খ্রিস্টীয় পঞ্জিকায় সাল গগনা শুরু হবার একহাজার (১০০০) বছর পূর্ব থেকে চীনের পশ্চিমে ঝু রাজবংশ প্রথম ধাতব মুদ্রার ববহার শুরু করে। তারা পণ্যের আদান-প্রদানের জন্য এইসব মুদ্রার ব্যবহার করত। খ্রিস্টীয় পঞ্জিকা চালুর ৬৮৬ বছর পূর্বে লিভিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) রাজা আলিয়াত্তেস প্রথম পশ্চিমা ধাতব মুদ্রার প্রচলন করেন। এর পর থেকে ধীরে ধীরে ধাতব মুদ্রার ব্যবহার বিকাশ লাভ করতে থাকে (সূত্র :- দৈনিক আমাদের সময়, ২৬/০২/২০১৭ ইং)।
যুগে যুগে পৃথিবীর সব দেশে মুদ্রার প্রচলন ছিল, এবং আছে। মুদ্রাগুলো বিভিন্ন ধাতব পদার্থের সংমিশ্র কিংবা একক ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরী। তবে সেইসব কয়েন বা মুদ্রার দেশ ভেদে ভিন্নতা রয়েছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীজুড়ে প্রযুক্তির কল্যাণে নানা ধরনের কয়েন তৈরী ও ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বর্ণ, রুপা, ব্রোঞ্জ, লোহা, তামা, প্লাটিনাম, সিলভার, লিথিয়াম ইত্যাদি ধাতব পদার্থ দ্বারা মুদ্রা তৈরী করা হয়।
ইতিহাস বলছে ভারতবর্ষের সাথে স্বর্ণের সম্পর্ক প্রায় ২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এখানে আদিতে মুদ্রা তৈরীতে কেবল স্বর্ণই ব্যবহার করা হত, মানে মুদ্রা তৈরীর মূল উপাদান ছিলো স্বর্ণ। স্বর্ণ দিয়ে তৈরী সেসব মুদ্রা বানিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হত। ভারতবর্ষে মুদ্রার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- প্রাচীনকালে যখন মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয় তখন থেকে এসব মুদ্রা তৈরী করা হত স্বর্ণ দিয়ে। শুরুর দিকে সব ধরনের মুদ্রা স্বর্ণ দিয়ে তৈরী হত। পরবর্তীতে সোনা ছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থ দিয়ে মুদ্রা তৈরী করা হত, বর্তমানেও তাই। বাঙলাদেশে বর্তমানে লাল ও সাদা দু'ধরনের মুদ্রার প্রচলন আছে, লাল এক টাকার মুদ্রা বর্তমানে তেমন পাওয়া যায়না বললেই চলে, সিলভারের তৈরী সাদা এক, দুই ও পাঁচ টাকা মানের কয়েন বা মুদ্রা যথেষ্ট রয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস বলছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুদ্রার প্রচলন ছিল এখানে। ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে ভারতবর্ষের সেসব মুদ্রা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক-
কুষাণ:-
সম্রাট ভীমকদফিসেস কুষাণ মুদ্রার ব্যবহার বা যুগ শুরু করেন। তখন মুদ্রার একপিঠে শিব, বুদ্ধ, কার্তিক আরো অনেক দেব দেবতার চিত্র খোদাই করা থাকত আর অন্যপিঠে থাকত রাজার ছবি। ৩০ থেকে ৩৭৫ খ্রিস্টাব্ধ পর্যন্ত কুষাণের এ মুদ্রার প্রচলন ছিল।
গুপ্ত (৩২০-৪৮০খ্রিস্টাব্ধ):-
এই সময়ও সোনার তৈরী মুদ্রা ব্যবহার করা হত, তবে সোনা দিয়ে বানানো এসব মুদ্রার আলাদা নাম ছিল। তখনকার রাজা-প্রজারা এই মুদ্রাকে 'দিনারাস' নামে চিনত। গবেষকরা এই মুদ্রার নাম দিয়েছে 'স্বর্ণ বৃষ্টি'। এইসময় মুদ্রার একপিঠে বিভিন্ন দেবীর ছবি এবং আরেক পিঠে রাজার ছবি থাকত। শাসকের ছবির সাথে কখনো তার বীরত্বের কাহিনী লিখা থাকত অন্যপিঠে বেশির ভাগ মুদ্রায় দেবী লক্ষ্মীর ছবি থাকত।
পাল (৭৭৫-৮১০খ্রিস্টাব্ধ):-
পাল সাম্রাজ্যের সময়ে ৭.৫৯ গ্রামের একটি সোনার মুদ্রার প্রচলন ছিল, এই সময়ে মুদ্রার একপিঠে পদ্ম সমেত দেবী লক্ষ্মীর ছবি এবং দুইপাশে দুইটা জলের পাত্র থাকত অপর পিঠে ঘোড়ার উপর বসা রাজার যুদ্ধরত অবস্থার কোন ছবি, যে ছবিতে বুঝানো হত রাজা কোথাও কোন যুদ্ধে যাচ্ছে তার হাতে থাকত বর্ষা, যুদ্ধ-সরঞ্জাম ইত্যাদি।
হৈসল(১০৪৭-১০৯৮খ্রিস্টাব্ধ):-
ভারতের দঃ পার্শ্বে হৈসল রাজত্ব ছিল, তাদের রাজত্বের সময়ে চার (৪) গ্রাম ওজনের স্বর্ণ মুদ্রা ব্যবহার করা হত। এই সময় মুদ্রার একপিঠে সিংহ, চন্দ্র, সূর্যের ছবি থাকত অন্যপিঠে কন্নড় ভাষায় কিছু লিখা থাকত।
কদম্ব:-
এই সময়ের মুদ্রাগুলোকে 'পদ্মমুদ্রা' বলা হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ভারতবর্ষে ব্যবহৃত সব মুদ্রারর মধ্যে কদম্ব সাম্রাজ্যের মুদ্রা খাঁটি সোনায় তৈরী এবং সবচেয়ে ভারী।
ঘুরি:-
১২শ শতাব্দীর শেষের দিকে এ সময়ের মুদ্রাগুলোকে নলা হত দিনার। এই মুদ্রা গুলো প্রতিষ্ঠা করে মোহাম্মদ ঘোর, ১২শ শতাব্দী পুরোটা এবং ১৩শ শতাব্দীর প্রথম দিকে এইসব মুদ্রার বেশ প্রচলন ছিল।
বিজয়নগর রাজবংশ (১৩৩৬-১৬৫৬ইং):-
এই সময়ের মুদ্রাগুলোতে তিরুপতি ভেস্কেটশ্বরের ছবি থাকত, কখনো স্ত্রী সমেত। একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদেরও ছবি থাকত। এই সময়ে ব্যবহৃত মুদ্রাগুলো ডাচ, ফরাসি এবং ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলোকে প্রভাবিত করে। বিজয়নগর রাজবংশীয় মুদ্রাগুলোর ওজন ছিল ৩.৪০ গ্রাম।
মুঘল বংশ(১৫২৬-১৮৫৭ইং):-
এই বংশের রাজাদের সময়ে ভারতে প্রথম বারের মত স্বর্ণ ছাড়া অন্য ধাতব পদার্থের মুদ্রা চালু করা হয়। সোনা ছাড়া রুপা ও তামার মুদ্রা তৈরী করা হয় এবং ব্যবহার চালু করা হয়। এই সময়ে মুদ্রাগুলোকে বলা হত 'মোহর'। এইসময়ে সোনার তৈরী মুদ্রাগুলো ছিল অনেক ভারী প্রায় এগার গ্রাম ওজনের। মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে মুদ্রায় বিভিন্ন ধরনের নকশা করা থাকত। রাজা ঔরাঙ্গজেব তার রাজত্বকালে শাসক ও মুদ্রাকের ছবি সম্বলিত মুদ্রা আর তাতে লিখা থাকত মুদ্রার চালু হবার তারিখটি যা বর্তমানে কাগজের নোটগুলোতে দৃশ্যমান।
যদিও প্রাচীন ভারতে মুদ্রার যথেষ্ট ব্যবহার ও সমাদর ছিল, পপরবর্তীতে এবং বর্তমান সময়ে তেমনটা আর থাকেনি। বর্তমান বিশ্বে কাগজের নোটের প্রচলনই অত্যন্ত বেশি। মুদ্রার প্রচলন এখন চরম ভোগান্তিতে, কেউ এইসব মুদ্রা এখন আর নিতে চায় না। ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ী, মাছ বিক্রেতা থেকে ঝালমুড়ি বিক্রেতা কেউ এখন কয়েন বা মুদ্রা নেয় না। ব্যাংক মুদ্রা নেয়ার নিয়ম থাকলেও নিয়মকে তোয়াক্কা না করে তারা এখন মুদ্রা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। বিবিসি বাঙলা এ নিয়ে এক প্রতিবেদন লিখেছিল-
মুদ্রার ব্যবহারে মানুষ ভোগান্তিতে পড়ায় বিবিসি বাঙলা একটা রিপোর্ট লিখে, তাতে কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। বাঙলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা ৮জানুয়ারি ২০১৬ সালে বিবিসি বাঙলাকে বলেন- "তিনি বলেন বৈধ মুদ্রা বা কয়েন নিয়ে সংশয়ের কোন ভিত্তি নেই কারণ এগুলো সচল আছে এবং থাকবে"।
ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে মুদ্রার প্রচলন ভারতবর্ষে একদম নেই, একথা সত্য।
২০১৮ সালে অর্থাৎ একুশ শতকের গোড়ার দিকে এসে এই ভারতীয় উপমহাদেশের সবকটা দেশে সোনার মুদ্রার ব্যবহার রুপকথার গল্পের মতই, ওসব মুদ্রার ব্যবহার নেই, প্রচলন নেই, তৈরীও নেই। সোনার মুদ্রা কেন (?) কোন মুদ্রার প্রচলনই তেমন আর নেই। আধুনিক ভারতবাসী সেকালের মুদ্রা একালে আর ব্যবহার করে না।
...................
রুদ্র সুশান্ত
বালুঘাট, ঢাকা।
১১ মে ২০১৮ ইং
0 Comments