ড. রিটা আশরাফ এর সাক্ষাৎকার

Interview with Dr. Rita Ashraf


ড. রিটা আশরাফ নরসিংদী জেলার সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মেসবাহ্ উদ্দিন ভূঞা মাতা জামসেদ খানম।  অজপাড়া গ্রাম রাজাদী সরকারী প্রাইমারী স্কুল থেকে শিক্ষজীবন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষজীবনের সর্বোচ্চ ডিগ্রী ডক্টর অব ফিলসফি (ড. বেগম তাহমিনা আশরাফ) অর্জন করেন। বর্তমানে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন ড. রিটা আশরাফ। তাঁরই সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিষয়ক মুখপত্র এইবি সাহিত্য পত্রিকা। প্রাইমারী জীবন খেকে লেখালেখির হাতেখড়ি হলেও ইন্টারমিডিয়েট ১ম বর্ষে পড়ার সময় নিজ কলেজ নরসিংদী সরকারী কলেজ থেকে বার্ষিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় স্ব-রচিত কথাসাহিত্যে ১ম স্থানের পুরস্কার লাভ করার পর এই শাখায় বেশী অনুপ্রাণিত হয়ে পড়েন। পরবর্তিতে এই শাখায় বহুবার ১ম স্থানের পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৯৫ সালে ‘বালুচরে বসতি’  উপন্যাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে নব্বই-এর সাহিত্য জগতে পাখা মেলেন রিটা আশরাফ। ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের টানাপোড়েন একটি চমৎকার পটভূমি তৈরী করেছেন “বালুচরে বসতি” উপন্যাসে। হেসেলপুরের ভূতুরে বেলতলী থেকে এক পরিত্যাক্ত নবজাতককে তুলে এনে সমাজের অবক্ষয় এবং পরিচয়হীন মানুষের আর্তনাদের ভেতর আমাদের পথ দেখায় “নৈবেদ্যর নারী”। মুুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস “বিবর্ণ স্বাধীনতা”। স্বাধীনতার ভ্রুণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করা একজন কলিমুদ্দি যেভাবে খুঁজে খুঁজে ফেরে ‘স্বাধীনতার অর্থ’-তা আমাদের ভেতরেও জাগিয়ে তোলে হাজার প্রশ্ন। ‘একটু ভূলের অনুভূতি’ সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের নিটোল রোমান্টিক উপন্যাস। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘বালুচরে বসতি’ (উপন্যাস), ‘নৈবেদ্যর নারী’ (উপন্যাস), ‘বিবর্ণ স্বাধীনতা’ (উপন্যাস), ‘একটু ভুলের অনুভূতি’ (উপন্যাস),  ‘তুতুলের খড়গোশ শিকার’ (শিশুতোষ গল্প), ‘মামদোভূতের পুত’ (শিশুতোষ গল্প সংকলন), ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনলো যাঁরা’ (গবেষণা), ‘নজরুল সাহিত্যে তৎকালীন বিশ্ব (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে উপমা (গবেষণা), তূর্যকে লেখা মায়ের চিঠি (ছোটগল্পগ্রন্থ) ইত্যাদি। কথাসাহিত্যে পেয়েছেন ভিন্নমাত্রা সম্মাননা, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি সম্মাননা। এই খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক ও গবেষকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ কবি ও প্রাবন্ধিক বঙ্গ রাখাল।


বঙ্গ রাখাল : আপনার ছোটবেলার গল্প শুনতে চাই?

রিটা আশরাফ : 

         ‘ছোটবেলার গল্প মানেই চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়া। 

         ছোট বেলার গল্প মানেই রঙিন চশমাটা ফিরে পাওয়া।

        ছোটবেলার গল্প মানেই স্মৃতির ঝাপির ডালা তুলে নেওয়া।’

এ বেলায় দাঁড়িয়ে ছোটবেলাটাকে এক জীবনের সাথে মেলানো যায় না। এখানে অল্পকথায় ছোটবেলার গল্প বলা সম্ভব নয়। ইচ্ছে আছে আমার ছোটবেলা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কিছু লেখার। এখনকার বাচ্চাদের যে ছোটবেলা আমাদের ছোটবেলা তাদের কাছে রূপকথার গল্প। যেমন-আমাদের কাছে আমাদের বাবা-মা, দাদা-দাদু, নানা-নানী এবং পূর্ব মানুষের ছোটবেলা। এ জন্যই লিখবো। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এটি প্রয়োজন।

বঙ্গ রাখাল : লেখালেখির জন্য পরিবার থেকে কেমন সাড়া পেয়েছেন কিংবা কোন প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন কি? 

রিটা আশরাফ : পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া কোন শিল্পী তৈরী হতে পারে না। তবে হ্যাঁ। এ সহযোগিতা কারো জন্যে হয় মসৃণ, কারো জন্যে হয় বন্ধুর। আমার সহযোগিতাটা বন্ধুর পথেই এসেছে। আমি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে। তাছাড়া আমার পূর্বে আমার পরিবারের কেউ এ পথে হাঁটেনি। এক সময় এ ক্ষেত্রে আমার পরিবারের প্রতি অনেক আক্ষেপ, অভিমান, অভিযোগ ছিল। কিন্তু এখন নেই। কারণ, সময়ের সাথে জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। এখন মনে হয় তারা তাদের রক্ষণশীল মানসিকতায় গড়ে ওঠা ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরেই আমাকে শাসন করেছে। আর আমি সেই শাসন ভেঙ্গে বের হতে চেয়েছি। কাজেই সংঘর্ষ তো হবেই। তাছাড়া কৌশল করে কিংবা নানাভাবে কারো মন জয় করে কিছু আদায় করার মানসিকতাটা আমার একদমই নেই। সোজা-সরল পথে যা পাই ততটুকুই, আর শ্রম দিয়ে ঘাম দিয়ে যতটুকু অর্জন করি।

একটি গণ পাঠাগার করার স্বপ্ন আমার দীর্ঘ দিনের। আমার পরিবারের আভিজাত্যের দেয়ালে সে স্বপ্ন এখনও আমার স্বপ্ন হয়েই আছে। এখন তো আমার নিজেরই একটি পরিবার হয়েছে। আর আমার সে পরিবারের সারথী আমার মেয়ে ‘সুবহা মুস্তারীণ জুঁই’।

Dr. Rita Ashraf’s books


বঙ্গ রাখাল : আপনি তো সাহিত্যের সব শাখাতেই বিচরণ করেছেন- কবিতা, কথাসাহিত্য না গবেষণা কোন শাখাটা বেশি ভাল লাগে?

রিটা আশরাফ : কথাসাহিত্য। এ ক্ষেত্রটি আমার প্রাণে অসম্ভব এক দোলা জাগায়। আমার কলেজ ‘নরসিংদী সরকারী কলেজ’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের বার্ষিক সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আমি যতবার এ শাখায় অংশগ্রহণ করেছি ততোবারই প্রথম পুরস্কার পেয়েছি।

বঙ্গ রাখাল : সাহিত্যে নারীদের আগমন এত কম কেন বলে মনে করেন?

রিটা আশরাফ : পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা। সাহিত্য প্রেমি হয়ে বেড়ে ওঠা একজন নারী বাবার বাড়ির প্রতিবন্ধকতা উতরিয়ে উঠতে পারলেও শ্বশুরবাড়ি যদি তাকে বাড়ির বউ এর বাইরে না ভাবে তাহলে বিয়ের পর একটি মেয়েমুখ থুবরেপড়ে। এই থুবরে পড়া জীবন থেকে যদি কোন নারী তার নিজের স্বপ্নটাকে, নিজের জীবনটাকে ভালবেসে উঠে দাঁড়াতে পারে তখন সে নারীকে সেলুট জানানো আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।

বঙ্গ রাখাল : আপনার কবিতা বা কথাসাহিত্য নির্মাণ সম্পর্কে জানতে চাই?

রিটা আশরাফ : আমার কবিতা বা কথাসাহিত্য নির্মাণ- এটি সম্পূর্ণরূপে ঐশ্বরিক দান। চেষ্টা করে কিংবা প্রশিক্ষণ দিয়ে এটি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। লেখকের ভেতরের অনুপ্রেরণার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

বঙ্গ রাখাল : আপনার গল্পের পরতে পরতে গ্রামীণ-জীবনের ছায়াতে ঠাশা-লেখার জন্য গ্রামীণতাকেই কেন বেচে নেন?

রিটা আশরাফ : এক্ষেত্রে বলতে পারি, একজন লেখক কখনোই তার ব্যক্তি জীবনকে অতিক্রম করে লিখতে পারেন না। ব্যক্তি জীবনের ঘটনাকে কিংবা চারপাশকে শব্দের জালে বুনে একজন লেখক সাহিত্য রচনা করেন। সাথে হয়ত কিছ ুকল্পনার মিশ্রণ ঘটে যায়। শুদ্ধ বাস্তবতা দিয়ে কবিতা বা কথাসাহিত্য হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারে না। আমি গ্রামে বেড়ে ওঠা এক জন মানুষ। আমাদের গ্রাম এখন শহরমুখী গ্রাম হলেও আমি যখন বেড়ে উঠেছি তখন আমার চারপাশ অজপাড়া গ্রাম ছিল। কাজেই আমি বেছে নেইনি, এটি আমার জীবন-বাস্তবতা।

বঙ্গ রাখাল : আপনি একটা নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবার বিভাগের দায়িত্বও পালন করে চলেছেন সুনামের সাথে- এর পরেও সাহিত্য র্চচা কীভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন?

রিটা আশরাফ : হ্যাঁ ! আমি বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’-এর বাংলা বিভাগে কর্মরত আছি। এখানে আমি বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছি। যে বিভাগ থেকে দেশের অনেক স্বনামধ্য কবি, সাহিত্যিক, সংগীত শিল্পী উচ্চতর ডিগ্রী গ্রহণ করেছেন। সাহিত্যটা আমার কামলাতান্ত্রিক পেশা। কাজেই শত ব্যস্ততার মাঝেও কোননা কোন ফাঁকগলে এটি স্ব-প্রণোদিত হয়ে উঁকি-ঝুকিমারে এবং সুযোগ পেলেই বের হয়ে আসে।

বঙ্গ রাখাল : আমরা জানি আপনি বাংলা বিভাগ থেকেও অনেকগুলো সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন-এ সম্পর্কে যদি আমাদের জানাতেন?

রিটা আশরাফ : এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক স্যারের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের অন্যতম একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’। যেখানে ১৯৯৬ সাল থেকে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম শুরুর প্রথম দিন থেকে বাংলা বিভাগ চালু রয়েছে। যে বিভাগ থেকে বাংলায় অনার্স এবং এম.এ ডিগ্রী প্রদান করা হচ্ছে। সেখানে আমি আমার শিক্ষা এবং সাহিত্যচর্চাকে প্রাণ ভরে বিলিয়ে দেয়ার সুযোগ পেয়েছি।

এখানে যোগদানের পূর্বে একটি সাহিত্য পত্রিকা করার স্বপ্ন আমি প্রতিনিয়ত দেখতাম। এইজন্য যে, এই সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমেই বাংলাসাহিত্যের দিকপালগণের আত্ম’র প্রয়াস ঘটে ছিল এবং এখনও ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সাদেক স্যারের কাছে আমি পত্রিকা করার প্রস্তাব করলে তিনি আমাকে অত্যন্ত উৎসাহিত করে তোলেন এবং প্রকাশের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন। যে পত্রিকায় দেশের এবং বিদেশের স্বনামধন্য লেখকগণের লেখা প্রকাশের সুযোগ হয়েছে। এই পত্রিকায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি’র  এমএলএসএস থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী, কর্মকর্তা, প্রতিষ্ঠাতা সকলের লেখা প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ভেতর পড়াশুনার বাইরেও যে সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল প্রতিভা রয়েছে তা বের করে আনার জন্যই মূলত এই প্রয়াস। এবং এই প্রতিভাকে স্বনামধন্য লেখকদের লেখার পাশাপাশি রেখে তাদের লেখার মান উন্্নয়নেরও প্রয়াস রয়েছে।

আমার এই পত্রিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিষয়ক মুখপত্র হিসেবে এতটাই সফল ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল যে, পরবর্তীতে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এটি নিয়মিত প্রকাশ করতে না পারায় আমার বেতনের একটি অংশ কেটে দেয়া হয়েছে। প্রথমে বিষয়টি আমার খুব মন খারাপ করলেও পরে এটি আমার স্বার্থকতা হিসেবেই আমি ভেবে নিয়েছি।

বঙ্গ রাখাল : আপনার মেয়েও তো লেখক তার সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন কী?

রিটা আশরাফ : ‘সুবহা মুস্তারীণ জুঁই’- আমার একমাত্র মেয়ে। আমার একমাত্র সন্তান। আমার সন্তান হিসেবে বলছি না, আমি একজন পাঠক সমালোচক হিসেবে বলছি, তার লেখার হাত অসাধারণ। ছোটবেলায় তার হাত দিয়ে তার নিজের অজান্তেই শব্দ বুননের যে কারিশমায় কবিতা, গল্প, ছড়া বের হয়ে আসে তা অনেক নামকরা লেখকদেরও তাক লাগাতে পারে। 

২০২০ সালের বই মেলায় তার একটি বইও প্রকাশ পেয়েছে ‘আমার প্রথম’ নামে। যেখানে ইংরেজী এবং বাংলা দুটোতেই গল্প, কবিতা, ছড়া স্থান পেয়েছে।  গ্রন্থে প্রকাশিত সবগুলো লেখাই (একটি ছাড়া) তাঁর অষ্টম শ্রেণীতে পড়া এবং তার পূর্বের অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়া অবস্থার লেখাও রয়েছে।

বঙ্গ রাখাল : বর্তমানের লেখালেখি সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই?

রিটা আশরাফ : আমার মেয়ে এবার ইন্টারমিডিয়েট-এর শিক্ষার্থী। শিক্ষকতা পেশা, বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন, মেয়ের পড়াশোনার খোঁজ-খবর রাখা ইত্যাদি কারণে বর্তমানের লেখালেখি সম্পর্কে আমার খুব একটা ধারণা নেই। পড়ারও সুযোগ হয়ে ওঠে না। তবে আমার মেয়ের ইন্টারপরীক্ষার পর আবার আমার এই প্রাণের জগতে ফিরতে পারবো বলে স্বপ্ন পোষণ করি। হয়তো পারবো...।

Post a Comment

0 Comments