কামরুল ইসলাম এর গল্প ~ চশমা

The story of Kamrul Islam ~ Chashma


ষাটোর্ধ্ব চশমাটা আজ হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গে গেল। তাই সকাল থেকে মনটা খারাপ। চশমাটাকে বড্ড ভালবাসেন তিনি। কারণ এটা কোনো যেন তেন চশমা নয়।এটা এই মানুষটার জীবনে এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। দিনের বেশির ভাগ সময়ই চশমাটা যথা স্থানে অবস্থান করে। চোখ থেকে সহজে নামান না যদিও চশমাটার কোনো পাওয়ার নেই। একটা ধাতব ফ্রেমের সাথে আটকানো সাদা গ্লাসের চশমা। তথাপিও তার সব একদিকে আর চশমাটা একদিকে। এর অবশ্য আরও একটা বিশেষ কারণ আছে তা ক্রমশ প্রকাশ্য। স্ত্রীবিয়োগের পর থেকে এই চশমাটাই তার দিবারাত্রির সঙ্গী। তাই চশমার প্রয়াণে বৃদ্ধ আজ বাকহারা।

পঁচাশি বছরের বয়স্ক এ. জি. ভূঁইয়া সাহেব এই এলাকার অনেক কিছুতেই সর্বপ্রথম। তিনি যখন মেট্র্রিক পাশ করেন তখন দূর-দূরান্তের লোকজন তাকে মণ্ডা মিঠাই নিয়ে দেখতে এসেছিল। আমাদের গ্রামে একজন মেট্রিক পাশ লোক আছে সেটা ভেবে আমরা সকলেই গর্ব করতাম। সর্বশেষ তার শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতার ধারণা  এই মুহুর্তে আমার কাছে নেই। তবে তিনি এই এলাকার সর্বপ্রথম ডাক্তার সে কথা আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি। অবশ্য আমাদের আশে পাশে দুই একজন ছাড়া তেমন কোনো ডাক্তার দেখি না। এখন আর তিনি রোগী দেখেন না। স্ত্রীবিয়োগের পর আর আয়-উপার্জনের প্রয়োজন বোধ করেন নি। তিনি ছিলেন নিশ্চিতভাবে আমাদের উপজেলার প্রথম আধুনিক পুরুষ। ছোটবেলা থেকেই আচার- আচরণ, চাল-চলন, বেশভূষায় তিনি ছিলেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। এলাকায় প্রথম তাকেই আমি কালো গ্লাসের চশমা পড়তে দেখেছি। অনেকেই তখন চশমা পড়তে ইতস্তত বোধ করত। লোকে কী বলবে সেই ভয় কাজ করত অনেকের মধ্যে। কিন্তু তার মধ্যে সেরকম কোনো লক্ষণ ছিল না। তার সাথে কোন বিষয়ে কথা বলতে গেলে মনে হতো যে তিনি সে বিষয়টা আমাদের চেয়ে বহু পূর্বে আয়ত্ব করে বসে আছেন। একবার তার কাছে গিয়েছিলাম আমার গলার সমস্যা নিয়ে। তিনি এমনভাবে কথা বললেন যে আমার কিছুই হয়নি। আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র জেনে তিনি আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন। শেকসপিয়ার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তার রচনার ব্যাপারে জানতে চাইলেন। আমি যে উত্তরগুলো দিয়েছিলাম তাতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পেরেছিলেন। 

-“মার্সেন্ট অব ভেনিস” পড়েছো?

-জ্বি স্যার।

- ভেনিস গিয়েছো কখনো?

- না স্যার যাইনি। তবে ইচ্ছে আছে।

-আমি তো গিয়েছি।

- আমাদের বরিশালকে তো বাংলার ভেনিস বলা হয়। সেটা অবশ্য এখানে বেশি খাল, নদী, নালা আছে সে জন্য। 

-তাই?

-জ্বি, স্যার। 

- আমার এখানে ভেনিসের তৈরি একটা জিনিস আছে। বলতো সেটা কোনটা?

অনেক দেখে শুনে ভেবে কোনো উত্তর খুঁজে পাই নি। 

তিনি একটু মৃদু হাসলেন।

-আমার চোখজোড়া! 

আমাকে হা করে থাকতে দেখে তিনিই সবকিছু পরিষ্কার করে দিলেন। 

-আমার চশমাজোড়া। তোমার চাচী আমাকে ভেনিস থেকে কিনে দিয়েছে। 

বুঝলাম ডাক্তার সাহেব ডাক্তারনীকে খুব ভালবাসেন। 

একসময় পরলোকগত দাদুর প্রতি তার ভীষণ অভিমান ছিল। এখন অবশ্য সেটা নেই। বড় সাধ করে তার দাদু হাশেম আলী ভূঁইয়া নাতীর নাম রেখেছিলেন আবদুল গনি ভূইঁয়া। নাবালককালে যদি বুঝতেন তাহলে তিনি এই নামে আপত্তি জানাতেন। কিন্তু ক্ষতি যা করার দাদুই করে গেছেন। সাবালক হতে হতে হাশেম আলী ভূঁইয়ার নাতীর নাম যে আবদুল গনি ভূঁইয়া সেটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সাবালক হবার পরে বুঝতে পারলেন যে তার নামটা আধুনিক নাম নয়। কিন্তু কী করবেন?  মা-বাবার কাছে নামের বিষয়ে আপত্তি তুললে তারা দাদুর দেয়া নাম পরিবর্তন করাকে পূর্বপুরুষের অপমান বলে মনে করেন। এ নিয়ে বাবার হাতের মারও খেয়েছিলেন কয়েকবার। কি আর করার! কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নন তিনি। বহু চেষ্টা করে সাপ আর লাঠি দুটোই রক্ষা করলেন। নিজের নাম জাহির করলেন এ. জি. ভূঁইয়া অর্থাৎ আব্দুল গনি ভূঁইয়া। পরবর্তীতে তিনি এ. জি ভূঁইয়া নামেই পরিচিত হন। তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে এই বার তার নামটা নিশ্চয়ই তার চাল-চলন ও বেশভূষার সাথে মানানসই হয়েছে। পরবর্তীতে আর কখনো তিনি নিজের নাম কারও কাছে বলতে দ্বিধা করেন নি। 

দীর্ঘ দিনের প্রণয়কে পরিনয়ে পরিণত করতে বেশি সময় নেন নি ডাক্তার সাহেব। বিয়েটা সেরে ফেলেন চাকরি হবার পরপরই। সহকর্মী ডা. রাজিয়া বানুকেই বিয়ে করলেন। খুব ভালবাসতেন পরস্পরকে। এই ডাক্তার দম্পতি সারাজীবন এক হাসপাতালে কাজ করেছেন বলে হাসপাতালের নামই পড়ে গিয়েছিল ‘স্যার-ম্যাডামের হাসপাতাল’। এতে অবশ্য তারা বিব্রত হতেন না। কথাটা শুনতে তাদের ভালই লাগত। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে প্রচুর মধুর সময় কাটিয়েছেন দুজনে। বিশ্ব ঘুরে চোখের ক্ষুধা মিটিয়েছেন। দুজন দুজনকে যে কত উপহার দিয়েছেন তার ইয়ত্বা নেই। মাঝে মধ্যে উপহারগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে মনকে হালকা করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাতে করে উল্টো চোখের কোনা ভিজে ওঠে। তাই এখন আর তা  করেন না।

সেবার ছিল তাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। অনেক পরিকল্পণা করে বিবাহ বার্ষিকীতে অবকাশ যাপন করতে গিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ড। সেখানে দুজনার সময় ভালই কাটে। আগে থেকেই জানতে যে সুইজারল্যান্ড ঘড়ির জন্য বিখ্যাত। রাজিয়া বানু স্বামীর জন্য একটা ঘড়ি কিনেছিলেন। ঘড়িটা পেয়ে ভূঁইয়া সাহেব যে কতটা খুশি হয়েছিলেন সেটা তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন নি। এরপর সেখান থেকে চলে যান ইতালি।  ইতালিতে আবার ভাল মানের চশমা পাওয়া যায়। রাজিয়া বানু স্বামীকে না জানিয়ে একটা চশমা কিনেছিলেন যেটা তিনি দেশে আসার পরে দিয়েছিলেন। ভূঁইয়া সাহেবের কাছে চশমাটা একটু সেকেলে সেকেলে মনে হয়েছিল তবুও তিনি সে উপহার সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। স্ত্রীকে বুঝতে দেননি যে তিনি যে আধুনিকতায় বিশ্বাস করেন তার সাথে তার চশমাটা যায় না। প্রথম প্রথম চশমাটা খুব একটা পড়তেন না তবে ঘড়িটা হাতছাড়া করতেন না কখনোই। ইতালি থেকে আসার কয়েক বছর পরে সরকারি কাজে ভূঁইয়া সাহেবকে একবার হংকং যেতে হয়েছিল। তিনি জানতেন না যে হংকং আসলে চোরের খনি। হাতের ঘড়িটা নিয়ে হংকং থেকে ফিরতে পারেন নি। কখন যে চোর ঘড়িটা গায়েব করে দিল টেরই পেলেন না। ঘড়িটা হারিয়ে মন খারাপ হয়েগিয়েছিল তার। কিন্তু কি আর করার! স্ত্রীর মন খারাপ দেখে মনে করলেন চশমাটা পড়ে দেখা যেতেই পারে। নাহ, দেখতে তেমন খারাপ লাগে না!

সারাজীবন হাসপাতালে চাকরি করেছেন। ডিউটির বাইরে নিজস্ব চেম্বার ছিল। জীবনে উপার্জন করেছেন প্রচুর। মাঝে মধ্যে নিজের সম্পত্তির হিসাব করতে গিয়ে মাথা গুলিয়ে ফেলেন। জেলা শহরেই কয়েকটা বাড়ি আছে। ভারাটিয়ারা থাকেন। এ. জি. সাহেব নিজে ভাড়া টাড়ার খবর রাখেন না। তার একমাত্র ছেলে সবকিছু দেখাশোনা করে। ছেলেও অবশ্য ডাক্তার। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। একধরণের লোক আছে যারা বিজি ফর নাথিং। ভূঁইয়া সাহেবের ছেলের অবস্থাও তাই। কোনো সহজ কাজকে তরিঘরি করে জটিল করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সে বাবার নাম রাখতে পারেন নি। ডাক্তারিতে খুব একটা ভাল করতে পারেন নি। রোগী খুব একটা আসে না। পারফরম্যান্স খারাপ। একবার এক রোগীকে ভুল জায়গায় ইনজেকশন দিয়ে ইনফেকশন বানিয়ে দিয়েছিলেন। তাই নিজেও এ পেশায় বেশি সাহস দেখান না। সাধারণ রোগী আসলে দেখেন। একটু জটিল হলেই এই হাসপাতাল ঐ হাসপাতালে রেফার করেন। তাই ডাক্তারিতে তেমন আয় উপার্জন না থাকার কারণে বাবার সম্পত্তির দিকে তার একটু নজরদারি বেশি। একমাত্র উত্তরাধিকার হিসেবে তিনি মনে করেন যে বাবার মৃত্যুর পূর্বে তার সমস্ত সম্পত্তি জেনেশুনে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। 

ভূঁইয়া সাহেবের ইচ্ছা যে তিনি মহা ধুমধামে ছেলের বিয়ে দিবেন। বেগম ভূঁইয়াই প্রস্তাবটা স্বামীর কাছে পেশ করেন। এক কথায় রাজী হয়ে গেল স্বামী। তারা মনে দুজনে মিলে একটা পাত্রীও  ঠিক করে রাখলেন। ছেলেকে একদিন ডেকে এ বিষয়ে কথা বললেন।

-আমরা তোমার জন্য পাত্রী দেখেছি। শীঘ্রই তোমার বিয়ে। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নাও। 

বাবা- মায়ের কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল ছোট ভূঁইয়া। কিছু না বলে সে আলোচনা বয়কট করল। মা বাবার বুঝতে বাকি রইল না যে ছেলে এ বিয়েতে রাজি নয়। আসলে ঘটনাতো একটা আছেই। ছোট ভূঁইয়া সাহেব আবার একজনের সাথে ইদানিং ভাব জমানোর চেষ্টা করছে। নিজে দেখতে তেমন সুন্দর না বলে মেয়ে তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। কিন্তু ছোট ভূঁইয়া সাহেব আবার তাকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। এই ব্যাকুলতায় দিবা রাত্রির ঘুম হারাম হচ্ছে তার। একদিন রাতে কাজের ছেলে রাকিব আসে তার ঘরে। 

-ভাই জান!

- কী হয়েছে?

- এই খানে রাইখা গেলাম। সময় হইলে দেইখেন। 

রাকিব চলে যাবার ঘণ্টা খানেক পর মনে হল কি রেখে গেল দেখা দরকার। একটা ছবি। একটা মেয়ের ছবি। অসাধারণ সুন্দর! দেখেই মন ভাল হয়ে যাবার মতো অবস্থা। জহির উদ্দিন ভূঁইয়া খেয়াল করলেন যে ধীরে ধীরে তার মনের অস্থিরতা কেটে গেছে। তিনি এখন আর দোটানায় নেই। মনের দিক ঘুরে গেল ছবির মেয়েটার দিকে। মানুষের মন হয়ত এরকমই। সকল সুন্দরকে ভালবাসতে চায় সে। 

-এর চেয়ে সুন্দর কেউ আছে নাকি! অবাক করা সুন্দর!

দুই একদিন পরে রাকিবকে ডেকে জানিয়ে দিল সে রাজি। মহা ধুমধামে বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়। ভূঁইয়া সাহেব ছেলের বিয়েতে দুহাত খুলে খরচ করলেন। পূত্র আর পূত্রবধূর খাতির যত্নের ত্রুটি রাখলেন না। ভূঁইয়া সাহেব কথা বলার মানুষ। ঘরে একজন নতুন মানুষ আসায় ঘরের আড্ডাটা এবার ভালই জমবে।কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। নতুন পূত্রবধূ মনে হয় আর পুরোনো হবে না! ঘর থেকেই বের হয় না সে। বৃদ্ধ দম্পতির আড্ডার আকাক্সক্ষা আর হয়ত পূরণ হবে না। লক্ষন সে কথা বলে না। তাদের সন্দেহই সঠিক। নতুন বৌ তেমন কথা বার্তা বলে না। তবে মাঝে মাঝে যখন স্বামীর সাথে ঝগড়া করে তখন পুষ্প বেগমের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। বৃদ্ধ ভূঁইয়া দম্পতির কাছে পূত্রবধূর ঝগড়া শুনতেও ভাল লাগে। মনে মনে ভাবেন তাদের সাথে ঝগড়া বাঁধলে ব্যাপারটা মন্দ হবে না। রাজিয়া বানু তার  জীবদ্দশায় এ সাধ মিটিয়ে যেতে পারেন নি। তবে রাজিয়া বানুর মৃত্যুতে পুষ্প বেগম কেঁদেছিল প্রচুর। 

রাজিয়া বানুর ইলিশের বড্ড সখ। ভূঁইয়া সাহেব ইলিশ পছন্দ করতেন না। তবে বৌ এর প্রভাবে তিনিও ইলিশ পোকা বনে গিয়েছেন। মাঝে মধ্যেই তারা বরিশাল শহর থেকে লং ড্রাইভ করে কাওরাকান্দি ঘাট যেতেন ইলিশ খেতে। সেদিনও বের হয়েছিলেন। ভূঁইয়া সাহেব নিজেই ড্রাইভ করছেন। ঘাটে পৌছে ইলিশও খেলেন। পন্টুনে দাড়িয়ে নদীকে দেখছেন। স্রোত বেশি তাই ফেরি বন্ধ। লঞ্চ আর স্পিডবোট চলছে। বেগম ভূঁইয়ার ইচ্ছা হল স্পিড বোটে করে ওপারে মাওয়া যাবেন। যেই কথা সেই কাজ। কোনো ভয় তাদের মধ্যে কাজ করল না। দুজনে যাত্রা শুরু করলেন পদ¥ার বুক চিড়ে। প্রমত্তা পদ্মতো কাউকে সমীহ করে না। আপন মনে সে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। ভূঁইয়া দম্পতি সে ঢেউ উপভোগ করছেন। ঢেউয়ের তোরে বোট উপরে উঠছে আর নিছে নামছে। হঠাৎ একটা দানবীয় ঢেউ এসে উল্টে দিল তাদের বোট। আবদুল গনি ভূঁইয়া কোনো রকমে নিজের জীবন রক্ষা করতে পারলেও স্ত্রীকে তিনি রক্ষা করতে পারেন নি। রাজিয়া বানুর লাশ কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। সেদিন ডাক্তার বাবুর আহাজারিতে আকাশ বাতাশ ভারী হয়ে উঠেছিল। জলে ঝাপ দিয়ে নিজেও কয়েকবার যেতে চেয়েছিলেন বেগম ভূঁইয়ার সঙ্গে। কিন্তু লোকজনের জন্য তা পারেন নি। পরে অচেতন হয়ে যান। চেতনা ফিরলে তিনি নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করেন। 


ঐদিকে আবার পুষ্প বেগমও হাসপাতালে ভর্তি। তার শারীরিক অবস্থা বেশি ভাল না। জহির উদ্দিন একবার স্ত্রীর কাছে যাচ্ছে আরেকবার বাবার খোঁজ নিচ্ছে। মাকে তো আর পাওয়াই গেল না। ডাক্তার এসে জানায় পুষ্প বেগমের ছেলে হয়েছে। তবে পুষ্প বেগম একটু অসুস্থ তবে ভয়ের কিছুই নেই। বাচ্চাও ভাল আছে। নাতীর জন্মের খবর পেয়ে ভূঁইয়া সাহেব যেন স্ত্রীবিয়োগের কথা নিমেষেই ভুলে গেলেন। ভূঁইয়া সাহেবের আর খুশি ধরে না। নাতিকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। নাতির নাম দিয়েছেন মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া। নাতীকে কোলে নিয়ে এ গালে ও গালে চুমু খাচ্ছেন তিনি। 

-‘তোর দাদী আর একটা দিন বেঁচে থাকলে তোকে দেখে যেতে পারত’ বলেই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। নাতীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। 

স্ত্রীকে এখন বারবার মনে পড়লেও জসিমকে দেখলেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সকল দুঃখ ভুলে যান। নাতীর যত্নের ত্রুটি রাখেন না এতটুকু। কোল থেকে মাটিতে নামান না। শৌচকার্য থেকে শুরু করে গোছল করানো সব কিছুই তিনি করেন। নিজের হাতে যত্ন করে খাওয়ান। দাদা- নাতির ভালবাসা দেখে জহির- পুষ্প দম্পতির ভাল লাগে। যতই দিন যাচ্ছে জসিম তরতর করে বেড়ে উঠছে। জসিম তিন বছর বয়স থেকে জসিম দাদুর সাথে ঘুমায়। রাতে গল্প শুনিয়ে জসিমকে ঘুম পাড়ান দাদু। কত যে গল্প বলেন তার শেষ নেই। বেশিই করেন বেগম ভূঁইয়ার গল্প। এই গল্পের যেন অন্ত নেই! যতই বলেন ততই বাড়ে। গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায় জসিম। 

ভূইয়া সাহেবই জসিমকে স্কুলে নিয়ে যেতেন আবার স্কুল থেেেক বাসায় নিয়ে আসতেন। এখন জসিম ক্লাস নাইনে পড়ে। মুখে দাড়ি গোঁফের রেখা পড়েছে। দাদুর কাছে কিছুই লুুকায় না সে। 

-মেয়েটার নাম কী, দাদু ভাই??

প্রথমে লজ্জা পেলেও কাউকে না বলার শর্তে সে দাদুকে সব বলে। 

-ওর নাম জোনাকী। দেখতে জোনাকীর মতোই সুন্দর। আমাদের সাথেই পড়ে। তুমি বিশ্বাস করতেই পারবে না দাদু ও যে কতটা সুন্দর! 

মোবাইল থেকে ছবি বের করে দেখায় দাদুকে। মেয়েটা আসলেই সুন্দর। নিজের ছেলেকে প্রেমে নিরুৎসাহিত করলেও এখন নাতীর সাথে বসে নাতীর প্রেমের গল্প শুনছে সে!

দাদু লক্ষ্য করলেন এখন আর জসিম তার কাছে সব কিছু বলতে চায় না। বয়স বেড়েছে। হয়ত মনে করেছে গোপনীয়তা রক্ষা করা উচিত। আর দাদুও জোড় করে শুনতে চায় না। তবে মন খারাপ থাকলে এসে দাদুর সাথে শেয়ার করে। আবার দাদুও তাকে তার মতো করে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। আবার যখন জসিম কিছু বলে না তখন মনে করে সবকিছু ঠিকই আছে। দাদু মাঝে মধ্যে ঠাট্টার ছলে বলে- কি রে, তোর নায়িকা কেমন আছে?

-‘ভাল’, বলে একটা লাজুক হাসি দেয় সে। 

-জোনাকীর এক কপি ছপি দিস তো আমাকে?

-ছবি দিয়ে তুমি কী করবে?

-দরকার আছে। 

-আচ্ছা।

ইদানিং ভূঁইয়া সাহেব একেবারে একা হয়ে পড়েছেন। ছেলের সাথে তো কথা বলার সুযোগই নেই। সে যখন বাড়ি আসে তখন তিনি থাকেন ঘুুমের ঘোরে। পূত্রবধূ তো শ্বশুরকে তিন বেলা খাবার আর সকাল বিকাল নাস্তা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। চাকর বাকরেরা যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কাজ না থাকলে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জসিমও এখন একা ঘুমায়। তাই ভূঁইয়া সাহেবের কথা বলার মতো কোনো কেউ নেই। টিভি দেখবেন তারও সুযোগ নেই। পুষ্প বেগম টিভির রিমোট কখনও হাতছাড়া করে না। অবশ্য নিজের ঘরেও একটা টিভি আছে। পছন্দের কোনো প্রোগ্রামও খুঁজে পান না। কোনো প্রোগ্রাম পছন্দ হলে সেটা আবার বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে দেখার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। তাই টিভি থেকেও মুুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এক পত্রিকা বারবার পড়ে মুখস্ত হয়ে গেছে।পাওয়ারহীন চশমা দিয়ে এখনো সাড়ে নয় বা দশ সাইজ ফন্টের পত্রিকার লেখাগুলো অনায়াসে পড়ে যান। বুকশেলফের বই একটাও পড়া বাদ নেই। আগে তো নাতীর সাথে সময় কাটিয়েছেন। এখন সেটাও পারছেন না। নাতী নিজের পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর ও এখন প্রেম করছে। জোনাকীকেও সময় দিতে হয়। দাদুর কথা আর এখন ওর ওভাবে মনে পড়ে না। দিনে দুই একবার উকি দিয়ে চলে যায়। একটাই অবলম্বন এখন- চায়ের দোকান। চায়ের দোকানে আড্ডাটা বেশ উপভোগ করেন ডাক্তার। কিন্তু কিছুদিন হলো পুরোনো বন্ধু নারায়ন সেন মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই সেখানে গেলে কষ্টে বুকটা ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিছুদিন ড্রাইভারকে নিয়ে শহরটা ঘুরে বেড়িয়েছেন। দুপুরে বাইরে খেয়েছেন। এখন ঘুরতেও ভাল লাগছে না। তার বুঝতে আর বাকি রইলো না যে তিনি কাকে মিস করছেন। রাজিয়া বানু এখনো তার মন পোড়াচ্ছে। মরেও শান্তি দিচ্ছে না। রাজিয়া বানুর উপরে মাঝে মধ্যে অভিমান করেন তিনি। যখন স্বর্গলোকে গেলেন তো একা গেলেন কেন? ভূঁইয়া সাহেব বিশ্বাস করেন যে রাজিয়া বানুও ওপারে ভাল নেই। দ্রুতই দুজনের দেখা হওয়া প্রয়োজন। মাঝে মাঝে রাজিয়া বানু স্বপ্নে দেখা দেন। তাতে আরও বৃদ্ধের মনের কষ্ট বাড়ে। তিনি যেদিনই স্বপ্ন দেখেন সেদিনই গাড়ি করে চলে যান পদ্মা নদীর পারে। দেখা করে আবার সন্ধ্যে বেলা চলে আসেন। 

আজও ভূঁইয়া সাহেব রাজিয়া বানুকে স্বপ্নে দেখেছেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে মিসেস ভূঁইয়া তাকে ডাকছেন। সকাল বেলাই তার চশমাটা ভেঙ্গে গেল। অবশ্য আগেও কয়েকবার হাত থেকে চশমাটা পড়ে গিয়েছিল। মেকানিকের কাছ থেকে ঠিক করিয়ে এনেছেন। কিন্তু এবার আর সে পরিস্থিতি নেই। ফ্রেম এবং গ্লাস দুটোই ভেঙ্গে গেছে। এটা আর মেরামতযোগ্য নয়। তাই ঠিক করেছেন যার জিনিস তাকেই ফেরত দিয়ে আসবেন। কাগজ কলম নিয়ে একটা চিঠি লিখতে বসলেন। চিঠিটা খুব বেশি বড় নয়। এক পৃষ্ঠা হবে। 

প্রিয় রাজিয়া,

আশা করি ওপারে ভালই আছো। আমাকে এপারে একা রেখে কিভাবে তুমি সুখে দিন কাটাচ্ছো? আমি আর তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। এখানে আমি অসম্ভব কষ্টে আছি। কেউ আমার সাথে কথা বলতে চায় না। তোমার ছেলে এক মহাব্যস্ত মানুষ! কিছু দিন হল নারায়নটাও স্বর্গে চলে গেছে। তোমাকে তো আগেই বলেছি তুমি যেদিন চলে গিয়েছিলে সেদিন আমাদের নাতী জসিমের জন্ম হয়। যে সুন্দর হয়েছে তোমার নাতী! দেখলে তুমি ঠিকই প্রেমে পড়ে যেতে। ও এখন একটা প্রেম করে। নায়িকার নাম জোনাকী। মেয়েটা খুব মিষ্টি।ওর ছবিটাও তোমার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। 

তোমার দেয়া চশমাটা আমি শেষ পর্যন্ত আমি রক্ষা করতে পারি নি। এজন্য আমায় ক্ষমা কর। রাগ কর না।

ওহ! আরেকটা কথা। শীঘ্রই আমাদের দেখা হচ্ছে। আমার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। আমি আসছি।

ইতি,

তোমার গনি।


পঁচাশি বছর বয়সেও ভূঁইয়া সাহেব টান হয়ে হাটেন। স্পষ্ট কথা বলেন। এখনো তিনি একজন ভালো ড্রাইভার। সকাল বেলা বলে গেছেন যে তিনি পোস্ট অফিসে যাচ্ছেন। 

-দাদু, তারাতারি এসো। আজ কিন্তু আমার জন্মদিন। 

তিনি কোনো জবাব দিলেন না। গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন পোস্ট অফিসে। এই পোস্ট অফিসে তিনি মাঝে মধ্যেই আসেন। পদ্মার বুকে তাকিয়ে তিনি কিছুক্ষণ অঝোরে কাঁদলেন। কান্না তার থামছেই না। চারপাশের পৃথিবীটা দেখে নিলেন ভাল করে। তার পরে চিঠি, চশমা আর একটা ছবি পাঠিয়ে দিলেন রাজিয়া বানুর ঠিকানায়। চিঠিটা দৃষ্টির অগোচরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দাড়িয়ে থাকলেন নদীর পারে। বাড়ি ফেরার পথে নিজের বাড়িগুলোকে একবার বাইরে থেকে দেখে নিয়েছেন। দোকানে গিয়ে নাতীর জন্য জন্মদিনের একটা গিফট কিনে রাত দশটার দিকে বাড়ি ফিরলেন। এসে দেখেন ততক্ষণে অনুষ্ঠান শেষ। মৃদু  একটু হেসে বললেন- বাহ!

উপহারটা নাতীর হাতে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিলেন বিছানায়। হারিয়ে গেলেন গভীর ঘুমে! তার এই ঘুম আর কখনো ভাঙ্গে নি। 

পরবর্তীতে জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া পৃষ্ঠার ছাঁপ থেকে দাদুর লেখা শেষ চিঠিটির কথাগুলো আবিস্কার করতে পেরেছিল। সীমাহীন আবেগে ভেঙ্গে পড়ে জসিম।

-দাদু, আমাকে ক্ষমা করে দাও দাদু! আমি তোমাকে খুব ভালবাসি, দাদু!










কামরুল ইসলাম

সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি)

পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, পিরোজপুর।


Post a Comment

0 Comments