কবি কবিতার জন্ম দেয় আর, কবিতা জন্ম দেয় বহুমাত্রিক চিন্তার ফসলি মাঠ। তবে সব কবির কবিতা বিস্তার ঘটাতে পারে না কিন্তু কবি বঙ্গ রাখালের কবিতা তেমনি যা বহুমাত্রিক চিন্তার প্রগাঢ়তম রূপ।
দ্বিতীয় দশকের এই কবির কবিতা পাঠ বলে দিতে পারে বহুমাত্রিক পথের রহস্য! গাণিতিক পদ্ধতির মতো একটি প্রশ্নের অনেকগুলো সম্ভাব্য উত্তর। প্রতিটি কবিতাতে অনুসন্ধানি দৃষ্টি ভঙ্গিতে সয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো বহু অর্থের আধুনিকতার সন্ধান খুঁজে পাওয়া যায়।
‘যৈবতী কন্যা ইশকুলে’ কাব্য গ্রন্থটি পাঠ করে তেমনটাই অনুভবের দোলাচলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে সাড়া জগালো।
‘বৈরি সময় আমার’ কবিতাটির গভীর জুড়ে বিস্তৃত আছে নারী ও শৈশব প্রেমের আদি নিদর্শন।
কবি লিখেছে
“রেবাতী মাহালি তোমার ঘুমন্ত পাখিগুলো নিঃস্ব স্নানে শীৎকার দেয় সন্ধ্যা ফাগুনে...
এখন আমি খেলার সাথী খুঁজি না মৃতের মতো ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে প্রস্থান করি”
মানুষের প্রতিকৃতির গভীর থেকে ধৈর্যের বাধ ভেঙে অধৈর্য্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে সৃষ্টি করে নির্মমতা ও শোষণ, সভ্যতা ও নম্রতার মুখোশধারী সমাজে আজও বারংবার ঘটে যাচ্ছে পূর্ব পুরুষ থেকে শুরু করে বর্তমানের শোষণের ছায়া। তাই হয়তো কবি বলেছেন-
“ফসলি মাঠ পার হলেই ভেঙ্গে যায় সভ্যতার রোমাল...
নম্রতার জালে আবদ্ধ শোষণের ক্ষুধার্ত উন্মাদনা”।
যাপিত জীবনে ভালোবাসার অদ্ভুত রহস্য অঙ্কিত হয় যুক্তিক অযৌক্তিক নেশার ভীড়ে-
কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা সহজে অনুধাবন সম্ভব হয়ে ওঠে না। কেউ কেউ মিথ্যা আকাঙ্ক্ষার দোকান সাজায় আবার কেউ সত্যিটা ফেরি করতে যেয়ে মিথ্যার জালে ফেঁসে যায়। সে হোক পুরুষ কিংবা নারী উভয়ের ক্ষেত্রে।
তবে কবি নামতা জীবন কবিতাটিতে নারীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে-
“কান্না কেন সত্যি বলো-
কান্নার কি অন্তর্বাসে কোন নারী থাকে, যে নারী মুক্তির নেশায় এ্যাবসার্ড জীবন আঁকে।”
শৈশব থেকে যৌবনে প্রদার্পন করা মাত্র স্বাধীন ভাবে চলা মুশকিল হয়ে পরে নারীদের। সুদর্শনা ঢেউ খেলানো শরীরের ভাঁজে ভাঁজে দৃষ্টি ছাপ রেখে কামুকতার স্বাদ নেয় আবার মায়া প্রেমের দৃষ্টিতে হারিয়ে স্বপ্ন দেখে যায় পুরুষ দৃষ্টি। সবকিছু উপেক্ষা করে একটা সময় সামাজিক নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে সংসার জীবনের জলছবি আঁকে কষ্টের আঁধার জমা করে। বিনিময়ে যৌবনবতী কন্যায় দেয় নতুন প্রজন্মের ফসল।
তাই কবি ‘যৈবতী কন্যা ইশকুলে’ কবিতায় বলেছেন-
“রাত তামাশা করে- দাঁতে দাঁত চেপে হারিয়ে ফেলে প্রাপ্তবয়স্ক শরীর...
নবীন রাতেও জমা হয় - প্রজাতিক হাসি- পোয়াতি সোমত্ত মেয়ে। সরষে মরিচের পেটে আজ নীলবৃক্ষের বিপন্ন চিরকুট...”
শব্দ সৃষ্টির কি দারুণ খেলায় মেতে উঠে কবি কবিতার গভীরে। তাইতো যৌবনের উন্মাদনাকে সাবলীল সহজ সরল সুন্দর মাধূর্যে উপস্থাপন করেছে সেরা সৃষ্টিতে।
কবির ‘আত্মকামী’ কবিতার প্রথম ও পংক্তিটি অসাধারণ-
তবে অন্য পংক্তিগুলো অনায়াসে বলা চলে সেরার সেরা।
“অন্ধকারের উৎসব তুমি দেখেছো বুঝি...
কেউবা ভোর রাতে আত্মকামী হয়ে ওঠে নিজেকে নিজেই কামড়ে খেতে কিংবা পাশের জনকে...”
প্রকৃত প্রেম ভালোবাসা কখনো কখনো বিদগ্ধ হয় সামাজিক প্রতিবন্ধকতায়। মানুষের দৃষ্টিতে সে প্রেম কলঙ্কিত সমাজ স্বীকৃত নয়।তাই নিদারুণ নিষ্ঠুর নিয়মের সাথে প্রেমের সুখের বাঁশি বেহালার করুণ সুরের সাথে বুকের পাজরে বাজতে থাকে। তাই কবি ‘কলঙ্কিত দুপুর’ কবিতায় বলেছেন-
“অনেকটা দুর্বল কিংবা বিদগ্ধ প্রেমে বুকে জ্বালিয়ে প্রদীপ তুমি আমি আমারা মানুষের ক্যানভাস আঁকি।
বেহালার সাথে বুকেও বাজে অঙ্কুরিত সুর-
কলঙ্কিত হয় মধ্যদুপুর”
স্বদেশ প্রেমের সুন্দর দৃষ্টান্তের সাথে সাথে নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের জীবন ফুটিয়ে তুলেছে ‘শরনার্থী সিরিজে’ মাতৃভূমি মায়ের সমতূল্য অথচ নানা দুর্ভিক্ষ মহামারি কিংবা নানা নির্যাতনের স্বীকার হয়ে একবুক যন্ত্রণা বুকের গভীরে জমা করে ভিনদেশের পথে যাত্রা করে। স্বদেশের বুকে নরপিশাচি কুকুর শকুনের কথা বলা হয়েছে যারা বোনেদের কামড়ে খুবলে খায় অমানবিক নির্যাতনে।
শরনার্থী সিরিজ১,২,৩ এ এমনটা বলেছেন কবি।
‘শরনার্থী সিরিজ’ এর ৪ পাঠ করার পর এর ব্যাখ্যা দেবার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছ। স্বাধীনতার জন্য আমাদের প্রতিটি ত্যাগ উচ্চতার শীর্ষে। বর্বরতার নিষ্ঠুরতম দৃশ্য ফুটে উঠেছে ‘শরনার্থী সিরিজের’ প্রতিটিতে।‘শরনার্থী সিরিজ’ পাঠ করা মাত্র যে কোনো স্বদেশ প্রেমি মানুষের অন্তর থেকে অশ্রু বর্ষিত হবে নিজের অজান্তেই।
গণিকালয়ের নারীদের হৃদয়ের রক্তঝরা হাহাকারের যন্ত্রণা শুধু তারা নিজেরা জানে। তবুও সাজ সজ্জায় বিভূষিত হয়ে মুগ্ধতায় মেতে ওঠে আর মাতিয়ে তোলে কামুক পুরুষের অন্তর, সমস্ত লুকানো কষ্ট বুকের পাজরে জমা করে। শরীর বিদ্যার কলাকৌশলে ও শরীরের ঘ্রাণে মাতিয়ে দিতে হয় গোপন সঙ্গমে।
তাই কবি ‘নারী অথবা গোপন বালিশ’ কবিতায় লিখেছে-
“মনের আর্তনাদ কখনো কখনো উজ্জ্বল সূর্যের মতো চিৎ হয়ে ঘুমায়, প্রাচীনতম মানুষের খুলির পাশে... তাকেই শরীর বিদ্যায় মেলে দিতে হয় গোপন নগ্নতার আগ্রাসীদেহ”
যুদ্ধরত নাবিক বুকের মাঝে হাজারো ঝড় নিয়ে যুদ্ধ কৌশলে হেটে চলে দিক বিদিক অন্ধকার চক্রবূহে কোন কূল কিনারা পায় না তবুও নাবিক জীবন মরনের কথা তুচ্ছ করে মিথ্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।
তাই কবি ‘অন্ধকার এক নির্মমতার নাম’ কবিতায় বলেছেন-
“মানুষ বেশিদিন বাঁচে না - সূত্রে বলে অনেক আঁধার ভিড় ঠেলে আসে - প্ররোচনার মিথ্যে জাহাজ।”
প্রিয়তম জিনিসটা যখন আত্মার অবস্থানে থেকেও অন্তরঙ্গতার গভীরে বসবাস করে না তখন তাকে আত্মার বাজার থেকে বিক্রি করে দিতে হয় যন্ত্রণা অবশিষ্ট রেখে। তাই হয়তো কবি ‘তোমাকেই বিক্রি করি’ কবিতায় বলেছেন-
“মেজাজী যন্ত্রণায়-
মাছ বিক্রেতা সেজে ধীরে ধীরে তোমাকেই বিক্রি করি।”
মা শব্দটা একটি অক্ষরের অথচ পৃথিবীর সেরা শব্দ মা। যার মা নেই সেই বুঝে, যে কতবড় মহামূল্যবান সম্পদ তার পৃথিবীতে নেই। তখন মনে হয় প্রতিটি মা কেই মায়ের মতো মনে করে জড়িয়ে নিতে।
তাই কবি তার ‘মা’ কবিতায় বলেছেন-
“গভীর রাঙা সন্ধ্যায় একজন বৃদ্ধা আমাকে জড়িয়ে প্রতিদিন হাঁটে -
সে আমার কেউ না; তবু মায়ের মতো আমারই হারানো অতীত।”
বিরহী যন্ত্রণার লিখন ও শব্দের ছন্দের ব্যবহার এতোটাই সুন্দর হতে পারে ‘চুমো’ কবিতা পাঠ না করলে বুঝতে পারা সম্ভব না। গভীর প্রেমের মধুর স্পর্শকাতর বিরহী লেখা হৃদয়ে এক অদ্ভুত দোলা দেয়।
কবির ভাষায়-
“স্বাপ্নিক অভিশাপে রক্তের সঙ্গম আড়াল করে তুমি -
আমার সৎকারে খাচ্ছো চুমো...”
মানুষেরা যখন জীবনের কঠিন বাস্তবের চূড়ান্ত কিছু চিন্তা ভাবনা করে তখন মস্তিষ্ক যেনো শরীর ছেড়ে বহু দূরে অবস্থান করে মহাজাগতিক জগতে। সন্তানকে নির্দেশিত শত ইচ্ছার ফুলঝুরি হাতছানি দেয় কিন্তু অপূর্ণতায় কোন এক সময়ে মায়ের চোখে জল আসে।
তাই কবি তার ‘জটিল স্বাপ্নিক বাস্তবতা’ কবিতায় বলেছেন-
১.
“শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে মাথা ঘুরে ঘুরে দ্যাখো সত্যি কী না”
২.
“সকাল থেকেই অফুরন্ত ইচ্ছাদের হাতছানি”
৩.
“মায়ের চোখে জল”
রাজনৈতিক দোলাচলে অরাজকতার ভীড়ে স্বদেশকে যেনো বিক্রি করে দিচ্ছে। স্বদেশকে রক্ষা করতে যাদের বেশি অবদান রাখার কথা তারা আসলে প্রেমিকার সাজ সজ্জার বখাটে হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায় স্বভাবচিত্ত স্বভাবে নিশ্চিন্তে অথচ গরীব দুঃখী সাধারণ মানুষ স্বদেশকে নিয়ে কতো গভীর ভাবে ভাবে অথচ তাদের হাত পা বাঁধা।
তাই কবি ‘বিদগ্ধ স্বদেশ’ কবিতাতে বলেছেন-
“তবু দেখো- ভীক্ষারীর মুখে বিদগ্ধ স্বদেশ ছটফট করে -জ্বলে অস্বচ্ছ অন্ধ মন্দির..."
সহজ ভাষায় প্রেম বিসর্জন দেওয়ার সতো কঠিন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে কবি তার ‘প্রেম’ কবিতাটিতে-
কবি বলেছে-
“ইশকুলের দেওয়াল টপকিয়ে যেদিন তোমাকে দেখেছি - সেদিন জেনে গেছি হারানোই প্রেম।”
পাখি বুকে আকাশের মানচিত্র অঙ্কিত করতে পারে শুধুমাত্র একজন প্রকৃত কবি। দূর থেকে বহুদূরে হেলেও ভাঙা বুকে আগলে রাখতে পারে সমস্ত প্রেম। সে হোক প্রেমিকার প্রেম অথবা স্বদেশ প্রেম। প্রথমেই বলেছি এমন কিছু কবির কবিতা আছে যা বিভিন্ন অর্থের সম্ভার।
তাই কবি ‘ভাঙাবুক’ কবিতাটিতে লিখেছেন -
“নৈকট্য ছুঁয়ে দিলে তুমি আমি আঁকি পাখি বুকে আকাশের মানচিত্র।
দূরে দূরে করে অনেক দূরে গেলে তবু রয়ে গেলে মুচড়ে ভাঙা বুকে।”
পৃথিবীতে আমারা ধনী গরীব সবাই গৃহপালিত জীব। বেঁচে থাকার সংগ্রামে আমরা কখনো হেরে যায় কখনো বা জয়ী হয়, স্বপ্ন আশার সুখ পাখির অন্তরালে বিসর্জন দিই ছোট ছোট হাজারো স্বপ্ন আশার গল্প। ঈশ্বরের কাছে প্রতিনিয়ত সুখি হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় প্রার্থনা করা সত্বেও শোষকের অত্যাচারের কাছে হেরে যেতে হয় বারবার।
তাই হয়তো কবি ‘গৃহপালিত জীব’ কবিতায় বলেছেন-
“প্রভু বড় দয়ালু - জীবন শোষণের মোহন কারিগর।”
নিজ সত্তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে বিবেক ও বোধহীনতার সাথে সংগ্রাম করে বিবেকহীনতাকে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া এবং পাপ পূণ্যের হিসেব কষে মিথ্যা ও অন্যায়কে পুড়ে ছাই হওয়ার কথা ব্যক্ত করেছে। ‘বন্ধন রাখিয়া কি হবে’ কবিতাটিতে-
“অগ্নি জ্বালাও ভষ্ম করে দাও আত্মবিসর্জনের গণ্ডমূর্খ সত্তা।”
মনের গীনে যে বৃষ্টি ঝরে সে বৃষ্টি কেউ দেখে না বুঝেও না শুধু নিজস্ব দৃষ্টিতে সেই বৃষ্টির জলছবি আঁকে। এক তরুণ বালকের হৃদয় জুড়ে যে যুবতী কন্যার বাস তাকে হৃদয়ের অজান্তে স্পর্শ করতে গিয়ে কল্পনার জগতে বিলীন হয় অসহায়ের মতো বৃষ্টিতে ভিজে নির্বাক হয় অন্ধের মতো।
তাই কবি ‘যৈবতী কন্যা ইশকুলে’ ২ কবিতাটিতে লিখেছেন-
“অসহায় আমি বৃষ্টিতে ভিজে তোমার স্পর্শ পেতে চাই - অন্ধ- বধির বালক।”
ভালো কিংবা মন্দ অতীতের বিশেষ কিছু স্মৃতি ভুলে যাওয়া বা ভুলিয়ে দেওয়া খুব সহজ ও সম্ভব নয়। কোনো না কোনো এক দৃশ্যপটে হৃদয়ে তাড়া করে বেড়ায়। বিশ্বাস, অবিশ্বাস বা বেঈমানী অথবা ছলনা ঘুরে ফিরে আসে কোন এক মুহূর্তে। তাই কবি ‘জুডাসজীব’ কবিতাতে বলেছে -
“তুমি ভুলিয়ে দিও অতীতের কথা
কী লাভ ভেবে আমি - তুমি, আমাদের নিয়ে ভাবি চল...
তবু তাড়া করে জুডাসজীবন”
কবি বঙ্গ রাখালের সমস্ত কবিতা পড়ে আশ্চর্য হয়েছি। তার কবিতার ভেতরে যেনো নিজস্ব কিছু শব্দ সৃষ্টি করে বাক্যের ভেতরে এক অলিক মাধূর্য সৃষ্টি করেছে বাস্তবতার সম্ভারে। তার কবিতার ভেতরে কঠিন বাস্তবতার দীপ্ত প্রদীপ ঝলমল করে। প্রেম - বিরহ, অরাজকতা,রাজনীতি, সামাজিক ও অসামাজিক প্রেক্ষাপট,যৌবনের ক্ষধিত তৃষ্ণা, স্বদেশ প্রেম, গণিকাজীবন বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে শোষণ নিপীড়নের নির্মমতার দৃশ্য সমস্তটা আলোক সজ্জার ডেকরেশনের মতো সাজিয়েছে কবিতার ভাষায় প্রাঞ্জলতার সৌন্দর্যময় কারুকাজে গভীর থেকে গভীরতম চিন্তা চেতনার গবেষনায় কবিতাকে নস্টালজিকে উপস্থাপন করেছে কবির অসাধারণ প্রতিভায়। কবির কবিতার শব্দ ঝংকার বাক্যের সৌন্দর্য যেনো ঝিনুকের বুকে লুকানো মুক্তার মতো খুঁজে নিতে হয় বুঝে নিতে হয় গভীর পাঠ মগ্নতায়।
0 Comments