কুলছুম শেলী’র গল্প ~ আনন্দ অশ্রু

Kulchum Shelley's story


টাকা হাতে পেলেই হাত খচখচ করে খরচ করার জন্য তাই না!
রেগে গিয়ে কথাটা বলল সেজান।আমার সংসারে এভাবে দুহাত ভরে খরচ করার অনুমতি নেই। আমি বলেই দিয়েছি চল্লিশ হাজার টাকা বাজেট।এবার ইদে এর বেশি একটা টাকাও খরচ করবে না।
গতক’দিন আগে অনলাইনে ১৫০০ টাকার খাবার অর্ডার করেছিল তিথি। পার্সেল দেখে সেজান ঠিক একই রকম কথা বলেছিল সেদিন।তিথি যখন খাবারের টেবিলে সবাইকে উৎসাহ নিয়ে অর্ডার করা খাবার পরিবেশন করছিল তখন সেজান বলে উঠল, আমি যেখানে সেখানে এভাবে টাকা ফুরাতে পারব না।
সেই খাবারটি আর গলা দিয়ে নামাতে পারেনি তিথি। 
আজও যখন সারাটাদিন ইস্টার্ন প্লাজা, গাউছিয়া, নুরজাহান আর নিউমার্কেট ঘুরে ঘুরে তিথি শশুর বাড়ি আর বাবার বাড়ির জন্য কেনাকাটা করে সবে বাড়িতে এসে উৎসুক মুখে কার জন্য কী কিনেছে, কতটা চিপ রেট, কতটা টেকনিক আর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা বলছিল ঠিক এমন মুহুর্তে সেজান কথাটি বলে বসল। তিথির সারাদিনের পরিশ্রান্ত মন যেন বিস্বাদে কানায় কানায় পূর্ণ এখন। যেমন, কেটে যাওয়ার পর যখন আনাড়ি নার্স  সেই ক্ষত স্থানটি আবার অনভ্যস্ত হাতে ড্রেসিং করে সেই সময় চিৎকার করা যায়না।কিন্তু যন্ত্রণাটা তুষের আগুনের মত ভেতরটা পুড়িয়ে দেয়। ঠিক তেমন দলা পালানো কষ্টে তিথির অন্তরটা টনটন করে ওঠে।
তিথি মনে মনে ভাবে টাকাতো মানুষের বেঁচে থাকতেই প্রয়োজন।মানুষের কবরটাতো অর্থ, সুখ আর বিলাসিতার উর্ধে। আর সিজান শুধু একা ইনকাম করেনা। তিথিও অল্প বেতনের একটা চাকরি করে। দুজনের বোনাস আর তার সাথে কিছু টাকা যোগ করে সবাইকে ইদে কিছু দিতে চায় তিথি। 
সেজানও তার পরিবারের জন্য প্রয়োজনে খরচ করতে কার্পণ্য করেনা। কিন্তু তিথির কোন স্বাধীনতা নেই নিজের ইচ্ছে মত অন্যকে কিছু দেবার। এত টাকা খরচ হচ্ছে এটা সেজানের রাগ নয়। রাগ হচ্ছে তিথি যা বলবে তা শুনতে হবে কেন! এতে পৌরুষত্ব মলিন হয়ে যায়।
মানুষকে ভালোবাসলেও আঘাত পেতে হয়। না দিলেও অপর পাশ থেকে শুনতে হয় কৃপণ। দুজন চাকরি করে তবুও নিজেদেরই হয়না। এসব মিষ্টি টিপ্পনি তিথি শোনে রোজ। শুধু যে কথার ভয়ে তা নয়। তিথির সবাইকে বিশেষ দিনে কিছু উপহার দিতে ভালো লাগে। ইদকে সামনে রেখে তাই কেনাকাটা করেছে সবার জন্য। তিথি বিশ্বাস করে রাসূলের কথা সম্মান করে...। রাসূল (সা) বলেন "তোমরা একে অন্যকে উপহার দাও। এটি মনের শত্রুতা ও বিদ্বেষ দূর করে দেয়।( তিরমিযী ২১৩০)
    ব্যথাতুর মনটা নিয়ে তিথি ঘরকন্নার সব কাজ সেরে ঘুমাতে গেল। সকালে অফিসে গিয়ে আবারও সারাদিনের ঝক্কি সামলানো। বাড়িতে ফিরে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে গিফট গুলো পৌঁছে দিল। পরদিন আবার অফিস,ব্যস্ততা, হুড়োহুড়ি করে বাসে ঝুলে বাড়ি ফেরা। কারণ তার চাকরিটা তো কর্মচারী লেভেলের।প্রাপ্তির চেয়ে পরিশ্রম তাই বেশি। 
ঠিক দুদিন পর ননদের ফোন-
ভাবি কেমন আছো
এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?
ভালো আছি ভাবি।
সবার ড্রেসগুলো পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ ভাবি সেটা জানানোর জন্যই তো ফোন দিলাম। 
আচ্ছা বলো।
ভাবি,সবগুলোই সুন্দর হয়েছে। তবে রাহাদের পাঞ্জাবিটার কালারটা একটু বেশি টকটকে। রাহাত বলছে এগুলো পোশাক পুরান ঢাকার লোক বেশি পরে। আরও অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথা শোনার পর ফোনটা ব্যস্ততার জন্য রেখে দিল। হাতের কাজগুলো গুছিয়ে অফিস থেকে বের হবে তার ঠিক পাঁচমিনিট আগে বড় জা ফোন করল- তিথি কেমন আছো গো?
আপা ভালো আছি। তারপর সবার পোশাকগুলো ঠিকঠাক হয়েছে তো? 
সব ঠিক আছে তিথি। তবে মিলি বলছিল চাচিম্মা এবার কেনাকাটায় বেশি সময় পায়নি হয়তো। 
মিলি একথা বলল কেন ভাবি?
না মানে, মিলি বলছিল ওর জামাটা এডাল্ট বয়সি। ওর কলেজের মিস নাকি এসব ত্রিপিস পড়ে। 
বুকের ভারটা কমানোর জন্য চুপ থাকল তিথি। 
রাতে সেহরির তরকারি চুলায় বসিয়ে, প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপ সবে মাত্র হাতে নেবে এমন সময় শ্বাশুড়ি ফোন দিলেন। সালাম আর কুশলাদি বিনিময় করে তিথি নিজের থেকে জানতে চাইল আম্মা শাড়ি গুলো পছন্দ হয়েছে? জানেন আম্মা আপনার আর মা’র জন্য এবার সবথেকে বেশি সময় নিয়ে শাড়ি চয়েস করেছি। আম্মা সেসব শুনলেন কিনা বোঝা গেল না। তিনি বললেন- আচ্ছা তিথি, আমাকে কী তোমার বুড়ী মনে হয়! নাকি বয়সের আগেই আমাকে বুড়ী বানাতে চাও? 
তিথি বলল- কেন আম্মা এভাবে বলছেন কেন?
আম্মা বললেন- এরকম চোখ বন্ধ করা রংয়ের শাড়ি কি আমি পরি?
তিথি বলল- আচ্ছা আম্মা। ইদে আসার সময় আপনার জন্য কালারফুল আরেকটি শাড়ি নিয়ে আসব।
আহারে এত সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে সবার জন্য কেনাকাটা করে তবুও কারো মনে জায়গা করতে পারল না। মানুষকে ভালোবেসে কলিজাটা ভুনা করে দিলেও কেউ বলবে লবণ কম। কেউ বলবে ঝাল একটু বেশি! 
    আগামীকালের জন্য বাবার বাড়ির গিফট গুলো গুছাতে গুছাতে তিথি ভাবছিল পর তো পর। আপনজনেরা নিশ্চয় তাকে বুঝবে। গিফটগুলো পৌছানোর পর কয়েকদিন পার হয়ে গেল। কারও কোন সাড়া না পেয়ে একদিন লাঞ্চ ব্রেকে তিথি নিজেই জানার জন্য মাকে ফোন করল। মা বলল- সবার সবকিছুই পছন্দ হয়েছে। তবে তনু বলেছে, রোহানের গেঞ্জি নাকি বড় হয়েছে। তিথি বলল কেন! তনু যে মাপটা দিয়েছে সে অনুযায়ীই তো কিনেছি। মা বলল- তনু নাকি তোকে বলেছিল কেনার আগে ফোন দিতে। তিথি বলল মা মার্কেটে যে ভীড় অত কথা কী আর মনে থাকে!
ছোটভাইকে ফোন দিল তিথি। কীরে তপু কিছুইতো জানালি না! টি-শার্টটা পছন্দ হয়েছে?
তপু বলল তিথিপা সত্যি একটা কথা বলবে। তুমি টি-শার্টটা শো-রুম থেকে কেনোনি তাই না? নিশ্চয় নিউমার্কেট থেকে কিনেছো। ঠিক বলেছি তো?
কিছু কথার পাশে নিরবতা অলংকারের মত শোভা বর্ধন করে মনে মনে ভাবে তিথি।
ছোট খালা রাখিকে ফোন দিল আরও দু’তিনদিন পর। কারণ বাবার বাড়ির সবার মধ্যে উনার শাড়িটাই কিনেছে বেশি সময় নিয়ে। বড্ড খুঁতখুঁতে। খালা ফোন পেয়েই পূর্বের মত বলল জানিস আমি এখনই তোকে ফোন দেব ভাবছি। তার পর টেপরেকর্ড বাজতে লাগল। জানিস রুপোস না আমার জন্য এবার আড়ং থেকে যে দুটো শাড়ি এনেছে। তোকে কী বলব! খুবই সুন্দর হয়েছে। যেমন গর্জিয়াস তেমনই সফট্।তিথি বলল- খালা এবার ইদে তাহলে তো তোমার বেশ ভালো কেনাকাটা হলো। খালা বললেন- কোথায় আর তেমন! সেদিন বসুন্ধরা থেকে দুটো থ্রিপিস কিনেছি। তোর খালুকে বলেছি সুতি আর দু-তিনটে কিনব। সে আর সাহস করে তার দেওয়া গিফটের কথা বলল না। কথার মাঝে খালাই বললেন- তিথি তোর শাড়িটা এবার বেশি সাদামাটা হয়েছে। তিথি বলল, না পরলে কাউকে দিয়ে দিও খালা। খালা বললেন- ঠিক বলেছিস বুয়াকে দিয়ে দেব। মনটা বিষ ফোঁড়ার ব্যথার মত টনটন করে উঠল। কষ্টটা নিচ থেকে জমাট হয়ে গলায় এসে আটকে আছে কিছুতেই গিলতে পারছেনা। কী অদ্ভুত একটা বিষয় শুধু দ’জন ছাড়া এতগুলো মানুষকে ফোন দিয়ে শুধু প্রবলেমই শুনল। কারো মনের মত ড্রেস হয়েছে তা শুনতে পেল না। অবাক করা বিষয় আরও যেটা, বাকি আর কেউ ফোন করে একটু সৌজন্যবোধটাও প্রকাশ করল না! অথচ বলা হয়, কেউ কিছু গিফট করলে তাকে নূন্যতম একটা থ্যাংকন্স জানানো এক প্রকার ভদ্রতা। রাসুলও (সাঃ) তো বলেছেন-কারো উপহারকে সামান্য /তুচ্ছ জ্ঞান না করতে, যদি তা বকরীর পায়ের ক্ষুরও হয়। 
তিথি মনে মনে ভাবল ভুলটা তারই হয়েছে। কাউকে খাইয়ে আর পরিয়ে কখনও খুশি করা যায়না।
কাউকে  খিচুড়ি দিলে আরেক জায়গায় বিরিয়ানি খেয়েছে বলে খিচুড়ির স্বাদটা পানসে লাগে। কী আজব আর কত বৈচিত্র্য মানুষের মন। আপনি সূতি দিলে তারা বলবে জর্জেট পছন্দ, প্যান্ট দিলে বলবে লুঙ্গি  পছন্দ, জামা দিলে বলবে শাড়ি পছন্দ। শাড়ি দিলে বলবে দামটা কম মনে হয়।ঠিক তেমনই খাবারের বেলাতেও। তিথি ভাবল, মহান আল্লাহ এত এত নিয়ামত দিয়েছে সবার সুন্দর জীবন যাপনের জন্য তাই মানুষ শুকরিয়া করেনা। আর এতো সামান্য উপহার। নিছক একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে তিথি সবকিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করে।
    একসপ্তাহ ইদের ছুটি শেষে তিথি আজকে সকাল সকাল অফিসে এসেছে। দীর্ঘ সাতদিনের ছুটির পর অফিস খুলছে। জ্যাম আজকে নিশ্চিত। তাই অফিস টাইমের অনেক আগেই বেড়িয়েছিল। অফিসে ঢুকতেই দেখে মোড়ের পিচ্চি সাবিহা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ পড়তেই কাছে এসে লম্বা একটা সালাম দিল। সাবিহাকে আজকে দারুণ দেখাচ্ছে। ও মোড়ে ফুল বিক্রি করে। বাসায় ফিরতে মাঝে মাঝে ওর থেকে ফুল কেনে তিথি। সেই থেকে পরিচয়। কোনদিন সে ফুল গলায় পরতে দেখিনি। একদিন মালা কিনে ওকে দিয়ে বলেছিল সাবিহা এটা তোমার, তুমি পরো। সাবিহা বলেছিল আপু, এসব পোশাকে এমন সুন্দর মালা মানাবে না। আপনি নিয়ে যান। আজ দেখে ও মালাও পরেছে। কাছে এসে বলল- আপু আপনার দেয়া ইদের জামা পরেছি। মা বলল আপুকে গিয়ে দেখিয়ে আয়। শখ করে দিয়েছে... আপু, মা আর আমি খুব খুশি হয়েছি। সকাল সকাল এসেছি পরে আবার গেটেও দাঁড়াতে দেবে না সেজন্য। 
তিথি দেখল জামাটা বেশ বড় হয়েছে। আগামী বছর লাগবে ঠিকঠাক। আসলে এত ভেবে চিন্তে ড্রেসটা কেনেনি তিথি। হঠাৎ চোখে পড়ল, আর চিপ রেট, তাই কিনে ফেলল। অথচ ওর খুশি দেখে আজকে  তিথির নিজেরই লজ্জা লাগছে। সাবিহা তাকে দুটো মালা উপহার দিল। বলল- মা দিতে বলেছে।
তিথি কিছু বলতে পারল না । উপহারটা নিয়ে অফিসে ঢুকে গেল। তিথির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছতে ইচ্ছে করছেনা। কোন পরিকল্পনা বা, কোন সময় ব্যয় করেনি তিথি। চোখে পড়েছিল আর সাবিহার কথা মনে হতেই কিনে নিয়েছিল। কাঁধ ঝুলিয়ে পড়া জামা নিয়েও সাবিহার চোখে মুখে কী নির্মল উচ্ছ্বাস। জীবনটা কত সহজ এদের কাছে! জীবনের আনন্দগুলো কত অল্পতেই ধরা দেয় এদের। তৃপ্তির আনন্দ ওদের কতটা সহজ।
তিথি বিগত দিনের আপনজনের কথাগুলো আর সাবিহার উচ্ছাস কিছুতেই মেলাতে পারছেনা। চোখের পানি পড়ছেই। তবুও তিথির ইচ্ছে করছে না মুছতে। চোখটা ঝাপসা হচ্ছে হোক। চোখটা কাঁদুক। পড়ুক জল অঝোরে। আনন্দের কান্না, সুখের কান্না কাঁদতে বড্ড আরাম লাগে। চোখের প্রশান্তি হয়। জীবনে এমন আনন্দ অশ্রুর খুব প্রয়োজন, খু্উব।

Post a Comment

0 Comments