জয়িতা ভট্টাচার্য’র প্রবন্ধ জরায়ুর স্বাধীনতা প্রসঙ্গ নারীবাদী সাহিত্য

জয়িতা ভট্টাচার্য’র  প্রবন্ধ  জরায়ুর স্বাধীনতা প্রসঙ্গ নারীবাদী সাহিত্য

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন যুগে যুগে সাহিত্যের বিভিন্ন জঁর ও শাখায় এসেছে বাঁক বদল তেমনি ফেমিনিস্ট লিটারেচার বা নারীবাদী সাহিত্যের ঘরানাতেও দেখা যায় বিশেষ বদল। প্রসঙ্গত নারীবাদী সাহিত্য মার্কসবাদী সাহিত্যের একটি শাখা বলা বাহুল্য। সমাজে নারীর বঞ্চনার কথা,পুরুষের আধিপত্য ও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব যে লেখনি তাকেই নারীবাদী সাহিত্য বলা যায়। 

নারীবাদী সাহিত্যের দুটি আধুনান্তিক উত্তরণ ইকো ফেমিনিজম ও নব্য নারীবাদ বা নিও ফেমিনিস্ট লিটারেচার। 
নিও ফেমিনিজম কাকে বলে জেনে নেওয়া যাক। যেখানে ফেমিনিস্ট সাহিত্য নারী পুরুষের সামাজিক বৈষম্য দূর করার কথা বলে,নারীর ওপর পুরুষের তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা চাপিয়ে দেওয়া বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে সরব। নব্য নারীবাদ প্রধানত পার নারীর আইনগত সুবিধা, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও উচ্চ শিক্ষার প্রসারের মতো বিষয়ে সরব আন্দোলনে।
প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচার আর নারীর ওপর পুরুষতন্ত্রের নিপীড়ন দুটোর মধ্যে একটা সামঞ্জস্য দেখা যায়। এই ধারনা কে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ইকো ফেমিনিজম তত্ত্বটি।
১৯৭৪ সালে ফ্রাঁসোয়া দ্যুবন প্রথম এই ইকো ফেমিনিজম এর বিষয়ে তত্ত্ব প্রদান করেন তার বই  'Le fe'minisme ou la mort' (নারীবাদ নাকি মৃত্যু) বইটিতে। ক্যারন ওয়ারেন, ভাল প্লামউড, জিম চেনি, বন্দনা শিবা প্রভৃতি ইকো ফেমিনিজম নিয়ে কাজ করেছেন। প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত থাকলেও মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজই যে পরিবেশ ও নরনারী নিপীড়নের কারন সেই বক্তব্য সকলেরই। 
বাংলা সাহিত্যেও নারীবাদী লেখকের অবদান গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। 

পুনরাধুনিক বাংলা সাহিত্যে আসার আগে প্রসঙ্গত স্মরণ করা জরুরি প্রথম যুগের সেইসব সাহসী নারীর কথা যাঁরা বাংলা সাহিত্যে নারীবাদের প্রবর্তক। প্রথম নারীবাদী লেখিকা হিসেবে রাসসুন্দরী দেবীর নাম পাওয়া যায়। জন্ম ১৮১০ পাবনা জেলার একটি গ্রামে। পরবর্তীকালে পুত্রের উৎসাহে লেখাপড়া শিখে বাংলা ভাষায় প্রথম আত্মজীবনী লিখেছেন "আমার জীবন" যা তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
এরপর আরো তীব্রতর ভাষায় লিখলেন কৈলাসবাসিনী দেবী (১৯৩০), গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকার প্রণেতা দুর্গাচরণ গুপ্তর সহধর্মিণী তিনি। লিখেছেন একের পর এক নারীবাদী প্রবন্ধ। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রবন্ধ সংকলন। "হিন্দু মহিলাগনের হীন অবস্থা ", "বিশ্বসভা", হিন্দু অবলাকুলের বিদ্যাভ্যাস, সমাজ সংস্কার প্রভৃতি। 
প্রথম ভ্রমণবৃতান্ত ও নারীর উন্নতিকল্পে বহু কাজ করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিণী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। আধুনিক শাড়ি পরিধানে রীতিও তাঁর প্রবর্তিত। তিনি লিখেছেন " ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা" প্রভৃতি নানা কবিতা, গল্প ও নিবন্ধ। 
তবে সবচেয়ে উজ্জ্বল ও জনপ্রিয় নারীবাদী লেখিকা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। জন্ম ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২, রংপুর পোরবন্ধে। মৃত্যু কলকাতায় ৯ ডিসেম্বর। তিনি Mrs.R.S.Hossain ছদ্মনামে লিখতেন প্রাথমিকভাবে।
অবরোধবাসিনী, মতিয়ার, পদ্মরাগ ও ইংরেজিতে লেখা উপন্যাস "সুলতানার স্বপ্নউল্লেখযোগ্য। 
প্রথম বাঙালি ফেমিনিস্ট লেখিকা হিসেবে বেগম রোকেয়াকেই অনেকে মানেন তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও নারীস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় তাঁর অগ্রণী ভূমিকার জন্য। শত বর্ষ আগে তিনি মৌলবী দের সঙ্গে লড়াই করেছেন বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে। 
প্রসঙ্গত "সওগাত পত্রিকা" ও তার সম্পাদক মহম্মদ নাসিরুদ্দিন নারী আন্দোলনে বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করে। এই পত্রিকার সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামও জড়িত ছিলেন।
"যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকাজে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি আমরা স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না?"
বেগম রোকেয়া খুব সহজ ভাষায় তীক্ষ্ম আক্রমণ করেছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে। "অশিক্ষিত স্ত্রী লোকের শত দোষ সমাজ অম্লানবদনে ক্ষমা করিয়া থাকে। কিন্তু সামান্য শিক্ষা প্রাপ্ত মহিলা দোষ না করিলেও সে বেচারির দোষ ঐ শিক্ষার ঘাড়ে চাপাইয়া দেয় ও শতকন্ঠে সমস্বরে বলিয়া থাকে স্ত্রী শিক্ষা কে নমস্কার!" 
বেগম পত্রিকা ছাড়াও অনেক পত্র পত্রিকায় ও সভা সমিতিতে তিনি স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ও কুসংস্কার দূর করার, নারীর প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তাঁর লেখার মাধ্যমে। গল্প, উপন্যাস কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন বেগম রোকেয়া, বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারীবাদী লেখিকা। 
জেন অস্টিন, স্যিমন দ্য ব্যোভর, Anne সেক্সটন, ভার্জিনিয়া উল্ফ, সিলভিয়া প্লাথ........ তসলিমা নাসরিন, মল্লিকা সেনগুপ্ত.... কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরে আসা যাওয়া অনেক নারী কবির। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিপন্নতা, কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন কেউ নির্বাসিত। তবু এঁরা সকলেই কাল কে অতিক্রম করতে পেরেছেন তাঁদের কবিতায় । নারীবাদী কবিতার স্রষ্টা কবিতা সিংহ আপন বৈশিষ্ট্যে চিরন্তন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে।
তাঁর নারীবাদী কবিতার একটি নিদর্শন, 

"অপমানের জন্য বার বার ডাকেন
  ফিরে আসি
আমার অপমানের প্রয়োজন আছে!
.............
অপমানের জন্য বার বার ডাকেন 
ফিরে আসি 
উচ্চৈঃশ্রবা বিদূষক সভায় 
শাড়ি স্বভাবতই ফুরিয়ে আসে
আমার যে
কার্পাসের সাপ্লাই মেলে না।

অপমানের জন্য বার বার ডাকেন 
ফিরে আসি 
ঝাঁপ খুলে লেলিয়ে দেন কলঙ্কের অজস্র কুকুর _____
আমার কলঙ্কের প্রয়োজন আছে!
...................
(অপমানের জন্য ফিরে আসি)
এত সাহসী উচ্চারণে নারীবাদী কবিতা বোধহয় বাংলা সাহিত্যে আর কেউ লিখতে পারেনি।

আশির দশকের দুই নারীবাদী কবি, মল্লিকা সেনগুপ্ত ও তসলিমা নাসরিন। তসলিমা মূলত স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা লিখেছেন নারীবাদী কলমে যদিও তা অনেক সময় সেই বেড়া টপকে হয়ে উঠেছে এক সর্বজনীন উপলব্ধির প্রকাশ।
 নারীবাদী কবিতা নামে তকমা লাগানো কবিতা আসলেই প্রতিবাদের কবিতা। কবির অস্তিত্ব যখন বিপন্ন তখন সোজা সাপটা আঘাত আসবেই পুরুষের ওপর সমাজের ওপর।
তসলিমাদির একটি কবিতার অংশ,

"তিনকূলে কেউ নেই ডাগর হলেই মেয়ে টের পেয়ে যায় 
অভাবের হিংস্র দাঁত জীবন কামড়ে ধরে ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়।
যুবতী শরীর দেখে গৃহিণীরা সাধ করে
ডাকে না বিপদ
বেসুমার খিদে পেটে, নিয়তি দেখিয়ে দেয় নারীকে বিপথ।
দুয়ারে ভিক্ষার হাত বাড়ায়ে বেকার নারী তবু বেঁচে থাকে
স্টেশনে কাচারি পেলে গুটি সুটি শুয়ে
পড়ে মানুষের ফাঁকে।
এইসব লক্ষ্য করে ধড়িবাজ পুরুষেরা
মুখ টিপে হাসে
দেখাতে ভাতের লোভ,আঁধার নিভৃতে
ফন্দি এঁটে আসে।
তিনকূলে কেউ নেই কোথাও কিছু নেই, স্বপ্ন শুধু ভাত,
শরমের মাথা খেয়ে, এভাবেই ধরে নারী দালালের হাত।"
(শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা)

 আশির দশকের সবচেয়ে আলোচিত ও নির্যাতিত নারী কবি তসলিমা নাসরিন।
কবিতাটি একটি নিপুন গল্প বলে, চিত্রকল্প সহযোগে।একটি পরিপূর্ণ কবিতা যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিচ্ছবি।
কবি তসলিমা নাসরিন কোন দেশের কবি? জানি না আমরা।তিনি যতটা ভারতের ততটাই বাংলাদেশের, বিদেশি ও বটে।অতএব তসলিমা নাসরিন এক বিশ্ব নাগরিক।
পেশায় চিকিৎসক তসলিমা সমাজে নারীর বাক্ স্বাধীনতা ও "জরায়ু র স্বাধীনতার" তথা "যৌন স্বাধীনতার"
জন্য লড়াই করেছেন, নারীর মুক্ত চিন্তার প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন তাঁর কলমের মাধ্যমে। তুলনামূলক ভাবে বিপরীত অবস্থান ও সামাজিক ছত্রছায়ায় কিছুটা নিরাপদ কৌশলে মূলত নারীর আরাধনা ও তার মহত্ত্ব লিখেছেন মল্লিকা সেনগুপ্ত। প্রথমজনের জন্ম 1962, দ্বিতীয় কবির জন্ম 1960
বাংলা সাহিত্যে নারীবাদী কবিতার ইতিবৃত্তে, তার আগে, দুই প্রবাদ প্রতিম কবি, কবিতা সিংহ ও দেবারতি মিত্রর নাম করতেই হয়। তারও আগে তরু দত্ত বা সরোজিনী নাইডু প্রভৃতি।
আমরা এখানে আশির দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারীবাদী কবি মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতা নিয়ে আলোচনা করব।

"মিলেনিয়াম মিলেনিয়াম 
চর্যাপদের পুঁথির পাতায়
আমিও ছিলাম,
অশ্বমেধের ঘোড়ার খুরে
আমিই ধুলো উড়িয়েছিলাম ..........
(মিলেনিয়াম,মল্লিকা সেনগুপ্ত)

মল্লিকাদির কিছু কবিতা সহজ সরল।তিনি ইতিবাচক প্রতিবাদী কবি। স্বভাবতই, নারীর জয় বেশির ভাগ কবিতায়।
তসলিমাদির কবিতায় বাস্তব বেদনা ও অবিচারের কথা ঝরে পড়েছে। বার্তা দিতে চেয়েছেন।মল্লিকাদি নারীর শ্রেষ্ঠত্বকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরেছেন। একটি সিদ্ধান্ত আরেকটি বাস্তবতা। standardreality.

"আমি কান্না পড়ি, আগুন লিখি, নিগ্রহ দেখি, অঙ্গার খাই, লাঞ্ছিত হই, আগুন লিখি।" (মল্লিকা সেনগুপ্ত)

     কেউ কেউ বলেন কবিতায় জেন্ডার বায়াস এসে যাওয়া সঙ্গত নয়। কেউ বলেছেন কবিতায় কোনো "বাদী" বলে কিছু হয় না। আমি ঠিক এই জায়গায় শুরু করতে চাই।

বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে বিভিন্ন অধ্যায়ে, পরিস্থিতি ও সামাজিক পটভূমি অনুযায়ী নানা শাখায় কবিতা বিভক্ত হয়েছে। রেঁনেসা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলস্বরূপ পাল্টে গেছে যাপনচিত্র। জন্ম নিয়েছে নানা মতবাদী কবিতা। সাহিত্যে এগুলি আলাদা আলাদা অধ্যায় এবং সবই প্রতিবাদমূলক.....প্রতিবাদী কবিতা।

এভাবেই এসেছে মার্কসিস্ট সাহিত্য বা সাম্যবাদী সাহিত্য কবিতা (বার্নার্ড স,ভ্লাডিমির মায়াকভস্কি,বার্ট্রাণ্ড ব্রেখট,জ্যাক লণ্ডন প্রভৃতি। Anti poetry (নিকোনার পারা,ইলিয়াস পেট্রোপুলাস,বাংলায় অমিয়ভূষণের কবিতায় কিছুটা ছায়া), এবং ফেমিনিস্ট লিটারেচার ও ফেমিনিস্ট পোয়েট্রি বা নারীবাদী কবিতা__ সাহিত্যের একটি বড় অধ্যায়।

যে কবিতায় নারীর সামাজিক অবমাননা, নির্যাতন, একাকীত্ব,অন্তরালের সন্ত্রাস ও পুরুষতন্ত্রের প্রতি ক্ষোভ স্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত হয়েছে গোপনীয়তার প্রাচীর ভেঙে, যা আগে কখনো হয়নি।
নারীবাদী কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য প্রায় এটাই।
1800 খৃষ্টাব্দে প্রথম নারীবাদী কবিতা ও নারীবাদ সাহিত্যে স্থান পায়।
বিশ্বের অসংখ্য নারীবাদী কবি আছেন, মুখ্যত, ইলিনয় হ্যালোইন এবট, ক্যাথী একর, মিল্টন এক্রন, ডেবরা এগর, জুলিয়া এলভেরি, মায়া এঞ্জেলু, মেরী উলস্টোনক্রাফ্ট, এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং, মিনা লয়, এমিলি ডিকশন, মার্গারেট অটউড প্রমুখ উল্লিখিত কবিরা নারীবাদী কবি।

তসলিমা নাসরিন -আত্মগত কবিতা 
  কোনো পুরোনো, অবরুদ্ধ সমাজকে তার যাপন, তার ধর্ম কে সময়োপযোগী করে তুলতে গেলে নাড়া দেওয়া আবশ্যক। বদ্ধজলার মতো পরম্পরাকে আঘাত রাষ্ট্র সইবে কেন, সইবে কেন পরিবার, সমাজ।হুমায়ুন আজাদ খুন হয়ে যান, নির্বাসিত তসলিমা নাসরিন। বাক্ স্বাধীনতা যদিও মৌলিক অধিকার।ভারতও ভয় পেয়েছে একা একটি নারীর কিছু সত্য বাচন। "আমার সজ্ঞায় চরিত্রহীনতার সঙ্গে যৌনতার কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক আছে নীচতা,অসভ্যতা, মিথ্যা প্রতারণা, শঠতা,ছলনা ও চাতুরির সঙ্গে"
তসলিমা বিরুদ্ধাচরণ করেছেন কুসংস্কার ও বদ্ধজলায় পরিণত সমাজকে। তিনি অবনত মস্তকে মার্জনা ভিক্ষা করেননি কারো কাছেই।তাই কি তাঁর কবিতার মূল্যায়ন হয়নিতসলিমাদির কবিতাকে কনফেশনাল পোয়েট্রি অবশ্যই বলা যায়। কনফেশনাল পোয়েট্রি সম্পর্কে একটু তার আগে জেনে নিলে মন্দ হয় না কারণ বিশ্ব সাহিত্যে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা একটি ভিন্ন ধারার জঁর। 1959 সম্ভবত M.L.Rosenthal প্রথম শব্দটি ব্যবহার করেন।

যে গোপন কথাগুলো এতদিন এতদিন অন্তরমহলে নিঃশব্দে লুকোনো ছিলো হঠাৎ সেগুলো কবিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। মৃত্যু, ট্রমা, স্বামীর নির্যাতন,স্ববিরোধিতা বা ফ্রাস্ট্রেশনের কথা লিখিত হতে শুরু করে। রবার্ট লোয়েল, স্নবগ্রাস, সিলভিয়া, আনি সেক্সটন বিশেষত উল্লেখযোগ্য নাম।একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বন্ধু অধ্যাপক সুবীর সেন মনে করিয়ে দিলেন যে কনফেশনাল কবিতা কিন্তু কেবল নারী কবিরাই লেখেননি বহু পুরুষ কবিও এই জঁর এর কবিতা লিখেছেন বলা বাহুল্য।এমনকি জন কিটস এর কবিতা রয়েছে, হালের জয় গোস্বামীর কথা বলেছেন সুবীরবাবু তবে "মালতীবালা .....কে সেই অর্থে কনফেশনাল পোয়েট্রি বোধহয় বলা যায় না।

স্বাধীনচেতা ও সত্যি বলার সাহস,মধ্যমনস্কতার বাইরে যে নারী, সে খাপ খাওয়াতে পারে না এই সমাজে।নিগৃহীত হয়।হয়ত বেছে নেয় মৃত্যু কিন্তু তাদের জবানবন্দি আমাদের বিচলিত করে।
কনফেশনাল পোয়েট্রি সাহিত্যগুণে কোনো অংশে কম নয়।তবে তার ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
সতন্ত্র ভাষা, ফ্রি ভার্সান বা মুক্ত ছন্দ, একটি দৃশ্য বিন্যাস কিংবা তুলনামূলক বিষয় যা অপ্রত্যক্ষ কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা। সব চেয়ে বড় কথা স্বীকারোক্তির কবিতা আত্মগত কবিতা নিজের বয়ানে লেখা। কখনো অনুপ্রাশের ব্যবহার ও পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। তবে কনফেশনাল পোয়েট্রি কেবল নিজের কথাই বলে না পৌঁছে দেয় বৃহত্তর কোনো বার্তা যা তুলনীয় কোনো অঘটনের সাথে। সিলভিয়ার "ড্যাডি" কবিতাটি একটি নিদর্শন যেখানে বাবাকে লেখা কবিতা তার বাবার প্রসঙ্গে উচ্চারিত হলোকাস্ট শব্দটি।
আমরা আলোচনা করব ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অনুন্নত ধর্মীয় রাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া এক নারীর,এক কবি ও চিকিৎসকের। এক সংকীর্ণ সমাজে দাঁড়িয়ে তিনি নারীমুক্তি,যৌন স্বাধীনতা ও বাক্ স্বাধীনতার জন্য লিখছেন/লড়ছেন। লিখছেন তার ব্যক্তিগত জীবনের বঞ্চনার কথা তথা একটি ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশে সামগ্রিক নারীদের প্রতিনিধি হয়ে। কনফেশনাল কবিতার বৈশিষ্ট্য এটাই।আত্মগত বয়ানে সমষ্টি র কথা।

"এসব দিন রাত,এসব সময়, এসব বিয়ে
আমার করার কিছুই নেই,
জীবন আর মৃত্যু একাকার হয়ে গেছে 
কিছু আর করার থাকে না
কিছু না।
আমি এখন মৃত্যু থেকে জীবনকে বলে কয়ে ও সরাতে পারি না,
জীবন থেকে মৃত্যুকে আলগোছে তুলে নিয়ে রাখতে পারি না আপাতত।"

কনফেশনাল কবিতার সব বৈশিষ্ট্য এখানে দেখা যাচ্ছে।

".....কান্না রেখে একটুখানি বস
দুঃখ-ঝোলা একেক করে খোল
দেখাও,তোমার গোপন ক্ষতগুলো 
এ কদিনে গভীর কতো হলো,
ও মেয়ে শুনছ!
বাইরে খানিক মেলে দাও তো এসব
দুঃখ তোমার একদম গেছে ভিজে .....
হাওয়ার একটি গুণ চমৎকার 
কিছু দুঃখ উড়িয়ে নেয় নিজে।
ও কি গুনছ!
দিন!
দিন তো যাবেই! দুঃখ পোষা মেয়ে!
শুকোতে দাও স্যাঁতসেঁতে এ জীবন 
রোদের পিঠে আলোর বিষম বন্যা
হচ্ছে দেখা,নাচছে ঘন বন.....
সঙ্গে সুখী হরিণ।
ও মেয়ে বাসো,
নিজের দিকে দু চোখ দাও,
নিজেকে ভালোবাসো।
(দুঃখ পোষা মেয়ে) আমার অন্যতম প্রিয় কবিতা।

তসলিমা নাসরিনের কবিতা অনেকটাই আত্মগত কবিতা বা কনফেশনাল পোয়েট্রি।
কনফেশনাল কবিতার ছন্দ বৈশিষ্ট্য তাঁর কবিতায় প্রতীয়মান।একটা rhyme style, যে ছন্দ শিশুদের জন্য লেখা হয়।সিলভিয়া প্লাথ কিছু কবিতায় এমন ছন্দ ব্যবহার করেছেন।
   একটা প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য, যে সময় তসলিমাদি বাংলাদেশে কবিতা লিখতে শুরু করেন সেই সময় খুব অল্প মহিলা লেখালিখি করছেন এবং সেই সব লেখার মূল বিষয়বস্তু ছিলো কিভাবে সংসার ভালো করে করা যাবে, সন্তান পালন করার নিয়ম কিংবা স্বামীকে সুখী করার কথা। "মহিলাঙ্গন" বা উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয় "বেগমপত্রিকাতেও এই ধরনের লেখা।এর বাইরে মহিলাদের কম্যুনিস্ট পার্টি র যে পত্রিকা বেরোতে তা সাম্যবাদী পত্রিকা আক্রমণ করেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে। তসলিমা নাসরিন সরাসরি আক্রমণ করেছেন ইসলাম ধর্মের গোঁড়ামিকে (যদিও তারও অনেক বছর আগেও দুইজন অধ্যাপক ভিন্ন সময়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি র খোলাখুলি সমালোচনা করেছিলেন কিন্তু তা ছড়িয়ে পড়েনি)
এমনকি পরবর্তীতে আহমেদ ছফা ও ফরহাদ মজাহার ও স্বাধীন চিন্তাধারার জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন দিক্ষণপন্থী দলে।তসলিমা নাসরিন সেখানে এক "তসলিমা প্রজন্ম" সৃষ্টি করতে সফল হয়েছেন।
তসলিমাদি একা এক নারী হিসেবে একের পর এক লেখার মাধ্যমে সামাজিক নানা কুসংস্কার তথা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। লাইম লাইটে আসার জন্যে যদি হয় হোক অথবা স্ট্র্যাটেজিক্যালি তিনি বেছে বেছে শব্দ ও বাক্য প্রয়োগ করেছেন এখনো করেন যা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের মতো 
একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে।
"গর্ভধারনে নারীর স্বাধীনতার দাবি না করে তিনি সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন, "জরায়ুর স্বাধীনতা শব্দবন্ধটি। খালেদা জিয়া সরকার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে তসলিমাদির বিরুদ্ধে সরব সমস্ত ধর্মীয় নেতাদের চাপে। তার পরিবারও সেদিন ছিলো না তার পাশে। রাষ্ট্র শক্তি কে ক'জন চ্যালেঞ্জ করতে পারে। সব্যসাচী হয়ে তার পরেও তসলিমা নাসরিন লাগাতার গদ্য ও কবিতা রচনা করে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও ক্ষত বিক্ষত হতে হতে।

".......আগাগোড়া তুমি সেই তুমি 
বড়শিতে শুধু গেঁথেছেন দু' চার খেলা
অলস বিকেল খেলে খেলে পার হলে
রাত্তিরে ভালো নিদ্রাযাপন হয়।

তুমি তো কেবলই নিদ্রা সুখ চেনো
একশো একর জমি নিজস্ব রেখে
এক কাঠা খোঁজো বার্গার তাড়নায় 
বার্গার চাষ পৃথক স্বাদের কিনা!
...........
............
বড়শিতে গাঁথা হৃদপিণ্ডের আঁশ
ছিঁড়ে খেতে চাও তুমি তো পুরুষ ই
খাবে।
সাঁতার জানি না,মধ্যনদীতে ডুবি
অন্ধকে টোপ দেবার মানুষ নেই।"(টোপ
আরেকটি প্রিয় কবিতা।
"ভুল প্রেমে কেটে
গেছে তিরিশ বসন্ত 
তবু
এখনো কেমন যেন হৃদয় টাটায় প্রতারক পুরুষেরা এখনো আঙুল ছুঁলে
পাথর শরীর বেয়ে ঝরণার জল ঝরে।"(তসলিমা নাসরিন
          _____














Jayeeta Bhattacharya

 কলকাতা নিবাসী ও অধ্যাপিকা জয়িতা ভট্টাচার্য গত দশ বছর যাবৎ কবিতা গদ্য,অনুবাদ লিখছেন নিয়মিত ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়।অদ্যাবধি প্রকাশিত চারটি কবিতার বই ও একটি উপন্যাস।অজস্র সংকলনে লেখা স্থান পেয়েছে।

Post a Comment

0 Comments