রত্না মাহমুদা'র গদ্য~ সত্যেন সেনের- পরীবানুর কাহিনী : মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা

Ratna Mahmuda's Prose ~ Satyen Sen's Paribanu Story : Role of Women



সত্যেন সেন(১৯০৭-১৯৮১)-এর  ‘পরীবানুর কাহিনী’ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একটি ছোট গল্প।  মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অগ্রণী ভূমিকা অব্যক্ত ও সর্বসাধারণের  কাছে সবসময়  অনুচ্চারিত। গল্পকার নারী যোদ্ধাদের বহুমাত্রিক অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘পরিবানুর  কাহিনী’ গল্পটি রচনা করেছেন।মুক্তিযোদ্ধা  হারুনের দেশপ্রেম যেন পরীবানুর আত্মত্যাগের কাছে মাথা নত করেছে। তাই  হারুন ও পরীবানু  স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী নারী -পুরুষের চেতনার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম। পর্দার বেড়াজাল ছিন্ন করে-  ঘরের বাইরে এসে -অস্ত্র হাতে -যুদ্ধ করার মত সাহসিকতা  -পরীবানুকে সম্মানের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে।যে পরী শুধু নারী নয়, হয়ে উঠেছে নেত্রী, যাঁর হুকুমে শত্রুদের দমন করা হয়।


হারুনের  শিক্ষক পরী সম্পর্কে মন্তব্য করে- “হারুনের স্ত্রী পরীবানুকে কে জানতাম তার বাপ মা তার পরী নামটা বৃথা দেয়নি। পরীর মতই সুন্দরী মেয়ে। শুধু রূপই  নয়,  রূপও যেমন আছে গুণও আছে। কিন্তু দুজনের এই ছোট সংসারটুকুতে শান্তি ছিল না।।এটা -ওটা নিয়ে দুজনের মধ্যে খিটিমিটি বেঁধে যেত। আর সেই খিটিমিটি যখন তখন তুমুল কলের মধ্যে দিয়েই বিস্ফোরণের মতোই ফেটে পড়তো। পৃঃ৪

গল্পকথকের ভাষায়-

“পরীবানু  সাধারণ ঘরের মেয়ে হলেও  কিছুটা লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিল। ওর মনে অনেক উচ্চাশা। সে চেয়েছিল রান্না ঘরের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না হয়ে বাইরের মুক্ত পরিবেশে আপনার ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে। এ যুগে সেটা দোষের কথা নয় গুণের কথাই। তার মতো আরো অনেক মেয়ের মনেই হয়তো ইচ্ছাটা গুমরে  গুমরে মরে। কিন্তু গ্রামের সাধারণ মুসলমান ঘরের কূলবধুর পক্ষে সেই  পথে এগুতে গেলে পদে পদে  অনেক বাধা। এই উচ্চাশার পাখিটাকে ছড়িয়ে দিতে গেলে প্রচণ্ড  ঘা পড়ে। তখন হয়তো সে উদ্ধত্ব পাখিটাকে গুটিয়ে নিতে হয়,নয়তো চূর্ণ  হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে জেনেও বিদ্রোহ করতে হয়।” পৃঃ ৪

প্রতিবাদী পরী  সবসময় স্বামীকে প্রশ্ন করতো। কথার পিঠে কথা বলতো। জবাব দিত, হারুন যখন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত দেশ নিয়ে শংকিত দেশের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তিত তখন পরী  প্রশ্ন করে ওঠে, ‘এই বাংলাদেশটা কি তোমাদের পুরুষদেরই মেয়েদের কিছু নয়! আমাদের মেয়েদের নামগুলো কি শুধু সেন্সাস রিপোর্টের পাতা ভর্তি করে রাখবার জন্যই’? পৃঃ৫ 
হারুন অবাক হয়ে শুনল আর বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলো এরকম প্রশ্ন কেন করছে তার স্ত্রী পরী। 
প্রতিউত্তরে পরী বলল - “কেন সে কথা ও আবার জিজ্ঞেস করছেন এতদিন ধরে স্বাধীন বাংলার আন্দোলন চলছে আপনারা সভা করছেন মিছিল করছেন আমাদের মেয়েদের কোনদিন কোন কাছে ডাক দিয়েছেন?” - পৃঃ৫
পরীর ভাবনাকে স্যালুট জানিয়ে- হারুন বলল প্রকৃত অর্থে যদি আমরা মেয়েদেরকে শক্তি  হিসেবে ব্যবহার করি, তাহলে আমাদের আরো বেশি শক্তি বাড়বে। অথচ হারুন পরীকে শাসন করে বলেছিল  মেয়েদের স্থান ঘরে, বাইরে নয়। আজ সে হারুন তাঁর স্ত্রীর সাহসিকতার প্রশংসা করছে। কিন্তু কীভাবে ঘরের মেয়েরা এতদিনের পর্দাপ্রথা ভঙ্গ করে পুরুষের সাথে যুদ্ধ করতে মাঠে নামবে!
"পরী বলল কেন? আসবে না? তাদের মনকে আসতে চায় না? তাঁরা  কি আপনার মত এদেশের মানুষ নয়?আপনারা জোর করে  দরজাটা বন্ধ করে রাখেন, আসতে পারে না, দরজাটা খুলে দিয়ে তাদের ডেকে দেখুন না একবার। "-পৃঃ৫

পরীবানু কাজ করছে গোপনে গোপনে কাজ করছে দেশের জন্য কাজ করছে। 
পরীবানু নেমে এলো কাজে। দিনের পর দিন নতুন নতুন মেয়েকে কাজের সাথী করে নিয়ে আসলো। তার দলবল ক্রমশ বেড়ে চলল। বাধা দেব  দূরে থাক, আমি  তাকে সাগ্রহে  আমাদের মধ্যে টেনে নিয়ে এসেছিলাম। তারপর থেকে কখনো কাছে,কখনো বা দূরে, আমরা  মনে মন মিলিয়ে কাজ করে চলে আসছি”। পৃঃ৫

“পরী দূরে চলে গেলে চিঠিতে যোগাযোগ হয়। না হয় যোগাযোগ না করে  থাকতে হয়। পরী -হারুনকে চিঠিতে জানায় শরীরটাকে যতটা সম্ভব সুস্থ রাখতে চেষ্টা করবেন। আর একটা কথা সাবধান ওদের হাতে কিছুতেই ধরা দেওয়া চলবে না। আমার জন্য ভাববেন না আমি মেয়ে মানুষ। আমার পক্ষে অনেক সুবিধা, আমি পানি হয়ে একরাশি পানির সঙ্গে মিশে আছি। পৃঃ৬
হারুন -পরী দম্পতি যেন এলাকার মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শক্তি। গ্রামের ভেতরে যখন সৈন্যরা আক্রমণ শুরু করল। তাদেরকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্যই পরী ও তার দল ফন্দি  আটল।শুধা পান করে যখন সৈন্যরা ঝিমিয়ে পড়ছিল। ঠিক তখনই -উপযুক্ত মুহূর্ত বুঝে সেই শরিনীরা রণরঙ্গিনীর মূর্তি ধরে লাফিয়ে উঠল,তারপর ধারালো  পা দিয়ে ওদের কুপিয়ে কুপিয়ে কাটলো। যারা শত শত নিরীহ লোকের রক্তে লাল করেছে, সেই ঘাতকের ূল তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। কিন্তু তাদের রক্ষা করবার জন্য কি  কেউ এগিয়ে এল না। এইভাবে তিনজন সশস্ত্র সৈন্য এই মেয়েদের হাতে মারা পড়ল। পৃঃ ৭
পত্রিকায় সত্য ঘটনাটি প্রকাশিত হলো এবং সারা জাগালো। দেশের মানুষ ভাবতে লাগলো দেশের শত্রুদের ধ্বংস করবার সংকল্প নিয়ে দীর্ঘকালের ঐতিহ্য সূত্র অতিক্রম করে যেতে পারে? -পৃঃ ৭
হারুনের শিক্ষক যখন সত্য ঘটনা জানতে পারলো সমগ্র ঘটনার পেছনে একটি মেয়ের নেতৃত্ব। মেয়েটিকে সবাই আপা বলে ডাকতো। মুক্তিবাহিনী নেত্রী বলে তার নাম কি প্রকাশ করতে চাইতো না। তার আসল নাম চাপা পড়া ছিল না। তার নাম পরিবানো। লোকে বলেছে পরিমাণও নাকি পরীর মতই সুন্দর তবে বাস্তবে আমি দেখিনি কোনদিন। শিক্ষক রাত্রিবেলা তার স্ত্রী হালিমাকে সব ঘটনা খুলে বললেন। হালিমা বললেন এরা আলাদা জাতের মেয়ে। তখন থাকতে লাগলেন এবার থাকার পালা আমার চুপ করে থেকে বললাম কথাই বলেছ হালিমা জাতের মেয়ে এদের চিনে ওঠা আমাদের সাধ্য নয়।

"সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ লেখকমাত্রই সমকালের মধ্যে সন্ধান করেন অনিবার্য প্রকরণ।সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অনুষঙ্গে সংগঠিত মানবতাবিরোধী, জনঘাতী বৈরী আচরণের প্রতিক্রিয়ায় আলোড়িত সংবেদনশীল লেখকরা নিয়ত সন্ধান করেন বিকল্প আঙ্গিক।কাহিনি বিন্যাসে প্রতীক- ফর্মের ব্যবহার লেখকদের এই আধুনিক আঙ্গিক সচেতনতার পরিচায়ক।"(২০০৯ঃপৃঃ২৭৭)
সমাজের প্রতি দায়বোধ থেকে সত্যেন সেনের পরীবানুর কাহিনী গল্পটি রচনা করেছেন।১৯৭১ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত নারী প্রতিকূলতা ডিঙিয়েও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছেন।পুরুষের সমকক্ষ হয়ে কাজ করছেন!তা একমাত্র গল্পকারের সৃজনীশক্তি ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী চিন্তার রূপকায়ন! পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে- অস্ত্র হাতে- যুদ্ধ করার মত- স্বাধীনতা অর্জন করা- অতৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় চরম হুমকির ছিল।মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য   বাঙালি নারীদের আত্মত্যাগের অন্তরমহল সব সময় চাপা পরে থাকে।গল্পকার সত্যেন  সেন পরীবানু চরিত্রটি কে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নারী অবদানের পথিকৃৎ হিসেবে শৈল্পিক কারুকাজে সজ্জিত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী পরীবানু একবিংশ শতাব্দীর নারীর স্বাধীনতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সত্যেন সেন তৎকালীন সময়কে বর্তমান নারী সমাজের বিবর্তনের ধারক হিসেবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন! নারী জাগরণ ও নারী প্রত্যয়ের স্বপ্নচারী পরীবানু কাহিনী গল্পটি!




রত্না মাহমুদা
কবি ও গবেষক,বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments