচাপাকা রূপ

শরীরে লেগে থাকা আমার রসবাক্য কামিনীর হাসি

প্রজাপতি আর ঘাসফড়িং এর রঙ

পাখির ডানায় উড়ে উড়ে ঘুরে

ঝাঁপসা চোখে পথিক দেখে পথ হারায়

কিন্তু আজ আমার শরীর বেদখল

চলছে ইচ্ছে মতো মাড়াই




টিকটিকির জিহ্বা


অসীমের মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে রঙিন টিকটিকি

চারিদেকে কেবল আঁধারের স্রোত

নাগালে না পেলেই পতপত করে উড়ে আকণ্ঠ ক্রোধ

তবু প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা

কখনো নদীর মতো ঢেউ

কখনো গাঢ় অন্ধকার ডিঙগিয়ে

তৈরি করে অমরাবতী স্বপ্ন

তবু রঙিন টিকটিকি

হা করে তাকিয়ে আছে

আর আলাজিহ্বা বের করে

ফেলছে অতৃপ্তির নিঃশ্বাস




খড়ম পা


তিনি কথায় কথায় উপমা জুড়ে দেন

রূপকের আশ্রয়ে বিস্তার করেন গালগল্প

দৃষ্টির পখরতায় মনের পরিসীমা খোঁজতে থাকেন

কিন্তু অধরা মন কখনোই বোঝা হলো না তার

স্বরবিন্দু সোহাগে সলাজে তাকে বুঝতে গিয়ে

কখনো অবুঝ শিশু

কখনো বা গড়িয়ে পড়া জল

খড়ম পা দিবারাত্রি ছুটেই চলেছে

স্বরবিন্দু মনে মনে বলে

সই তুই কি বুঝেছিস

চরণের ভাষা কোন রূপে সাজে




কালো টিপ


সব থুতুই বেহিসেবি নয় বরং

কোনো কোনো থুতু

পূর্ণিমার চাঁদ বদনে আর্শীবাদ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে

সোহাগী বাতাসে জোৎস্নার রঙ মাখানো বধুর

কালো টিপ বিমূর্ত বিষ্ময়

তারই আলপথ ধরে এগিয়ে যায় কামসূত্র

প্রেম তো সাধ্য বস্তু

যেখানে মনপুরুষ বসে উজানের গান গায়




স্পর্শশূন্য


হাতের নাগালে থাকা সময়টা

বাঁকা ধনুকের পথে চলে গেছে

ধরতে পারিনি

তাই অধরে আঁকা ভিঞ্চির রঙ

নীলাভ কষ্টে ঘুমিয়ে বিভোর

সরীসৃপের মত হেঁটে গেছে অসীমে

বেধের শব্দবাণে মুদিত হয়েছে যে চোখ

তার প্রাণের সন্তর্পণে সাঁতার কাটে

কষ্টের ডোরাকাটা ধ্বনি

সত্তার গভীরে বিমর্ষ ব্যর্থতা

ছুঁয়ে দেয় উপহাস উপঢৌকনের ঝুলি

ব্যঙ্গ করে রাতের গভীরতা

মহাকাল নৃত্য করে অশুদ্ধ সাধনে

তবু ফুলেল সৌরভ খসে পড়ে

তমিস্রার অতল বিতলে

তুমি আমন ফসল ঠিঁকই গোলায় তুলেছ

এখন তোমার বীজ বাগানে ময়ূর পেখম

ধরতে পারিনি বলে সময়টা

অর্ধনমিত পতাকা তলে

শোকের মাতম খেলে




অর্ধেন্দু শর্মা

জন্ম : ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ, পিতা: মনোরঞ্জন শর্মা, মাতা: শ্রীমতি পুষ্প শর্মা। পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার জগৎপুর গ্রামে। মামার বাড়ি কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার সাহার পদুয়া গ্রামে (রজনী চেয়ারম্যানের বাড়ি) তাঁর জন্ম। প্রাথমিক শিক্ষা: সাহার পদুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, বরুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সর্বশেষ জিনসার প্রাথমিক বিদ্যালয়। তারপর বরুড়া হাজী নোয়াব আলী হাই স্কুল (১৯৮৭) থেকে এসএসসি পাস। বাকি শিক্ষাজীবন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘ধিক’ ও ‘কালসূত্র’ সম্পাদনা করছেন। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিতব্য মুক্তিযুদ্ধ-কোষ-এর তথ্য-সংগ্রাহক ও গবেষক বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জজ কোর্টে আইনপেশায় নিয়োজিত।

গল্পগ্রন্থ : কালোমেঘের আছর (২০১৭), জল ঘর (২০২১), পান পিচকিনি (২০২২)
প্রবন্ধ: অদ্বৈত অন্বেষণ (২০১৯)
উপন্যাস : অদ্বৈত (২০২১)
কাব্যগ্রন্থ: বৃত্তান্তরে এক জন্ম (২০০৫), সেই নাগরিক রাজহাঁস (২০২১), চোখে’র চৌকাঠে চোখ (২০২২)
কাব্যালোচনা : প্রাণস্পন্দনের কবি (২০২৩)
সম্পাদনা : স্বরূপ-অরূপ প্রাণতোষ চৌধুরী (২০২২)
মানিকরতন শর্মা নামে গদ্য লিখছেন।

Post a Comment

0 Comments