মায়ের দ্বিতীয়বার স্বামী গ্রহণের পর হালিম এবার সত্যি সত্যিই খুব বিপদে পড়লো। বাপের মৃত্যুর পর সহায় সম্বল হারিয়ে মায়ের হাত ধরে যখন সে নানার বাড়ির এই ঘরটাতে এসে উঠেছিলো তখন তার বয়স দশ। নানা তখনো বেঁচে ছিলেন। নইলে গরীব মামার এই খেটে খাওয়া সংসারে দু-দুটো আস্ত মানুষের খাদ্যের সংকুলান হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। বাড়ির আশেপাশে দুটো শাক-সব্জি তুলে, ভাইয়ের সংসারে ফরমাস খেটে, উঠানটা লেপে, কিছু হাঁস-মুরগি পালন করে, আর একান্তই অভাবে পড়লে এর ওর কাছে চেয়ে চিন্তে দিন তাদের মন্দ কাটতো না। অভাব থাকলেও দুঃশ্চিন্তা ছিলো না। তাই সারাদিন খাটাখাটনির পরেও এই অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরে এসে রাতের ঘুম তাদের ভালোই হতো।
কিন্তু হঠাৎ এক বয়স্ক লোকের সাথে মায়ের এই বাড়াবাড়ি রকমের সখ্যতা হালিমের ভালো লাগে না। নানা মারা গেছেন আজ দুই বছর হলো। মামার সংসারে অভাব বেড়েছে। মায়ের সাথে মামীদের ঝগড়ার তীব্রতাও দিনদিন বেড়েই চলেছে। এমন সময় ভিনদেশি এক পুরুষের সাথে মায়ের এই জড়িয়ে পড়াটাকে তার মামারাও ভালোভাবে দেখেননি। প্রতিবেশিরা কানাকানি করে। মুখের উপর যেই সেই বলে। এক মামী তো সেদিন বলেই ফেললো,”বুড়ি মাগীর আবার হাউস দেখো! এতো বড় ছাওয়াল থুয়্যা লিক্যা বসিচে।”
হালিম এসব কথার অর্থ বোঝে। বছর খানিক ধরে সে এই গ্রামের অলিতে গলিতে ঘুরেছে। ঘোর জঙ্গলের সবচেয়ে জটিল প্যাঁচটি পর্যন্ত তার চেনা। এরই মধ্যে কতো বিচিত্র রকমের গালি সে আয়ত্ব করেছে! একেকবার মনে হয়, গালি দিয়েই ওই বুড়া বেটাকে বিদায় করে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। সারাদিন মাঠে মাঠে খেলে, এর ওর সাথে মারামারি করে। আর একান্তই ক্ষুধা না লাগলে বাড়িতে ফেরে না।
মা’কে তার আজকাল কেমন জানি লাগে! কিছুদিন আগেও সে মায়ের কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতো। অথচ এখন তার অস্বস্তি লাগে। একটু কোল ঘেঁষে দাঁড়াতেই লজ্জা লজ্জা করে। সে কি জানে না, মায়ের কাছে সন্তানের লজ্জার কিছু নেই!
এছাড়া হাজেরার উপায় কী ছিলো? গ্রামের লোকেরা নানান কথা বলে। ভাইয়ের সংসারে আজ আছে, কিন্তু কাল যে তাড়িয়ে দেবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? সরাসরি কিছু না বললেও বিভিন্ন সময়ে আকারে ইঙ্গিতে অনেক কথাই তারা বলেছে। এক ভাবী তো সেদিন বলেই ফেললো,”বইসা বইসা এভাবে আর কদ্দিন খাবু? তুর ভ্যাইয়ের কী ট্যাকার গাছ আচে নাকি?”
কথাগুলো শুনে খুব রাগ হলো হাজেরার। মনে হলো, অনেক কথা তো সেও শোনাতে পারে! এই বাড়ি তার বাপের। এখানকার প্রতিটি ধুলিকণা, মাটি, পানি, গাছ তার বাল্যকালের সাথী। এই ঘরে তার মা মরেছে। এই গ্রামের প্রতিটি মানুষ তার চেনা। অথচ কোথাকার কোন ঝিয়ারি দুই দিন হলো এসে আজ তাকে বড় বড় কথা শোনায়!
নিজেকে সংযত করে নিয়ে বলে,”বস্যা বস্যা কুন্টে খানু ভাবী? কতো কামই তো আমি তুমার কর্যা দিই!”
নারী জাতির জীবনটাই এমন। একটা না একটা অবলম্বন থাকা চাই। নইলে কোথাও তার ঠাঁই নাই। না শ্বশুর বাড়ি, না বাপের বাড়ি।
এর চেয়ে জমিরের কথাতেই সে আশ্বস্ত হয়। লম্বা মানুষটার মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। যত্নে কলপ করা মাথাভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। গ্রামের আর দশজন মানুষের মতো হাজেরার কাছেও সে সমান দুর্বোধ্য। কেবল দূর থেকে দেখে দেখে হালিমই তাকে যা একটু চিনেছে: “শালা শয়তান বুড়া!”
নানা বেঁচে থাকতেও জমির একবার এসেছিলো এই বাড়িতে, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। অমত কারোই ছিলো না।
এখান থেকে দক্ষিণের মেঠো পথ বেয়ে মিনিট দশেক হাঁটলে জয়নাথপুর গ্রাম। তারপর পাকা রাস্তা ধরে কিলো পাঁচেক পূর্বদিকে গেলেই গৌরিপুর। তারই উত্তর পাড়ায় আত্রাই নদীর কোল ঘেঁষে জমিরের ছোট্ট বাড়ি। আপাদমস্তক টিন দিয়ে ঘেরা দুইটি ঘর। কাঠা পাঁচেক জমিও নাকি করেছে! আগের পক্ষের স্ত্রী গত হয়েছে তিন বছর হলো। কোনো ছেলে-পুলে নেই। শরীরে যতই বল থাকুক, সন্তান উৎপাদনের অক্ষমতা তার ঈশ্বর প্রদত্ত। সবকিছু খাপে খাপ মিলে গেলেও হাজেরার আপত্তির কারণেই বিয়েটা তখন হয় নি। সেই থেকে টানা দুই বছর জমির আর এই পথে পা বাড়ায় না।
হালিমের নানা মারা যাবার সময় এ বাড়িতে তাকে আবার দেখা গেলো। তারপর একবার নয়, বহুবারই সে এ বাড়িতে এসেছে। শোক সন্তপ্ত হাজেরাকে বুঝিয়েছে, ভাইয়ের বাড়িতে কতোদিন আর এভাবে থাকা যায়! একদিন না একদিন তারা তাড়িয়ে দেবেই। তখন ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় যাবে সে? তারপর বলেছে, বিয়ের পর গ্রামে-ট্রামে নয়, তাকে ঢাকা শহরে নিয়ে যাবে। সেখানে অনেক কাজ। কতো কল কারখানা আছে! গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে! ইচ্ছে করলেই প্রতি মাসে খেয়ে পরে কমসে কম পাঁচ হাজার টাকা তারা জমাতে পারবে।
হালিমকে কাছে ডেকে কোলের উপর বসিয়ে রেখে সোহাগ করে বলেছিলো,”আমারও তো ছাওয়াল পাওয়াল নাই। ও-ই আমার ছাওয়াল।”
অতটুকু ছেলে হালিম। সে কী আর এতোকিছুর মানে বোঝে! তবু এই বুড়োর কথাবার্তা তার ভালো লাগে না। মামার বাড়িতে সে সুখেই আছে। জীবনের ক্ষুধা তৃষ্ণা তার খেলা আর খাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এরই মধ্যে বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব সে জুটিয়ে ফেলেছে। কারো গাছের আম নামানো, কারো চালায় ঢিল দিয়ে দৌড়ে পালানো, বিলের মধ্যে থেকে কলার ভেলায় চড়ে শাপলা তুলে আনা, আরও কতো রকমের ব্যাস্ততায় এখন তার দিন কাটে।
আশ্বিন মাস। সেবার জমির এসে হাজেরার ঘরে টানা পাঁচদিন থাকলো। বিয়ের পর একটানা এতোদিন থাকা এবারই প্রথম। সামান্য জমি জিরাত থাকলেও কৃষিকাজ সে করে না। একটা ইণ্ডিয়ান হিরো সাইকেলে চড়ে গ্রামকে গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। জিজ্ঞেস করলে বলে ব্যাবসা করে। মানুষের ব্যাবসা। সাইকেলের প্যাডেলে প্যাডেলে তার প্রসার। বড় সৌখিন মানুষ এই জমির। কলপ দেওয়া চুল সর্বদা পরিপাটি করে আঁচড়ানো, মুখে দোক্তা দেওয়া পান, বাম হাতের তিনটি আঙ্গুলে বাহারি পাথর বসানো। ভাঁজ করা পাঞ্জাবি থেকে আতরের কড়া গন্ধ ভেসে আসে।
এবারের আসায় তার বেশ কিছু খরচাপাতি হয়েছে। বউয়ের জন্য দুটো শাড়ি, প্রসাধনী ও কিছু গহনা, ছেলেটার জন্য এনেছে লাল টুকটুকে শার্ট ও একটা জিন্সের প্যান্ট। হাজেরা খুশি হলো। এতোদিন পর লোকটাকে দেখে চোখ দুটো ঝলমল করে উঠলো তার। নীল রঙের ফিনফিনে শাড়ি দিয়ে মুখটা আড়াল করে বললো,”অনেক পেরেশান হয়্যা আইছেন। একটু বসেন, আমি শরবত বানায়্যা দেই।”
-“অতো পেরেশানির কি আছে? আছিই তো! আমি কি হারায়া যাচ্চি নাকি?”
বলেই হাজেরার হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসালো জমির।
এতোদিন পর কোনো পুরুষ হাতের স্পর্শে শরীরের ভিতরে শিরশির করে উঠলো তার। জমা করা গোপন বাসনাগুলো নড়ে চড়ে ওঠে। কী আর এমন বয়স হয়েছে তার? সেও তো মানুষ! হাতটা সরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,”ছাড়েন, ছাড়েন! দরজা খুলা আচে! ম্যানসে দেক্যা ফেলবে তো!”
ঘরে আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। পুরনো আমলের মরিচা ধরা একটা ট্রাঙ্ক, চটের ব্যাগ, কিছু হাঁড়ি-পাতিল আর একটা কেরোসিনের চুলা। শোবার জন্য ঘরের একপাশে বাঁশের চাটাইয়ের উপর কয়েকটা মলিন কাঁথা পরিপাটি করে বিছানো। জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে কলঘর থেকে পানি আনতে গিয়েই মনটা বড় উদাস হয়ে গেলো হাজেরার। কী জানি! কী তার মনে পড়েছে আজ! এরকম উপহার প্রাপ্তির ঘটনা তার জীবনে এটাই তো প্রথম নয়!
প্রথম প্রথম গোঁ থাকলেও নতুন জামা কাপড় পেয়ে হালিম খুশিই হলো। ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে কিছু একটা খেয়েছে কি খায়নি, নতুন শার্ট-প্যান্ট পরে সারা গ্রামে একবার চক্কর দিয়ে এলো সে। মামীরা বিদ্রুপের হাসি হেসে বললো,”কি রে হালিম! লতুন জামা কাপুর কুন্টে পালু? লতুন বাপে দিসে, লয়?”
এমনিতেই মামীদের চোখের সামনে সে যেতে চায় না। লজ্জা লজ্জা করে। কিন্তু আজ নতুন জামা কাপড় পরে নিজেকে দেখানোর লোভ সে কিছুতেই সামলাতে পারেনি। মামীর কথার ভেতরে শ্লেষ বা তীরষ্কার কেমন ছিলো, সেটা বড় কথা নয়। এর চেয়ে অনেক ধারালো ধারালো কথা সে আগেই শুনেছে। তদুপরি আজকের কথাটা শুনে হালিম একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলো। নিজের পরিধানের দিকে বড় বড় চোখ করে একবার তাকিয়ে দেখলো সে। লাল চকচকে জামাটার উপরে বিভিন্ন রকমের প্রিন্ট। তারই ভিতরে আস্ত একটা গোলাপ হা করে ফুটে আছে। মামীদের কথার কোনো জবাব না দিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো উঠান থেকে। তারপর জঙ্গলের ধারে একটা মজা পুকুরের পাশে বসে ধীরে ধীরে শরীর থেকে খুলে ফেললো জামাটা। দুই হাত দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে এক ঝটকায় সেটাকে ফেলে দিলো ডোবার ভিতর। মামীর কথার উপর তার কোনো রাগ বা অভিমান নেই। কেবল ‘লতুন বাপের’ এই শব্দটা তার কানের ভেতরে এসে আগুনের মতো আঘাত করেছে। সারাদিন পুকুরের পাড়ে বসে থেকে সন্ধ্যার আগে আগে খালি গায়ে সে ঘরে ফিরলো।
এদিকে সময় পেলেই হাজেরা ঘরের ভেতর নতুন স্বামীর সাথে ফিসফিস করে গল্প করে। জমিরের স্বপ্ন জাগানিয়া কথায় বুকের ভেতর জটলা পাকানো আশাগুলো তার পুনরায় জাগ্রত হয়। এখন সে প্রাণ ভরে খিলখিল করে হাসতে পারে। নতুন শাড়িটা পরে এপাড়া ওপাড়া বেড়িয়ে আসে। গাল ভরে পান খায়, লাল টুকটুকে মুখ করে ভাবীদের সাথে পা মেলিয়ে গল্প করে। অভাব তাদের কিছুটা কমেছে বটে! সুযোগ পেলেই জমির বাজার থেকে মাছ কিনে আনে, তরকারিটা কিনে আনে।
জীবননাটকের বিয়োগাত্মক পর্বটি শেষ করে হাজেরা যেনো কতো সহজেই মিলনাত্মক পর্বটির সন্ধান পেয়ে যায়!
কেবল ছেলেটাকে নিয়েই যতো চিন্তা। কী সুন্দর ফুটফুটে দুরন্ত ছেলেটি তার! সারাদিন এখানে সেখানে খেলে। খিদে পেলেই বাড়িতে এসে পেট ভরে ভাত খায়। ‘আজ এখানে কি হলো, কাল ওখানে কি হবে’ মায়ের সাথে বসে বসে কতো রকমের গল্প সে করে। কথায় কথায় সে কী হাসাহাসি! ধমক দিলেও থামে না।
অথচ দুইদিন ধরে কী হয়েছে ছেলেটার? ঠিক মতো কাছে আসতে চায় না। দরজায় উঁকি দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,”মা! আচু নাকি ঘরত?”
হাজেরা অবাক হয়! এতো তারাতারি ছেলেটা তার কীভাবে এতোটা বড় হয়ে গেলো! আদর করে কাছে ডেকে নেয়। কোলের উপর বসিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,”মুন খারাপ ক্যা বাবা? কি হসে তুর?”
হালিম জবাব দেয় না, মাথা নিচু করে থাকে। মা তার খাবার প্লেটের উপর মাছের মাথাটা তুলে দেয়, মুরগির রানটা খাইয়ে দেয়, আরো কতো কি!
জমির বলেছে, “দুঃশ্চিন্তার কিছু নাই। বারো বছর পার হয়্যা তেরোত পরিচে, ছেলে তো এখন এরকমই হবে!”
হাজেরাও তাই দুঃশ্চিন্তা করে না। কতো কথা সে নিজেই বলে। নতুন বাড়ির কথা, ঢাকার কথা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কথা। তারপর জমিরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে হাসতে হাসতে বলে,”ঢাকায় গেলে ছেলেকে কিন্তু ইশকুলে ভর্তি করাতে হবে।”
আজকাল মায়ের এই ফিসফিসানি হাসিটা তার অসহ্য লাগে। বাপের মৃত্যুর সময় যে অনিশ্চয়তার কালো ছায়া সে মায়ের চোখে মুখে আবিস্কার করেছিলো এখন তার বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই। অথচ ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যেও তখন একটা মায়াবী নির্ভরতার সন্ধান সে মায়ের কাছেই পেয়েছিলো। আজ তারই এই উচ্ছ্বল হাসিখুশি মুখ দেখে হালিম শুধুই ব্যাথিত হলো।
এ জগতে মা-ই তার একমাত্র আপন জন। আর যদি কেউ থাকে, সে এখন অন্তরালে। সেই মায়েরই হাসিমুখ দেখে কষ্ট পায়, এমন হতভাগা সন্তান ক’জনার ঘরে আছে?
সন্ধ্যা থেকে একটানা ঝরবার পর বৃষ্টির বেগ এতোক্ষণে কিছুটা কমেছে। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় নারিকেলের পাতাগুলো শোঁ শোঁ শব্দ করে দুলে উঠে। আবহসঙ্গীতের মতো তাল লয় ঠিক রেখে একটানা ডেকে যাচ্ছে কতোগুলো জলাশ্রয়ী ব্যাঙ। বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস অহেতুক ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতর। মাচাটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। জমির আসাতে এখন পূর্ব-পশ্চিমে আড়াআড়ি ভাবে ঘুমাতে হয়। হালিম আস্তে করে নেমে এসে নিচে রাখা হারিকেনের সলতেটা একটু বাড়িয়ে দিলো। তখন রাত আনুমানিক ক’টা হবে? দরজা খুলে একবার বাইরে বেরনো দরকার। কিন্তু এতো রাতে তার সাহসে কুলায় না। একবার ভাবলো, মা’কে ডাক দিলে হয়। কিন্তু পরক্ষণেই হারিকেনের মৃদু আলোয় মায়ের মুখটা দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সে। আধো আলো-অন্ধকারে সেই মুখ খানি দেখে বড় মায়া হলো তার। মনে হলো, জগতের সমস্ত স্নেহ আর বেদনার অকৃত্রিম সংমিশ্রন ঘটেছে এই মুখে। পাশেই খানিকটা দূরে পশ্চিমের দেয়াল ঘেঁষে ঘুমিয়ে আছে জমির। একটা সৌম্য প্রশান্ত ভাব তার চোখমুখ থেকে ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। এতোদিনে মনে হলো, অযথাই লোকটার উপর এতোগুলো রাগ সে পুষে রেখেছিলো। আজ এই বাদলের রাতে একজোড়া নিঃষ্পাপ ঘুমন্ত মুখ দেখে সব রাগ তার কোথায় হারিয়ে গেলো?
সাহস করে দরজা খুলে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হলো সে। আকাশে গুনবার মতো কোনো তারা নেই। মাঝে মাঝে ব্যাঙ আর ঘুঘরির ডাক। একটা আচমকা বাতাস লেগে হারিকেনের আলোটা মরি মরি করতে করতে বেঁচে গেলো। সেটাই হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে হেঁটে গেলো কলঘরের দিকে। নতুন বাপের উপর তার বিশেষ কোনো রাগ বা অভিমান নেই। মা’কেও সে আগের চেয়ে কোনো অংশে কম ভালোবাসে না। তবু এই দুটি স্বপ্নবান মানুষের হাসিখুশি মুখ, ফিসফিসানি কথাবার্তা কেনো তার অসহ্য লাগে? কেনো সে তার মাকে নতুন বাপের কাছ থেকে কেবলই আড়াল করে রাখতে চায়?
জমির এসে তো তার ভালোই হয়েছে! খাওয়া পরার চিন্তা নাই। আগে এক কাপড়ে তার বছর ঘুরতো। এখন কতো রঙ বেরঙের কাপড়ে তার বছর ফুরায়! এছাড়া মায়ের জীর্ণ মুখখানিও কতো উজ্জ্বল ও ভরাট হয়েছে। সন্তানের কাছে এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে! কলঘরে বসে বসে এইসব ভাবতে ভাবতে হালিমের মুখটা প্রশান্তিতে ভরে উঠে। কতোক্ষণ এভাবে বসে ছিলো কে জানে! ভোরের আজানের কিছু আগে আগে ঘরে এসে চাদরটা টেনে নিয়ে একপাশে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বেশ খানিকটা বেলা হয়ে গেলো।
রাতের ক্লান্তি তার চোখ থেকে এখনো পুরোপুরি বিদায় হয়নি। হাজেরা তখন ঘরের চৌকাঠের উপর বসে বসে মাথা আঁচড়াচ্ছে। এইমাত্র স্নান করে আসা ভেজা চুলগুলো তার পিঠের উপর পড়ে ব্লাউজটাকে ভিজিয়ে দিয়েছে। প্লাস্টিকের টুলের উপর বসে একটা নতুন আয়না হাতে নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে জমির। সেটাতেই মুখ দেখে দেখে টিপটিপ করে হাসছে হাজেরা। জমিরের মুখেও তখন বিশ্বজয়ের হাসি। বয়স পঞ্চাশ পেরোলেও, কলপের আড়ালে চুলগুলোতে তার পাক ধরলেও, সকালের এই দুষ্ট-মিষ্টি হাসি দেখে হাজেরা যেনো আজ বাইশ বছরের জমিরের সন্ধান পেলো।
পেছন থেকে চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো হালিম। মাথার ভিতর কী একটা চক্কর দিয়ে উঠলো! গত রাতে হারিকেনের সামান্য আলোয় যে ঘুমন্ত মুখজোড়া দেখে তার মায়া হয়েছিলো, অনেক অনেকদিন জমে থাকা দ্বন্দ্বের সমাপ্তি হয়েছিলো, আজ তাদেরই এই উচ্ছ্বল হাসিখুশি মুখ দেখে শরীরের ভেতরটা তার জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো। কোথায় থেকে একটা অদৃশ্য সংবেদনশীল দেয়াল এসে মা আর এই কিশোরের মাঝে অস্পষ্ট আঁচড় টেনে দিলো।
আহত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। সারাদিন অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তার কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো না। সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরে এলো, তখন তার অনেক জ্বর। গা আগুনের মতো গরম। ভালো করে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলো সে।
-“সারাদিন না খায়্যা টো টো কর্যা ঘুরলে জ্বর তো হবেই!”
মায়ের এই মমতা মাখানো শাসনে তার কান নেই। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আছে। হঠাৎ চোখটা খুলে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নাক টেনে টেনে বিচলিত হয়ে বললো , “ক্যা মা! তুর গাওত এতো আতরের গুন্দ কিসোক? তুই জ্যানিস ন্যা, আতরের গুন্দে আমার মাতা ঘুরে?”
-“না তো বাবা! আতর তো ম্যাকি নি আমি!”
হাজেরা মিথ্যা বলেনি। আতর সে কখনোই মাখে না।
তামিম মাহমুদ সিদ্দিক
1 Comments
" আতর" নামের ছোটগল্পটি পড়লাম। হাজেরা, হালিম, জমির। মূলত তিনটি চরিত্র। তার সাথে হালিমের মামি। বাহ্যিকভাবে দেখতে গেলে এটি গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সাধারণ কাহিনী। কিন্তু তা নয়। এই গল্পে নর-নারীর প্রায় অপরিহার্য মনো-দৈহিক চাহিদার বিষয়টি খুবই চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে৷ কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে---কিশোর হালিমের অদৃশ্য গভীর বেদনা ও মনস্তত্ত্ব। মৃত বাবার স্থানে মায়ের জীবনে স্বাভাবিক ও বৈধ পথে আসা জমিরকে মেনে নিতে পারে না কিশোর হালিম। তার মা " আতর " মাখে না। কিন্তু হালিম এখন মায়ের শরীরে আতরের গন্ধ পায় যা তার অসহ্য মনে হয়। হয়তো আতর গায়ে মাখে তার মায়ের নতুন স্বামী জমির। অথবা সেও আতর মাখে না। তার মায়ের শরীরে৷ একজন নতুন মানুষের গন্ধ পায় হালম নাকে অথবা মানসিক অনুভবের ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে। জমিরের দেওয়া লাল শার্টটাও তাই সে সহ্য করতে পারেনি, ছিঁড়ে ফেলেছে আড়ালে। হালিম বালক বয়স পেরিয়ে ১২/১৩ বছরে তার মানে আমাদের ভূগোলে কৈশোরে পড়েছে। সে হালিমা এবং জমিরের শারীরিক মিলনের ব্যাপারটি আঁচ করতে পারছে। হালিমের মনস্তত্ত্বকে চাইলে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব দিয়েও বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তামিম মাহমুদ মূলত কবি। সম্ভবত এটিই তার প্রথম ছোটগল্প, অন্তত প্রকাশিত আকারে। জীবনের প্রথম গল্পে এতটা উৎরে যাওয়া এটা একেবারে নতুন ঘটনা না হলেও ব্যতিক্রমী ঘটনা তো বটেই। তামিম গল্প লেখা অব্যাহত রাখবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা৷ এবং শুভকামনা।
ReplyDelete