কবিতার কেন জন্ম হয়? এ প্রশ্নের উত্তর নেই অথবা আছে। আমি যদি প্রশ্ন করি-উপন্যাসের কেন সৃষ্টি হয়-তবে এর কি উত্তর আছে? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:
‘‘-----------অলৌকিক আনন্দের ভার
বিধাতা যাহারে দেন তার বক্ষে বেদনা অপার
তার নিত্য জাগরণ অগ্নিসম দেবতার দান
ঊর্ধ্বে শিখা জ্বালি চিত্তে অহোরাত্রি দগ্ধ করে প্রাণ।”
রবীন্দ্রনাথের মতে বিধাতাপ্রদত্ত কবির সেই সৃজনবেদনা থেকেই কবিতার জন্ম। নজরুলের মতে কবি হচ্ছে বিধাতার হাতের বীণা; তবে সে-বীণা বিধাতা নিজহাতে বাজায় না, সে-ই স্বপ্রণোদনায় প্রেমের পক্ষে এবং অসুন্দর ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বেজে ওঠে । জীবনানন্দ দাশ বলেছেন যে- অন্তরের দিক হতে কবি হচ্ছেন একজন নিঃসঙ্গ মানুষ; তার সেই নৈঃসঙ্গ এবং তারসাথে ক্রিয়াশীল ক্লান্তিগর্ভ অনির্বচনীয় এক বিপন্ন বিস্ময়-উদ্ভুত বেদনা কবিকে কবিতা লিখতে বাধ্য করে। জন্মগতভাবে কবিত্ব-প্রতিভার অধিকারী মানুষ প্রকাশের ব্যাকুলতভরা বেদনা এবং কোনো না কোনো ধরনের দায়বোধ থেকে কবিতা লিখে থাকেন বলে আমার মনে হয়। তবে অকবি-আধাকবিদের হাতে কবিতার নামে তৈরী অকবিতা-আধাকবিতার বিষয়টি ভিন্ন। একজন কবি তার প্রাতিস্বিক বেদনায় যত বেশি গভীর হোন, নিবিড় হোন, তার হাতে মৌলিক কবিতা রচিত হওয়ার সম্ভানা ততো বেশি থাকে।
‘মৌলিক’ শব্দটি শুনলে পদার্থবিজ্ঞানের ল্যাবরেটরীর ছবি চিত্রকল্প হয়ে ভেসে ওঠে মানসচোখে। মৌলিক শব্দটিকে পদার্থবিজ্ঞান কিংবা রসায়নশাস্ত্রের আলোকে গ্রহণ করলে- মৌলিক কবিতা বলে কোনো কবিতা নেই। থাকতে পারে না। হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দুটি মৌলিক পদার্থ। দুটোর সংমিশ্রণে সৃষ্ট পানি হলো যৌগিক পদার্থ বা যৌগ। কবিতা এসবের কোনোটির মতোই নয়। মৌলিক কবিতা বলতে সম্ভবতঃ অন্যকবির প্রভাবমুক্ত উৎকৃষ্ট মানের কবিতাকে বোঝায়। কবিতার ভেতরে থাকে ভাবনা বা বিষয়, এবং গঠনশৈলী। গঠনশৈলীর উপকরণ হচ্ছে- ছন্দ, নির্বাচিত শব্দ, মিথ, চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাস, কল্পচিত্র আর ব্যঞ্জনা। আর ভাবনা বা বিষয় হচ্ছে- প্রকৃতি, প্রেম, আনন্দ, হতাশা, বেদনা, বিষণ্নতা, নৈঃসঙ্গবোধ, দুঃখ, ক্ষোভ, সংক্ষোভ, বিদ্রোহ, অলৌকিকতায় বিশ্বাস, স্রষ্টার ধারণা, তার সাথে মিলন বা পুনর্মিলনের উৎকণ্ঠা, সাম্রাজ্যবাদ, প্রতিবাদ, মুক্তির আকাক্সক্ষা, বিশেষ কোনো অনির্বচনীয় অনুভূতি কিংবা মনের এলোমেলো অবস্থা- ইত্যাদি। বিষয় বলুন আর গঠনশৈলী বলুন- পৃথিবীর সবদেশের কবিতা তো কমবেশি সাদৃশ্যপূর্ণ। সে অর্থে মৌলিক কবিতা বিরল। তারপরও সূক্ষèভাবে দেখতে গেলে মৌলিক কবিতার অস্তিত্ব আছে। প্রাণী হিসেবে পৃথিবীর সকল মানুষের উপাদান ২টি-(১) জৈবিকতা (অহরসধষরঃু) এবং বিচারবুদ্ধি ( জধঃরড়হধষরঃু)। অনেক মানুষের চেহারায়ও সাদৃশ্য আছে-, বিশেষ করে একই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অনেক মানুষের চেহারার মধ্যে পারস্পারিক হুবহু মিলও আছে। তারপরও সূক্ষèভাবে বিচার করলে প্রত্যেকটি মানুষ একজন স্বতন্ত্র মানুষ; প্রতিটি মানুষই একেকজন মৌলিক মানুষ। প্রতিটি মানুষের চেহারা ও কণ্ঠস্বর আলাদা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজনের কণ্ঠস্বর আরেকজন নকল করতেও পারেন; তারপরও নানাভাবে ব্যক্তির মৌলিকত্ব রয়ে যায়। যেমন-তার মন, তার মেজাজ, তার রুচি, তার ব্যক্তিত্ব, তার মনো-দৈহিক-ভাষিক অভিব্যক্তি। উৎকৃষ্ট কবিতার ব্যাপারটিও তদ্রƒপ। তবে কোনো কবিতা স্বতন্ত্র হলেই তা মৌলিক কবিতা হবে না, প্রথম শর্তটি হচ্ছে সবার আগে কবিতাটিকে উৎকৃষ্ট মানের হতে হবে। সময়ের ব্যপ্ত পরিসরে তার আবেদন দীর্ঘস্থায়ী হতে হবে। স্বল্পস্থায়ী বা গড়পড়তা মানের কোনো কবিতা স্বতন্ত্র হলেও আমি তাকে মৌলিক কবিতা বলবো না।
মৌলিক কবিতার বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যায়। কেউ যদি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কিংবা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ- সূক্ষèভাবে ও গভীরভাবে পাঠ ও বিশ্লেষণ করেন কিংবা আবৃত্তি করেন বা শোনেন -তাহলে বুঝবেন-‘বিদ্রোহী’ কেন মৌলিক কবিতা, ৭ই মার্চের ভাষণ কেন মৌলিক ভাষণ। মানুষের মহিমাগর্ভ আমিত্বের অভূতপূর্ব উদ্বোধন-কে বিষয় হিসেবে বেছে নেয়া, বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যঞ্জনাগর্ভ টহপড়সসড়হ শব্দ নির্বাচন, একইসঙ্গে অনেক আন্তর্জাতিক মিথের যুৎসই ব্যবহার, অভিনব চিত্রকল্প ও উৎপ্রেক্ষা, নৃত্যশীল গভীর ও প্রবল ছন্দ, অনুপ্রাসের অনুরণন, গতির প্রচন্ডতা, সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের সুষম সহাবস্থানজনিত বৈচিত্র্যময় অখন্ডতা, একঘেঁয়েমিকে দূরে রাখার জন্য ছন্দ-বক্তব্য-ভাষার বৈচিত্র্যময় আরোহণ-অবরোহণ, পরম আবৃত্তিযোগ্যতা, বীররসে ভরা ব্যক্তিত্ব ও মেজাজ, সফল লক্ষ্যগামিতা, এবং সময়কে ধারণ করে উত্তর-সময়ে গভীর আবেদনে টিকে থাকার শৈল্পিক ক্ষমতা-- এসবকিছুর সমন্বয়ে সৃষ্ট বিস্ময়কর -সাবলিমিটি--‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিকে করে তুলেছে অনন্য ও মহিমান্বিত। এ কবিতার তুলনা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেও বিরল। তবে সবক্ষেত্রে এতগুণের দরকার নেই, দু’একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণেও কোনো কবিতা মৌলিক কবিতা বলে পরিগণিত হতে পারে। যেমন জীবনানন্দ দাশের অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষায় লিখিত স্বল্প-আয়তনের ‘বনলতা সেন’। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির উপমা ও চিত্রকল্পে ইউরোপীয় কবিতার প্রভাব রয়েছে। তথাপি এ কবিতায় ধারণকৃত নিবিড় বেদনা ও ক্ষণিকসুখের স্মৃতি-উৎসারিত অনিঃশেষ মাধুরী, রহস্যময়তা, প্রাচীন কাহিনীর বদলে ভূগোলকে মিথ হিসেবে অভিনবরূপে এবং ‘অন্ধকার’ প্রত্যয়টিকে নানাবিধ ভাবনা উদ্রেককারী ব্যঞ্জনায় ব্যবহারকরণ এবং আধুনিক কাব্যপাঠকের বহুগামী অন্তর-মন-রুচিকে অবিশ্বাস্য মাত্রায় জয় করে নেয়ার এবং সে-জয়কে ধরে রাখার বিরল ক্ষমতা কবিতাটিকে অনন্য সাফল্যে উত্তীর্ণ করেছে।
প্রশ্ন করা যায় কবিতা কিভাবে মৌলিক হতে পারে? এ প্রশ্নটিকে হেসে উড়িয়ে দেয়া যায়-পাল্টা প্রশ্ন করে: ‘মানুষ কিভাবে খাঁটি হতে পারে?’। আর উদারভাবে গ্রহণ করলে বলা যায়-উপরের ২টি প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই এ প্রশ্নের জবাব আছে। উৎকৃষ্ট কবিতার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কবিতায় প্রবাহিত শৈল্পিক প্রাণরস। প্রয়োজনীয় শৈল্পিক প্রাণরসের সঞ্চার ছাড়া কোনো কবিতা মৌলিক হয়ে উঠতে পারে না। বিষয় নির্বাচনের অভিনবত্ব অথবা কোনো বিষয়কে অভিনব শিল্পসফলতায় প্রাণরসে উপস্থাপন- একটি কবিতাকে মৌলিক কবিতায় উন্নীত করতে পারে। সেভাবেই রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, ‘বৃক্ষবন্দনা’, ‘পৃথিবী’, ‘বাঁশি’; কাজী নজরুল ইসলামের ‘দারিদ্র’, ‘সিন্ধু’, জীবনানন্দ দাশের ‘অবসরের গান’, ‘আট বছর আগের একদিন’, ‘বোধ’, ‘নির্জন সাক্ষর’, ‘জুহু’ এবং ‘আকাশলীনা’, জসীমউদদীনের সহজিয়া কবিতা ‘কবর’, ফররূখ আহমদের ‘ডাহুক’ এবং ‘লাশ’, আহসান হাবীবের ‘আমি কোনো আগন্তুক নই’ এবং ‘আমি আছি’, সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’, শামসুর রাহমানের ‘চাঁদ সওদাগর’, ‘যে আমার সহচর’ এবং ‘আমার মাতামহের টাইপরাইটার’, আল মাহমুদের ‘প্রকৃতি’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘জাতিস্মর’ ‘অভিযোজনা’, ‘কবিতা এমন’, ‘সিম্ফনী’, এবং ‘তুমি, আমার প্রথম উচ্চারণ’, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’, শহীদ কাদরীর ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’ এবং ‘সেলুনে যাওয়ার আগে’, শঙ্খ ঘোষের ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, আবুল হাসানের ‘উদিত দুঃখের দেশ’ এবং ‘ধরিত্রী’, আবিদ আজাদের ‘তোমার বাড়ি’, এবং ‘চুমু’, জয় গোস্বামীর ‘পাতার পোশাকের বিরুদ্ধে’ এবং ‘শান্তিকল্যাণ’ প্রভৃতি মৌলিক কবিতা হয়ে উঠেছে। আমাদের এমন আরও বহু মৌলিক কবিতাই তো আছে। সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’ এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ বিষয় গৌরব এবং উপস্থাপনার চমৎকারিত্ব দু’কারণেই অনন্য কবিতা হয়ে উঠেছে। শব্দ ব্যবহারের চমৎকারিত্ব এবং অভিনব চিত্রকল্পের সমাহার থাকলেও বলা যায় যে আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ মূলতঃ তার মহাকাব্যিক বিষয়- গৌরবে মৌলিক। কিন্তু তারঁ ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ কবিতাটি মৌলিকত্ব অর্জন করেছে মূলতঃ অতিপ্রচলিত একটি মিথকে বিপরীত অর্থে অভিনব ব্যঞ্জনায় ও অর্থে বর্তমান বিশ্বের প্রাসঙ্গিকতায় ব্যবহারের গুণে। মজিদ মাহমুদের ‘পুত্র ডুবে যায়’ নামে একটি কবিতা আছে। সেটিও সৃষ্টি হিসেবে মৌলিক- প্রচলিত মিথকে সম্পূর্ণ উল্টো ব্যঞ্জনায় সফলভাবে ব্যবহার করার ঐশ্বর্যে। আবার আবু হাসান শাহরিয়ার তাঁর ‘মাকে ঘিরে আমাদের ছবি’ নামক কবিতায় মা এবং এসময়ের শহুরে শিক্ষিত সন্তানদের সম্পর্ক এবং সন্তানদের নিজেদেরে মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক-এর অভিনব ছবি তুলে ধরেছেন সফল শৈল্পিকতায়। এ ছবি জসীমউদদীনের ‘পল্লীজননী’ এবং শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে’ , কিংবা ‘আমার মাকে’ প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতায় উপস্থাপিত মা-সংক্রান্ত ছবি হতে একেবারেই পৃথক এবং একইসাথে তা বর্তমান বাস্তবতার সাথেও সংগতিপূর্ণ। উপস্থাপনার রীতি সহজ হলেও তা গভীরভাবে আকর্ষণীয় ও মননশীল ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। ফলে কবিতাটি মানে-গুণে একটি মৌলিক কবিতা হয়ে উঠেছে। এভাবে আরও উদাহরণ দেয়া যায়, কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন নেই।
এপ্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয় যে- কোনো গৌণ কবির কলম হতে মৌলিক কবিতা সৃষ্টি হওয়া অসম্ভবের কাছাকাছি একটা ব্যাপার। কবিতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে, কিংবা কবিতার ব্যাকরণ রপ্ত করে, অথবা পরিকল্পনা করে- মৌলিক কবিতা রচনা করা সম্ভব নয়। আবার এটি যত না চেষ্টার, তারও বেশি হয়ে-ওঠার ব্যাপার। কবির হাতে এটি হঠাৎ করেও সৃষ্ট হয়ে যেতে পারে।
------------------------------------০০--------------------------------
0 Comments