উত্তরের হাওয়ায় নোনতা গন্ধ ~ রফিকুল নাজিম

Salty smell in the north wind  ~ Rafiqul Nazim



দা থেকে টুপ টুপ করে মাটিতে রক্ত পড়ছে। লাল টুকটুকে রক্ত মাটিতে পড়েই কালচে হয়ে যাচ্ছে। উপস্থিত সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। পেঁচার চোখের মত করে তাকিয়ে আছে লতার দিকে। লতার ডান হাতে দা। দা'য়ের পিঠে আলো পড়তেই চিকচিক করে ওঠছে। খুব ভালো করে শান দেয়া দা। জন্তু জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য রুস্তম দা'টা ঘরে এনেছিল। সুন্দরবন বলে কথা- মামাদের উৎপাত ভালোই আছে।


২.

একুশ দিন হয়ে গেল রুস্তমের কোনো খোঁজ নাই। মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে গেছে গভীর সমুদ্রে। রুস্তমের সাথে আরো সতেরো জন জেলে গিয়েছে। সবাই বেশ তাগড়া যুবক। রুস্তম সেই ট্রলারের সর্দার। হঠাৎ সাগরে নিম্মচাপ ওঠেছে। নিম্মচাপে সাগরের নোনাজল ফুঁসে ওঠেছে। ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে মানুষগুলোসহ রুস্তমদের ট্রলার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে? কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলছে রুস্তমরা সাগরের পেটে চলে গেছে। কেউ কেউ বলে হয়তো বেঁচে আছে; অন্য কোথাও। লতা আশায় বুক বাঁধে। পশুর নদীর উত্তাল ঢেউ গুনে গুনে তার দিন কাটে। রুস্তমের সাথে তার বিয়ে হয়েছে মাত্র চার মাস তিন হয়। তার বিয়ের মেহেদীর রঙ এখনো নখের শেষ প্রান্তের দৈর্ঘ্যকে অতিক্রম করতে পারেনি! এই চার মাসে কয়দিন আর রুস্তমকে সে বুকে পেয়েছে? একবার মাছ ধরতে গেলে দশ পনেরো দিন চলে যায় সাগরে। তখন কোনো খোঁজখবর থাকে না। মাঝেমধ্যে মোবাইলে নেটওয়ার্ক পেলে দু'একবার মোবাইলে কল দেয় রুস্তম। তাই দিন-রাত লতা তার কোমড়ে গুঁজে রাখে মোবাইল। কখন আবার কল দিয়ে না পায়! তখন রুস্তম খুব রাগ করবে। লোহার মত পেটা শরীর তার। শুধু লতা আর এমন নিশুতিরাত জানে- রুস্তমের বুকের ভেতরটা কেমন কোমল। ঠিক যেন পশুর নদীর জলে ভেজা তীরের মত লুতলুতে। হাঁটতে গেলে কাঁদায় যেমন গেঁথে যায় পা। ঠিক তেমনই রুস্তমের মন। একটু নড়তে গেলেই আরো চেপে ধরে। আটকে যায় মন তার মনে। তখন আর নড়া যায় না। তার বুকের লুতলুতে মায়ায় কেবলই ভিজতে হয়। আটকে যেতে হয়। আর কেউ না জানুক- লতা জানে। রুস্তমকে একমাত্র লতা-ই আবিষ্কার করতে পেরেছে। প্রতিদিনই রুস্তমকে আবিষ্কারের নেশা লতাকে পেয়ে বসে। কিন্তু কখনো সে পারে, আবার কখনো রুস্তমকে সে পায়-ই না। 


২.

রুস্তমের ঘরে আসার আগে বিজন বেপারীর শুটকির চাতালে কাজ করতো লতা। সমুদ্র থেকে ট্রলার বোঝাই করে মাছ ঘাটে আসে। মাছের ট্রলার ঘাটে আসলে মহাজনদের হাঁক ডাক শুরু হয়ে যায়। কেউ কেউ বাঁশে ঝুঁড়ি ভর্তি মাছ নিয়ে ছুটে যায় শুটকির চাতালে। তারপর শুরু হয় সমুদ্রের তাজা মাছগুলোকে শুটকি করার প্রক্রিয়া। ধাপে ধাপে মাছগুলো বাছাই করা হয়। তারপর কাটা ও ধোয়া শেষে চাতালের মাচায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। বড় মাছগুলোকে বাঁশের আড়ের সঙ্গে বেঁধে দিতে হয়। এই কাজগুলো দারুণ ভাবে করে লতারা। শুটকির চাতালে লতার মত আরো অনেক লতা কাজ করে। তারা সারাদিন বালুর ওপর কাজ করে। গনগনে রোদের তাপে বালি রুটির তপ্ত তাওয়ার মত গরম হয়ে যায়। সেই তাপের আঁচে পুড়ে যায় লতাদের শরীর। চোরা ঘামে ভিজে যায় তাদের শরীর ও পরিধেয় কাপড়চোপড়। আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে পান চিবাইতে চিবাইতে তারা উদয়াস্ত চাতালে কাজ করে। সারাদিনে কয়েক খিলি পান তাদের পেটে যায়। লতাও পান চিবায়। পান খাইলে লতাকে দারুণ লাগে। বুলবুলির লেজের মত টুকটুকে লাল হয়ে যায় তার ঠোঁট। সেই ঠোঁটে তখন আগুন ফুল ফুটে। সেই ফুলে ভ্রমর কামড় বসাতে চাইবে- এটাই প্রকৃতি চায় হয়তো! হয়তো রুস্তমের বুকেও সেই তৃষ্ণা আরো বেশি ছিল। 


একদিন রুস্তম লতাকে বিজন বেপারীর শুঁটকির চাতালে দেখে। চাতালে মাছ রাখতে গিয়ে চোখের রাডারের সীমানায় আচমকা এসে পড়ে লতার গৌড় মুখখানি। বালিয়াড়িতে ফোটা কলমি ফুলের মত কোমল সে মুখ। তারপর লতা আর যায় কই! জেলেপাড়া, মাছের ঘাট, আড়তের লোকজন ও চাতালের সব্বাই জেনে যায় লতাকে রুস্তম মন দিয়ে ফেলেছে। তাই আর কেউ লতার দিকে তাকানোর সাহস পেতো না। বিজন বেপারী লতাকে দেখে। যতটা চোখ দিয়ে দেখে তার চেয়ে বেশি দেখে কল্পনায়। লতার ঘামে ভেজা শরীরের প্রতিটি ভাঁজ বেপারীকে মাতাল করে দেয়। ঘোরের ভেতর সে লতাকে নিয়ে পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে। আকাশ বাতাস দাপিয়ে বেড়ায়। অথচ যখনই সে কল্পনার ফানুস থেকে মাটিতে পা রাখে, তখনই তার সামনে দন্ডায়মান হয় রুস্তম। ঘাড় ত্যাড়া রুস্তম, রগচটা রুস্তম, বন্য সাহসী রুস্তম- মাটির কাউকে কেয়ার করে না- এই কথা সবাই জানে। রুস্তমের মাথায় একবার খুন চাপলে তার আর রক্ষা নেই। বিজন বেপারীও এই কথা ভালো করেই জানে। এজন্যই সে আড়ালে আবডালে মনে মনে লতাকে শয্যায় নেয়। লালা ফেলে গোপনে। 


ওহ! আরেকটা কথা। রুস্তম কিন্তু কথা খুব কম বলে। জন্মের পর নাকি বিকট চিৎকার করেছিল। আতুড়ঘরে সেদিন মধু ছিল না। তাই তার মুখে সেদিন সরিষার তেল দিয়েছিল দাইমা। সরিষা তেলের ঝাঁজে নাকি রুস্তম একবেলা অনেক কেঁদেছিল। তারপর আর কখনো শব্দ করে তাকে কাঁদতে দেখেনি কেউ। মেয়েরা নাকি সহজেই পুরুষ মানুষের চোখ ও মুখ দেখে অনেক কিছু বলে দিতে পারে। আমার মনে হয়- এই গুনটা বেশি আছে। অন্য দশটা মেয়ের চেয়ে লতা বেশি শক্তিশালী। রুস্তমের চোখ সবচেয়ে বেশি পড়েছে লতা। রুস্তমের ঠোঁটের কম্পন দেখে বুঝতে পারে সে কী বলতে চায়। রুস্তমের আগাগোড়া সবকিছু বুঝতে পারে লতা। 


বিয়ের পর থেকে লতার ঘরে সারা দিনরাত সুখের জোনাক পোকা ওড়ে বেড়ায়। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া সেই ঘরের ফাঁকফোকর দিয়ে রাত্রে জোছনা নামে। গাঙের জলের মত টলমলে জোছনা নামে। সেই জোছনা ঠিকরে পড়ে ঘরের মেঝেতে। মাটির ওপর আলো ছায়ায় মায়ারা লুকোচুরি খেলে। ভূতের মত জাপটে ধরে রাখে রুস্তম ও লতাকে। বিয়ের চার মাসের মধ্যে যে ক'বার রুস্তমরা মাছ ধরতে সাগরে গেছে ততবারই ট্রলার বোঝাই করে মাছ নিয়ে ফিরে এসেছে রুস্তমরা। কোঁচড় ভরে টাকা নিয়ে ঘরে ফিরেছে তারা। ঘরে ফেরার আগে নতুন বউয়ের জন্য আলতার শিশি, স্নো'র কৌটা, তেলের বোতল, লিপস্টিক, নেইলপালিশ, চুলের ফিতা, রেশমি চুড়ি কিনে নিয়ে এসেছে রুস্তম। তার পুটলি থেকে একে একে সব বের করে তাজ্জব করে দিত লতাকে। লতা এসব দেখে হামলে পড়তো রুস্তমের বুকের ওপর। তারপর রাতের নদী ছলছল জল নিয়ে বেয়ে যেত আরো দূরের পথ। নাগিন সাপের মত জলকেলি চলত গোলপাতার ঘরে। রতি সুখের গোঙানির আওয়াজ রাতকে আরো কামুক করে তুলতো। রাতের অন্ধকারকে মুছে দিয়ে যখন সূর্য ওঠতো। যখন খিড়কি দিয়ে সেই আলো এসে হামলে পড়ত রুস্তমের কপালে, ভেজা চুল রোদে ছড়িয়ে রুস্তমের ঘুমন্ত মুখখানি দেখতো লতা। বড় মায়া লাগতো তখন।


রুস্তমের ঘরে আসার পর থেকে লতার গায়ের রঙ বদলে যাচ্ছে। তামাটে সেই রঙটা সোহাগে আদরে ধুয়েমুছে যাচ্ছে। নদীতে জাগা চরের মত লতার গায়ের নতুন রঙও জেগে ওঠছে। হলুদ রঙের শরীর। কাজল টানা চোখের অতলে হরহামেশাই হাবুডুবু খায় রুস্তম। কোনো ঠাঁই পায় না। অথচ এতো জল পশুর নদীতেও নেই। গভীর সমুদ্রেও নেই। কিন্তু এমন অতলে ডুবেও আনন্দ পায় রুস্তম। তাই বারবার ডুবতে চায় সেই মায়ার জলে....


৩. 

জেলে পাড়ার কারো বিশ্বাসই হচ্ছে না- লতা এই কাজ করতে পারে। এভাবে সে কাউকে খুন করতে পারে! বিজন বেপারীর রক্তাক্ত লাশ ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। কুরবানির গরুকে জবাই করলে যেমন রক্তের ফিনকি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি রুস্তমের ঘরের এঁটেল মাটিতে বিজন বেপারীর রক্ত ছড়িয়ে আছে। এমুখ ওমুখ করে সারা জেলে পাড়ায় খবর ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে। বিজন বেপারীর রক্তাক্ত শরীর দেখে কেউ কেউ আঁতকে ওঠছে। তার শরীরে বিভৎস রকমের কোপের দাগ। দগদগে রক্ত ও মাংসের আধিপত্য।  অথচ শত শত মানুষের ভীড়েও লতা কেমন পাথুরে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে। সে যেন কাউকে দেখছে না! এতো এতো মানুষের কোলাহল তার কানে আজ আর পৌঁছাচ্ছে না। কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে গেছে সে। অনুভূতি কিংবা মনের আনবাড়িতে তার কোনো মায়া নেই- প্রেম নেই! তার দৃষ্টি নবোদিত সূর্যের লাল আভার দিকে। তার মন আজ রুস্তমের ফিরে আসার পথের দিকে স্থির।


এদিকে টিভি ক্যামেরার লোকজনও চলে এসেছে। কেউ কেউ ফেসবুক লাইভে যুক্ত হয়ে সরাসরি দেখাচ্ছে এই লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের ইতিবৃত্ত। খবর পেয়ে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ঘটনাস্থলে পুলিশও এসে পৌঁছেছে। লাশের সুরতহাল চলছে। সাংবাদিকদের ক্যামেরার লাইট ও লেন্স বারংবার লতার গৌড় মুখের দিকে যাচ্ছে। লতার মেহেদী রাঙা হাতে দা। খুব ভালো করে শান দেয়া। সেই দা থেকে টুপ টুপ করে রক্ত ঝরছে। সেই রক্ত মাটিতে পড়েই ক্রমে লালচে হয়ে যাচ্ছে। অথচ এখনো ইস্পাতের মত শক্ত চোয়াল নিয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে আছে লতা। সেই ভোর রাত থেকে সে একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সাংবাদিকদের দু' একজন লতাকে একটাই প্রশ্ন করেছে- 'সে কেন বিজন বেপারীকে হত্যা করেছে?' 'ওয়াক থু' বলে লতা মুখ থেকে একদলা থুথু ফেলে বলল, আমি একডা জানোয়াররে খুন করিচি। সুন্দরবনের বাঘের মতন জানোয়াররে আমি মারছি। নাইলে রাইতে হেয় আমারে শেষ কইরা দিত।'


পুলিশ লতাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ ফাঁড়ির দিকে। পাড়া লোকজন দল বেধে তাদের পেছন পেছন যাচ্ছে। কার্তিকের শেষ দিক। হালকা কুয়াশা পড়েছে। শীত শীত একটা অনুভব হচ্ছে। বিজন বেপারীর শুটকির চাতাল থেকে উত্তরের হাওয়ায় ভর করে আসছে শুটকির ম ম গন্ধ। লতা সেই শুটকির গন্ধ আজ পাচ্ছে না। লতার চোখে মুখে আমি কোনো অপরাধী ছায়া দেখিনি। দেখে লৌহ এক বিপ্লবীকে হেঁটে যেতে। লতা সটানভাবে হাঁটছে সেই পথ ধরে, যে পথ ধরে সে রুস্তমের হাত ধরে সে হাঁটত। ভরা জোছনায় নদীর ঘাটে বসে গল্প করত। তারা আর কি কখনো এভাবে নদীর ঘাটে বসতে পারবে? ভরা জোছনায় লতার আলতা রাঙা পা ছুঁয়ে যাবে কি পশুর নদীর জল? 





রফিকুল নাজিম

মাধবপুর, হবিগঞ্জ।


Post a Comment

2 Comments

  1. গল্পটি বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি.....

    ReplyDelete