কুশল ভৌমিক এর প্রবন্ধ ~ কবিতায় জাদুবাস্তবতা

Kushal Bhowmik's essay is a magical reality in poetry




'জাদু' এবং 'বাস্তবতা' দুটো আলাদা বিষয়। জাদুর সাথে বাস্তবতার আক্ষরিক কোনো সম্পর্কও নেই কিন্তু এই দুটো শব্দ একত্রিত হয়ে সাহিত্যে একটি আবেদন সৃষ্টি করেছে যার নাম 'জাদুবাস্তবতা'। জাদুবাস্তবতা যার ইংরেজি নাম 'ম্যাজিক রিয়ালিজম'  সাহিত্যের সাম্প্রতিক প্রবনতা। 'জাদুবাস্তবতা' শব্দটিই ভীষণ বিভ্রান্তিকর কেননা জাদুর সাথে বাস্তবতা মিশে সবসময় বিশ্বাসযোগ্য ধারণা তৈরি নাও করতে পারে তবে অবশ্যই পাঠকের বোধকে নাড়িয়ে দেবে। জাদুবাস্তবতা কিন্তু অতিপ্রাকৃতবাদ নয়, এটি বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে না বরং বাস্তবতার পরম্পরা বা স্বাভাবিক প্রবাহের ভেতর এমনভাবে জাদু মিশে যায় যাকে একসময় আর বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। অনেকেই জাদুবাস্তবতার সাথে পরাবাস্তবতাকে মিলিয়ে ফেলেন। পরাবাস্তবতার ক্ষেত্রে যা ঘটে তা হলো স্বাভাবিক বাস্তবতাকে পরাভূত করে একটা ঘোরগ্রস্ত জগত বিনির্মাণ এবং সেটাও এক ধরনের বাস্তবতা(আমরা বলতে পারি তৃতীয় বাস্তবতা)  তবে চেতনে নয় এই নির্মাণ সম্পূর্ণ অবচেতনে। ম্যাজিক রিয়ালিজমের ক্ষেত্রে ম্যাজিক এবং রিয়ালিজম পাশাপাশি হাঁটবে, জাদুর সাথে বাস্তবতা মিশ্রিত হবে এবং পুরোটাই চেতনার ভেতর, অবচেতনে নয়। অর্থাৎ লেখক সচেতনভাবেই এই সংমিশ্রণ ঘটাবেন এবং যা ঘটবে তা খুব সহজে ব্যাখ্যা করাও সম্ভব নয়। জাদুবাস্তবতা আসলে কী এ সম্পর্কে ম্যাক্সিকান সাহিত্য সমালোচক লুই লীলের একটি চমৎকার কথা রয়েছে। তিনি বলেছেন - ''আপনি যদি ব্যাখ্যা করতে পারেন এটি কী তাহলে তা জাদুবাস্তবতাই নয়''। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যে জাদুবাস্তবতা একটি আলোচিত বিষয় তবে অনেকই এটিকে ভুল ব্যাখ্যা করেন। অনেকেই ইলিউশান, সুপারন্যাচারালিজম, সুররিয়ালিজমকে ম্যাজিক রিয়ালিজম বলে চালিয়ে দেন। আমাদের মনে রাখতে হবে জাদুবাস্তবতার ক্ষেত্রে লেখায় উপস্থাপিত বিষয়টি ঘটবে আচমকা, মুহুর্তের মধ্যে, ধারাবাহিক বাস্তবতার ভেতর হঠাৎ করে ম্যাজিকের মতো। কিন্তু যারা অনুভব করবেন তারা ঠিকই উপলব্ধি করবেন এই ম্যাজিকের মধ্যে লুকিয়ে আছে গভীর সত্য, চরম বাস্তবতা। 

সাহিত্য সমালোচকদের মতে  'জাদুবাস্তবতা' কথাটি প্রথম উল্লেখ করেন ফ্রানৎস রোহ। তিনি জার্মান চিত্রকলা বিষয়ক একজন সমালোচক। তিনি ১৯২৫ সালে ‘এক্সপ্রেসিওজমুস : মাগ্রিশের রেয়ালিজমুস : প্রোবলেমে ডের নয়েস্টেন অয়রোপেইশেন মালেরাই’ অর্থাৎ ‘এক্সপ্রেশনিজমের পর ম্যাজিক রিয়ালিজম : নবীন ইউরোপীয় চিত্রকলার সমস্যাবলী’ বইতে এ কথার প্রথম সূত্রপাত করেন। রোহ বলেছেন, ‘জাদুবাস্তবতা পরিমিত ও সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী। এটি আবেগহীন এবং ভাবালুতামুক্ত। তাই শিল্পী দৃষ্টি রাখবেন ছোটখাটো গুরুত্বহীন বিষয়ের প্রতি। যা অস্বস্তিকর হলেও নিঃসঙ্কোচে তুলে ধরবেন। এর কাঠামো স্থির, ঘনবদ্ধ, কাঁচে ঘেরা স্থানের মতো। এটি শ্বাসরুদ্ধকর।    

জাদুবাস্তবতার উদ্ভব  চিত্রকলার মাধ্যমে ঘটলেও  এর বিকাশ ঘটেছে সাহিত্যেই। ১৯৫৫ সালে এ্যাঞ্জেল ফোর্স ‘আমেরিকান স্প্যানিশ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে এর কথা সাহিত্যরীতি হিসেবে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেছিলেন। আর উইকির মতে, জাদুবাস্তবতা এমন এক ধরনের সাহিত্যরীতি যাতে জাদুর উপকরণ অপরাবাস্তব জগতের অপরিহার্য অংশ।  জাদুবাস্তবতার গডফাদার মার্কেজ বলেছেন, ‘আমরা যে বাস্তবকে দেখি, তার পেছনে যে ধারণাটা আছে সেটাই জাদুবাস্তবতা'। সহজভাবে বলা যায়, বাস্তব পার্থিব কাঠামোর সঙ্গে ফ্যান্টাসির উপাদান মিলে তৈরি হয় জাদুবাস্তবতা। এটি এমন একটি জাদুময় অনুভূতি, যা জাদু ভেদ করে চরম বাস্তবতাকেই তুলে ধরে। 

জাদুবাস্তবতাবাদ এবং পরাবাস্তবতাবাদ উভয়ই ১৯২০ সালের দিকে তাত্ত্বিক রূপ পায়। এবং প্রায় সমসাময়িক সময়েই এদের ইশতেহার রচিত হয়। সে সময়টা ১৯২৫ সালের দিকে ফ্রাঞ্জ রোহ জাদুবাস্তবতাবাদ এবং এর কিছুদিন আগেই আন্দ্রে ব্রেতঁ প্রকাশ করেন পরাবাস্তববাদের ইশতেহার।জাদুবাস্তবতার আধুনিক ইতিহাস মূলত  ল্যাটিন ইতিহাস। কিউবান লেখক আলেহো কার্পেন্তিয়ের, আর্জেনটাইন লেখক হোর্হে লুইস বোরহেস, কলম্বিয়ান লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের হাত ধরে ম্যাজিক রিয়ালিজমের পুর্নাঙ্গ বিকাশ ঘটে। 

ম্যাজিক রিয়ালিজম এর অসাধারণ উদাহরণ দেখতে পাই মার্কেজের "সরলা এরেন্দিরা তার নিদয়া ঠাকুরমার" গল্পটিতে। উলিসিস প্রেমে পড়ে এরেন্দিরার। তারপর উলিসিস যে কাচেই হাত দেয়, সেই কাচ রঙিন হয়ে ওঠে। তখন তাকে বলা হয়, নিশ্চয়ই তুই প্রেমে পড়েছিস, কেবল প্রেমে পড়লেই এ রকমটা ঘটতে থাকে। 
''নিঃসঙ্গতার একশ বছর ''  বইটিতে দেখা যায় মরিসিও বাবিলিওনা নামের একজন প্রেমিক যেখানেই যায়, তার পেছনে পেছনে যায় প্রজাপতি।  তার দাদিও এই কথাটাই বলেছেন। একজন বিদ্যুৎ মিস্ত্রি আসত তাদের বাড়িতে। সে চলে যাওয়ার পর রান্নাঘরের তোয়ালেতে দাদি দেখলেন একটা প্রজাপতি। দাদি বললেন, এই ছেলে যখনই আসে, তার পেছনে পেছনে আসে প্রজাপতি।ব্যাখ্যা করা দুরুহ কিন্তু আমরা কি অবিশ্বাস করতে পারছি? 
গার্সিয়া মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর উপন্যাসে কত বিস্ময়কর ঘটনাই না ঘটে। মাকান্দো নামের জনপদটিতে হঠাৎ অনিদ্রা দেখা দিল। ওই জনপদের প্রতিষ্ঠাতা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বলেন, ‘কখনো আর যদি না ঘুম আসে তো খুবই ভালো হয়। জীবনের কাছ থেকে আরও অনেক কিছু পাওয়া যাবে।’ কিন্তু তাতে যেটা হলো, ওই জনপদের সবাই ঘুম হারানোর সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিও হারিয়ে ফেলতে লাগল। সবকিছুর নাম ও ব্যবহার তারা ভুলে যাচ্ছে। তা ঠেকাতে তারা জিনিসপাতির গায়ে নাম ও সেসবের ব্যবহার লিখে রাখতে শুরু করল। যেমন গরুর গায়ে তারা লিখে রাখল, ‘এটা হলো গরু। যাতে সে দুধ উৎপাদন করতে পারে, সে জন্য রোজ সকালে তাকে অবশ্যই দোহাতে হবে। আর সেই দুধ অবশ্যই জ্বাল দিতে হবে, যাতে করে কফির সঙ্গে মিশিয়ে কফি ও দুধ বানানো যায়। এসবই মার্কেজের জাদুবাস্তবতার কতগুলো উদাহরণ। এই যে জাদুবাস্তবতা, এর উৎস কী?। মার্কেজ তার নোবেল পুরস্কার ভাষণে (১৯৮২) বলেছেন, এসবই আসে ল্যাটিন আমেরিকার বাস্তবতা থেকে। অর্থাৎ জাদুবাস্তবতার উৎস কিন্তু উদ্ভট কল্পনা না নিছক অলৌকিকতা বা অতিপ্রাকৃতরস নয়, এর উৎস নিখাদ বাস্তবতা, আসল টুইস্টটা হলো এই বাস্তবতার সাথে ম্যাজিকের অপূর্ব মিশ্রণ।টনি মরিসনের "বিলাভেড" আমার ভীষণ প্রিয় একটি উপন্যাস। উপন্যাসে দেখতে পাই,একজন নিগ্রো কৃতদাসী সিথি,নিজের অভিশপ্ত জীবনের গ্লানি যাতে সন্তানকে বয়ে বেড়াতে না হয় এজন্য সন্তানকে হত্যা করে। কিন্তু বিশ বছর পরে সেই প্রিয় সন্তান বিলাভেড তার জীবনে ফিরে আসে, পেতাত্মা হিসাবে। এখানে স্পষ্টতই আমরা সুপারন্যাচারাল মেশিনারির প্রয়োগ দেখতে পাই কিন্তু গোল বাঁধে তখনই যখন বিলাভেড নিছক অশরীরী থাকে না হয়ে যায় সিথির চেতনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তার উপস্থিতি কেবল সিথি নয় পল ডি সহ অন্যরাও অবলোকন করে এবং বিলাভেড হয়ে ওঠে গোটা দাসপ্রথা ও দাসবৃত্তির মূর্ত প্রতিক। এখানে জাদু এবং বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার। কেবল ল্যাটিন বা ইংরেজি সাহিত্যে নয় আমরা জাদুবাস্তবতার সার্থক প্রয়োগ বাংলা সাহিত্যেও দেখতে পাই, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বীরেন্দ্র চট্রোপাধ্যায়,শহীদুল জহির, নাসরিন জাহান,হুমায়ুন আহমেদের লেখায় আমরা জাদুবাস্তবতা দেখতে পাই। 

জাদুবাস্তবতা বিংশ শতাব্দীর সাহিত্য প্রবনতা হলেও আমরা কিন্তু অনেক অনেক আগে থেকেই সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা খুঁজে পাই।  ডেনিয়েল ডিফোর "রবিনসন ক্রুসো", জনাথন সুইফট এর "গালিভারস ট্র‍্যাভেলস" কাফকার "মেটামরফোসিস" এমনকি শেক্সপিয়রের " দ্যা টেমপেস্ট" নাটকেও আমরা জাদুবাস্তবতার উপকরণ খুঁজে পাই। সাম্প্রতিক সময়ে আমার পড়া দুটি গ্রন্থে আমি জাদুবাস্তবতার ব্যবহার দেখে চমকে উঠেছি। একটি সময়ের আলোচিত কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেনের  "মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ "। মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’নামক নাম গল্পটি ম্যাজিক রিয়ালিজমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ । মার্কেজের মতো বাস্তব পরিবেশ তৈরিতে ডিটেইলিংয়ের ব্যবহার গল্পটিতে অনন্যতা এনেছে। পুরো পরিবেশ বর্ণনা করে প্রচ্ছন্ন জাদু ব্যবহার করে তিনি বাস্তব সময়কে কী তীব্রভাষায় যে স্যাটায়ার করলেন-
“আমরা ‘মিট হিউম্যান মিট’এ এলাম। হোটেলের মালিক একজন সাবেক মন্ত্রী। দেয়ালে বড় করে তার ছবি টাঙানো। ছবিটার নিচে টেবিলে আমরা বসেছি। এদিকে আলো ও মানুষের চাপ, দুটোই কম। গল্প করতে করতে সময় নিয়ে খাওয়া যাবে। মানুষের মাংস দ্রুত খেলে নাকি স্বাদ পাওয়া যায় না। মুখের ভেতর অনেকক্ষণ রেখে গিলতে হয়।”
তরুণ কথাসাহিত্যিক রুদ্র মোস্তফার "যে গল্প লেখা হয়নি" বইয়ের "গল্পটি সৌমিক অথবা মিশু অথবা অন্য কারো"। অতীত থেকে উঠে আসা আলেয়া কী চমৎকারভাবে হয়ে যায় বর্তমানের অংশ। গল্পের একটা সময় আলেয়াকে সমাজের মুখপাত্র মনে হয় এবং পাঠক যেন খুব সহজবাস্তব হিসাবেই তাকে গ্রহণ করে। এভাবে বাস্তবতার ভেতর ঢুকে পড়ে জাদু এবং ঘটনার পরম্পরায় তা হয়ে উঠে নিখাদ বাস্তবতা। 

আলোচনাটি পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হতে পারে, জাদুবাস্তবতা কি কেবল কথাসাহিত্যেই আলোচিত, কবিতায় কি এর সার্থক প্রয়োগ ঘটেনি? অবশ্যই ঘটেছে এবং তা কথাসাহিত্যের চাইতে আরও সুক্ষ্ম ও গভীরভাবে কিন্তু যেহেতু জাদুবাস্তবতার মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ল্যাটিন কথাসাহিত্যের হাত ধরে তাই এই আলোচনায় কথাসাহিত্যে এর প্রয়োগের দীর্ঘ বয়ান। কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবতা আসে প্রবাহমান ঘটনার ভেতর আলাদা কোনো ঘটনার চমক,অলৌকিকতা, ফ্যান্টাসি বা কোন বিস্ময়কর চরিত্রের মধ্য দিয়ে কিন্তু কবিতায় এভাবে না এসে তা কিন্তু শব্দ বা কল্পচিত্রের জাদুতেও আছড়ে পড়তে পারে। ধরা যাক, জীবনানন্দ দাশের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতাটি শুরু থেকেই আমাদের মধ্যে এক ধরনের পরাবাস্তব ঘোর তৈরি করে। 
" শোনা গেল লাশকাটা ঘরে 
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে-ফাল্গুনের রাতের আঁধারে 
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ 
মরিবার হলো তার সাধ!"

এখান থেকেই কবিতাটি একটা অবসেশানের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যায়, এরপর স্পর্শ করে  অবচেতনের তৃতীয় মাত্রা--

" থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে 
বলেনি কিঃ 'বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে? 
চমৎকার! -
ধরা যাক দু'-একটা ইঁদুর এবার! "

ফ্যাক্ট এবং ফিকশনের মধ্যে আমরা দুলতে থাকি এবং একটা জায়গায় এসে আমরা থমকে যাই। 

" জানি -তবু জানি
নারীর হৃদয় -প্রেম-শিশু-গৃহ- নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় -
আরো এক বিপন্ন বিস্ময় 
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে;" 

এখানে একটি শব্দও আমাদের অপরিচিত নয়। কিন্তু বিপন্ন বিস্ময় পড়তে গিয়ে আমরা চমকে উঠি। আমরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না বিস্ময় কী করে বিপন্ন হতে পারে কিন্তু আমরা কেউ কেউ কি বিপন্ন বিস্ময়কে অবিশ্বাস করতে পারছি।  না,পারছি না -এখানেই লুকায়িত জাদু আর জাদুর ভেতর বাস্তবতা। 

রবীন্দ্রনাথের "কৃপণ" কবিতাটি আমরা সবাই পড়েছি। কবিতাটির একটা জায়গায় আমরা চমকে উঠি --

যবে       পাত্রখানি ঘরে এনে

                    উজাড় করি-- এ কী!

                   ভিক্ষামাঝে একটি ছোটো

                    সোনার কণা দেখি।

                  
ভিক্ষার পাত্রে চাল থাকবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে সোনার কণা, এটা বিস্ময়কর, অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা। কিন্তু পুরো কবিতাটি পড়ে আমরা কী এক মুহুর্তের জন্য অবিশ্বাস করতে পেরেছি? একটি কবিতার সম্পূর্ণ শরীরজুড়ে জাদুবাস্তবতা থাকে না,কখনো একটি পঙক্তি, এমনকি একটা লাইনের ভেতরও থাকতে পারে জাদুবাস্তবতার নির্যাস।

সাহিত্যে 'জাদুবাস্তবতা' বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসার অনেক পূর্বেই ইংরেজ কবি কোলরিজ তার 'দ্যা রাইম অব দ্যা এনসান্ট মেরিনার' কবিতাটি অতিপ্রাকৃতবাদের খোলসে পরাবাস্তবতার ভেতর নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে জাদুবাস্তবতার ঝলক দেখিয়েছেন। সুতরাং সাহিত্যে এটি সাম্প্রতিক প্রবনতা হলেও অনেক আগে থেকেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে হয়তো কবি লেখকদের অজান্তেই।

পশ্চিমবঙ্গের কবি সৌমিত বসুর একটি কবিতা "সংসার " কবিতাটি পড়ে আমি চমকে উঠেছিলাম--

"তোমার ভল্ল আমার বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে
চতুর্দিকে গরম কুমকুম
আমি ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছি দেখে হেসে উঠছে মানুষজন
ভাবছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হলো
এবার তালুতে আসবে সমস্ত বিধবারা
যারা আমার পাশের চেয়ারে বসতে গিয়ে
হোঁচট খেয়েছে বারবার তারাও খুশি
সর্বোপরি আমি নেই ভেবে যারা রাস্তা ফাঁকা ভেবেছিল তারাও আজ গল্পে গল্পে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।সাজিয়ে দিচ্ছে আনন্দময় সন্ধ্যা ,তোমার প্রশংসায়।

আমার তলোয়ার ঠিক তোমার দুটো বুকের মাঝে।রক্ত নয়,থোকা থোকা চেরিফল আর আনন্দ।
জোৎস্না এসে পেতে দিয়েছে উঠোন তাতে গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে তোমার স্থাবকেরা।
সমস্ত নিন্দামুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে টার্কিস ব্লু রঙের স্রোত
সেই রং দুহাতে মেখে কারা যেন নেমে যাচ্ছে খাঁড়ির গভীরে।তুমি মৃত্যুঘুমে।

গুটিয়ে রাখা পর্দা কার্টেন কল এর আগেই টানটান হয়ে উঠছে
যেন দুটো মৃত মানুষ উঠে বসে জড়িয়ে ধরছে পরস্পর।আর
হাততালি দেওয়া হাতগুলো ক্রমশ নীল হয়ে আসছে।
অন্ধকারে বসে হঠাৎ ফুটোর ভেতর দিয়ে চাঁদ দেখে প্রথমবার  নিজেদের বোকা বলে আবিষ্কার করছে মানুষজন।"

ব্যবহৃত প্রায় প্রতিটি চিত্রকল্পই ম্যাজিকের মতো এক অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে কিন্তু রক্তের বদলে থোকা থোকা চেরিফল আর আনন্দ,টার্কিস ব্লু রঙের স্রোত আর ফুটোর ভেতর দিয়ে আমরাও কী চাঁদ দেখছি না?এই যে ম্যাজিকের মধ্য দিয়ে বাস্তবতাকে ছুঁয়ে দেবার সচেতন প্রচেষ্টা এরই না ম্যাজিক রিয়ালিজম -জাদুবাস্তবতা। 

এই সময়ের কবিদের মধ্যে আমার ভীষণ আদরের রুদ্র মোস্তফা, সকল প্রকার স্বজনপ্রীতিকে দু'হাতে সরিয়েই বলছি -ওর লেখা "ভাত ও সরাইখানার সাতকাহন " কবিতাটিতে জাদুবাস্তবতার অসাধারণ প্রয়োগ আমাকে মুগ্ধ করেছে। 



"আমি ফুলের বনে দেখেছি ভাত কুড়ানো এক শিশুকে —
ফুল নয়, সে কুড়ায় ভাত 
সাদা-কালো রঙিন ফুলেরা যাদুর স্পর্শে কেমন ঝরঝরে ভাত হয়ে যায়! 
সে ভাত কুড়ায় ঝড়-বৃষ্টি কুয়াশায়
রোজ রোজ বিরামহীন... 
ভাত কুড়াতে কুড়াতে ভুলে যায় ঝরা শৈশবের ব্যথা। 
মা'র কাছে শুনেছে সে, তার বাবা একজন মাতাল। 
ভাত পচিয়ে যে মদ তৈরি হয়,সেই মদ খেয়ে 
হারিয়ে যাওয়ার আগে রোজ ঘরে ফিরতো মাতাল বাবা। 
বাবার কথা মনে হওয়ায় শিশুটি যত্ন করে কুড়িয়ে নেয়
 ফুলের বনের সব ভাত, আর মনে মনে ভাবে,
যদি ভুল করে পড়ে থাকে কোথাও একটি ভাত
সেটি পচে গিয়ে যদি হয় মদ
তবে হয়তবা ঘটবে আরো কারো সর্বনাশ! 
হারিয়ে যাবে কোনো না কোনো বাবা—  
থোকা থোকা সরাইখানা হবে হয়ত তখন   
পৃথিবীর অবশিষ্ট সব ফুলের বাগান।"


ফুলের বনে একটা শিশু ভাত কুড়োচ্ছে,এখানেই পাঠক চমকে যাচ্ছে এবং শেষে এই চমকটি এঁকে দিচ্ছে নিগূঢ় বাস্তবতা ' থোকা থোকা সরাইখানা হবে হয়তো তখন পৃথিবীর অবশিষ্ট সব ফুলের বাগান'।



কবিতায় জাদুবাস্তবতার ব্যবহারে আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে আমার সমসাময়িক কবি রিগ্যান এসকান্দার। বাংলা কবিতায় জাদু বাস্তবতার ব্যবহার খন্ডিত এবং বিচ্ছিন্ন কিন্তু পুরো কবিতার বই জুড়ে বাস্তব এবং পরাবাস্তব এর সম্মিলনী আমার নজরে একটিই পড়েছে সেটি রিগ্যান এসকান্দারের "সুফিয়াতন্ত্র"। একটি কবিতায় কবি লিখেছেন -


“আমি আমার সমস্ত কৈশোর কাঁধে তুলে সুফিয়াখালার বেণীর ওপর দুলতে দুলতে পুলসিরাত পার হয়ে যাই।”

অন্য আরেক জায়গায়--

'কারণ, সুফিয়াখালা সরিষাখেতে এখনো হলুদ ফুল হয়ে ফুটে আছে।আর মাঠে আমি দেখছি সরিষাখেতের হলুদ ফুল থেকে মৌমাছিরা সংগ্রহ করছে মধু'

 
কবিতা কখনোই শরীরসর্বস্ব নয়। ধ্যানমগ্ন হয়ে নিবিড় পরিচর্যায় একজন কবিকে শব্দের ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। আত্মাহীন কবিতা কেবলই শব্দজট।
রিগ্যান এসকান্দারের কবিতা পড়ে আমি অবচেতনেই বলে উঠেছি- প্রাণ আছে!প্রাণ আছে!

আসুন আরেকটি কবিতার অংশবিশেষ পাঠ করা যাক--

''প্রভাতে হঠাৎ একদিন মসজিদে যাওয়ার সময় দেখি,বাড়ির উঠোনে সুফিয়াখালা কুড়োচ্ছেন শিউলিফুল। আর নামাজ শেষে ফিরে এসে দেখি,শিউলিতলায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন রাবেয়া বসরি।

আমাদের উঠোন তখন পবিত্র বসরা নগরী।''


কবিতায় জাদুবাস্তবতার প্রধান অনুষঙ্গই হলো চমক তবে এই চমক কেবল অতিপ্রাকৃতবাদ বা রহস্যময়তার ভেতর আটকে থাকবে না, এই চমক পরাবাস্তব কবিতার মতো আমাদেরকে চেতন থেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্য কোনো অবাস্তব বা অধিবাস্তব জগতেও নিয়ে যাবে না বরং বাস্তবতার ভেতর জাদু প্রবেশ করে বাস্তবতাকেই আরও শক্তিশালী করবে। দিন শেষে এই জাদু বা ম্যাজিক নয় আমাদের করোটিতে সুর তুলবে বাস্তবতা -নির্ভেজাল নিঁখুত সত্যের মতো সুগভীর বাস্তবতা।  



Post a Comment

1 Comments

  1. পুরো লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়লাম। জাদুবাস্তবতা নিয়ে একটি চমৎকার লেখা। ব্যাখ্যা ও উদাহরণ সহযোগে বিষয়টি এতটাই পূর্ণাঙ্গ ব্যঞ্জনায় তুলে ধরা হয়েছে যে জাদুবাসস্তবতা সম্পর্কে যার পূর্বধারণা শূন্য, তিনি বেুঝতে পারবেন অনেকখানি। কুশল ভৌমিকের একটিমন্তভ্য কবিতা-লেখিয়েরা মনে রাখতে পারেন:----- ‘‘ কবিতা কখনোই শরীরসর্বস্ব নয়। ধ্যানমগ্ন হয়ে নিবিড় পরিচর্যায় একজন কবিকে শব্দের ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। আত্মাহীন কবিতা কেবলই শব্দজট ‘’

    ReplyDelete