সরদার মোজাফ্‌ফর হোসেন এর গল্প “হাট ভাঙার আগে”

 
Sardar Mozaffar Hossain's story "Before breaking the hat"




 
একটু শীত শীত করছে ওর। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই মাগরিবের আজান হয়েছে। জানালাতে এখন আর ভিড় নেই। একটা দুটা মাথা মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। উঁকি দিয়েই সরে যাচ্ছে। ঘরের ভিতরটা অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কারণে ওকে আর ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছে না কেউ। বাহিরে এখনও অন্ধকার ঘন হয়নি। ঘরের কোণে বসে সে জানালার ধার দিয়ে হেঁটে যাওয়া হাটুরে মানুষগুলোর মাথা দেখতে পাচ্ছে এখনও। যখন আলো ছিল, জানালাতে একজন আরেকজনকে ঠেলাঠেলি করে মানুষগুলো ওকে দেখছিল। যেন ফাঁদে-আটকা কোনো জন্তু দেখছে। ওর মতো অল্প বয়সী কেউ কেউ ঢিল ছোঁড়াছুঁড়িও করেছে। এদিক ওদিক সরে গিয়ে কোনো রকমে রক্ষা পেয়েছে সে।
 
এবার নিয়ে তিনবার ধরা পড়ল সে। মাস পাঁচেক হয় এ লাইনে নেমেছে। ওস্তাদ অবশ্যি এত তাড়াতাড়ি হাটে বাজারে ঢুকতে নিষেধ করেছিলো। প্রথম প্রথম বাস বা ট্রেনে হলে ধরা পড়ার ভয় কম থাকে। ট্রেনে সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু ট্রেনে ভালো পোষাচ্ছিলো না দেখে ওস্তাদকে অনুরোধ করে হাটে নামা শুরু করেছে দু’মাস হলো। এরই মধ্যে ধরা পড়ল তিনবার। প্রথম দু’বার অল্পতেই ছাড়া পেয়েছে। কম বয়স বলে বেশি মারধর না করে পুলিশে দিয়েছিল। ওস্তাদ গিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে।
 
আজ কপালে কী আছে বুঝতে পারছে না সে। ঘণ্টা দেড়েকের মতো হলো ওকে আটকে রাখা হয়েছে এ ঘরে।
মনে হচ্ছে এটা একটা স্কুলের অফিস ঘর। ঢোকার সময় দেখেছিল বড় একটা টেবিলের দু’পাশে সারি করা অনেকগুলো চেয়ার। ঘরের মাঝামাঝি একসাথে লাগানো কয়েকটা আলমারি। আলমারিগুলো দেয়ালের মতো হয়ে ঘরটাকে দু’ভাগ করেছে। ওকে রাখা হয়েছে আলমারিগুলোর পেছন দিকে। এপাশে দেয়ালে ঝুলানো কয়েকটা ম্যাপ, একটা টেবিলের উপর চকের প্যাকেট, কয়েকটা ডাস্টার, অনেকগুলো বেত, একটা প্লাস্টিকের জগ, ঘরের কোণে মাটির একটা কলস, আরেক কোণে দু’টো ঝাঁটা।
 
এরা কি বেত দিয়ে মারবে ওকে ? হাতের মার সহ্য করা কঠিন না। কিন্তু বেতের শপাং শপাং --- ! মনে মনে শিউরে ওঠে সে। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে এরা তেমনটা করবে না। যা বাঁচান বাঁচিয়েছে তখন। ‘সরকারি মার’ থেকে রক্ষা পাওয়া চাট্টিখানি কথা না।
 
এ লাইনে মারের বিভিন্ন নাম আছে। দু’আনি মার, খুচরা মার, পাইকারি মার, সরকারি মার, হাড্ডি-ফাটা মার - কত নাম। সবচেয়ে শান্তি দু’আনি মারে। দু-চারটা চড়-থাপর আর নাক ছেঁচড়। সবচেয়ে কঠিন হাড্ডিফাটা মার। পুলিশের ডাণ্ডার বাড়ি নাকি হাড়ে চিড় ধরায়। আর, বিপদ বেশি থাকে সরকারি মারে। তখন চোখ, নাক, মুখ আর তলপেট সামাল দিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকতে হয়। আজ সেই সরকারি মারেই মধ্যেই পড়েছিল সে।
 
দুপুরের অনেক আগেই হাটে এসেছে ওরা। ওরা মানে ওর সাথে একজন সেকেন্ড ওস্তাদ। বড় অস্তাদ এখন আর কাজে বের হয় না। ওদের আটজন সেকেন্ড ওস্তাদ আছে। কারও দায়িত্ব ট্রেনে, কারও বাসে, কারও হাটে। এদের কাজ নতুনদের দেখেশুনে কৌশল বাতলে দেওয়া আর বিপদ বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া। ওরা দু’জন হাটের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘুরে দেখেছে। মাঝারি সাইজের হাট। পশ্চিম দিক থেকে এসে হাটের দক্ষিণ ধার ঘেঁষে একটা নদী পূর্ব দিকে খানিকটা এগিয়ে দক্ষিণে চলে গেছে। নদীর ধারে দু’টা গরু আর একটা মোষ জবাই করা হয়েছে। ছাগলও জবাই হয়েছে কয়েকটা। সেগুলোর চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে। হাটের উত্তর পাশে টানা স্কুলঘর। স্কুলঘরের সামনের মাঠে একটা দু’টা করে গরুর গাড়ি এসে একসার হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দাঁড়াচ্ছেনা ঠিক, গাড়িয়াল গরুগুলোকে একপাশে খড় খেতে দিয়ে গাড়িগুলো উপুড় করে ফেলে রাখছে নামাজের সেজদার মতো করে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো গরুর গাড়ি নিয়ে ধান কেনার জন্য মহাজনেরা এসেছে পশ্চিম থেকে। গৃহস্থরা কেউ ডালিতে, কেউ বস্তায় ধান নিয়ে এসে জমা হচ্ছে মাঠের মাঝামাঝি। কাঁধে ভার-ডালি নিয়ে আরও অনেক মানুষ আসছে দলে দলে। কেউ আনছে বেগুন, কেউ কপি, কেউ আলু, কেউ টমেটো, কেউ মুদি দোকানের মালপত্র – আরও কত কী।
 
দেখতে দেখতে হাট জমে উঠলো। গমগম করছে চারদিক। ওস্তাদ খানিক আগেই ওকে যা বলার বলে সরে পড়েছে। এখন কাজে নামতে হবে। মাঠের একপাশে গোল হয়ে মানুষের একটা জমায়েত তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে ডুগডুগির শব্দ কানে ভেসে আসছে। এক পা দু’পা করে সেদিকে এগিয়ে গেল সে। কাছে যেতেই দেখতে পেল, একটা লোক দাঁত দিয়ে একটা সাইকেল আকাশের দিকে তুলে ধরে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। আর, ওর বয়সী একটা ছেলে ডুগডুগি বাজাচ্ছে। ওর পাশ থেকে একজন বলে উঠলো,
 
-       শালার দাঁতরে বাবা।
অন্য আরেকজন বলল,
 
-       অর নাম কী, জানিস ? আজরাইল। একটানে ঘচাং করে পোকা-খাওয়া দাঁত তুলে দেয়।
 
ওদের কথা-বার্তা শুনে বুঝতে পারলো সে, লোকটা দাঁত-মাজার পাউডারের ক্যানভাসার ইসমাইল। হাটে-বাজারে পরিচিত আজরাইল নামে। ছেলে-বুড়োদের নড়ে-যাওয়া পোকা-খাওয়া দাঁত তুলে দিয়ে নিজের তৈরি মাজন বিক্রি করে। ওস্তাদের কাছে শুনেছে সে।
 
যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকে সরে পড়ল সে। ছোট-খাট একটা কাজ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। যা হয়েছে সেটা সেকেন্ড ওস্তাদের কাছে চালান করা দরকার। ওস্তাদ এখন মসজিদের বারান্দায় বসে আছে। কিন্তু তার আগে এই গোল জমায়েতটার ওপাশে একটা চান্স নেওয়া দরকার। একটা লোক হা করে আজরাইলের কাজ-কারবার দেখছে, যাকে খানিক আগে ধান বেচতে দেখেছে সে।
 
আজরাইল একটা পোটলা খুলে ছোট-বড় নানান ধরণের দাঁত দেখাচ্ছে দর্শকদের। কয়েকশ’ দাঁত। সাথে সাথে কোনো কোনো দাঁতের ইতিহাস বর্ণনা করছে বেশ রসিয়ে রসিয়ে।
-       এড্যা হলো, ভাইসব, এক তাগড়া-জোয়ানের আক্কেল দাঁত। গাল ফুলে এক্কেবারে সাত মাসের পোয়াতি বউয়ের প্যাট। ব্যাটা ষাঁড়ের মতন তাগড়া হলে কী হ’বে, ক্যান্দে-ক্যাটে অস্থির...
বেশ মজা পাচ্ছে সবাই। লোকটা তখনও হা করে দাঁত দেখছে আর আজরাইলের রসের কথা গিলছে। বিকালের রোদ তখনও গরম আছে বলে লোকটা তার চাদরটা পুরোপুরি গায়ে জড়ায়নি। ঘাড়ের উপর দিয়ে ওড়নার মতো করে সামনে ঝুলিয়ে নিয়েছে। ভালোই হয়েছে। আজরাইল এখন তার মাজন দিয়ে এক বুড়োর পান-খাওয়া দাঁত মেজে দিচ্ছে। সবার দৃষ্টি সেদিকে। এই সুযোগটাই কাজে লাগালো সে।
 
সব ঠিকঠাক মতোই হলো। কিন্তু ঝামেলা করল পেছন থেকে একজনের ধাক্কা। হুড়মুড় করে পড়ল লোকটার গায়ের উপর। সব টের পেয়ে গেলো ব্যাটা। গায়ের উপর ওকে পেয়ে জাপটে ধরেই চিৎকার জড়ে দিল,
-       পকেটমার, পকেটমার, হামার পকেট মারিচে।
 
যা হবার তা শুরু হয়ে গেলো। পালানোর উপায় না পেয়ে দু’হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকলো সে। ‘সরকারি মার’ এই প্রথম। ঠোঁটের এক জায়গায় কেটে গেলো। মুখে রক্তের নোনা স্বাদ জানান দেয় সেটার। এভাবে কতক্ষণ কাটলো বুঝতে পারলো না সে। উদ্ধার করল হাট-কমিটির লোকজন। পাবলিকের হাত থেকে বাঁচিয়ে আটকে রাখলো এই ঘরে। আচ্ছা, এরা কী করবে ওকে নিয়ে ? পুলিশে দিবে ? নাকি চড়-থাপর আর নাক ছেঁচড় ? জেরা-টেরা তো করবেই। মনে মনে একটা মহড়া দেওয়ার চেষ্টা করল সে।
 
-       কিরে, তোর নাম কী ?
-       সাদ্দাম হোসেন।
-       আসল না নকল ? আর কোনো নাম আছে নাকি রে ?
-       না।
-       বাড়ি কদ্দূর ?
-       শান্তাহার।
-       তোর বাপ কী করে ?
-       বাপ নাই।
-       তোর সাথে আর কে আছে ?
-       কেউ নাই।
-       শান্তাহার থ্যাকে তুই একাই অ্যা‍দ্দূর অ্যাচু ? তোর সাথে আর কেউ নাই ? ঠিক করে ক।
-       সত্যি কচ্চি। আল্লার কসম।
 
ঠাস করে গালে একটা চড় পড়বে তখন।
 
-       মিচ্চ অ্যানা চ্যাংড়া, কথাৎ‌ কথাৎ‌ মিথ্যা কওচু। তোর সাহস তো কম লয় ! তোর জিবা তো ক্যাটে লেওয়া লাগবে রে। ঠিক করে ক তোরা কয়জন অ্যাচু। কত ট্যাক্যা মারিচু অ্যাজকা ?
 
চুপচাপ থাকবে সে। কারণ, ওর কোনো কথাই এরা বিশ্বাস করবে না।
 
-       এর আগে কয়বার অ্যাচু এই হাটৎ‌ ? সত্যি করে ক। ক’দ্দিন থ্যাকে পকেট মারিস ?
-       সত্যি কচ্চি পকেট মারিনি।
 
আবার ঠাস্‌। আগের চেয়ে জোরে। ছিটকে পড়ে যাবে সে। গোঁ গোঁ শব্দ বের হবে মুখ দিয়ে। চোখ উল্টে তুলবে।
 
-       হারামজাদা তো ফিট হয়ে গেছে, পানির ছিটা দেয়া লাগবে।
-       আরে না না, শালা ভান করোচে, পাছাৎ ক’ষে লাত্থি লাগা অ্যাডা।
 
দরজা খোলার শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়ল তার। হারিকেনের ঝাপসা খানিকটা আলো এদিকে এসে পড়ল। চেয়ার টানার শব্দ হলো একবার। তারপর আগের মতো নীরব। উঁকি দিয়ে ওপাশে দেখার চেষ্টা করল সে। যে লোকটা ঢুকেছে সে একটা চেয়ারে বসে কাগজে কী যেন লিখছে। মাথায় একটা ফন্দি এসে গেলো তার।
 
ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে এগুলো। দরজার সামনে বারান্দায় কাউকে দেখতে পেলো না। দ্রুত দরজা পার হলো সে। ঠিক তখনই মাঠে চার-পাঁচ জনকে আসতে দেখলো এদিকে। তাড়াতাড়ি একটা থামের আড়ালে লুকালো। লোকগুলো কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকে গেলো। বারান্দার আলো-আঁধারিতে ওকে দেখতে পায়নি কেউ। 
 
মাঠে গরুরগাড়িগুলো নেই। মানুষের ভিড়ও নেই। এখানে ওখানে দু’তিন জনের জটলা দেখা যাচ্ছে। বাতির আলোতে কোথাও চলছে বস্তা বাঁধাবাঁধি, কোথাও চলছে ভার-ডালিতে মালামাল সাজানো। মাঠের ওপাশে সারি সারি চালাঘরগুলো হারিকেন, কুপিবাতি আর হ্যাজাকের আলোতে ভরপুর হয়ে আছে। বেচা-কেনায় এখনও সরগরম হয়ে আছে ওদিকটা। ঘরে ফেরা মানুষের স্রোতও দেখা যাচ্ছে একটা। সুযোগ বুঝে ওই স্রোতে মিশে যেতে পারলেই হবে। বোকার মতো দৌড়ানো যাবে না। সময়ের অপেক্ষায় থামের গা ঘেঁষে বসে পড়ল সে।
 
ঘরের ভিতর থেকে চড়া গলার কথা-বার্তা কানে আসছে।
-       হাট কুমিটির হাতৎ‌ থ্যাকে পালালো ! মান্‌ষে শুনলে কী ক’বে ?
-       ছিদ্দিক ভাই, আপনে এড্যা কী করলেন, কন তো ! ছোঁড়াডাক আপনে দেখাই পাননি ?
-       আমার মনে হয়, ছেলেটা আশে পাশেই কোথাও ঘাপটি ম্যারে আছে। ছামাদুর, হারিকেন দিয়ে দ্যাখো তো।
 
আঁতকে উঠল সে। কেউ বের হয়ে আসার আগেই বারান্দা থেকে নেমে সামনে হাঁটা শুরু করলো। মনে মনে বলতে লাগলো,
-       এবারকার মতো বাঁচা আল্লা, তুই চ্যালে সব হয় আল্লা, এবারকার মতো বাঁচা।
 
খানিকটা এগুতেই পিছন থেকে টর্চের আলো এসে পড়ল গায়ে। চেঁচিয়ে বললো কেউ,
-       কেরে ওড্যা ? ওই থাম, ওই ওই, কেরে ওড্যা, থাম।
 
একবারও পিছনে তাকায় না সে। হাঁটার গতি বাড়ায়। দ্রুত, আরও দ্রুত পা চালায়। পিছনে তখনও থামতে বলছে,
-       ওই থাম, থাম।
 
ঘরমুখো মানুষের নিরাপদ স্রোতটা তখন ওকে টানছে প্রবল আকর্ষণে।

Post a Comment

0 Comments