আব্দুর রাজজাক বকুল এর গল্প

The story of Abdur Razak Bakul SHODH




রাতে ভাল ঘুম হয়নি রাখালের। মাঝরাতের দিকে কি একটা ভৌতিক স্বপ্ন দেখেছে। কি স্বপ্ন দেখেছে তা ভাল করে মনেও নেই ওর। তবে এতে সে ভয় পেয়েছে ভীষণ। স্বপ্ন ভাঙ্গার সাথে সাথে ঘুমটাও ভেঙ্গে গেছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলে শরীরে হাত দিয়ে দেখেছে স্রোতের মতো ঘাম নামছে সেখান থেকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলো। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে কলসি থেকে দু’গ্লাস জল ঢেলে এক নিঃশ্বাসেই সাবাড় করেছে রাখাল। এরপর আর ঘুমানোর সাহস হয়নি ওর। ঘুমোলে যদি আবার সেই দুঃসহ স্বপ্নটা দেখে!

রাখালের বয়স চব্বিশ। লম্বা, তাগড়া দশাসহ শরীর ওর। সিংহের মতো শক্তি শরীরে। এই শরীরে এতো শক্তির উৎস খুঁজে খুঁজে পেরেশান গ্রামের লোকজন। বাম কাঁধে আড়াইমন ওজনের পাটের ভার তুলে যখন থপ থপ করে মাটি কাঁপিয়ে হাঁটে তখন ওর শরীরের মাংসপেশী গুলো ফুঁসে ওঠে। রাখালের শরীরটা তখন তাকিয়ে দেখার মতোই দৃশ্য হয়ে যায়। 
সংসারে রাখাল একা। বড়ই হতভাগ্য সে, পোড়া কপালে। তিন কূলে এখন আর আপন বলতে কেউ নেই ওর। ওকে জন্ম দিতে গিয়ে পরপারে পাড়ি জমাল ওর মা মরজিনা বেওয়া। বাবা ছিল ওর শেষ আশ্রয়। মা মারা যাবার পর বাবাই ওকে বড় করেছিল কোলে পিঠে করে। জমিদার বাড়ির বান্ধা চাকর ছিল রাখালের বাবা আলাদ্দিন। তখন সবে বারোতে পড়েছে রাখাল। টেনেটুনে পাঁচ ক্লাশ পাশ দিয়েছে। একদিন কাকডাকা ভোরে কে একজন এসে খবর দিল, রাখালের বাপ উজানকান্দি চরের ওপর মরে পড়ে আছে। গ্রাম ভেঙ্গে শত শত লোক দেখতে গেল। রাখালও গেল সেখানে। রাখালের বাবাকে কারা যেন খুন করে ফেলে রেখে গেছে চরের ওপর। সারা শরীরে রক্তের বন্য। বুক, পিঠের এপাশে ওপাশে গন্ডা তিনেক ছুরি দিয়ে খোঁচানোর চিহ্ন। সেই থেকে রাখাল একা। 
গ্রামের লোকজন রাখালের বাবার খুনের বিচার করল না। দশ ক্রোশ দূরের থানা থেকে নৌকায় করে ডজন খানেক পুলিশ এল সন্ধ্যের আগে। ভূঁড়িওয়ালা দারোগা এল। জমিদারের চামচা খবির উদ্দিন দারোগাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কানপড়া দিল। জমিদার বাড়ির আঙ্গিনায় দু’দুটো তাজা পাঁঠা জবাই করা হল। সেখানে রাতভর চলল ভূঁড়ি ভোজন, মদ আর বাইজি নৃত্য। ভোর হবার সাথে সাথে পুলিশেরা খুশি হয়ে বিদায় নিল গ্রাম থেকে। রাতে জমিদার বাড়িতে ভূঁড়ি ভোজনের আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা করে গেল তারা। রাখালের বাপের খুনের উপযুক্ত বিচার করবে বলে ঘোষণাও দিয়ে গেল গ্রামের লোকজনের সামনে। সেই বিচার আজও হয় নি। জমিদার বাড়ির তাজা পাঠার রক্তে ভেসে গেল উজানকান্দি চরের বালু। মুছে গেল রাখালের বাবার রক্তের দাগ। 
বাবা বেঁচে থাকতে এক রকম ভালই চলছিল রাখালের। দু’খানি আদান ধানী জমি ছিল ওদের। তাই দিয়ে বারো মাসের ভাত জুটতো বাপ ছেলের। বাকী তরিতরকারীর পয়সা ওর বাবা জোগাতো জমিদার বাড়িতে চাকরগিরি করে। দিনমান কাজ করে বাবা আসতো সন্ধ্যের পর। লম্প জ্বালিয়ে খুপচির ছাপড়া বেড়ার ঘরের মধ্যে তখন বিড়বিড় করে একাকি ক্লাসের পড়া পড়তো রাখাল। বাবা এসে চাল চড়াতো পাতিলে। রান্না শেষ করে বাপ ছেলে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তো। রাখালকে অনেক রাত অব্দি গল্প শোনাতো ওর বাবা। বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখতো সারারাত। রাখালকে ভাল করে লেখাপড়া করতে বলতো। বলতো, লেখাপড়া কইরা একদিন অনেক বড় পাশ দিবি, বড় চাকরি করবি। তখন আমাগো আর কোন দুঃখু থাকবো না বাজান। 
রাখাল ওর বাবার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতো। ওর বুকেও স্বপ্ন ছিল একদিন অনেক বড় হবে। কিন্তু বধি বাম। রাখালের বাবাকে লোকজন দিয়ে খুন করিয়ে আদান জমিটুকু কব্জা করেছে জমিদার। রাখাল এখন এতিম। 
রাখালের জন্মের সময় ওর মা কঠিন যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। মহিষের একটা গাড়ির অভাবে রাখালের মাকে গঞ্জের হাসপাতালে নেয়া যায়নি। অথচ জমিদার বাড়ির আঙ্গিনায় তখন দু’দুটো মহিষের গাড়ি পড়েই ছিল। রাখালের বাবা জমিদারের অনেক হাতে পায়ে ধরলেও নিষ্ঠুর, পাষাণ জমিদারের মন গলেনি তখন। রাখালের মা’কে হাসপাতালে নেয়র জন্য একখান মহিষের গাড়ি কিছুতেই দেননি তিনি। সময়মতো চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে রাখালের মা রাখালকে জন্ম দিতে গিয়ে। এসব কাহিনী দিনে দিনে ঠিকই জেনে ফেলেছে রাখাল। পরে বাবার মতো রাখালকেও চাকরের চাকরি দিয়েছে জমিদার। সবই জমিদারের পরিকল্পিত সূক্ষè চক্রান্ত। বড় হয়ে রাখাল ঠিকই ধরে ফেলেছে এসব। 
লোকে বলে হ্যাবলা রাখাল। মাথা মোটা, বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারেই কম। ও কেবল দিনরাত গরুর মতো খাটতেই জানে। দশ কথায় রা নেই। কেউ বকাঝকা করলে চোখ দুটো শুধু পিটপিট করে। উত্তর দেয় না। এসব ভেবে অবশ্য জমিদারও নিজের বাড়িতে কাজ দিয়েছে রাখালকে। 
কিন্তু রাখালকে নিয়ে লোকজন যত রকম কথাই ভাবুক না কেন, সে আসলে অন্য ধাঁচের মানুষ। পাঁচ ক্লাশ পাশের পর ওর আর লেখাপড়া হয়নি সত্য, কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাখাল ঠিকই চালাক চতুর। মুখোশের আড়ালে রাখাল অন্য মানুষ। পাঁচ গ্রামের মানুষের যাবতীয় কর্মকান্ড, জমিদারের যাবতীয় অন্যায় অবিচারের কাহিনী ওর নখদপর্ণে। বাইরে থেকে নিজেকে বুঝতে দিতে রাজি না রাখাল। ও আছে কেবল সুযোগের অপেক্ষায়। পিতৃহত্যার শোধ নিতে না পারলে ওর বাবার রক্ত যে শান্ত হবে না। 
তখনও ভোর হয়নি পুরোপুরি। আবছা অন্ধকারে ঢাকা চারিদিক। ঘুম ভাঙ্গা পাখিদের কিচির মিচির। ভোরের মৃদু মন্দ বাতাস জানালা দিয়ে শিরশির করে প্রবেশ করছে ঘরে। চৌকির ধারে পা ঝুলিয়ে অনেকক্ষণ এক মনে কি যেন ভাবছিল রাখাল। ঘরের কপাট খোলাই ছিল। আস্তে করে কপাট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে বিজলী। এই আবছা অন্ধকারে একনজরে বিজলীকে চিনতে মোটেও কষ্ট হয় না রাখালের । বিজলীর চোখ দুটো চকচক করছে। ওর সমস্ত মুখ হাসি হাসি। ভোর রাতে নতুন শাড়ি পরে সাজাগোজ করে এসেছে বিজলী। ওর শ্যামলা শরীর থেকে সস্তা পারফিউমের গন্ধ বের হচ্ছে। এই সাত ভোরে বিজলী কিভাবে এতো সাজগোজ করল ভেবে পায় না রাখাল। বিজলীর ক্ষেত্রে এ ঘটনা নতুন কিছু না। মাঝে মধ্যেই বিজলী চুপি চুপি এভাবে আসে রাখালের ঘরে। প্রাণ খুলে কিছুক্ষণ গল্প করে দুজনে। হাসাহাসি করে। আর কি সব করে বোঝা যায় না। আকাশ ফর্সা হবার আগেই বাড়ি চলে যায় বিজলী। লোকলজ্জার বালাই নেই মেয়েটার। এভাবে রাতের আঁধারে চুরি করে ওর ঘরে আসতে বিজলীকে অনেকবার বারণ করেছে রাখাল। বিজলী তাতে কান দেয় না। বড় অভিমানী, বড় জেদী মেয়ে বিজলী। 
বিজলীকে দেখে কোন রকম ভাবান্তর হয় না রাখালের। একটু আকর্ষনও বোধ করে না। মাঝরাত থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে রাখালের মনটা। আগের মতোই চুপচাপ বসে থাকে চৌকির ওপর। ভেতরে ভেতরে বিজলীর ওপর খুব রেগে আছে রাখাল। এই মেয়েটা একটা কেলেংকারী না বাঁধিয়ে ছাড়বে না দেখছি!
বিজলী একগাল হেসে বলে, আইজ কিছু বললা না যে?
মনে মনে গজগজ করে রাখাল, কি কমু, তর কুনো লজ্জা শরম আছে নাহি?
নরম সুর বিজলীর, কি করমু কও, তোমারে না দেইখ্যা থাকতে পারি না যে। সারাডা দিন তো কাছে পাই না। 
দ্যাখা তো অইছে। এবার যা। 
না যামু না। তোমার লগে আমার কিছু কতা আছে। 
কিসের কতা?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে বিজলী। তারপর মাথা নিচু করে ভেজা গলায় বলে, পরশু আমার বিহা। 
এবার নড়ে চড়ে বসে রাখাল। ওর চোখে মুখে বিস্ময়, তর বিহা?
হ। তোমারে কইতে আইছি। মন খারাপ করা কণ্ঠ বিজলীর। 
অ।
আর মনে অয় আমাগো এরকম দেখা অইবো না। 
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাখাল। দীর্ঘশ্বাসটা ওর বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। কিছুই বলে না। 
বিজলীর চোখের কিনারা দিয়ে নোনতা জল গড়িয়ে পড়ে। 
এবার মুখ খোলে রাখাল। নিদারুন কষ্টে চোখ দুটো পিটপিট করে বলে, ভালই অইছে। আমার চাল নাই চুলা নাই। তরে যত্নে রাখতে পারতাম না। ঠিক মতন খাওন দিতে পারতাম না। 
জওয়ান মদ্দা পোলা তুমি। সারাডা দিন মইষের মতন কাম কর। আমাগো খাওন পরনের অভাব অইত না। আসলে তুমি আমারে ভালবাস নাই। 
না রে পাগলি। তর কতা হাছা না। 
আমি সব বুঝি। 
তরে ক্যামনে বিহা করুম ক? তর বাজান বড় লোক। আমার সাথে তর বিহা দিব?
বাজান না দিলে কি অইত, আমরা পালাইয়া যাইতাম?
না রে, তা অয় না। আমি পারুম না। 
এবার খেঁকিয়ে ওঠে বিজলী, তা পারবা ক্যান? সারাজীবন তো হ্যাবলা অইয়াই থাকলা। একবার বুকে সাহস আনলা না। ভীরু, কাপুরুষ!
রাখালের মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হয় না। নিথর বসে থাকে চৌকির ওপর। নীরবে একের পর এক হজম করতে থাকে বিজলীর আক্রমনাত্মক তীর বাক্য। 
আরও কয়েকটা তীর কথা শুনিয়ে বিজলী শেষ বারের মতো ঝড়ের বেগে বের হয়ে যায় রাখালের ঘর থেকে। যাবার আগে বলে যায়, আর কখনও রাতের আঁধারে আসবে না সে রাখালের ঘরে। রাখাল যেন তাকে ভুলে যায়। 
আগের মতোই রাখাল নিথর বসে থাকে চৌকিতে। ওর দুর্বল বুকটা হাহাকার করে ওঠে। মুহূর্তেই বিশাল পৃথিবীটা ফাঁকা মরুদ্যান মনে হয় ওর কাছে। বিজলীকে হঠাৎ এভাবে হারিয়ে আবার নতুন করে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়। বড় কষ্ট হয় বিজলীর জন্য। ভীষণ কষ্ট হয়। 
হাত মুখ ধুয়ে মন ভার করে উত্তর দিকের জমিদার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে রাখাল। রাখালের গা খালি। ঘাড়ে একটা আধছেঁড়া আধময়লা গামছা। পরনের লুঙ্গিটাও আধময়লা। শীতে বা গরমে রাখাল সাধারণত খালি গায়েই চলাফেরা করে। হাঁটা চলার সময় দূর থেকে পোদ্দার বাড়ি আর খন্দকার বাড়ির যুবতী মেয়েগুলো ওর লোমশ শরীরের দিকে নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বুকের মধ্যে গর্ব গর্ব একটা ভাব ওঠে তখন রাখালের। 
জমিদার বাড়িতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বেলাটা পুরোটা উঠে যায় পুব আকাশে। দরজা পার হয়ে ভেতরে উঁকি দিয়েই হতাশ হয় রাখাল। বিশাল বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। কোন প্রাণীই নেই আশেপাশে। অবশ্য না থাকারই কথা। এতো বড় একটা বাড়ি অথচ সদস্য সংখ্যা মোটে ছয়জন। জমিদার আর তার স্ত্রী। বাকি চারজন কাজের লোক। রাখাল এ বাড়ির সদস্য না বটে, তবে এ বাড়িতে তার অধিকার অনেক খানি। দীর্ঘ বারো বছর ধরে যুক্ত সে এ বাড়ির সাথে।
 জমিদারের বয়স এখন ষাটের কাছাকাছি। তিনি প্রথম বিয়ে করেছিলেন পঁয়ত্রিশ বছর আগে। এর পরের দু’বিয়ে মাত্র কয়েক বছরের ব্যাবধানে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও তার ঘরে কোন সন্তান হয়নি। এটা জমিদারের জীবনে সবচেয়ে বড় অতৃপ্তি, বড় কষ্টের ঘটনা। তার প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন পক্ষাঘাতে। পরের এক স্ত্রী আত্নহত্যা করেছে। অপর জন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। এতেও ক্ষান্ত হননি জমিদার। মাত্র একটা সন্তানের আশায় এ বৃদ্ধ বয়সেও বিয়ে করেছেন আরও একটা। সে প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল। জমিদারের নতুন পত্নীর নাম নূরী। নূরী একদম কাঁচা মেয়ে। আঠারোর বেশি হবে না ওর বয়স। দুধে আলতায় চেহারা নূরীর। দেখতে ছোট্ট একখান পরীর বাচ্চার মতো। তিন ক্রোশ দূরে নূরীর বাপের বাড়ি। নূরীর বাপকে পাঁচ একর ধানী জমি লিখিয়ে দিয়ে নূরীকে চিরদিনের মতো কব্জা করেছে শয়তান জমিদার। ফুলের মতো মেয়ে নূরী। বিয়ের আগে এপাড়া ওপাড়া দৌড়ে বেড়াত হি হি করে। সেই বয়সেই বুড়ো জমিদারের সাথে হুট করে বিয়ে হয়ে গেল ওর। জমিদার বাড়িতে যেন ওর নরম কোমল দুপায়ে লোহার শিকল পরিয়ে দেয়া হল। এখন হাজার প্রয়োজনেও বাইরে বেরুনোর সামান্যতম সুযোগ নেই নূরীর। 
রাখালকে সাত ভোরে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখে রান্নাঘর থেকে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে সালেহা। সালেহার বয়স ষোল-সতেরো। ছোটবেলা থেকেই এ বাড়িতে আছে ও। ভেজা হাত ওড়নায় মুছে রাখালের সামনে এসে দাঁড়ায় সালেহা। 
সালেহা রাখালের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলে, আইজ এতো ভোরে আইলা যে?
সালেহার এ প্রশ্নে সহসা হোঁচট খায় রাখাল। আসলে কি জন্য রাখাল আজ এ বাড়িতে এত সকালে এসেছে তা সালেহাকে বলা সম্ভব না। সালেহা কেন, কাউকেও বলা সম্ভব না। রাখাল সালেহার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কোন উত্তর করে না। 
জমিদার পত্নী নূরী বেগম ঘুম থেকে জাগে সূর্য ওঠার পর। তখন জমিদার বাড়িতে থাকেন না। ভোর রাতে নদীতে গোসল করে ঘোড়া নিয়ে হাওয়া খেতে যান দূর গেরামে। ফেরেন বেলা চড়ে গেলে। এই সময় নূরী বেগম সালেহাকে সঙ্গে নিয়ে নদীতে যায় গোসল করতে। গোসল সেরে ভেজা শাড়ি ওর টাইট শরীরের এখানে সেখানে জড়িয়ে ঘরে ফেরে নূরী। ওর ফর্সা, টাইট শরীরে সেঁটে থাকে ভেজা পাতলা ফিনফিনে শাড়ি। শাড়ি গলিয়ে নূরীর শরীরের ফর্সা অংশ অনেকখানিই দেখা যায়। গলা, বুক, পেট, নাভী, পিঠ এসব দেখা যায়। শাড়িতে অনভ্যস্ত নূরী শত চেষ্টা করেও পুরো শরীর ঢাকতে পারে না। 
গতকালই প্রথম এ দৃশ্যটা দেখেছিল রাখাল। ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে নদীর ধারে এসেছিল সে। সরু রাস্তার ধারে ঝোপ পার হতেই একেবারে মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল নূরী। নূরীকে ভেজা শাড়িতে এক পলক দেখেই বেহুশ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়েছিল রাখালের। ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল অনেকখানি। কাল নূরীর সাথে সালেহা ছিল না। নূরী ছিল একা। নদীর পাড়ও ছিল জনমানব শূন্য। রাখালের শরীরটা হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠেছিল তখন। অনেক কষ্ট করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে সে। কিন্তু ওর নির্লজ্জ, বেহায়া চোখকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। মিনিট কয়েক খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল নূরীকে। ব্যাপারটা নূরীর কাছে বেশ লজ্জার কারণ হয়েছিল বটে। লজ্জায় জড়সড় হয়ে গিয়েছিল নূরী। কিন্তু রাখালকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন তাড়া লক্ষ্য করা যায়নি নূরীর মধ্যে। বরং নূরীও লাজুক দৃষ্টিতে মিনিট খানেক তাকিয়ে ছিল রাখালের লোমশ পেশিযুক্ত মাংসল শরীরের দিকে। নূরীর ঠোঁট জোড়া অল্প অল্প কাঁপছিল তখন। রাখালের মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনি নূরী। লজ্জায় মরে যাচ্ছিল যেন। সেদিকে খুব একটা খেয়াল ছিল না রাখালের। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নূরীর ফর্সা ভেজা শরীরটার দিকে। এতে অবশ্য নূরী বেগমের বেশ রাগ করার কথা। জমিদার বাড়ির সুন্দরী বউ নূরী। রাখাল সে বাড়ির সামান্য একটা চাকর মাত্র। জমিদার পত্নীর গোসল শেষে ফেরার সময় তার পথের সামনে দাঁড়িয়ে রাখালের এভাবে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করার অপরাধে রাখালকে অপমান অপদস্ত করার কথা। জমিদারকে বলে দিয়ে রাখালকে শাষিয়ে কিংবা পিটিয়ে নেয়ার কথা। অথবা রাখালের গালে কষে একটা ধাপ্পড় মারার কথা। কার্যত এসবের কিছুই হয়নি। রাখালের সমস্ত ধ্যান ধারণাকে পায়ে দলে ঘটনা ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। পাশ কাটিয়ে যাবার সময় রাখালের দিকে নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে একগাল মিষ্টি লাজুক হাসি হেসেছে নূরী। এ হাসির ভাবার্থ মুহূর্তেই ধরে ফেলেছে রাখাল। আর এটাই কাল হয়েছে রাখালের জন্য। নূরীর ভাবনায় সারারাত ঘুমই হয়নি ওর। সাত সকালে ফের সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তির আশায় ছুটে এসেছে জমিদার বাড়িতে। এ ঘটনা কি সালেহাকে বলা যাবে?
সালেহা রাখালকে ধমক দিয়ে বলে, অমন হ্যাবলার মতন তাকাইয়া আছো ক্যান? কও, ক্যান আইজ এতো ভোরে 
আইছো?
সালেহার ধমকে চৈতন্য ফিরে পায় রাখাল। ইতিউতি করতে করতে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে হ্যাবলার মতো বলে, না মাইনে জমিদার হুজুর ঘরে নাই?
জ্বে না। উনি হাওয়া খাইতে গেছেন। 
সালেহার কথায় মনে মনে খুশি হয় রাখাল। বলে, উনার ইস্ত্রী?
উনি ঘরে বইসা আছেন। 
গোসল করতে যান নাই?
রাখালের এ কথাটায় ওর দিকে কটমট করে তাকায় সালেহা। আশ্চর্য হয়ে বলে, গোসল করতে মাইনে?
নিজের ভুল ধরতে পারে রাখাল। শুধরে নিয়ে বলে, না মাইনে উনার তো অহন গোসল করতে যাওনের কতা। 
উনি আইজ গোসল করবেন না। 
গোসল করবেন না ক্যান?
সালেহা হেসে বলে, উনার মন ভালা নাই। 
সালেহার হাসির অর্থ বের করতে পারে না রাখাল। একই ভাবে বলে, মন ভালা নাই ক্যান?
বুইড়ার লগে ঝগড়া অইছে। 
ঝগড়া অইছে ক্যান?
এবার রাখালের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় সালেহা। ঝাঁঝালো গলায় বলে, ক্যান ঝগড়া অইছে তা আমি ক্যামনে কমু? সোয়ামী আর ইস্ত্রীতে ঝগড়া অয় না?
জ্বে অয়। কিন্তুক.....। 
কিন্তুক কি? তোমার জানার দরকার থাকলে তুমি গিয়া জিগাও। তুমি জিগাইতে পারো না?
লজ্জা পায় রাখাল। বলে, ক্যামনে জিগামু, আমি ছ্যালে মানুষ না? আমার শরম করে। 
এবার রেগে যায় সালেহা, সাত সক্কালে আইসা এমন প্যাচাল পাড়তাছো ক্যান? আইচ্ছা উনাগো ক্যান ঝগড়া অইছে হেইডা জানা কি তোমার খুব জরুলী?
হোঁচট খায় রাখাল। না তেমুন জরুলী না। 
তয় চুপ কইরা থাকো। ওই যে দ্যাহো কোদাল, হেইডা নিয়া আমগাছের মুড়োডা তোলো। জমিদার মশাই কইয়া গেছে। বলে হনপন করে চলে যায় সালেহা। 
জমিদার বাড়ির উঠোনটা বেশ বড়। উঠোনের পুব পাশে রান্নাঘর ঘেঁষে একটা প্রকান্ড আমগাছ ছিল। গত বছর বর্ষার সময় আকাশের ডাক পড়ল বুড়ো গাছটার ওপর। ডালপালা পুড়ে ছাই হল। এরপর আর বাঁচল না গাছটা। মাস কয়েক পরে কেটে ফেলা হল ওটাকে। গাছের মুড়োটা রয়ে গেল। গাছটা ছিল বাড়ির সৌন্দর্য। গরমে ছায়া দিত, ঠান্ডা বাতাস দিত। মৌসুমে বস্তা বস্তা আম দিত। 
নূরী বেগম অন্দর মহল থেকে বের হয়ে এসে মন খারাপ করা ভঙ্গিতে বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারটায় বসে। একদৃষ্টিতে রাখালের কোদাল কোপানো দেখে। ওর ঘেমে যাওয়া তেল চিটচিটে পেশিবহুল লোমশ শরীর দেখে। দেখে পুলকিত হয় নূরী বেগম। সেদিকে খেয়াল নেই রাখালের। করিতকর্মা ছেলে সে। যে কোন কাজে ফাঁকিঝুঁকি ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। যে কাজ একবার ধরে তা শেষ না করে যেন শান্তি নেই ওর। শরীরের সমস্ত শক্তি হাতের মুঠোয় জমা করে বিরতিহীন ভাবে সজোরে কোদাল চালাতে থাকে রাখাল। গাছের মরা মুড়োটা মাটি থেকে তুলে আনতে খুব বেশি সময় দিতে রাজি না সে। বিকেলে আরও অনেক কাজ পড়ে আছে।
 
গাছের গোড়ালীর মাটি ছড়াতে ছড়াতে একসময় হাঁপিয়ে ওঠে রাখাল। ওর শরীর থেকে দরদর করে নোনতা ঘাম ঝরে পড়ে মাটিতে। ক্ষুধায় পেটের ভেতরটা জ্বলতে শুরু করে। কিছুটা পেরেশান দেখায় রাখালকে। কোমর থেকে ময়লা গামছাটা খুলে মুখ মোছে। গামছাটা কোমরে বাঁধার আগে বারান্দার দিকে একনজর তাকায় রাখাল। তাকিয়েই চমকে ওঠে। বারান্দায় বসে থাকা নূরী বেগম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রাখাল অবাক হয়। চোখের পলক পড়ছে না নূরীর । রাখালও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নূরী বেগমের দিকে। তারপর হঠাৎ যেন লজ্জা পায় রাখাল। মাথাটা নিচু করে হাত থেকে পড়ে যাওয়া গামছাটা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। গামছাটা কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বারান্দার দিকে আবার একবার তাকায় রাখাল। নূরী বেগম তখনও তাকিয়ে আছে রাখালের দিকে। এবার দু’জনের দৃষ্টি এক হয়ে যায়। শেষবার মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চেয়ার ছেড়ে ভেতরে চলে যায় নূরী বেগম। বুকের ভেতর চিনচিন করতে থাকে রাখালের। আবার কাজে মনযোগ দেয় সে। সজোরে কোদাল চালাতে থাকে। 
একটু পর রাখালের সামনে এসে দাঁড়ায় সালেহা। সালেহা হেসে বলে, তোমার কপালে ফুল চন্দন পড়ছে। 
কোদাল ছেড়ে দিয়ে সালেহার দিকে তাকায় রাখাল, মাইনে?
বিবিসাব তোমারে ঘরে ডাকতাছে। তোমার জইন্যে খাওন লইয়া বইসা রইছে। 
কান দুটো গরম হয়ে যায় রাখালের। সালেহার কথা বিশ্বাস করে না। সালেহা কি তার সাথে ইয়ার্কি করছে? নূরী বেগম তার জন্য খাবার নিয়ে বসে আছে, এর মানে কি? আজতক নূরীর সাথে রাখালের কোন বাক্যালাপ হয়নি। কেবল বার কয়েক তীক্ষè দৃষ্টির আদান প্রদান হয়েছে মাত্র। এতদিন সে খেয়েছে বারান্দায়। মাটিতে বসে। সালেহাই খাবার দিয়ে যেত তাকে। আজ কেন হঠাৎ নূরী বেগম তার জন্য খাবার নিয়ে ডাকবে?
রাখাল বলে, আমার লগে ফাইজলামো করস?
ফাইজলামো করতে যামু ক্যান? বিবিসাব তোমারে যাইতে কইল, তাই কইলাম। 
সালেহার মুখে একথা শোনার পর মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে রাখালের। কোমর থেকে একটানে গামছা খুলে ঘর্মাক্ত শরীরটা মোছে। কলতলায় গিয়ে চোখমুখে পানির ঝাপটা দেয়। হাত পা ধোয়। তারপর সংকোচে ধীরে ধীরে নূরী বেগমের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজার কাছে রাখালের উপস্থিতি টের পায় নূরী। রাখালকে দেখে তার সাদা দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। নূরী ঈষৎ হেসে নিচু গলায় বলে, তোমারে খুউব পেরেশান লাগতাছে। সক্কালে কিছু খাও নাই বুঝি?
রাখাল মাথা নিচু করে বলে, জ্বে না। 
আও ভেতরে আও। তাড়াতাড়ি খাইয়া ফের কামে লাগো। 
রাখাল ইতস্তত করতে থাকে। নূরী তাড়া দিয়ে বলে, আহা খাড়াইয়া রইলা ক্যান? আমারে তোমার খুউব শরম করে?
রাখাল একটু সময় নিয়ে বলে, জ্বে, জ্বে না। 
তাইলে তাড়াতাড়ি আও। আমার ম্যালা কাম আছে। 
লুঙ্গিটা ঝেড়ে মেঝেতে পেতে দেয়া মাদুরে আয়েস করে বসে রাখাল। নূরী বেগম ধবধবে ফর্সা হাতে ওর পাতে গরম ভাত বেড়ে দেয়। পরম যত্নে তরকারি তুলে দেয়। পাতে এটা সেটা তুলে দেয়ার সময় নূরীর হাতের কাঁচের চুড়িগুলো রিনিঝিনি শব্দে বেজে ওঠে। সেদিকে অপলকে চেয়ে থাকে রাখাল। মাঝে মধ্যে তাকায় নূরীর মুখের দিকে। নূরী বেগম তখন হাসে। তৃপ্তিতে খেতে থাকে রাখাল। 
একটু পর নূরী বেগম বলে, ময়নাডাঙ্গা চেন?
ঢোক গিলে পেটের ভেতর ভাত চালান করে দেয় রাখাল। তারপর বলে, আফনের মায়ের বাড়ি?
জ্বে। 
জ্বে না। চিনি না। 
আমার লগে যাইবা?
এইবার বিষম খায় রাখাল। আধগ্লাস পানি গিলে বিষমটা সামাল দেয় কোন মতে। কিছু না বোঝার ভান করে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নূরীর মুখের দিকে। লজ্জা পায় নূরী বেগম। মুখ নিচু করে বলে, কাল মায়ের বাড়ি যামু। অনেক দিন অইল মনডা ভালা যাইতাছে না। জমিদার সাবরে তোমার কতা কইছি। উনি রাজি দিছেন। 
মুখে বড় একটা লোকমা পুরে দেয় রাখাল, আমি ক্যান যামু?
আমার লগে যাইবা। তিন কোরশ রাস্তা। নদী পার অইতে অয়। আমার বয়েস কম। কাঁচা যৌবন। জমিদার সাব একা আমারে যাইতে দিব? তুমি বোঝ না? বলে মুচকি হাসে নূরী। 
এবার ঢোক গেলে রাখাল। নূরী বেগমের চোখের মধ্যে কী একটা ভাষা খুঁজে পায় সে। বুকের ভেতরটা চিন চিন করে উঠে। নিচু গলায় বলে, আমি কিন্তুক বেশি দিন থাকুম না। 
রাখালের সম্মতি পেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠে নূরী বেগমের মুখ মন্ডল। হেসে বলে, তা না থাইকো। আমিও বেশিদিন থাকুম না। এক সপ্তা থাকুম। তারপর আবার আসুম। 
রাখাল সম্মতি দেয়, আইচ্ছা। 
কাল তাইলে তুমি সক্কাল সক্কাল এহানে আইসো। জমিদারের লোকজন আমাগো নদীর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিবো। কি আইবা তো? নূরী বেগমের চোখে আকুতি। কণ্ঠে অধিকারের সুর। 
রাখাল লজ্জিত কণ্ঠে মুখ নিচু করে বলে, জ্বে আসুম।
রাতে শোয়ার সময় স্মৃতির বৃত্ত বেঁধে ফেলে রাখালকে। একযুগ আগে এই জমিদারের লোকরাই মেরে ফেলেছে ওর নিরীহ দেবতুল্য বাবাকে। রাখালের জন্মের সময় ওর মা’র মৃত্যুর নেপথ্যে ছিল ওই জমিদারই। সেই কিশোর বেলায় রাখালকে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়ে ওদের সামান্য জমিন টুকুও কব্জা করেছে পিশাচ জমিদার। সেসব স্মৃতি এখনও ভীষণ যন্ত্রণা দেয় রাখালকে। চোখ বুঁজলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জখম করা তার পিতার রক্তাক্ত লাশ। মুহূর্তেই হিংস্রতায় রূপ পায় রাখালের সহজ সরল মন। প্রতিশোধ স্পৃহায় নিশপিশ করে ওঠে ওর লৌহদন্ডের ন্যায় শক্ত হাত দুটো। ওই শুয়োরের বাচ্চা জমিদারকে কোনদিন ছাড়বে না সে। কালই এ সুযোগ গ্রহণ করবে রাখাল। জমিদারের সুন্দরী পত্নী নূরী বেগমকে মাঝ নদীতে নৌকা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে সে। এই বৃদ্ধ বয়সে এমন সুন্দরী বউকে হারিয়ে নিঃসন্দেহে পথ হারিয়ে ফেলবে জমিদার। হা পিত্যেস করবে। রাখাল তখন দূর থেকে জমিদারের বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করবে। হাসবে। 
পরদিন পশুপাখির ঘুম ভাঙ্গার আগেই জমিদার বাড়িতে এসে হাজির হয় রাখাল। জমিদার পত্নী নূরী বেগমের সম্মোহনী আবেদন তাকে সাতভোরে এ বাড়িতে নিয়ে আসার দ্বিতীয় কারণ জ্ঞান করে সে। এই আবেশে রাতে তার ঘুমই হয়নি ঠিকমতো। নূরী বেগমের সাথে একই নৌকায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে নদী পার হওয়ার রোমাঞ্চিত মুহূর্তের অনুভব চিন্তা করতে করতেই পার হয়ে গেছে পুরো রাতটা। জ্বলা চোখে এসে রাখাল হাজির হয়েছে জমিদার বাড়ির আঙ্গিনায়।
দরজার সিটকিনি খোলার শব্দ হয় খট করে। সেদিকে নজর যায় রাখালের। চোখ দুটো চকচক করে ওঠে তার। কারণ, দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসে নূরী বেগম। এই সাতভোরেও নূরীর চোখ মুখ ঝরঝরে। সামান্য ঘুম জড়ানো ভাবটাও নেই ওর চেহারায় । উঠোনে রাখালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঈষৎ মুচকি হাসে নূরী। এক পা দু পা করে রাখালের সামনে এসে দাঁড়ায়। রাখাল লজ্জায় মুখ নিচু করে। সারা বাড়িতে পিনপতন নিরবতা। এ বাড়ির কেউ জাগেনি এই সাত সকালে।
নূরী বেগম হেসে বলে, এই ভোর সক্কালে আইছো?
কতো সক্কালে আইতে অইবো, আপনে তো কন নাই। তাই......। মৃদু কণ্ঠে উত্তর দেয় রাখাল। 
আবার হেসে ফেলে নূরী, এমুন ময়লা জামা কাপড় পইরা আইছো ক্যান? পরিষ্কার জামা কাপড় নাই?
আছে। ধুয়ার সময় পাই নাই। আপনে হুট কইরা সিদ্ধান্ত দিলেন....। 
হাসি মুখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে নূরী। তারপর বলে, আইচ্ছা, তুমি ওই মোড়াডায় বসো। সূর্য ওঠার আগে তো বাইর হওন যাইবো না।
 
সূর্য ওঠার অনেক পরে বাপের বাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে বের হয় নূরী বেগম। দরজার বাইরে দুটো ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়ানো। একটায় ওঠে নূরী বেগম। অন্যটাতে রাখালসহ জমিদারের আরও দু’জন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রহরী। নিরাপত্তা প্রহরী দুজন যাবে নৌকা ঘাট পর্যন্ত। সেখানে নৌকা ভাড়া করে রাখা হয়েছে। নূরী ও রাখালকে নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে তারা ফিরতি পথ ধরবে। নদীর ওপারে যাবার দরকার নেই তাদের। ওপার থেকে নূরীর বাপের এলাকা শুরু। রাস্তা ও মানুষজন সবই চেনা। এটাই সুবিধা।
গাড়ি ছাড়ার আগে জমিদার সাহেব মুখে একরাশ বিরক্তি এনে রাখালকে বলেন, সালেহা থাকতে বিবি তরে ক্যান নিতাছে বুঝতাছি না। শোন, বিবির মেজাজ মর্জি খুউব খারাপ। ওর লগে কোন কতা কবি না। যা কয় শুনবি। পরে যদি তর নামে কোন অভিযোগ শুনি, তাইলে কইতাছি তর কপালে মহাবিপদ আছে। তর বাপের মতন অবস্থা অইবো তর। কতাডা মনে রাখিস। যা.....। 
জমিদারের শেষ কথাটায় শিরদাঁড়া খাঁড়া হয়ে ওঠে রাখালের। রক্তের গতি বেড়ে যায় মুহূর্তেই। হাত পা নিশপিশ করে। ইচ্ছে করে কষে এক লাথি মেরে ফেলে দেয় বুড়োটাকে। তা করে না রাখাল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেয়। এখন মাথা গরম করতে রাজি না সে। প্রতিশোধ নিতে তো সে বেরিয়েছেই। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। নৌকা মাঝ নদীতে এলেই হল। একটা মাত্র ধাক্কা। ব্যাস.......। 
নূরী ও রাখালকে নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে বিদায় নেয় দু’জন নিরাপত্তা প্রহরী। যাবার আগে মাঝিকে বলে যায়, দেইখা শুইনা যাইও মিয়া। আকাশের অবস্থা খুউব একটা সুবিধার না। বাতাস অইতাছে। সাবধানে যাইও। নূরী বেগম আর রাখালকেও একই কথা বলে চলে যায় ওরা। 
নৌকাটা খুব ছোট। ছইওয়ালা। এই নৌকায় পাঁচ ছয় জনের বেশি ধরবে না। মাঝির দিকের ছইয়ের খোলা মুখে কাপড় টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে। সাঁ সাঁ বাতাস ছাড়া এই কাপড় পড়ে যাবার সম্ভবনা কম। গলুই থেকে মাঝি নূরীকেও দেখতে পারবে না। 
পা মুড়িয়ে ছইয়ের ভেতরে চুপচাপ বসে আছে নূরী। মাঝে একটু জায়গা রেখে অন্য গলুইয়ের কাছে বসেছে রাখাল। এতো ছোট নৌকা। ঢেউ আর বাতাসের তাড়নায় হেলছে দুলছে। হুট করে উল্টে যাবে না তো? এটা হলে অবশ্য লোকসানের চেয়ে লাভই হবে রাখালের। সে নিজে খুব ভাল সাঁতার জানে। ঝাঁপিয়ে কোন এক কিনারে ঠিকই গিয়ে উঠতে পারবে। পারবে না কেবল নূরী বেগম। নূরী বেগম সাঁতার জানে না। এই খরস্রোতা নদীতে পড়লে কিছুতেই নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না সে। মাঝিও রাজি হবে না নিজের জীবনকে বিপন্ন করে নূরীকে রক্ষা করতে। নিশ্চিত ডুবে মারা পড়বে নূরী। এটা হলে লাভই হবে রাখালের। নূরী মরার অপরাধে তার পাপের পাল্লা ভারী হবে না। উপরন্তু পিতৃহত্যার শোধ নেয়াটাও হয়ে যাবে। 
কিনার থেকে অনেক দূর এসে নদীর মাঝপথ দিয়ে হেলেদুলে এগোতে থাকে ওদের নৌকা। মাঝি সাবধানী বাণী দেয়, আফনেরা কইলাম চুপ কইরা বইসা থাকেন গা। একদম নড়াচড়া কইরেন না। বড় বড় ঢেউ উঠতিছে। বাতাস উঠতিছে। আফনেরা কইলাম ডরাইয়েন না। 
নূরী বেগমের দিকে তাকায় রাখাল। আজ খুব যত্ন করে সেজেছে নূরী। দুধে আলতায় আঁটশাঁট শরীর ওর। গাল দুটো পাকা আপেলের মতো টসটসে। লাল শাড়িতে সাক্ষাত পরীর মতো লাগছে দেখতে। আঠারো বছরের বাড়ন্ত দেহ ওর। এখনও চোখে মুখে তারুণ্যের ছাপ স্পষ্ট। এই মেয়ের বিয়ে হয়েছে ছ’মাস আগে। কে বিশ্বাস করবে? 
হঠাৎ করে চোখাচোখি হয় রাখাল আর নূরীর। হেসে ফেলে নূরী। সে হাসির অর্থ অন্য রকম। দুধের ন্যায় দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে বিজলীর মতো। নূরীর হাসি রাখালের বুকে আগুন ধরায়। ভেতরটা কামনায় চিনচিন করে ওঠে। একটা ঢোক গেলে রাখাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে--ইস্ এরকম একটা সুন্দরী বউ যদি তার থাকতো! 
রাখাল নূরীর ওপর থেকে দৃষ্টি নামায় না। অসভ্যের মতো ওকে দেখে। নূরীর হাত, কোমর, পেট, গলা, বুক পর্যবেক্ষণ করে। দখিনা বাতাসে স্নো পাউডারের কড়কড়ে গন্ধ আসে রাখালের নাকে। সে গন্ধ বুঁদ করে ফেলে রাখালকে। 
রাখালকে অবাক করে দিয়ে নূরী বলে, অত দূরে বইছো ক্যান? কাছে আসো।
নূরীর কথায় রাখালের বুক ধ্বক ধ্বক করে ওঠে। লজ্জা পায় ঈষৎ। মৃদু কণ্ঠে বলে, না অসুবিধা নাই। 
আহা আসো না, ওই দিকে তো খুউব বাতাস। তোমার ঠান্ডা লাগবো। 
আমার ঠান্ডা লাগে না। 
তাইলে কাছে আসো, আসো তো। 
রাখাল কাছে আসে না। পাথর হয়ে বসে থাকে গলুই এর কাছে। নূরী কি বলছে এসব? ওর কাছে গিয়ে বসতে হবে কেন? নূরীর এ আহবান কিসের ইঙ্গিত?
গতকাল থেকেই নূরীর কথাবার্তা, আচার অস্বাভাবিক ঠেকছে রাখালের কাছে। নূরী কোন উদ্দেশ্যে রাখালকে আজ সঙ্গে নিয়েছে তা বুঝতে পারেনি রাখাল। এটা বোঝার দরকারও নেই রাখালের । তার দরকার শোধ। পিতৃহত্যার শোধ। নূরীকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিয়ে সেই কর্মটিই রাখাল আজ সারবে সবার আগে। 
নৌকা মাঝ নদীতে এসে পড়েছে। আশপাশে কোন নৌকা বা মানুষ নেই। এখনই মোক্ষম সময় নূরীকে নদীতে ফেলে দেয়ার। মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাখাল। 
নূরীর জন্য কষ্ট হতে থাকে রাখালের। নূরী নিষ্পাপ মেয়ে। যেমন রূপবতী তেমনি আগুন বয়স ওর। আচার ব্যাবহার অত্যন্ত মধুর। রাখালের পিতৃহত্যার সাথে ছিঁটে ফোঁটাও সম্পৃক্ততা নেই নূরীর। তবু নিষ্ঠুর জমিদারের পাপের কারণে নূরীকে ওর মহামূল্যবান প্রাণটা দিতে হবে। জমিদারকে তিলে তিলে নিঃশেষ করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এটা ছাড়া আর কোন সহজ পথ জানা নেই রাখালের। নিজের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে অন্য কেউ যদি এর সাথে কাকতালীয় ভাবে জড়িয়ে যায়, তাতে কিছুই করার নেই ওর। প্রতিশোধের এমন অনুকূল সুযোগ কিছুতেই নষ্ট করতে রাজি না সে । মনকে শক্ত করতে থাকে রাখাল। সিদ্ধান্ত নেয় নৌকার দুলুনিতে ছল করে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেবে নূরীকে। নিজেও ঝাঁপ দিয়ে কিনারে গিয়ে উঠবে। 
রাখালের পাথর হয়ে বসে থাকা দেখে নৌকার ভেতর থেকে উঠে এসে ওর শরীর ঘেঁষে বসে নূরী। মন খারাপ করা সুরে বলে, তোমারে খুউব চিন্তাযুক্ত লাগতাছে। কি ভাবো অত?
কৃত্রিম হাসি দেয় রাখাল, না কিছু না। এমনি। 
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে নূরী। কি যেন চিন্তা করে একমনে। তারপর অকস্মাৎ খপ করে রাখালের একটা হাত চেপে ধরে। কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আমারে তোমার ভালা লাগে না, কও?
বিস্মিত হয় রাখাল নূরীর এ প্রশ্নে। নূরীর এরকম ব্যাবহারে লজ্জিত কণ্ঠে বলে, জ্বে লাগে। এমুন পরীর মতন মাইয়া আপনে, কার না ভালা লাগবো?
প্রতিবাদ করে নূরী, আমারে আপনি কইরা কইবা না। তুমি কইরা কইবা।
নূরীর হাতের মধ্যে রাখালের হাত অস্থির হয়ে ওঠে। ওর হাতটা নিয়ে লুকোচুরি খেলতে থাকে নূরী। রক্তের গতি বেড়ে যায় রাখালের। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নেয় সে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলে, জ্বে কমু। 
তোমারে আমি ক্যান সঙ্গে লইছি জানো?
জ্বে না। জানি না। 
রাখালের কানের কাছে মুখ আনে নূরী। উত্তেজনায় ফোঁস ফোঁস করে বলে, আমারে একখান সন্তান দিবা। পারবা না? বলেই খিল খিল করে হেসে ফেলে নূরী। 
চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয় রাখালের, কি কইলেন?
জমিদার সাব বুইড়া মানুষ। উনার সাথে শুইতে আমার ভালা লাগে না। উনার অহন সন্তান দেওনের ক্ষেমতা নাই। বুইড়ার ভয়ংকর একটা অসুখ অইছে। যক্ষা। মুখ দিয়া রক্ত পড়ে। কখন যে মরবো কে জানে। বুইড়া মরলে আমারে দেখবো কে? কে আমারে বিহা করবো? আমি বাঁচুম কি নিয়া?
নূরী বেগমের গলা ধরে আসে। চোখ দুটো জলে ছলছল করে ওঠে। খুব আত্নবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে রাখালের মুখের দিকে। 
রাখাল কিছুক্ষণ চিন্তা করে ঠান্ডা গলায় বলে, হেইডা ক্যামনে সম্ভব?
সম্ভব, খুউব সম্ভব। আমার সন্তান অইলে জমিদারের সব সম্পত্তি সেই পাইবো। জমিদার মইরা গেলে তুমি আমারে বিহা করবা। আমরা সুখে শান্তিতে ঘর করুম। কি তুমি রাজি না?
-০-

Post a Comment

0 Comments