সেলফি
ভিড় ঠেলে সামনের সারিতে যারা রীতিমতো দাঁত কেলিয়ে আসীন
পদকপ্রাপ্ত, আরো রপ্ত কত গুরুগম্ভীর বয়ান
শুক্লকেশ, তাদের পেছনে যারা সম্পাদকের কোটায়
তাদের ভিতরে কিছু স্লিভলেস, স্তনবতী, নরোম পরিষেবায়
পাতিকবি, উপকবি, সুহৃদ, মুরিদ-তাদেরও পিছনে একা
সামান্য গোঁফের রেখা অথবা একটা চোখ চেনা যায়?
এই তো অমিও পাঞ্জাবি সেই আদ্যোপান্তমফস্বল
সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছি বাংলা কবিতায়।
জলসাঘর
একটা নিচুমুদি দোকানের গল্প লিখতে পরিনি বলে
রাস্তা পেরোতে আমার সংকোচ হয়।
আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে একটা পাগলের চোখ
স্বপ্নের ভেতরও অর্থ খুঁজে দাও, অর্থ খুঁজে দাও!
অভিধানের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কেমন বিবর্ণ হচ্ছে শোক
মানুষ পড়তে পারিনি বলেই তো এই রক্তাক্ত হোচট
এত বিবমিষা!
স্বপ্নের ভিতরও স্বাদুসেই অন্ধ নারীর ঠোঁট
কী সংকেত পাঠায়!
শরীরকে শরীর দিয়ে আমি কখনো তৃপ্ত হতে পারিনি
সেই মৃদু হরিণীর কথা কোথাও লেখা নেই
কেবল আলগোছে তার পায়ে ভেঙে যাওয়া প্রতিটি ভোর
ছলকে যাওয়া যত ঘুঙুর পাঠায়!
ঘুঙুরের কোনো ভাবার্থ হয়না পৃথিবীতে
যদিও জলসাঘরে রোজ টিকিট বিক্রি হয়।
কুঠার
বহুজন্ম কেটে গেছে অবিকল জলের কিনারে।
আমি সে নই-আমি সেই অন্ধ কাঠুরিয়ার ছেলে।
চেয়েছিলাম শুধু ক্ষুধার মিমাংসা হোক।
ফিরিয়ে দেবার আশ্বাসে যারা চেয়েছিল রাজার ভোট,
তাদের ঘরে ব্যাগভর্তি বাজার।
ইচ্ছেমতো কেড়ে নিয়ে সামান্য কিছুগেছে ফেলে।
বংশপরম্পরায় তিনি মন্ত্রী আর আমি কাঠুরিয়ার
ছেলে।
নদীর পারে এসে দেখি জমে গেছে অগুনতি লোক।
উৎসুক জনতা চেয়েছে জলদেবী বিবসা হোক।
নদী থেকে দেবী উঠে আসতে পারতেন
যদিও দেবী জানেন না সাঁতার।
যত বেশি বৃক্ষ জন্মেছিল, তারো বেশি জন্মেছে কুঠার।
সমাস
হাইফেন-দূরত্বেথেকে
এতগুলো বছরেও আমাদের দ্বন্দ্ব সমাস হলো না।
পরপদে ভুল ছিলো, পূর্বপদেও ছিলো অহেতুক তাড়না।
ভয়ানক স্মৃতি, আমি যার রূপক ক্রীতদাস
মধ্যপদলোপী-মুছে গেছে গোপন অভিলাষ।
চন্দ্রমুখ বলো, ভেসে যায় আমার উপমান
তোমারও তৎপুরুষ নেশা ছড়িয়েছে আকাশসমান।
বহুব্রীহি সে? আমি যে লুকানো পঙ্কজ
ব্যাসবাক্যে তুমি তারে কতটুকুকরেছিলে তার খোঁজ?
সমাসবদ্ধ প্রেম? কতটুকু দিতে পারে সুখ
লণ্ডভণ্ড হে ঋষিকেশ, অহেতুক ব্যাকরণ-মুলুক।
আমিও যেমন বাড়িয়েছি ব্যথাতুর ব্যাতিহার
তুমিও তেমন করে খুলেছ সুচতুর অলুক।
গণিত
কোনো এক প্রাণের মে․লিকে আমি অবিভাজ্য নই
ভাজ্য আর ভাজকের খোলায়।
হৃদয়ে অসংখ্য গণিততবু আমি গ্রাফ পেপার নই।
আমার উত্থান-পতন ঘিরে অজস্রডাটাবেজ,
লোকনিন্দা, কিন্তু আমি দেবতা নই।
কতকাল বেঁচে আছি বর্গাকার বেদনার ঘরে
তুমি কোন পীথাগোরাস দিয়ে যাচ্ছ সমকোণী লোভ!
কেন্দ্র ফুঁড়ে চলে যাচ্ছে বহুগামী ব্যাসের ধারণা।
তবু আমাকেই ফিরে আসতে হবে প্যারাবোলা
এই সংসারে।
গণিতের দিদিমিণি শোনো,
হৃদয়ের সঠিক কোনো স্থানাঙ্ক নেই।
বিরামচিহ্নের দোষে
এতটা বিরামচিহ্ন, তবুও আমার বিরাম নেই
এই হাইফেন, ঊর্ধকমা ফেলে রেখে যাও।
বৃদ্ধ কাঠমিস্ত্রীর চশমায় শেষবেলায় কী দেখা যায়?
এতগুলো প্রশ্ন? বিস্ময়!
তর্ক করে কিছু ‘রেফ’ তুমি বসিয়ে দিয়েছ বর্ষায়,
কিছু ব্যক্তিগত ‘র’ ফলা।
বর্ষাতিবিহীন অক্ষর তাই পিছলে গিয়েছে হসন্ত-স্বভাবে।
তুমি জানতে না বাংলার দিদিমিণি
বই থেকে লাফিয়ে ওঠা সব চন্দ্রবিন্দু
আজ, ‘চাঁদ’ হয় না।
বিসর্গ মানেই কি কেবল দুঃখ?
এই শুদ্ধিকরণের জীবন, এই যতিচিহ্নের জীবন
একাডেমি বা আকাদেমির আমি কেউ নই।
পাপে ঘেরা সেই নিষিদ্ধ গলির মোড়ে
বিরামচিহ্নের দোষে থামার নিয়ম নেই।
‘একের’ দ্বিগুণে যেখানে অন্ধ সেমিকোলন
সেখানে দাঁড়িয়ে কেবল শেষবার চুমু খাই।
বোধি
বোতলবন্দি কবিতারা ভেসে যাক সাগরের পার
আপাতত, এই প্রেম তোমার দিকে যাবে না।
আপাতত এই প্রেম দীপান্তরের ঘাসের,
স্মৃতিভ্রষ্ট কোনো নাবিকের কম্পাসের,
আপাতত এই প্রেম গৃহস্থসুখ পাবে না।
আমাকে ক্ষুধামান্দ্যের শ্লোকে ভুলিয়ে রেখে তুমি
অন্য চ্যানেলে জমিয়েছ রেসেপির ক্লাস।
ও মলমবিবি, ফুটপাত থেকে গ্যালারিতে রোজ
জমে যাচ্ছে তোমার ম্যাজিক,
প্রেমিকবদল আর হাতসাফাই।
মুর্ছিত গোলাপের নিলামে ভরিয়ে তুলছো বেশ অপবাগান।
প্রিয় মক্ষিকা,
শূন্য সঙ্গম শেষে ছড়িয়ে দিচ্ছ কার নিথর দেহ?
এইসব দৃশ্যপতনের পর কুমীরের কান্না দেখে আমি অট্টহাসি করি
বিগলিত প্রেমের প্রস্তাবে সর্দিকাতর হয়ে কফসিরাপ খাই।
অবন্তিকা, তোমার বন্ধ জানলা থেকে খুব লম্বা সিদ্ধেশ্বরী লেনে
সিদ্ধার্থথেকে আমি বুদ্ধ হয়ে যাই।
হারিকেন
আমাদের ক্সশশব দুলে দুলে ওঠা এক হারিকেন।
নীল কেরোসিনের ঘ্রাণ। সলতের সুখ।
আমাদের ক্সশশব যেন সুগোল বিশ্বাসে ঘিরে রাখা
আলোর কোকিল,
হারিকেনের কাচে হাত রেখে পাওয়া উত্তাপ আর
পাপের ধারণা।
আমাদের মুখস্থ ক্সশশব, কাচভাঙা জীবন
গুঁজে দেয়া কাগজের ওপার থেকেও বিবর্ণ হাসে।
আগুন নেভালেও জেগে থাকে টলটলে আগুনের ফুল।
ফুল নাকি ফুলকি?
আমরা ছিটকে পড়েছিলাম কবে
আমাদের ভেঙে গিয়েছে বৃত্ত।
আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন
বদলে গিয়ে উঠেছি উঁচুফ্লাটে।
আর পুরানো স্টোররুমে আজো ঝুলমাখা এক হারিকেন
জন্মান্ধ বোনের মতো একা একা জাগে।
অশ্বমেধ
অন্য এক কবিকে ভালোবেসেছ জেনে খুশি হয়েছি।
অন্তত, কবিদের কেউ তোমাকে পাবে।
পাবে, অথবা পাবে না।
তোমার আঙুল, নখ, ঠোঁট ও বুকের বর্ণনা দিয়ে
যে কবি কবিতা লিখেছিলো
শাস্ত্রমতে তার সাথে সঙ্গম করতে মানা।
শহর ছেড়ে দিয়েছ যে অশ্বমেধের ঘোড়া
প্রত্যেক গলিতে, মহল্লায় সে একটা যুদ্ধ রটাচ্ছে।
সামান্য ইঙ্গিতে ভাইয়ে-ভাইয়ে, গুরু-শিষ্যে
সরকার-বিরোধীতে এক অপূর্বহেজিমনি।
তবুও মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের দোষে তুমি ম্যাজিক মামণি
আজও প্রাসঙ্গিক আহা বাংলা কবিতায়!
অথচ, গ্লানি লেগে আছে রাজপথে রক্ত-লালায়।
যদিও বেহায়া আমি কোনো প্রশ্ন তুলিনি চূড়ান্ত
রাজমহিষীর সাথে ঘোড়ার সঙ্গম দেখে দেখে
আমি ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত।
কমলালেবু
মা, অন্ধকার বারান্দায় তবে আরো দীর্ঘ রাত
ওরা বলেছিলো- পুরোটা আনো, তবেই ছুঁতে পারা যাবে
হাত তোমার,
চুড়ির স্পর্শ আর আঙুলের সেই কাটা দাগ।
অদূরে যতোটা ঝিঁকির কোরাস- আরো কতকটা হিম
নামিয়ে রেখেছে ময়লা বেড থেকে শীতল মাদুরে যখন।
মা, বড়ো ভাইয়ের তো আসার কথা ছিলো কারখানা থেকে সরাসরি
যদিও ফোন ধরছে না আর কত আত্মীয় স্বজন
লোকাল ট্রেনে ফিরে গেলো যারা, সবাই শহরে ছিলো।
মা, একটা গ্রিলের ওপার থেকে তোমার ঘ্রাণ পাচ্ছি
এখনো, একটা পানির গ্লাসে কিছুটা পানি,
সিরাপের শিশির পাশে আরো একটা পিঁপড়ের সারি।
একাকী একটা মেয়ে এই শহরের কলরবে
ভাবছি, শুধু ভাবছি:
হাসপাতাল-ফেরত এইসব কমলার, তবে কী হবে!
বিপ্লব রায়ের শামুকখোলে শিস : প্রতিসাম্যে জীবনদর্শ
অন্তরা বিশ্বাস
কবিতা ছাড়া কবির কোনো মুখ নেই, মুখোশও নেই। তাই উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ের অনিবার্য দায়
ও দহনের সূত্রে কবিঅস্মিতার (Poetic Ego) এই দ্বিচারিসংকট একদিকে যেমন সত্য, তেমনি
ব্যক্তিমাত্রই কবিবাচক অভিধায় উন্নীত হবার প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে তাঁরই জীবনঘনিষ্ট
দার্শনিক সংরূপ। এসব যাবতীয় উপলক্ষকে বাক্সময় করে প্রকৃত কবিতার আত্মপ্রকাশ ঘটে কবির
নির্বাচিত শব্দসমবায় ও ভাষিক অবয়বে। কবি বিপ্লব রায়ের (জ. ১৯৮৭) সে উন্মোচিত অন্তর্লোকের
সঙ্গে পাঠক হিসেবে আমাদের পরিচয়ের শুভ্রতা এই শব্দসান্নিধ্যেই। তত্ত্বের বহুকোণ, নির্ণীত প্রকরণ
আর সনাতন সমালোচনার ভীষণদৃষ্টিকে ভ্রƒকুটি করে, কবিতা যে সদ্যজাত সাহসে সামনে দাঁড়ায়- তার
বেড়ে ওঠা সবদিনই গোকূলে, সবার অলক্ষ্যে। তবুও সে দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে থাকে- এই দাঁড়ানোর
ভঙ্গিটাই দৃষ্টিনন্দন। নিঃসন্দেহে, কবি বিপ্লব রায়ের প্রথম কাব্য শামুকখোলে শিসের (২০১৯) প্রায়
প্রতিটি কবিতা সুখপাঠ্য। প্রস্তরে বিদ্যমান তরঙ্গচিহ্নের মতো পাঠকের চেতনবিশ্বে ছায়া ফেলে তাঁর
প্রবাদপ্রতিম বেশকিছু পঙ্ক্তিনিচয়। হয়তো শুরু থেকেই শুরু করার ঝোঁক কবির ছিলো না, অথবা
নিছক শব্দ নিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে গিয়ে কখন যে দলছুট চিন্তারা বয়ঃসন্ধির উঠোন পেরিয়ে যৌবনের
পথে পা বাড়িয়েছেÑ তা হয়তো কবির নিজেরই অজানা। কতো একাকী সে সৌন্দর্যে অবগাহন,
কতোটা বন্ধুর আর কর্দমাক্ত শিল্পের সে পথ! তবুও সৃজনের এক অনির্বচনীয় স্বাদ, আনন্দ-বেদনার
বিমিশ্র অনুভবÑ কবিকে তাড়িত করেছে, ভ্রমণসুখের বাসনায় নিয়ে এসেছে এতোটা পথ। এভাবেই
তাঁর নন্দনমাত্রায় চিহ্নিত আপাত অসংলগ্নতার মাঝেও জড়িয়ে থাকে জীবনসংলগ্ন হবার দুর্নিবার যোগ
এবং অভিজ্ঞাত সত্য প্রকাশের বাসনা। আর সে সত্য নিহিত থাকে কবির যাপিত জীবনের ভারসাম্যে
নয়, বরং প্রতিসাম্যে (Juxtaposition)।
এই কথার সূত্রে স্বভাবতই বিশ শতকের আধুনিক কবিতা সৃজনের পরিপ্রেক্ষিত প্রাসঙ্গিকতা পায়।
অগ্রজ কবিদের কবিতার ঐতিহ্যকে স্বীকার করেই কবি বিপ্লব রায় নিজের ব্যক্তিবিশ্ব প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর
প্রথম কাব্যে। জন্মসূত্রে তিনি বিশ শতকের জাতক হলেও, একুশ শতকের পরিবর্তমান জীবনবাস্তবতায়
তাঁর মানসগঠন এবং স্বীয় চিন্তার বিকাশমুহূর্ত প্রস্তুত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তেপ্রসারিত নতুন
আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষেপণ, মানবিক অবক্ষয়ের সার্বিক দৃশ্যে ভেঙে পড়া মূল্যবোধ,
ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির আধিপত্যে উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়েও জনমানসের স্বপ্ন ও বাস্তবের
বিপরীতমুখী অবস্থান কবিকে ভাবায়। এই ভাবনার পারম্পর্যে বাস্তবতার নিরিখে তাঁর কবিতার নির্মাণ
বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। ব্যক্তিমাত্রই সবাইকে ভাবায় না, প্রকাশের তাগিদও সবার সমান নয়। এর জবাব
মেলে পূর্বজ কবিদের ভাবনার নিদর্শনে। তিনের দশকের কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) খুব
সহজ করেই বলেন : সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ‘কবিতার কথা’
প্রবন্ধে চিহ্নিত করেন ব্যক্তির ‘চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তার’ কথা। অন্যদিকে পাঁচের দশকের
কবি শঙ্খ ঘোষ (জ. ১৯৩২) তাঁর ‘প্রতিষ্ঠান এবং আত্মপ্রতিষ্ঠান’ প্রবন্ধে শৈলেশ্বর ঘোষের কথা উদ্ধৃত
করে বলেন : ‘কবি শব্দই বিদ্রোহবাচক, কারণ জীবনের ষড়যন্ত্রময় বস্তুসমূহের মারাত্মক অবস্থানকে যে
মেনে নিতে অস্বীকার করে ও বেঁকে বসে সে-ই কবি।’ মূলত এই ‘প্রাতিস্বিক সারবত্তা’ ও ‘বিদ্রোহবাচক’
রূপ নিয়েই ‘কবিঅস্মিতা’ দাঁড়ায় এবং কবিতার ভাষা পরিচিতের শম্বুকীয় খোলস ছেড়ে নন্দনে উপনীত
হয়। এরূপ চিন্তাকাঠামো প্রাসঙ্গিকতা পায় শামুকখোলে শিস কাব্যের ক্ষেত্রেও। সুতরাং, ‘কবি’ শব্দটাই
এক অর্থে প্রাতিস্বিকতা ও বিদ্রোহবাচক ইঙ্গিতসমূহের প্রশ্রয় হয়ে ওঠে। এ কাব্যের কবিতায় কবির
অভিপ্রায়ে এ প্রবণতা সহজাত রূপ পেয়েছে। এই কথাগুলো স্বপ্রণোদিত হয়ে জানান দেয় কবির
ঐকান্তিক সামর্থেরও। কবির দায় থাকে পাঠকের কাছে, সেই অজ্ঞাতকুলশীল দূরদর্শী পাঠক- যার কাছে
সত্যকে বিশ্বস্ত করার প্রেরণা থাকে। এ কাব্যের আধার ও আধেয় বিবেচনায় ব্যক্তিঅভিজ্ঞতাকে
নৈর্ব্যক্তিকে উন্নীত করার সংলক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। বিষয়টির গুরুত্ব চিহ্নিত করে অন্যদিকে লেখক
লিও তলস্তয় What is Art? শীর্ষক গ্রন্থে বলেন : : Universal art arises only when someone of
the people, having experienced a strong emotion, feels the necessity of transmitting it
to others. অর্থাৎ, শিল্পের নন্দনজাত অভিযাত্রায় অভিজ্ঞতার তীব্রতা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি তাকে
প্রতিস্থাপন করে অন্যের দিকে প্রেরণের ব্যাপারটিও গুরুত্ববহ। কবি বিপ্লব রায়ের কবিতার নিবিষ্টপাঠে
অনুরূপ নন্দনচিন্তার নির্যাস (Phenomenon) লক্ষ করা যায়। কেননা, এ কবির প্রাত্যহিক
সংবেদনশীলতা থেকে এসেছে বিষাদ, আর সচেতনতা থেকে এসেছে ক্রোধ। এই বিষাদ ও ক্রোধের
অনবরত সংঘর্ষে কবিমানসে যে নির্বেদ (Ennui) আত্মস্থ হয়, তাই বাণীবন্ধনে স্থীতধী লাভ করেছে এ
কাব্যে। শামুকখোলে শিসের কবিতাসমূহ তারই সাক্ষ্য বহন করে আছে, যা সম্ভাবনাময় ও
প্রশংসাযোগ্য।
দুই.
কবি বিপ্লব রায়ের কবিতায় সময়চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়। সময়ের অবক্ষেপণ
(Temporality) তাঁর কবিতায় প্রভাবক ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি প্রাথমিক অনুশীলন পর্বেই
কবিতায় এক পরিণত উচ্চারণ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়ে ওঠে তাঁর কবিমানস। কৈশোরেই তাঁর
লেখালেখির সূচনা ঘটে। স্কুল ম্যাগাজিনের সাহিত্য বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার সাহচর্যে
কবিতা অনুশীলনের বিষয়টি রপ্ত করেন তিনি। পাঠক্রমের বাইরেও বহুকৌণিক পাঠের সামর্থ আর
জীবন অতিবাহনের সূত্রে প্রাপ্ত দুর্লভ অভিজ্ঞতা তাঁর কবিমানসে প্রভাব ফেলেছে। তাই সময়অন্বিষ্ট
ভাবনাকে তিনি সৃজন ও মননে প্রাধান্য দিয়েই ব্রতী হন কবিতাচর্চায়। উজান বৈঠা পত্রিকায় প্রকাশিত
‘বেহুলা ভাসান’, ‘একদল পিঁপড়ে অথবা একদানা চিনির কবিতা’, ‘রিখিয়া’ অথবা অমিত্রাক্ষর পত্রিকায়
‘শীতের শব্দার্থ’ শীর্ষক কবিতায় তাঁর কবিচেতনার উৎকর্ষের দিকগুলো মসৃণতা পায়। তবে
শামুখখোলে শিস কাব্যে কবির বিজনবাসের কৃতিত্ব ও সম্ভাবনার সমস্ত সূত্রই গ্রথিত হয়েছে। কবিকে
পাঠ করা এবং অনুভব করার গভীরতা এতে সম্ভব। ফলে প্রিয় পাঠকের তৃপ্তিও যেমন একটা অবলম্বন
পেয়েছে, তেমনি এর মধ্য দিয়ে ‘কবি ও পাঠকের’ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির এক অলখ সেতুবন্ধনও সম্ভব
হলো। কবিতাসমূহে উন্মোচিত হয়েছে কবির অন্তরমহলের আপাতবিচ্ছিন্ন কথাচিত্র। এ কাব্যের
ভূমিকাংশের শিরোনামহীন কবিতাটি তাঁর মানস পরিব্রাজনার সংলক্ষণ বহন করে আবর্তিত হয়েছে।
কবি স্বয়ং নিজেকেই কবিতার বিষয় করে তুলে জীবন অতিবাহনের সত্যকে সামনে আনেন। কিন্তু
সেখানে এমন এক পথের দৃশ্য উপস্থাপিত হয়, যাকে তিনি ‘শবযাত্রা’ ধ্বনিপুঞ্জে প্রতীকায়িত করেন।
তখন সচেতন পাঠকমাত্রই সচকিত হন, জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠেন এই শব্দনির্ণয়ের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে। এর
পরের স্তবকে কবিতায় চিহ্নিত হয় : ‘শব্দে শব্দে জাগে অজস্র জোনাকবাতি/ অহম কিংবা জখম, অস্পষ্ট
ইশারা!’ এ বাক্যে ‘শবযাত্রার’ প্রকৃতি ও সামর্থের প্রসঙ্গ দৃশ্যমানতা পেয়েছে। কিন্তু এর পরের স্তবকে
কবি নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন নিজেকে এবং ব্যক্তিশাসিত সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থা-সাংস্কৃতিক আবহকেও।
কবির ভাষায় : ‘কে ফিরে তাকাবে? শৈশব? শ্রেয়নীতি?’ এই অনুসন্ধিৎসু মননে প্রকটিত হয় কবির
সমাধানের সুতীব্র বাসনা। অথচ পরিণতিতে কবিতায় সিদ্ধান্তের মতো ঘোষিত হয় : ‘আদর্শলিপি ফেরি
করা লোকটার মুখ/ আজ আর মনে নেই।’ এই পুরো কাব্যিক অবয়বে শামুকখোলে শিস কাব্যের
মূলসুর প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এখানে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় কোন এক ‘কবিঅস্মিতা’র উত্তরণপর্ব ধ্বনিত হয়েছে।
মূলত এই উত্তরণ ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিকে, বিশেষ থেকে নির্বিশেষে, একক থেকে সার্বিক সত্তায়।
কিন্তু এ উত্তরণের যাত্রাপথ সহজসাধ্য নয়, বরং দুর্গম-জরাগ্রস্থ সমাজকাঠামোর মধ্য দিয়ে। নীতিতর্কের
অসারতা, জীবনে স্বপ্নের সঙ্গে দুঃস্বপ্নের যোগ কবিকে শিহরিত করে। এ কাব্যের অভিপ্রায়ে (Notion)
সে সত্য উন্মোচনের দায় নিহিত। তিনি তাঁর প্রতিটি কবিতার মধ্য দিয়ে সেই বৈচিত্র্যময় পদব্রজের
দার্শনিক অভিজ্ঞানকে বাণীবদ্ধ করেন। এভাবেই তাঁর কবিতার করণকৌশলে বহুত্বকে (Plurarity)
প্রতিবিম্বিত করার এষণা বিশিষ্টতা লাভ করে। এই বৈচিত্র্যের দৃশ্যায়নে জীবনের সুষম রূপ নয়, বরং
বিপরীত অনুষঙ্গের পারস্পরিক সহাবস্থানই সত্য হয়ে ওঠে। কবিজীবনের প্রারম্ভেই ‘শবযাত্রা’র ইঙ্গিতে
প্রতিসাম্য যেমন স্থিতি পায়, তেমনি ‘জোনাকবাতি’ শব্দে প্রতীকী হয়ে ওঠে জীবনে দীপায়নের
(Enlightenment) যোগসূত্র। এর মাধ্যমেই তিনি একইসঙ্গে অনুভব করেন তাঁর ‘অহম’ ও ‘জখম’কে।
পাশাপাশি উক্ত এই বিপরীতমুখী শব্দ নির্বাচনে প্রাপ্ত দার্শনিক সংরূপে ঘোষিত হয় : একইসঙ্গে যা তাঁর
গৌরবের, অপরপক্ষে তাই-ই হয়তো পরাজয়ের পরিপূরক কারণও। তিনি তাই চরম অসহায়ত্বের
বোধকে পুঁজি করে ‘তথাগত নীতিশাস্ত্রের’ প্রভাব এড়িয়ে পৌঁছে যান আরো গভীর সত্য আবিষ্কার ও তা
প্রকাশের দৃঢ় সম্মোহনে। এ কাব্যে নিহিত চল্লিশটি কবিতা বস্তুত তাঁর বহুকৌণিক অনুভবেরই বিন্যাস।
তাতে প্রতিসাম্যে অন্তর্গত হয় ‘কবিঅস্মিতা’র উৎকণ্ঠা, মনস্তাপ, দুশ্চিন্তা, পরিণামভয়; তখন সে ভূমিকা
নেয় নির্বিকার দ্রষ্টার (Voyance)। ফলে, কবি হিসেবে অনুসৃত স্রষ্টার একপাক্ষিক মঙ্গলচিন্তার ধারণা
বদলে যায়; সেখানে নির্বিকার দ্রষ্টার তাৎপর্যও প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
কবির ব্যক্তিবিশ্বে যাপিত জীবনের ক্ষয় ও দহনের অনিবার্য প্রভাব পড়ে কবিতায়। কবি বিপ্লব রায়ের
কবিতাসমূহও তার হিরণ¥য় সাক্ষ্য বহন করে। বাংলা কবিতার পারম্পর্য কাব্যবোধ ও আঙ্গিককে
ঐতিহ্যের মতো স্বীকার করে নিজস্ব ‘কবিকণ্ঠস্বর’ প্রাপ্তির প্রয়াসেই তাঁর কবিতার উন্মোচন। এ কাব্যে
তাঁর কবিতা হার্দ্যবৃত্তির অনুপ্রেরিত পথে অগ্রসর হলেও, ভাবের আড়ম্বর ও অহেতুক বাহুল্যদোষ
এড়িয়েছে। প্রভেন্সের প্রেমিক ‘ত্রুবাদুরদের’ মতোই স্বমহিম তার প্রতিটি উচ্চারণ। প্রসঙ্গত স্মরণ করা
যায়, কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) রচিত ‘অস্তচাঁদ’ কবিতা, যেখানে তিনি বলেন : ‘আমি ছিনু
‘ত্রুবাদুর’ কোন্ দূর প্রভেন্স-প্রান্তরে!’। অনুরূপ ভাবকে ধারণ করে প্রায় তিন দশক পরে কবি আবুল
হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫) তাঁর ‘গোলাপের নিচে নিহত, হে কবি কিশোর’ কবিতায় বলেন : ‘আমারও
ভ্রমণপিপাসা আমাকে নারীর নাভিতে ঘুরিয়ে মেরেছে / আমিও প্রেমিক ত্রুবাদুর গান স্মৃতি সমুদ্রে একা
সাম্পান হয়েছি/ আবার’। অগ্রজ কবিদের এ স্বঘোষিত বিশ্বপরিব্রাজনা সম্পর্কে ভাবা যেতে পারে।
প্রভেন্সের অভিজাত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এই ত্রুবাদুররা, জার্মানিতে যাদের পরিচয় ‘প্রেম-বয়াতি’ হিসেবে
স্বীকৃত। দ্বাদশ শতাব্দীতে চার্চের আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে একান্ত ব্যক্তিগত ও প্রাতিস্বিক অভিজ্ঞতা
হিসেবেই তারা (ত্রুবাদুররা) নারী-পুরুষের ‘প্রেমপ্রসঙ্গ’টি সামনে আনেন। জীবনের এ চমৎকার
অভিজ্ঞতাকে যারা বহুকাল পাপ বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলো, তাদের বিরুদ্ধে অনমনীয় প্রতিবাদ
করেই ত্রুবাদুররা এরূপ ব্যক্তিশাসনের প্রয়াসকে সরাসরি ‘না’ বলেছে। তাদের মতাদর্শে চিহ্নিত হয় :
‘ভালোবাসাই তো জীবনের সবÑ জীবনের সর্বোচ্চ শিখর।’ কবি বিপ্লব রায় এ সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়িয়েই
জীবনকে দেখার পক্ষপাত ব্যক্ত করেন তাঁর কবিতায়। মূলত তাঁর কবিতার করণকৌশলে
আত্মজৈবনিক প্রেমের স্বর স্বঘোষিত। প্রেমের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক সম্পর্কের সংস্পর্শে তাঁর
প্রতিদিনের শব্দশাসিত বিশ্ব ঘনায়িত হয়েছে কবিতায়। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, এমনকি
বিশ্বনীতির বহুমাত্রিক গল্প যেন ‘ছুঁয়েও, না ছুঁয়ে থাকার’ শর্তে কবিতার অন্তর্গত নৈঃশব্দ্যে বাঁধা পড়েছে,
যা কবির জন্য ইতিবাচক। ব্যক্তি অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতায় স্বকীয় অঙ্গীকার, ব্যক্তির নিজের অভিজ্ঞতায়
আস্থা স্থাপন এবং সে অভিজ্ঞতা যাপন করাÑ ত্রুবাদুরদের মূল কথা, যা অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে আধুনিক
বহুকবির কবিতায়। শামুকখোলে শিস কাব্যের কবিতায়ও এর সফল ও সাবলীল আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
তিন.
শামুকখোলে শিস কাব্যের কবিতাসমূহে বহুকৌণিক বিষয়ের সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়। মূলত তাঁর
কবিতাসমূহে আত্মজৈবনিক স্বর প্রাধান্য পেয়েছে। আত্মপ্রীতি, দুঃখবোধ, বেদনাবিলাসে অন্তস্থলে মগ্ন
হলেও, তাঁর সংবেদনশীল শিল্পিসত্তা তাঁকে অন্তর্লোকের দুর্ভেদ গ্রাচীর ভেঙে বারবার টেনে এনেছে
বহির্লোকের প্রাঙ্গনে। কবিমাত্রই কবিতায় ‘দায়ের’ প্রশ্নটি সামনে আসে। এক্ষেত্রে কবিতার
বিশ্ববীক্ষণজাত ইতিহাসে বরাবরই সুনির্দিষ্ট দ্বান্দ্বিক তর্ক বিদ্যমান, অর্থাৎ কবির দায়ের গন্তব্য মূলত
কার কাছেÑ শিল্পের ((Art for art’s sake) কাছে, নাকি জীবনের (Art for life’s sake) কাছে? এই
ঐতিহাসিক প্রতিসাম্যে দাঁড়িয়েই তাঁর ‘দায়’ শীর্ষক প্রথম কবিতায় তিনি এই সনাতন দায়কেই প্রশ্নবিদ্ধ
করেন। সেখানে শব্দবিম্বের আড়ালে দেখা যায় : ‘ভূমিতল উত্তপ্ত’ তবুও ‘স্থির কোলাজ’ ধরে রাখেন
একান্ত বাধ্য হয়েই। তাই ‘ফটোগ্রাফে হাসি হাসি মুখ’ অর্থাৎ এই দৃশ্যই সবটুকু সত্য নয়, বরং এই
মুখোশ পরা মানুষের আরোপিত জীবনসংকটের প্রতি নিক্ষেপ হয় তাঁর কবিদৃষ্টি। তাই ‘শাস্ত্রের শামুক’
রূপকে ধ্বংস করে কবিতা আরো গভীর সত্যের অভিমুখী হয়। তখন এ কবিতাযাপনের সত্যে
কেন্দ্রমুখী ভাবনায় জেগে থাকে ‘মূলত উঞ্ছবৃত্তি’ অথবা ‘নিজেরই নিরঙ্কুশ নিলাম’ শব্দ সমবায়। এসব
শব্দগুচ্ছের মধ্য দিয়ে বাস্তবকে ইঙ্গিতবাহী করতে এভাবেই তিনি উপযুক্ত বিশেষণ প্রয়োগ করেন।
এখানে ব্যক্তিজীবনের সার্বিক ‘দায়ে’র অবস্থিতির প্রতি দ্রোহ প্রদর্শন করে এতোসব সাম্যহীনতায় উত্তপ্ত
থেকেও তাঁর কবিতা নতুনমাত্রা লাভ করে।
আত্মজৈবনিক বলেই এ কাব্যের বেশকিছু কবিতায় কবিতাযাপন, কবিঅস্মিতার যন্ত্রণা ও তাৎপর্য,
নিজের জীবনের প্রতি দার্শনিক বোঝাপড়ার প্রসঙ্গ বিষয় হিসেবে উপজীব্য হয়েছে। ‘কবিতা কারখানা’,
‘মোড়ক উন্মোচনের শেষে’, ‘সংবাদপত্রের মতো’, ‘সামান্য তো একটা কবিতা’, ‘টেস্টটিউব কবিতা’
শীর্ষক কবিতায় এসব দার্শনিক মাত্রার সাক্ষ্য মেলে। সংহত শব্দে তিনি এ বিষয়গুলোকে দৃশ্যযোগ্য
করে তোলেন এসব কবিতায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় :
ক. সংবাদপত্রের মতো ছুড়ে দিয়েছিলে আমাকে
ও ঘণ্টিবাজানো ঈশ্বর।
প্রত্যেক পাতা থেকে কলামে কলামে
কেবলই দুঃসংবাদ। কেবলই আত্মহনন
রাশিচক্রের বিভ্রম,
দুইঞ্চির নিখোঁজ সংবাদ।
ও ঘণ্টিবাজানো ঈশ্বর, ও খবরের ফেরিওয়ালা
সংবাদপত্রের মতো ছুড়ে দিয়েছিলে কেনো
ভুল ব্যালকনিতে।
(‘সংবাদপত্রের মতো’, শামুকখোলে শিস)
খ. সেদ্ধ ভাতের গন্ধ পাই কবিতার খাতা থেকে
পাতা ওল্টালেই সাদা সাদা মমতা
মায়ের।
এতো ভুল, অবিন্যস্ত, কাটাকুটি জীবনের পরও
কবিতা কল্পলতা, এখনো আশা রাখো স্বতন্ত্র বাসরের!
অনূঢ়া বোন, ভগ্নি, কালো;
ভোঁতা পেন্সিলের ডগায় সেও কি আশাবাদী!
বরং এই ফাঁকে দেখে নেওয়া ভালো
পুরানো হলদে চোখ, কুঁজো;
ঝুঁকে আছে টেবিলল্যাম্পÑবাবা
আর কতো আলো দিয়ে যাবে?
(‘কবিতা কারখানা’, শামুকখোলে শিস)
এখানে উদ্ধৃতি ‘ক’ ও ‘খ’ এ কবির জীবন অতিবাহনের সত্য বিশেষ রূপ অর্জন করে। ‘ক’ তে,
সংবাদপত্রের প্রতীকে নিজের জীবনকে চিহ্নিত করেন তিনি। তাতে কবিতায় কবির ‘ঈশ্বরভাবনা’ তথা
আস্তিক্যচেতনা মুহূর্তেই নেতিদর্শনের নন্দনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখানে নিছক ‘ঘণ্টিবাজানো খবরের
ফেরিওয়ালার’ ব্যঞ্জনায় ‘ঈশ্বরের’ অধিষ্ঠিত সনাতন উচ্চতায় যেমন ধ্বস নামে, সেখানে আরো নিম্নমুখী
হয় স্বয়ং ‘কবির মানবজন্মের’ তাৎপর্য। খুব সচেতনতায় এই বিষয়টি আঙ্গিকগত উৎকর্ষে নতুনমাত্রা
লাভ করে। কবিতায় কবিজীবনের প্রতিসাম্য চিত্রিত হয় ‘সংবাদপত্রের’ ভূমিকায়। খুব সন্তর্পণে কবি
এখানে পাঠকের সম্পূর্ণ মনোযোগ সজোরে আকর্ষিত করেন সংবাদপত্রের চিত্রকল্পে। পাঠক তখন কবি
বা ব্যক্তি দেখতে ভুলে যায়, তাদের মানসপটে ভেসে ওঠে শুধুই একটা ‘সংবাদপত্র’, যেখানে প্রতিদিন
স্বাভাবিক হয়ে ওঠে ‘প্রত্যেক পাতা থেকে কলামে কলামে কেবলই দুঃসংবাদ’, ‘কেবলই আত্মহনন’,
‘রাশিচক্রের বিভ্রম’ আর ‘দুইঞ্চির নিখোঁজ সংবাদ’। অনুরূপ ‘সংবাদপত্রের’ সত্যের মতো স্বাভাবিক এই
ব্যক্তিজীবন তখন শুধু কবির নয়, অস্থিতিশীল জাতিরাষ্ট্রের সব মানুষেরও প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে
কবিতার করণকুশলতায় শুধু কবির ব্যক্তিগত জীবনভাষ্য একক হতে সার্বিকতায় উন্নীত হয় নি; তাতে
মানুষের ব্যক্তিজীবনের তাৎপর্য ও প্রাণতা প্রতিস্থাপিত হয় অন্যকিছুতে। বলা যায়, ব্যক্তি (Subject)
প্রতিস্থাপিত হয়ে যাচ্ছে বস্তুতে (Object)। এই চিত্রকল্প নির্মাণের সামর্থ তাঁর আঙ্গিকভাবনার
বিশিষ্টতার চিহ্নায়ক। আবার, ‘খ’ তে অর্থাৎ ‘কবিতা কারখানা’ কবিতায় পারিবারিক সমীকরণে দাঁড়
করেন গোটা জীবনকে। যেখানে পরিবারের প্রতিটি ভিন্ন পদবাচ্য তথা ‘মা’, ‘বাবা’, ‘প্রেয়সী’ ও ‘অনূঢ়া
বোনে’র অবস্থিতিজাত সমূহ সত্য কবির নির্মিত উপমা, রূপক ও চিত্রকল্পে প্রতীকী হয়ে ওঠে। কবিতায়
শব্দবাহুল্য এড়িয়ে এই প্রতিটি মানুষ কখনো যেন বস্তুতে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়, কখনো বা বিশেষ
মতাদর্শে (Idea) স্থিতি লাভ করে। এখানেও কবির পরিবার পরিচিতের খোলস ছেড়ে সমষ্টির
প্রতিনিধিত্ব করে। তখন ‘মা’ কোনো ব্যক্তি নন, ‘সাদা সাদা মমতা’; জীবনে শত দুর্দৈবের মাঝেও
‘বাবা’ এক অনিঃশেষ আশা ও আলোবাহী ‘টেবিলল্যাম্পে’র মতো ঝুঁকে থাকে, ‘অনূঢ়া বোন’ কালো
এবং ‘ভোঁতা পেন্সিলের’ প্রতীকে জীবনের আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে নির্দিষ্ট হয়ে ওঠে। এই দুই কবিতায়
কবির সৃজননৈপুণ্য নন্দনবিশ্বে অপরিচিতিকরণের (Defamiliarization) সাফল্যে প্রবহমানতা অর্জন
করেছে। এতে তাঁর কবিতার জগৎ আরো উন্মুক্ত ও প্রকরণশীলিত দর্শনে পরিণতি লাভ করে।
একইভাবে অন্যান্য কবিতায় বিশেষত ‘মোড়ক উন্মোচনের শেষে’, ‘সামান্য তো একটা কবিতা’,
‘টেস্টটিউব কবিতা’ ও ‘লোডশেডিংয়ের রাতে’ কবিতাসমূহে কবিতাসৃজনের অসাম্য যন্ত্রণা, উপলব্ধি,
আত্মপ্রকাশের দুর্নিবার আর্তি প্রকটিত হয়। এসব কবিতায় কবি অনিবার্য শব্দ সহযোগে ও অভিনব
ধ্বনিসুষমায় ‘মেধাহীন পালিয়ে বাঁচা’, ‘যতোবার চুম্বন সাজাই/ অগ্রজ কবির ঠোঁট’, ‘মজবুত বাঁধুনি
মানেই কি চিরকাল সুখী থাকার ভান’, ‘অক্ষরের শরীরে কাটাকুটিÑছন্দের সেলাই’ এসব বাণীপ্রধান
সত্যকে উপস্থাপন করেন। এই কবিতাসমূহে কবির সৃজন ও মনন পৃথিবীর সকল ‘কবি ও কবিতা
প্রজননে’র সত্যের একাত্মতায় স্বাদেশিক মানচিত্র ছাপিয়ে বৈশ্বিক সংবেদনায় শিল্পিত হয়ে ওঠে।
কবিতা যখন কবির সৃজনযজ্ঞের আয়ুধ হয়, সে যেমন একা, তেমনি কবির পাশে শেষ পর্যন্ত যে দাঁড়ায়,
সে কবিতাÑ হয়তো ‘পারমিতা’। ‘পারমিতা’ এ কাব্যে দুইবার উচ্চারিত নারীপ্রতিম শব্দ। তবে তা
রক্তমাংসে গড়া কোনো নারীপ্রতিমা, নাকি কোনো কবিকল্পনার ধারণামাত্রÑ তা আমাদের জানা নেই।
কিন্তু ‘পারমিতা’ নামটি নিলেই কেনো জানি ‘পারদ’ শব্দটি মনে ভেসে আসে। কেমন জ্বরবোধ হয়Ñতাপ
লাগে, মনস্তাপও লাগে। বিশ্বায়নের এ যুগে, পুঁজিবাদের অন্তঃস্রোতকে স্বীকার করে কবির যে প্রতিবেশ,
তা সহসা আমাদের অতিপরিচিত জগতকেই সামনে আনে। কিন্তু আমরা তো তা কবির মতো করে
বলতে পারি না। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা, আর কবির সেখানেই অমিত সম্ভাবনা। কবিতা পাঠে
অনুরূপ মনে হয়, অভ্যাসের অন্ধকারে ঘূণলাগা এই ‘ক্লান্তিকর প্রতিদিন’ আর ‘বাসনার অন্তর্দাহ’ মিলে
জাগর শব্দের সংকেতে প্রেমনিবেদনের এক অভিনব কৌশল কবি শিখে নিলেন। সেক্ষেত্রে কবির
রহস্যটুকু প্রেমের, আর সৃজন Ñ‘সময়েরই অনিবার্য সন্তান’। অভিনন্দনযোগ্য কবির সে প্রতিভা, যা
কবিতায় বহু অভিনব চিন্তার সমাবেশ নিশ্চিত করেছে। এ মুহূর্তে স্মরণ করা যেতে পারে কবির
‘বিসর্জন’ কবিতাটি। যার শুরুতে বলেন : ‘বিসর্জনের পর তাকে আর দেবী বলা যায় না’, এবং
কবিতাটি শেষ হয় এভাবে : ‘ভাসন্ত শবের মতো সে এখন বাঙলার নারী’Ñতখন উপমা আর চিত্রকল্পে
অনন্য হয়ে ওঠে তাঁর বাণীভঙ্গি। কবিতাটি ধারণ করে এক বহুমাত্রিক সংবেদন। নিবিড়পাঠে দেখা
যায়, প্রতিটি কবিতাই যেন বহু দুঃসংবাদকে ধারণ করে সংযত ও মিতবাক হয়ে ‘নীরব বিদ্রোহে’
সামনে দাঁড়ায়, তবে শেষে পিলসুঁজের মতো জ্বলে কবির আশাবাদ। বৈনাশিক বাস্তবের বিপরীতে,
কবির এ স্বাপ্নিক উচ্চারণ কবিতাকে শাণিত ও মসৃণ করে তুলেছে, যেখানে ‘হরিৎ মৃত্যু’ আর
‘নীলবাসনা’র হাত ধরে ‘কফিনের তপস্যা’ও মুগ্ধতা আনে। একে একে স্মরণ করা যেতে পারে ‘প্রেম’,
‘দেয়াল’, ‘লক্ষ্মীপূজা’, ‘ছাই’, ‘মিথ্যেবাদী রাখাল’, ‘নিছক প্রেমের কবিতা’, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’সহ বেশ কিছু
কবিতা। যেখানে কবির নিরীক্ষাপ্রবণ মনঃস্বিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিন্তার সৃজননৈপুণ্য। কবি তাঁর
অনুভবের সত্যকে যেভাবে প্রকাশ করেন, তাতেই মিশে থাকে কবিঅস্তিত্বের স্মারক। এ প্রসঙ্গে কবি
শঙ্খ ঘোষ (জ. ১৯৩২) তাঁর ‘শব্দ ও সত্য’ প্রবন্ধে বলেন :
শব্দ আড়ম্বরের থেকে নিজেকে সেইভাবে স্খলিত করে নেবার মধ্যেই আছে এক বিদ্রোহ।...শব্দবাহুল্যের
বাইরে দাঁড়িয়ে, বিজ্ঞাপনের বাইরে দাঁড়িয়ে, ভুল আস্ফালনের বাইরে দাঁড়িয়ে সত্যিই যদি নিজেকে, নিজের
ভিতর এবং বাহিরকে, আগ্নেয় জীবনযাপনের বিভীষিকার সামনে খুলে দিতে পারেন কবি, সেই হবে আজ
তাঁর অস্তিত্বের পরম যোগ্যতা, তাঁর কবিতা।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর কবিতায় আত্মজৈবনিক স্বর আর প্রেমভাবনার মুকুরে বিম্বিত হয় কবির
স্বদেশ ও স্বকালের সত্য। ব্যক্তিজীবন ও প্রেমের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপে অনায়াসে কবিতার দেহে প্রতিষ্ঠিত
হয় রাষ্ট্রীয় অসাম্য, জনমানসের দুর্ভোগ, বিশ্বায়নের নামে জেঁকে বসা ‘নব্য উপনিবেশবাদ’ ও
প্রযুক্তিনির্ভর নাগরিক জীবনের ক্লেদ, বিকারতাড়িত অবক্ষয়। এ প্রসঙ্গে শামুকখোলে শিস কাব্যের
একটি উল্লেখযোগ্য কবিতার নাম ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। কবিতার নামকরণে এখানে যেমন পুরাণকে স্মরণ
করা করা হয়েছে, তেমনি এখানে নামবাচক প্রতিটি চরিত্রই সমন্বিত হয়েছে কবিতায়। এখানে ‘রাধা’,
‘কৃষ্ণ’, ‘বড়াই’ ও ‘আইহনে’র নামগুলো অনুসৃত হলেও প্রতিটি চরিত্রের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ বদলে
গিয়েছে। পুরাণের বির্নিমাণে কবিতায় কবি উপস্থাপন করেন বর্তমান প্রসঙ্গ। উদাহরণস্বরূপ কবিতায়
বিষয়টি এমন :
রাধিকা : ওয়াসার জলে ব্যাঙের উৎপাত শেষে
তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যুতে লম্বা এক মানববন্ধনে সামিল।
কৃষ্ণ : চারুকলার বাঁশিবিক্রেতা,
সবিনয় অনুরোধে বাজিয়ে চলেছে জনপ্রিয় হিন্দি গানের সুর।
বড়াই : এপার ওপার কাঁটাতার ছিঁড়ে
ঈদের বাজারে নিয়ে এসেছে ভারতীয় শাড়ির চালান।
(‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, শামুকখোলে শিস)
এখানে প্রতিটি নামচরিত্র ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যের দ্যোতনা নিয়ে কবিতায় হাজির হয় এবং প্রত্যেকে সম্পূর্ণ
ভিন্ন অথচ দীর্ঘ গল্পের ইশারা হয়েও সমসূত্রে স্বকালকে ধারণ করে আছে। এখানে উদ্ধৃত প্রতিটি চরিত্রে
নিজস্ব গল্পের ডিটেল সামান্যই উপস্থাপিত হলেও, পাঠকের চেতনায় তার প্রভাব ব্যাপক। এভাবে
প্রতিসাম্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে কবি বিপ্লব রায় জীবনদর্শনে জারিত সত্যের ঐক্যে পৌঁছে যান। তাই, এ
কবিতায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সনাতন প্রেমপ্রসঙ্গটি বিনির্মিত হয়ে কবির স্বকালবীক্ষণে রূপ নেয়, পাশাপাশি
গল্পের ভিন্নতায়, বহু চরিত্র ও বহু কাহিনির কাব্যিক সংকোচন প্রক্রিয়ায় বহুত্ব (Plurarity) নির্মাণের
সক্ষমতা কাব্যদেহে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। অনুরূপ প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় এ কাব্যের ‘ফুলের বাগান’,
‘নিছক প্রেমের কবিতা’, ‘দেয়াল’, ‘মাতালের কবিতা’ শীর্ষক বেশকিছু কবিতায়। তাই কবিতায়
ব্যক্তিগত প্রেমপ্রসঙ্গে প্রবহমান সময়ের অনিবার্য উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এখানে কবির
উপলব্ধিজাত এষণার তাৎপর্য সার্বিক গতিতে প্রাগ্রসর হয়ে ওঠে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০৯-১৯৬০) যে
উপলব্ধিতে উক্ত করেন : ‘সময়রূপ চতুর্থ আয়তনের মার্গে শাশ^ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে যতক্ষণ না মিশতে
পারছে, ততক্ষণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিতান্ত মূল্যহীন।’
শামুকখোলে শিস কাব্যের কবিতায় কবির প্রেমভাবনা উচ্চকিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই প্রেম
অনুধাবনের সূত্রে তাঁর কবিতায় এসেছে নারীভাবনার বৈচিত্র্য। এ কাব্যে প্রেমের রূপ নাগরিক সভ্যতার
অনুগামী মানুষের স্বপ্নের মতোই ‘বহুগামী, বিবশ / ক্লান্ত গণিকার কাঁধে’। প্রেমের এই হতাশ,
পশ্চাৎপদ, পলানয়মুখর, দ্বিধাজর্জর রূপকেই তিনি সর্ববিদ করে তোলেন সিংহভাগ কবিতায়। এর
কারণও নিহিত তাঁর সময়জাত সংরূপে। কবিতায় শুধু ‘পারমিতা’ নয়, ‘নয়নতারা’, ‘মনীষা’ শীর্ষক
নারীপ্রতীক সংযুক্ত হয়েছে। এরই বিন্যাসে কবিতার সৃজনকর্মেবহুকৌণিক ও বহু স্তরবিশিষ্ট প্রেমের
রূপকল্প প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পাশাপাশি ‘আশ্রয়’ শীর্ষক কবিতায় তিনি অতীতচারিতার মধ্য দিয়ে জিজ্ঞাস্য
করে তোলেন পূর্বজ কাব্যের ‘বনলতা সেন’, ‘চর্যার ডোম্বী, শবরী’, ‘রাধা’, ‘ফুল্লরা’, ‘মলুয়া’,
‘কঙ্কাবতী’, ‘ক্রেসিডা’, ‘বেহুলা’র দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী প্রেমভাবনাকে। কারণ এসব প্রতিষ্ঠিত প্রেমপ্রবাদ
কবির বর্তমান বিশ্ব ও বাস্তবতার সঙ্গে সহাবস্থান না করে, মূলত প্রতিসাম্যে অনুধাবিত হয়েছে। কবির
সংলগ্ন বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠিত প্রেমভাবনার স্বরূপ অবলুপ্ত হওয়ার এক নিঃসীম অসহায়ত্ব বিশিষ্ট হয়েছে।
কবির এই প্রেমসংবেদ কবিতায় স্বীয় নারীপ্রতীক সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলে। কখনো ক্রোধ, শ্লেষ, বিষাদের
ব্যঞ্জনায় নারীর প্রতি অভিব্যক্ত হয় তাঁর প্রেমবাসনা। এই প্রেমযাপনের বিবিধ বিন্যাসের বিষয়টি
নিম্নোক্ত কবিতাংশগুলোতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে :
ক. আমি জানি নয়নতারা
কাগজের এরোপ্লেনে আমেরিকা যাওয়া যায় না।
(‘আমেরিকা’, শামুকখোলে শিস )
খ. এই শহরে শীতবস্ত্রের মতো তুমি এসেছ মনীষা
তাই দারুণ উৎসুকতা তোমাকে ঘিরে।
(‘মনীষা’, শামুকখোলে শিস)
গ. পারমিতা, জতুগৃহ জেনেও কেনো
এই ঘর বড় ভালোবাসি?
(‘হারানো গোলাপ’, শামুকখোলে শিস)
এসব উদ্ধৃতাংশে কবির প্রেমানুভব বাস্তব ও স্বপ্নের প্রতিসাম্যে উপস্থাপিত হয়ে প্রবল সত্যানুসন্ধানী রূপে
আবর্তিত হয়। তখন রক্ত-মাংস তথা দেহসর্বস্ব নারীসংলগ্নতা এড়িয়ে কবির প্রেম ক্রমশ উর্ধ্বমুখী
অভিযাত্রায় রূপ লাভ করে। যেখানে সমাজ, সংস্কার, বাস্তবতার সকল প্রতিকুলতা জয় করে প্রকৃত
প্রেমের শক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকার আশাবাদ অভিব্যক্ত হয়। এই প্রেম তখন দয়িতার প্রতি কবির
সমর্পণের ইঙ্গিত বহন করে না; তা ব্যক্তিবিলোপ অথবা বিসর্জনের করুণ দর্শনের প্রতীতী হয়ে ওঠে।
এই প্রেমবীক্ষার দর্পণে পরিলক্ষ হয় : বিতৃষ্ণা (Spleen) থেকে আদর্শে (Ideal) উত্তরণের অনিবার
সংগ্রাম। এই প্রতিসাম্যে তাঁর প্রেমভাবনা সম্পূর্ণ হয়। এ কাব্যের নাতিদীর্ঘ কবিতায় তা প্রকাশ পায়
এভাবে :
উলের বলের মতো বুক খুলে তুই মেয়ে
দিয়েছিলি এক দলা রেশম, নাকি প্রেম?
জড়ানো সুতোর মায়ার এই সংসার,
জীবনভর বুনে যাবি-
ভুল মানুষের সোয়েটার। (‘সোয়েটার’, শামুকখোলে শিস)
এই ‘জীবনভর বুনে যাওয়া’র ভরকেন্দ্রে, অহর্নিশ ভুল পদক্ষেপে আরক্তিম তাঁর প্রেম ও নারীভাবনা।
তখন সেটি কোনো নির্দিষ্ট নারীকে নয়, সমহিত হয় এক অলখ আদর্শের জগতে; কবির নির্মিত
ব্যক্তিবিশ্বে স্বমেহনে বলয়িত হয়।
কবিতায় কবির জীবনাকাক্সক্ষার সুতীব্র রূপ যেমন বিম্বিত হয়েছে, তেমনি তাঁর মৃত্যুচেতনাও প্রাণতা
পায় বেশ কয়েকটি কবিতায়। ‘মাতালের কবিতা’, ‘ট্রাক’, ‘নির্বাণের টিকিট’ শীর্ষক কবিতায় বারবার
মৃত্যুর প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে এসেছে। তবে এক জটিল জীবন অনুধ্যানের সাপেক্ষে কবির মৃত্যুচেতনা
কবিতায় দার্শনিক অভিব্যক্তিতে অভিনব রূপ লাভ করেছে।
চার.
শামুকখোলে শিস কাব্যে কবির নিরীক্ষাপ্রবণ মনস্বিতার সাক্ষ্য মেলে। সময়ের পারম্পর্যেযেকোনো
কবির প্রাতিস্বিক স্বরগ্রাম তাঁর বিষয়ের বৈচিত্র্যে নয়, বরং অনেকটাই নির্ভর করে প্রকরণগত উৎকর্ষে
অথবা তারতম্যে। তাই ‘কবিতার যাবতীয় ইতিহাস মূলত টেকনিকের ইতিহাস’Ñ এমনটাই বলেন
ফরাসি জননন্দিত কবি লুই আঁরাগ (১৮৯৭-১৯৮২)। কবি বিপ্লব রায়ের প্রথম কাব্যেই এক পরিণত ও
নিরীক্ষাপ্রিয় কবিঅস্মিতার স্মারক অবমুক্ত হয় পাঠকের কাছে। তাঁর কবিতায় স্বদেশ ও স্বকালবীক্ষণের
অনিবার্য আঙ্গিক হিসেবে দেখা যায় প্রতিসাম্য (Juxtaposition) নির্মাণের তাৎপর্য। দৃষ্টান্ত হিসেবে
স্মরণ করা যেতে পারে বেশ কিছু কবিতাংশ :
ক. ছোবলকে চুমু ভেবে নিতে আরো কিছু নেশা আছে বাকি
চৌরাস্তায় এলেই কেনো জড়িয়ে যায় গন্তব্য?
(‘মাতালের কবিতা’, শামুকখোলে শিস)
খ. প্রেম ছিলো, ঘাম ছিলো, ফুলস্কেপ বাসর
যতবার চুম্বন সাজাইÑঅগ্রজ কবির ঠোঁট
( ‘টেস্টটিউব কবিতা’, শামুকখোলে শিস)
গ. নিদ্রার এপাশ ওপাশ, মোহ ও সন্ন্যাস
ছেনে ছেনে আমাদের ঘুম চলে গেছে।
(‘এই গ্রীষ্মে’, শামুকখোলে শিস)
এখানে প্রতিটি উদ্ধৃতিতে প্রতিসাম্য সৃজনের নিপুণতা লক্ষ করা যায়। তাই ‘ছোবল’ আর ‘চুমু’; ‘যতবার
চুম্বন সাজাই- অগ্রজ কবির ঠোঁট’ এবং ‘মোহ’ ও‘সন্ন্যাস এসব বিপরীতমুখী শব্দের পারস্পরিক অবস্থানে
কবিতার করণকৌশল অভিনব হয়ে উঠেছে। এই প্রতিসাম্য সৃজনের এষণা বিশিষ্ট হয়ে ওঠে ‘বায়স্কোপ’
ও ‘ভস্মশেষে’ শীর্ষক দুটি কবিতায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ :
গ. শেষ দৃশ্যে মিলন হবে জেনে কেউ
ছেড়ে দিচ্ছে কাঠের চেয়ার,
উঠে যাচ্ছে তৃপ্ত মানুষ যারা ছিলো
উদ্বেগে, অশ্রুতে
এতোক্ষণ।
চিতাকাঠ জ্বলে উঠতেই শ্মশানভূমি ছেড়ে
চলে যাচ্ছে কেও
যারা ছিলো অভ্যাসের বশে-
একান্ত স্বজন।
(‘বায়স্কোপ’, শামুকখোলে শিস)
ঘ. ডোমের মতো আমারো শরীরে আগুনের খিদে
চন্দন কাঠে সাজানো তোমার চিতার শরীর
চুমুতে চুমুতে মুখাগ্নি হবে, এসো প্রিয়তমা।
পাঁজরের কাছে পাঁজর ভাঙার করুণ শব্দ
আলিঙ্গনে আগুন দু’জন দারুণ দগ্ধ
ভস্মশেষে ছাই নিয়ে যেও দুহাত ভরে।
(‘ভস্মশেষে’, শামুকখোলে শিস)
এখানে দুটি কবিতায় ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা হলেও চিত্রকল্প সৃজিত হয়েছে প্রতিসাম্যেরই আলোকে।
কখনো স্তবক থেকে স্তবকে, কখনো পাশাপাশি শব্দসমবায়ে আপাত অসংলগ্নের মধ্যেই কবির জীবনমৃত্যু ও প্রেমচেতনা এক দার্শনিক সত্যে উন্নীত হয়; যা কবিপ্রতিভার সম্ভাবনাকে গতিশীল করে তোলে।
কবির নন্দনভাবনায় আধুনিক কবিতায় বহু ব্যবহৃত ধ্রুবপদকল্প চরণ (Refrain) অনুসৃত হয়েছে।
মূলত ব্যক্তিগত অনুভবের তীব্রতাকে পাঠকের মনোজগতে বিশিষ্ট করার তাগিদেই কবিতায় একই
বাক্য বা শব্দগুচ্ছের পুনরাবৃত্তি হয়। এ কাব্যের বেশকিছু কবিতায় এই আঙ্গিকের প্রয়োগ পরিলক্ষিত
হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে কবিতায় ‘এই পরাজিত করতলে লেগে আছে শব্দের লালসা’ (টেস্টটিউব কবিতা)
অথবা ‘ভালোবাসার ম্যাজিক ফুরিয়ে গেলে’ (ম্যাজিক ফুরিয়ে গেলে) এই শব্দগুচ্ছের একাধিক প্রয়োগ
কবির সচেতন করণকুশলতারই ইঙ্গিত বহন করে। তবে কিছু কবিতায় এরূপ প্রয়োগের পাশাপাশি
শব্দগুচ্ছ হতে দুই, একটি শব্দ বদলে দিয়ে উপস্থাপনের রীতিও লক্ষ করা যায়। আবার ‘নকল জামা’
কবিতায় অপরতাবোধের (Otherness) আঙ্গিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এরূপ শব্দসমবায় : ‘এই নকল
জামা আমি কোত্থেকে কিনেছিলাম / মনে নেইÑশরীর গলালেই কেবল অন্য শরীরের ঘ্রাণ’।
এ কাব্যে কবির উপমা, রূপক, প্রতীক সৃষ্টির তাৎপর্য যেমন বিশিষ্টতা পেয়েছে, তেমনি কবিতায়
শব্দালঙ্কার হিসেবে অভিনব অনুপ্রাস সৃষ্টি ও শব্দমধ্যে বিশেষণ প্রয়োগের সাফল্যও দৃশ্যমান হয়। তাঁর
কবিতার পাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এ কাব্যের সিংহভাগ কবিতায় শব্দমধ্যস্থিত অজস্র অনুপ্রাস
অসামান্য ধ্বনিসুষমা সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে বিশেষণ প্রয়োগের তাৎপর্যে যাপিত জীবনের
‘প্রতিসাম্যের বাস্তব’ দৃশ্যযোগ্য রূপ পরিগ্রহ করে। এছাড়াও কবিতায় মিথের (Myth) ব্যবহার নিশ্চিত
হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রভাবনার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতকে সমুন্নত রেখে। এ সত্যও নির্ণীত যে, যন্ত্রসভ্যতাই
ব্যক্তিকে যূথবদ্ধ সমাজ হতে সরিয়ে এনে ক্লেদাক্ত পরিস্থিতির মুখে নিক্ষেপ করে। ফলে এ সভ্যতায়
বস্তুর উন্নতি নিশ্চিত হলেও, ব্যক্তির মানসিক গঠন ও তার সামূহিক নির্জ্ঞান এ প্রক্রিয়ায় তাল মেলাতে
ব্যর্থ হয়। সুতরাং ব্যক্তি ক্রমাগত আত্মত্রাণের পথ খুঁজতে থাকে। বিশ্বসংসারের অসংলগ্ন ও
অনাকাঙ্খিত স্মৃতিপুঞ্জের সমতা বিধান, টেনশনের দূরীকরণ ও অজেয় পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াতে
তাকে নিতে হয় মিথের আশ্রয়। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, ‘চুম্বন’, ‘মিথ্যেবাদী রাখাল’, ‘লক্ষ্মীপূজা’, ‘বুমেরাং’
শীর্ষক কবিতাসমূহে অতীতস্মৃতিচারণ ও বর্তমান প্রসঙ্গের সূত্রে মিথ এসেছে। রঁলা বার্ত (১৯১৫-
১৯৮০) তাই মিথকে চিহ্নিত করেন এভাবে : ‘Myth is depoliticized speech.’ এবং মিথের সঙ্গে
মানববিকাশ এবং মিথ প্রয়োগের সম্পর্ক বিষয়ে অনুধ্যান করেন এভাবে : `Men do not have with
myth a realationship based on truth but on use; the depoliticize according to their
needs. Some mythical objects are left dormant for a time; they are than no more than
vague mythical schemata whose political.'
ব্যক্তির স্বরূপ-সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিটি বিষয় ইঙ্গিতবাহী হয়ে উঠেছে এবং সেখানে নান্দনিক অবস্থিতি
পেয়েছে প্রতিসাম্যে জীবনদর্শন।
কবি বিপ্লব রায়ের প্রথম কাব্য শামুকখোলে শিস মূলত কবির আত্মবীক্ষণের স্বরগ্রাম। তাই কবিতায়
সমাজ-রাষ্ট্র-গণমানুষের জীবনের প্রত্যক্ষ উপস্থাপনের দৃষ্টান্ত প্রায় অপ্রতুল। তবে এর মধ্য দিয়েই
কবিতায় তিনি এমন এক ব্যক্তিবিশ্বের মুকুর নির্মাণে আগ্রহী হন; যেখানে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিশাসিত এবং
অস্থিতিশীল রাষ্ট্রকাঠামোয় মানুষের সামূহিক সত্য প্রতিবিম্বিত হয়। এভাবেই কবির কবিতার পাঠ
উন্মোচনকে বিশিষ্ট করা যেতে পারে। শব্দবাহুল্যের দোষ এড়িয়ে কবিতায় অনিবার্য বাণীবিন্যাস নির্মাণে
ব্রতী এ কবির কাব্যযাত্রা পাঠকপ্রিয়তা ও অভিনন্দনের দাবি রাখে। ‘মোটামুটি স্বচ্ছল, তবু সফলতা
আত্মস্থ নয়’Ñ কবির এ বোধ নন্দনবিশ্বের প্রতি কবির ঐকান্তিক সংলগ্ন থাকা, নিজ প্রতিভার প্রতি বিশ্বস্ত
থাকার ইঙ্গিতকেই প্রতিষ্ঠিত করে। এভাবে তাঁর কবিতায় আপাত অসংলগ্ন দৃশ্য আর প্রতিসাম্যে
জীবনবয়ানের অভিনবত্বে বিজড়িত হয় সত্য, সুন্দর ও মানুষের প্রতি মাঙ্গলিক আকাক্সক্ষার যোগ।
0 Comments