কথা বলছিলাম সোহাগ হাসান সম্পর্কে। হ্যা, সে গল্প লেখে। তবে কোনো লেখা অন্যের পত্রিকায় পাঠায় না। সে এবং তার বন্ধুরা মিলে নিজেদের লেখা নিজেদের মধ্যে পাঠ করে, নিজেদের জ্ঞান অনুসারে শিল্পের নানা মাল-মশলা মিশিয়ে যদ্দূর পারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবনানন্দীয় স্টাইলে নিজেদের মতো করে রেখে দেয়। আমরা অনেকেই জানি লিটলম্যাগ আন্দোলন নামে বলতে একটা কিছু একসময় ছিলো এবং তা বাজারি পত্রিকার দাম্ভিক ঐশ্বর্যের সামনে কুঁজো হয়ে যেতে যেতে পৃথিবীর তাবৎ মিথের মতো ফসিলে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছিলো। এখন সেটাকেই জিন্দা রাখার তাগিদে শেষ জামানার উম্মতের মতো একদল তরুণ তৎপর। আছে সোহাগরাও। ইবাদতের নমুনা হিসেবে তারাও একটা লিটলম্যাগ বের করে। নাম ক্রায়োসার্জারি। মাসিক-ত্রিমাসিক নয়, বছরে একবার। প্যাসিফিক বলতে গেলে, বাংলা একাডেমির আয়োজিত একুশে বই মেলা উপলক্ষ্যে ফেব্রুয়ারিতে। প্রকাশ হওয়ার পর এটা কে দেখলো না দেখলো, এগুলোকে তারা থোরাই কেয়ার করে। এতো উদাসিন কেনো? কেউ প্রশ্ন করলে, এককথায় উত্তর, উদাসীন দেখলা কই? বছরে কে কি লিখলাম, ওগুলো একমলাটে বন্দি করলাম আরকি। এই লও সিগারেট, টানো।
সোহাগ মাস্টার্স শেষ করেছে পাঁচ বছর হয়ে গেলো, চাকরির বাজারে এখন পর্যন্ত কোনো সুবিধা করতে পারেনি। যতোদিন পকেটে এনার্জি ছিলো, বগলে প্যাপার কাটিং আর ফাইল-পত্র চেপে এ-অফিস থেকে ও-অফিস, এই-ভাই থেকে সেই-ভাইয়ের আস্তানায় তাঁতের চাকা হয়ে ঘুরেছে অবিরাম। এখন পকেটে ভগবান ঘুমায়। বাবা-মাও তার ব্যাপারে বেশ তিতি-বিরক্ত। দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে বাবা আফসার আহমেদ কিছু না বললেও মা আয়েশা খাতুনের মুখটা যেনো ব্যাটারি চালিত কোনো অটোযন্ত্র। সামনে পড়লেই চালু হয়ে যায়। ‘অমুকে-তমুকে তোর চায় দুর্বল ছাত্র অইয়া চাকরি পাইলো কিভা? তুই পাস নাই ক্যান? টেহা কি তোরে কম দিছি?’ চাকরি যে কেনো পাচ্ছে না, এটা এই মুর্খ মহিলাকে বোঝানো জটিল। তাই কোনো কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কেটে পড়ে। অপরদিকে ছোট ভাই-বোনদের ভাষায় সে হচ্ছে—ফোর-সাবজেক্ট। কাজে লাগলে লাগলো, না লাগলে নাই। এমন একটা ভাব দেখিয়ে তারাও তাকে পাশ কাটিয়ে চলে। এতে বরং তারই সুবিধা। অন্তত ওদের নিয়ে তাকে কিচ্ছু ভাবতে হচ্ছে না। ভাবতে গেলেই টের পায়, মাথার হার্ডডিক্সটা দিনকে দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। বেশি প্রেসার পড়লে হয়তো বিকলই হয়ে যাবে। যে কারণে বাইরে কোনো কাজ না থাকলেও বাসায় বেশিক্ষণ থাকে না। খাওয়াটা গোসলটা সারা হলেই বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় নেমেই লাটাইচ্যুত ঘুড়ি। কোন দিকে যায়, ঠিক-ঠিকানা নাই। কোনো কিছু ভালোও লাগে না, আবার মাথার ধারণ ক্ষমতার কথা ভেবে মনকে কোনো কিছুতে খারাপও লাগায় না। চোখ-কান যা-ই দেখুক-শুনুক সবকিছুতেই এক ধরনের ডেম-কেয়ার ভাব দেখিয়ে নিজেকে আড়াল করে চলে। দেশের সবকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে দলীয় অস্ত্রোপচার চলছে, না ইতিহাসের পাছায় লাথি মারা হচ্ছে। শিক্ষা-বিনোদন-সংস্কৃতি কেন্দ্রগুলোতে বাঙালিআনা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, না মাগি ভাড়া চলছে, কোনো ক্যাঁচর-মেচরেই সে মাথা ঘামায় না।
যাক ওসব, যেখান থেকে শুরু করেছিলাম। বলছিলাম, সোহাগ গল্প লেখে। তার গল্পের আঙ্গিক-ভাষাগত বয়ান এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভিন্নরকম। মনে হয় শূন্য দশকের কোনো শিল্পীর আঁকা বিমূর্ত ক্যানভাস। তাকিয়ে থাকলে কতকগুলো জটিল ধারণার জন্ম হয় বটে কিন্তু স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায় না। আর যেকটা বোঝা যায়, সেগুলোর বেশির ভাগই প্রধান চরিত্রকে দেখা যায় পত্রিকার সম্পাদক। সম্পদাকীয় কলামগুলোর গতিও অন্যরকম। আমাদের বুড়ো বুদ্ধিজীবীদের সত্তর হাজার মাইল পেছনে রেখে বাংলাদেশকে নিয়ে রকেটের মতো ছুটে যায় ত্রিশ শতাব্দির প্রযুক্তি-স্বর্গের দিকে। যেখানে মানুষকে কোনো কিছুর জন্যেই কারো দারস্থ হতে হয় না। যখন যা ইচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ঈপ্সিত বস্তুটি হাতের কাছে চলে আসে। এখানেই শেষ নয়, গল্পের শব্দগুলোরও রয়েছে এক ধরনের সম্মোহনী শক্তি। পড়লেই চালান দেয়া বাটির মতো টেনে ধরে, নিয়ে যায় অদূর ভবিষ্যতের এক বায়োস্কোপের কাছে। যেখানে অপেক্ষা করছে পাঁচটি গোল আয়না। যেকানো একটিতে চোখ বসালেই দৃষ্টির পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে বাংলাদেশের এমন সব দৃশ্য যা পৃথিবীর কোনো চামড়ার চোখ কখনো দেখেনি।
কখনো কখনো দেখা যায়, গল্পের প্রধান চরিত্র ইলেক্ট্রনিক চ্যানেল পরিচালনা করছে। যেখানে কোনো খবর থাকে না। নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপন, কিছুই থাকে না। থাকে শুধু ‘টক-শো’। ‘টক-শো’তে আমন্ত্রিত হয় দলীয়-নির্দলীয় সব বুদ্ধিজীবী। তারপর সঞ্চালক হিসেবে সে তাদেরকে এমন সব প্রশ্ন করে, যা তাদের কান কোনোদিন শুনেনি। তারা তখন মক্তবের অবোধ শিশুর মতো তার দিকে চেয়ে থাকে। সে তখন কোনো তত্ত্ব-কথায় ঢুকে না। ঢুকে না কালের বেলা ভূমিতে পড়ে থাকা ইতিহাসের ক্ষয়িষ্ণু ফসিলের ভেতরও। কেবল ভালোবাসার গল্প শোনায়। যে ভালোবাসার কথা আগেও অনুরণিত হয়েছে একাধিকবার কিন্তু সাড়া পড়েনি।
দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, আসমানি ওহীর মতো গল্প-কবিতাও কখনো কখনো কোথায় যেনো আটকে থাকে। তখন শত চেষ্টা করেও এক লাইন লিখতে পারে না। এই খড়ায় পড়ে অনেকেই হাল ছেড়ে দেয়। তারা আর লেখায় ফিরে আসতে পারে না। শহীদ কাদরী, মাহমুদুল হক খড়ায় পড়ে ফসলি মাঠের মতো শুকিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যারা ফিরে আসার নিরন্তর চেষ্টায় থাকেন, তারা একসময় সফল হন। খড়া কাটিয়ে ফিরে আসেন নিজস্ব জগতে। সোহাগও মাঝে-মধ্যে খড়ায় পড়ে। তখন গল্প লেখা স্থগিত রেখে ক্যামেরায় ডুব দেয়। নাতিদীর্ঘ ফিল্ম তৈরি করে। সাধারণত ফিল্মে নায়ক-খলনায়ক থাকে। বাংলা সিনেমাতে সাধারণত আমরা যা দেখে থাকি। শুরুতে খলনায়কের দৌরাত্ম্যতা প্রবল দেখালেও সবশেষে নায়কেরই জয়। কিন্তু তার ফিল্মে এসবের কিছুই থাকে না। থাকে কেবল অন্ধকার। অন্ধকার আর অন্ধকার। তার ইচ্ছে—দর্শক পাঁচ মিনিট পর্যন্ত কেবল নিñিদ্র অন্ধকারই দেখে যাবে। যারা ধৈর্য ধরবে তারা দেখবে খুব ধীরে ধীরে একটা আলোর সুতো এসে অন্ধকারকে প্যাচিয়ে ধরছে। খুব ভালো করে দৃষ্টি দিলে বুঝতে পারবে, এই শাদা সুতোটা চার ডিজিটের একটা সংখ্যা হয়ে দর্শকের দিকে তাকিয়ে। সংখ্যাটা কথায় লিখলে হয়—সতেরোশো সাতান্ন। পলকমাত্র চেয়ে থেকে সংখ্যাটা চলে যাবে। তারপর আবার দীর্ঘ অন্ধকার। গুহার নাভির মতো কুচকুচে কালো অন্ধকার। এভাবে থাকবে আরো মিনিট পাঁচেক। তারপর আরেকটা সংখ্যা ভেসে উঠবে। ওটা কথায় লিখলে হবে—আঠারোশো পঁচাশি। তারপর আবার অন্ধকার।
যারা কৌতূহলী নয়, অস্থির প্রকৃতির, তারা নিশ্চিত বিরক্তিতে ফিল্ম বদল করে নেবে। কিন্তু যারা কোথাও কোনো সাংকেতিক চিহ্ন দেখলে, সেটার নিগূঢ় তত্ত্ব উদঘাটনের জন্যে উঠে পড়ে লেগে যায়, তারা দুটো সংখ্যা নিয়ে কল্পনায় গবেষণা শুরু করে দেবে। গবেষণা করতে করতে যখন একটা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবার উপক্রম হবে, তখনই সবার চিন্তাকে আরেকটু সম্প্রসারিত করতে আরেকটি সংখ্যা ভেসে উঠবে। সেটি হচ্ছে—উনিশশো চল্লিশ। পর্দাটা আবার একদলা কালি এসে গ্রাস করে নেবে। তার ধারণা—তিন-তিনবার শুধু সংখ্যা ভেসে উঠায় কৌতূহলী দর্শক বলবে, বেশ মজা তো! বাঙালির চরিত্র বলে কথা। যাতে বিরস, তাতেই বশ। আম-লিচু-কাঁঠাল না হলেও চলে কিন্তু বিরস সুপারি না হলে এক মুহূর্ত বাঁচে না। সে বাঙালি ফিল্মের বাকি অংশ না দেখে চলে যাবে, ভাবতেই পারে না সে। তার কথা, ফিল্মের এই পর্যায়ে এসে একজন দর্শকও উঠে যাবে না। তারা ফিল্মের শেষ পরিণতি দেখার জন্যে ঠাঁই বসে থাকবে। এমনকি সামনে দীর্ঘ অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে কোন সংখ্যাটি প্রকাশ পেতে পারে, তা নিয়ে তারা রীতিমতো বাজি ধরতে থাকবে। তাস-পাশা-ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলায় যেভাবে হাজার হাজার টাকা বাজি ধরে থাকে, এখানেও সেভাবেই ধরবে। কেউ বলবে, পাঁচ হাজার, পরের সংখ্যাটি উনিশশো উনসত্তর, কেউ ধরবে দশ হাজার, সংখ্যা উনসত্তর নয়, হবে একাত্তর, কেউ বলবে বিশ হাজার, সত্তর-একাত্তর কিছুই না, সংখ্যা হবে পঁচাত্তর। এভাবে ধরতে ধরতে সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে শুধু পর্দার দিকে চেয়ে থাকবে, তখনই সবাইকে হতাশ করে দিয়ে ভেসে উঠবে—উনিশশো নব্বই। তারপর আবার অন্ধকার।
দর্শকরা ভাববে হচ্ছেটা কী! এটা কোন ধরনের কানেকশন! এ-নিয়ে যখন দর্শক একে-অপরের দিকে চেয়ে এর নিগূঢ় তত্ত্ব উদঘাটনের জন্যে বলাবলি করতে থাকবে, তখনই পর্দা ভরে ভেসে উঠবে কোটি কোটি নামের তালিকা।
0 Comments