মোহাম্মদ ইমরান এর গদ্য

Mohammad Imran's prose Dewan-i-Majid: God Consciousness of the Poet



পাঠক সমাজে প্রচলিত ‘জীবন্ত লাইব্রেরি’ বলে সুপরিচিত বাংলা সাহিত্যের বর্তমান সময়ের শক্তিমান লেখক মজিদ মাহমুদ’র গ্রন্থ নিয়ে আলোচনার সাহস আমার হৃদয়ে দানা বাঁধলেও হাতের কম্পন থামানোর কবিরাজি আমার জানা নেই। ব্যাভিচার হয়ে যায় কি-না সেভয়ে শরীরের শীর্ষ ভাগে ব্যথার উদ্রেক হচ্ছে! কবি মজিদ মাহমুদের কবিতার কাঁচা পাঠক আমি, তবে উপলব্ধি তেমন কাঁচা নয়। শক্ত, মজবুত ও জুতসই উপলব্ধি নিয়ে কবির লেখনীর প্রতি আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে- কাঁপা কাঁপা হাতে অনুভূতির সমাপ্তি ঘটাতে চাই। কবিতার মাধ্যমে সকল অন্যায়, অবিচার, নষ্টামি-দুষ্টামি, ভঙ্গুরতা, নিষ্ঠুরতা, বোকামির বিরুদ্ধে কবির বাতিনী জিহাদ আমার ভিতরে ঝড় তুলে দেয়। প্রচলিত কাঠামোর বিরুদ্ধে কবির নীরব ও নান্দনিক বিদ্রোহ সত্য পথের দিশারী হয়ে সঠিক ও সুন্দরের অনুসন্ধান দেয়। মজিদ মাহমুদ’র কবিতায় প্রমিত ভাষারীতির অবিচল ব্যবহার আমার ভালোলাগার যৌক্তিকতা। কৃত্রিম কাঠামোকে ঠাঁয় পিছনে ফেলে অন্যের কাঁধে না ঝুঁকে মজিদ মাহমুদের কবিতার ধরন সত্যিই আকর্ষণীয় চিহ্ন বহন করে। উনার কবিতা পাঠের ফলে বুঝতে সক্ষম হওয়া যায় উনার জ্ঞানের গভীরতা ও বিস্তৃততা কতটুকু। উনি নির্ভার নয়, উনি চিন্তিত। উনি চিন্তিত ইহকাল- পরকাল বা একূল-ওকূল দু-কূল নিয়ে। শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তার আসরে ধ্যানে মগ্ন নয়, কবিতায় অবলীলায় উপস্থাপন করেছেন শুধরে উঠার রাস্তা ও ভঙ্গুরতা সংস্কারের উত্তম পন্থা। তার কবিতার সাথে আমার পরিচয় খুবই স্বল্প সময়ে। কবিতার পাতা উল্টিয়ে লাইনে দৃষ্টি দিতে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি লাইনের পর লাইন, স্তবকের পর স্তবক গবেষণালব্ধ জ্ঞান কত সুন্দর ভাবেই না সাজিয়েছেন! আমি জানতে আগ্রহী হই আর তাই অকাতরে পড়তে থাকি পঙক্তির পর পঙক্তি। কবিতা যে অনুভূতি ও অনুপ্রেরণার ব্যাপার তা উনার কবিতার পাঠক হলে স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। ইংরেজ কবি ‘উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ’ বলেছেন, "চড়বঃৎু রং ঃযব ংঢ়ড়হঃধহবড়ঁং ড়াবৎভষড়ি ড়ভ ঢ়ড়বিৎভঁষ ভববষরহমং". ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় এই বাক্যটির বা উক্তিটির যথাযথ সার্থকতা রয়েছে। কবি মজিদ মাহমুদও এই বাক্যের উপযুক্ততা দেখিয়েছেন তার কবিতায়। কবির শক্তিমান অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ কবিতার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন।


আশির দশকে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হওয়া কবি মজিদ মাহমুদ আলো ছড়াচ্ছেন মননশীল গবেষণা কর্মে। উপন্যাস ও প্রবন্ধ লেখায় কবির সিদ্ধহস্ত রয়েছে। চল্লিশের অধিক প্রকাশিত গ্রন্থ নিয়ে কবির বাংলা সাহিত্যে বর্তমান ভরবেগ চোখে পড়ার মতো কবি লিখে যাচ্ছেন অবিচল, আপন নিভৃতির জগতে বসে কবিতা লিখছেন। কোনো উচ্চ আকাক্সক্ষার মশাল হাতে নিজেকে বিস্তৃত করার মনোবাসনাকে ডানা মেলে উড়িয়ে দেননি; জীবনের সরলতা মূল্যায়নে কবিতার স্তবক পাঠকের কাছে সমাদৃত হোক এই বাসনায় কবিতা রচনা করে যাচ্ছেন তিনি। নিজস্ব বলয়ের বাইরে দুর্গম পথের দিকে তার গতি নয়। তার কবিতার যথার্থ মূল্যায়ন হোক এ লক্ষ্যে আত্মমগ্ন থেকেছেন একাগ্র চিত্তে। তিনি দার্শনিক অনুভূতি ভাগাভাগি করেছেন, পাঠকসমাজে রচনা করেছেন ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’ (২০১২)।


২০১২ সালে প্রকাশিত মজিদ মাহমুদের সুপরিচিত কবিতাগ্রন্থের নাম “দেওয়ান-ই-মজিদ”। এ গ্রন্থে তিনি দিওয়ানা চরিত্রের অধিকারী। প্রেমে পাগল মজিদ পার্থিব জীবনের সকল মায়া ত্যাগ করে তিতিক্ষা করেন স্বর্গে যাবার। তার অকৃত্রিম দর্শনানুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটিয়েছেন ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’ গ্রন্থে। প্রেমের মূল্য বোঝার সাধ্য সবার হয় না। খোদা প্রেমে মশগুল কবি মজিদ কবিতায় খোদার প্রতি ভীরুতার চিহ্ন প্রকাশ করেছেন। কবি মজিদ মাহমুদ বলেছেন,“মরনে হয় চির প্রশান্তি; প্রতীক্ষায় প্রাণ করে টিকটিক; অস্থির যারা করে অহেতুক অপেক্ষা ভীতি”। বোধিবৃক্ষের তলে বসে তুমি মৈথুন করো প্রিয়ার স্মৃতি। আধ্যাত্মিক জগতে নিজেকে সমর্পণ করে কবির কবিতা রচনা যেন সরল খোদা প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। আত্মার প্রশান্তিতে স্্রষ্টাকে ছুঁতে চাওয়ার প্রবণতা দেখা মিলেছে কবির কবিতায়। ক-জনা এ সন্ধানে নিজেকে ফেলে দেয়? লোক দেখানো অবয়বে নিজেকে সঁপে অভিনয় করা মানুষের সংখ্যা অত্যাধিক। এই মানুষেরা নিকৃষ্ট পাপাচারে লিপ্ত অন্যায় থেকে মুক্তি পেতে আর তাঁর পরিশুদ্ধতা বৈ অন্য সরণি হয়ে মুক্তি মেলা ভার। কবি মজিদ মাহমুদ তার কবিতাগ্রন্থ ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’ এ পবিত্র প্রেমের জয়গান গেয়েছেন। অবলীলায় তিনি তার কবিতাপটে পবিত্র প্রেমের ছবি এঁকেছেন। এখানে কয়েকটি কবিতা আলোচনা করা যেতে পারে।


চির-বিবাহিত
এই কবিতার মধ্যে কবি মজিদ মাহমুদ বলেন, “আমি তো অক্ষম, দেহের সুখ আমার নয়!” কবি এ কবিতায় উল্লেখ করেছেন চিন্তা-চেতনায় যিনি শূন্য দেহ বিহীন, প্রেম তার জন্য নয়; ধ্যান ছাড়া খোদাকে পাওয়া সম্ভব নয়। খোদার সাথে মানবের প্রেম লাইলি-মজনুর প্রেমের মত নয়। ‘চিরবিবাহিত’ কবিতায় কবি নিজেকে বধুবিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। সঙ্গবিহীন বিচ্ছেদে যৌবনকাল কাটিয়ে দেয়া কবি দেহের চাহিদাকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। সত্যিই তো আত্মার পরম শান্তিতে স্বীয় কাম প্রবণতাকে ঢেকে ফেলতে হবে মোরাকাবায়। ধ্যান, চিন্তা, ভাবের পৃথিবী শূন্য করে কখনো খোদাকে পাওয়া যাবে না। দুনিয়াবি রুটিনের চরম হেসেলে দার্শনিকতার সন্ধান মেলে না। দর্শন বৈ চিনবে কেমন করে তারে। তিনি তো মোরাকাবার শেষ প্রান্তে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে লীলায় মগ্ন আছেন অনন্তকাল।

মহানৃত্য
যারা দুর্বল লঘু চিত্তের 
কিংবা আছে হার্টের অসুখ 
ঘরে তালা দিয়ে থাকুক তারা 
এই আসরে না আসুক।।


হাওয়ার দোলনাচলে যাদের হৃদয়ের রং পাল্টে যায় তাদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন কবি। কবি ধ্যানের আসরে ভাবের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন একলা, সেখানে সঙ্গী চায়। তবে দুর্বল লঘু চিত্তের কিংবা হার্টের অসুখ-ওয়ালাকে অনুমতি দেননি। হার্টের রোগীরা সুন্দর ইকো সিস্টেমে বিশৃঙ্খলা ঘটায়, ওরা নিজেকে পরিচয় দেয় শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে। শুদ্ধতা যেন ওদের নিত্য সঙ্গী!! ওরে গাধা শুদ্ধতা অবয়বে আসে না, পোশাক আর বাহ্যিক গঠনে চাকচিক্য থাকলেই ভেতরের কয়লা মুছে ফেলা যায় না। কবি মজিদ মাহমুদ বলেন নৃত্যে জাগে মহাবিশ্ব, বহে চলে হেতা, সংগীতে সুর, তুমি কেন আছো ঘরের কোণে, রয়েছে পড়ে অনেক দূর? এ জলসা থেকে কবি তাদেরকে দূর করে দিতে বলেছেন যারা বঞ্চিত করে সুর সঞ্চিত করে ধন-সম্পদ।


বরণ
মানুষের চোখে যা পড়ে না মজিদ মাহমুদ তা দেখতে পান। মহাযজ্ঞে ক্ষুদ্র তৃণ বা অনু যা আমরা দেখি না কবি মজিদ মাহমুদের তা আছে জানা। কবি বলেন, “ভেবোনা আমি বঞ্চিত হব ঘরে ফেরার এ উৎসবে।” বরণ কবিতার মধ্যে কবি মন্দির ও মসজিদের ইবাদতের উল্লেখ করেছেন। তিনি পার্থিব কর্মকাণ্ডের সকল শ্রেণির চিত্র এঁকেছেন এই কবিতায়। কবি ঐসব দলে নিজেকে সঁপে দিতে চান না। তিনি চক্ষু দিয়ে ক্ষুদ্রতৃণ বা অনু দেখেন যা সবাই দেখেনা। কবির কন্ঠে আত্মবিশ্বাসের সুর ঝরে, বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সক্রিয় লোকেদের বলেন, “ভেবোনা মজিদ বঞ্চিত হবে এই দুনিয়ার কোন অভিসারে নিশ্চয়ই তার বরণ হবে।”

জলন
জল কবিতায় কবি বলেন বাতাস পানির মহামিলন এ দুনিয়ার আসল রূপ। কবির উচ্চ বাক্যে লেখা আধ্যাত্মিক চেতনার মিশ্রণে এই কবিতায় জলের অবস্থান ভেদে ভিন্ন রূপের বর্ণনা করেছেন। তিনি জলের বর্ণনার পাশাপাশি প্রশ্ন শুনেছেন, সাধারণ মনে সরাবকে জলের আরেক রূপ বলে চিহ্নিত করে সাকিকে চুপ থাকতে বলেছেন।

দিওয়ান
‘দিওয়ান’ কবিতায় কবি প্রথম দিকে লাইনগুলোতে ভাবের সৃষ্টি করেছেন। সাধারণ কিছু বর্ণনার দ্বারা জীবনের পরিচয় দিয়েছেন। একাকি দেওয়ান বুঝতে পারে না সে কার। দেওয়ান অসংখ্য বন্ধু জোটাচ্ছে, ফ্যাশন-ব্যাসন মার্জিত নয়, যেমন ইচ্ছে তেমন বন্ধু জুটিয়ে নিচ্ছে। কেউ চাচা ডাকে, কেউ বুড্ডা লোক। কবি মজিদ মাহমুদ শেষের লাইনগুলোতে ভাবের পরিণতি টেনেছেন। উনি বলেন, “এসব ছোকরা আজকে আছে কালকে ঠিক অন্য নারী খুঁজবে মাংস যাহার অধিক।”
“দেওয়ান-ই-মজিদ” কবিতাগ্রন্থে কবি আরো লিখেছেন উপেক্ষা, বিগত, কবিতা, সহমরণ, সরাব-সাকি, প্রিয়ার স্মৃতি সূরা ও সাকি, খল, বিষন্ন দিন, আজান,  হাফিজ-১, হাফিজ-২, মদ-মাতাল, ভিক্ষুক, বিহঙ্গ, ফুলের ভাজে, খাস-কামরা, মদ ছাড়া, অভিসম্পাত, গুড়েবালি, অন্বেষণ, কামনা, কাব্য কলা  নামে কবিতা। কবি তার কবিতায় সাধারণ আর অসাধারণের পার্থক্য আঁকার বৃহৎ চেষ্টা করেছেন। তিনি সফল হয়েছেন বলে আমি মনে করি। কবির এ চেতনা সাধারণের বুঝতে অসুবিধা হবে। সাধারণেরা নির্দিষ্ট লেবাসে ধর্মকে আটকে ফেলে। তবে ধর্ম নির্দিষ্ট লেবাসে নয় ধর্মের অবস্থান আত্মায়, ধর্মের প্রকাশ চরিত্রে। ধর্মকে যিনি ধারণ করবেন তিনিই ধার্মিক। কবি মজিদ মাহমুদ দুনিয়ার চাক্ষুষ কাঠামোকে তার কবিতায় হেয় করেছেন, এমন হীন কাঠামো থেকে বের হয়ে সঠিক পথ বাতলিয়েছেন। তিনি পবিত্র রাস্তায় হাঁটার আহ্বান জানিয়েছেন। আত্মার পরিশুদ্ধতায় জোর দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পবিত্র করতে চায়, পরিশুদ্ধ করতে চায়। আত্মশুদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে পরকালে শাস্তি বৈ শান্তি পাওয়া যাবে না। সেই সফলকাম যে শুদ্ধ অন্তঃকরণে দুনিয়া ত্যাগ করে আখিরাতে গমন করবে।
 

Post a Comment

0 Comments