শ্রদ্ধেয় কবি সমর চক্রবর্তীর "বঙ্গনগরীর বাউলাকাশ" কাব্যগ্রণ্থ প্রসঙ্গে কিছু কথা না লিখলেই নয়, কারণ তার এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা যতোবার পড়ি ততোবার মুগ্ধ হই।
“বঙ্গনগরীর বাউলাকাশ” কবি সমর চক্রবর্তীর একটি আত্মপ্রত্যয়ী কাব্যগ্রন্থ।
কবি তার কবিতায় সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ভাবে আধুনিকতার ছোয়ায় ফুটিয়ে তুলেছেন গভীর দেশপ্রেম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রেম, বিরহ, বাস্তবতা ও সুপ্রাচীন ইতিহাস।
‘বঙ্গনগরীর বাউলাকাশ’ কাব্যগ্রন্থটির প্রথম কবিতা, এই কবিতায় তিনি লিখেছেন_
মাটির গোপন রেনু মাখি গায়ে
পূর্ব পুরুষের মাথার কসম খেয়ে সামনে দাঁড়াই
এ মাটি আমার
এই মাটির কাদাজলে আমার চৌদ্দ পুরুষের ইতিহাস।
গভীর দেশপ্রেম প্রকাশের সাথে সাথে তিনি এই কবিতায় তুলে ধরেছেন প্রাচীন ঐতিহ্য সংস্কৃতি।
এই কবিতাটি আরো কিছু পঙক্তি হৃদয়ে আন্দোলিত করে। যেমন -
ফিরিয়ে দাও আর্য,ফিরিয়ে দাও
রক্ত-ঘামে লেখা মানুষের প্রাচীনলিপি
কালের কলম, লাঙলের ইতিহাস
স্বপ্নবিপরে মৃত্যুঞ্জয়ী জন্মক্ষুধা...
প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে যেনো পান্ডুলিপির ফ্রেমে ও প্রেমে বাঁধাই করেছেন ‘আমার ঠাকুরমা এক মৎস্যগন্ধা নদী’ কবিতাটিতে।
জীবনের স্বপ্ন ভাঙার যাতনা মন্ত্রের প্রতিধ্বনি ও বাস্তবতার গান লেখা যেনো ‘বাবার স্বপ্ন’ লেখাটিতে।
বাবার স্বপ্নপোড়া দীর্ঘশ্বাসে বেজে ওঠে সাতান্ন বছর বয়স...
আবার জ্যামিতিক প্রকাশে আত্মকেন্দ্রিক হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করেছেন , ‘বিন্দুতে কম্পাস’ কবিতায়।
কবিতাটির প্রথম পঙক্তি-
বিন্দুতে কম্পাস ঘুরিয়ে বৃত্তের কোন ব্যাসার্ধ আঁকনি তুমি.....
জীবনের নানা বাস্তবতা, জীবনের চেতনাবোধ, সমাজ, সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিক জগতের লস্টালজিক জ্ঞান ও আত্মার নিগূঢ়তম অনুভুতির গভীর প্রেমে বাস্তব চিত্র অঁঙ্কিত করেছেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে।
‘বঙ্গীয় নগরীরর শ্যামল গ্রাম’ কবিতার এই পঙক্তিটি যেনো জীবনের এক কঠিন বাস্তব-
“ঋণের মুদ্রায় বাধানো সোনার দাঁত চিকচিক হেসে ওঠে এনজিও রোদে”
অসাধারণ অভিব্যক্তির প্রকাশ করেছেন প্রতিটি কবিতায়।
শৈল্পিক নিপূনতার সাথে তিনি শূন্যতার মাঝেও সৃষ্টি করে প্রেমিকার হাসিমাখা ঠোঁট, বিরহের মাঝেও সৃষ্টি করে মিলনের সুর স্মৃতিময় দোত্যনায়।
কালের কালচক্রে মূল্যবান সময়ের বুকে সৃষ্টি করে স্মৃতিচিহ্নের হৃদয়গ্রাহী আল্পনা। প্রতিটি পঙক্তি যেনো হৃদয়কে অান্দোলিত করে নিজের অজান্তেই...
কবির ভাষায় -
সময় এমন এক সুউচ্চ মিনার
মাটিতে দাড়িয়ে থাকা আমাকে দেখতেই পেল না
আমি পাহাড় বেয়ে উঠলাম
সমুদ্রের গভীরে ডুবে গেলাম
পরিত্যক্ত কিছু হাহাকার ছারা
আমার মুঠোয় আর কিছুই উঠে এল না।
কবি যেনো শব্দের অলঙ্কারে হৃদয়ের প্রাসাদ সাজিয়েছে সুনিপূন যত্নে।
যেমন -
জীবন ছুটে চলে অর্ধনগ্ন উন্মাদ ঊর্ধ্বশ্বাসে সময় জুড়ে হাসে কনজ্যুমার সংস্কৃতি!
ওহ্ আমার হুম হুম হুমনা সুর ব্যঞ্জনার গোধুলিমায়া.....
সুখ - দুঃখের দোলাচলে জীবনের ভেতর জীবন আঁকে কবির আত্মার দিব্যজোত্যি।
শহর, নগর, গ্রামের পথে প্রান্তরে হেটে যেতে যেতে কবি শব্দের বীজ রোপন করে।
জল -স্থল, পাহাড় -সমুদ্র, পশু- পাখি, আকাশ বাতাস, বৃক্ষলতার গভীরে কবি প্রবেশ করে আত্মার নিগূঢ়তম প্রেমে।
বোধের অবস্থান থেকে মানুষ কিভাবে প্রকৃত মানুষের স্বরূপ অনুধাবন করতে পারবে, কবি তার চেতনাবোধ থেকে সেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তার ‘স্বরূপ’ কবিকাটিতে
যেমন,
তাকাই না ভয়ে আয়না ও জলে
মুখ দেখে যদি নিজেকে না যায় চেনা,
তারচে বরং গাছের ছায়ায় বসি সবিস্ময়ে জেনে নিই, অামিও মানুষ কী না!
নিজস্ব প্রকৃত সত্ত্বার থেকে বড় অায়না পৃথিবীতে নেই কবির কবিতাটিতে সেটাই স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে।
দুস্থ অসহায় শিশুর জীবনের রঙিন স্বপের বীজ ধোঁওয়ার মতো বাতাসে ওড়ে, জীবন বৃন্তে ওরা সেই সুন্দর সোনালি স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত করতে পারে না। ঘন অন্ধকারের বুকে হাজারো কোমলমতি শিশুর স্বপ্ন অবহেলায় ডুবে যায় গভীর ঘুমে। কবি এমনটাই যেনো প্রকাশ করেছেন তার ‘পার্কের শিশুগুলো’ কবিতায়।
জীবন মৃত্যুর পরিক্রমাই জন্মান্তরের উপলব্ধি প্রকাশ ও জীবনের ভেতর জীবন সাজিয়েছেন অভূতপূর্ব ব্যাখ্যায় ‘জীবনপুরাণ’ কবিতাটিতে।
কবির ভাষায়-
বুক থেকে ঝরে গেছে যেসব
হৃদয় মাটিতে তাদের গুচ্ছ গুচ্ছ চোখ গাছ হয়ে ছায়া দ্যায় আমারই কঙ্কালে!
কবিতাটির শেষ পঙতিটি আশ্চর্য রকমের মাধুর্য মেশানো..
“নিজের সামনে সাজানো নিজেরই মাংসের দোকান!”
দৈনন্দিন জীবনের কঠিন বাস্তবতা,জন্ম- মৃত্যু,
প্রেম- বিরহ, রাগ- অনুরাগ, দাম্পত্য জীবন ও সত্য - মিথ্যার নানান বহুমাত্রিক অভিব্যক্তির প্রকাশ করেছে। আধুনিকতা সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় জাগতিক চেতনাবোধের শিল্প সৃষ্টি করেছেন কবি অভাবনীয় সৌন্দর্য অলঙ্কারে।
বাস্তবতার নিরিখে যেনো পৃথিবীর বুকে প্রদক্ষিণ করে কবিতার ভাষায়।
কবি হৃদয়ের বিশালাকার পৃথিবীর বর্ণনা দেবার মতো ভাষা আমার জানা নেই।
সামান্য পাঠক হিসেবে নিজের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছি শ্রদ্ধেয় কবি সমর চক্রবর্তীর "বঙ্গনগরীর বাউলাকাশ" কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা পড়ার মুগ্ধতায়।
0 Comments