অলোক বিশ্বাসএর কবিতার কথা

My poetic thoughts Belief in light




সাহিত্যের যেকোনো আন্দোলন থেকে চিন্তা ও কল্পনার নতুন সূত্র পেতে আমার ভালো লাগে। দেশ বিদেশের চিত্রকলা ও ফিল্মের বিমূর্ততার উন্মেষ ও প্রয়োগ চেতনাকে প্রবল ঝাঁকি দিয়ে যায়। অতীতের ও বর্তমানের শিল্প সাহিত্যের, সিনেমার ও পেইনটিংসের বাঁকবদল আমার কবিতার উৎসে পরোক্ষে কাজ করে। ইম্প্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, ডাডাবাদ, ইংল্যান্ডের ইমেজিস্ট কবিতা আন্দোলন, সুররিয়ালিজম, অধিবাস্তবতা, অস্তিত্ববাদ, মার্ক্সবাদ তথা কমিউনিস্ট ইশতেহার, এ্যন্টিপোয়েট্রি মুভমেন্ট থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের সামন্ততন্ত্র বিরোধী বিপ্লব বিদ্রোহের ইতিহাস থেকে কিছু না কিছু উপাদান সংগ্রহ করি কবিতার জন্য। চেতনাকে নাড়াবার জন্য। যেকোনো ইতিবাচক প্রতিঘটনা বা কল্পনার বিস্ময় চেতনাকে হ্যামার করুক, আমি পছন্দ করি। মিশেল ফুকো, বাখতিন, জাঁক দেরিদা, সার্ত্রের চিন্তাধারা, এডওয়ার্ড সাঈদের পোস্ট-কলোনিয়াল বিষয়ক ভাবনা, এমনকি প্রাচীন ভারতবর্ষের জৈন ও বৌদ্ধ যুগের সামাজিক ও প্রথাবিরোধী ধর্মীয় আন্দোলন একটু আধটু পাঠের সুযোগ পেয়ে নিজের চেতনাকে সম্প্রসারিত করতে ভালোবাসি। তথাপি, আমি অতীত দর্শন ও মতবাদ থেকে মুক্ত থাকতে চাই কবিতা লেখার সময়। কবিতা আমার কাছে কোনো দর্শনবাহিত প্রোডাক্ট নয়, মন্তব্য নয়, মতবাদের প্রচার মাধ্যম নয়।

##

যেকোনো সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন, ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লবের ইতিহাস থেকে শুরু করে, চিলি, কিউবা, বলিভিয়া, ভারত, ভিয়েতনাম ও চীনের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাস থেকে নির্মাণ বিনির্মাণের প্রক্রিয়া খুঁজে বেড়াই। শিলচর ও বাংলাদেশের ভাষামুক্তি আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় পাতায় উপলব্ধি করি নতুন জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী ভূমিকা। এইসব উপাদান আমার চেতনাকে সম্প্রসারিত করলেও, এগুলোকে সরাসরি কবিতায় ইম্পোজ করার বিরোধী আমি। এইসব উপাদান পাশে বসিয়ে বা তাদের বিবৃতি পদ্ধতিতে আমার কবিতা নির্মিত হয় না। একথা উপলব্ধি করেছি যে, পাশ্চাত্য চিত্রকলায় বিমূর্ততার উন্মেষ ছিল তৎকালীন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ফলক। আমাদের এখানে তিরিশের কল্লোল যুগ থেকেই বাংলা সাহিত্যের বহুদিশাময় অব্রাহ্মিক কর্মকারিতা শুরু হয়ে গেছিল, যা চল্লিশের দশকের কবিদের ও কথাকারদের শিল্পের ভাষাকে আন্তর্জাতিক শিল্পের ভাষার সঙ্গে সেতুবন্ধনে সাহায্য করে। পরম্পরাকে কখনো অস্বীকার করি না। প্রশ্নচিহ্ন রেখে পরম্পরাকে গ্রহণ করি। পাঁচের দশকের নব্য আধুনিক কবিতার আলোচনায় কখনো আধুনিকের অবক্ষয়বাদের প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়। ছয়ের দশকের হাংরি আন্দোলনকে মার্কিন প্রভাবিত অবক্ষয়বাদ দিয়ে কখনো চিহ্নিত করা হয়। এখনো পর্যন্ত কোনো দশকের বাংলা কবিতাকে অবক্ষয়বাদ তাড়িত বলে মনে হয়নি আমার। পাঁচ ও ছয়ের দশক বাংলা কবিতায় প্রথম অপর ধারার মাইলফলক নির্মাণ করলো বলে আমার মনে হয়েছে। যদিও, পাঁচ ছয় সাত দশকের অনেক কবি ও লেখক তেড়েফুঁড়ে প্রতিষ্ঠানিকতাকে সরাসরি উত্তাপ দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানও তাঁদেরকে দিয়ে সাহিত্যের ব্যবসা করে নিয়েছে অবাধে। স্বাধীনতার পরে, এরকমটি ঘটা ছাড়া হয়তো অন্য কোনো পথ ছিল না, অন্তত ভারতের আধা-সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক রাজনৈতিক পোস্ট কলোনিয়াল ব্যবস্থার পটভূমিতে। সবাই একত্রে প্রাতিষ্ঠানিক জঙ্গমতার বাইরে কাজ করবে, তা কখনো সম্ভব নয় বলেই, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার প্রসঙ্গটিও জোরদার হয়ে ওঠে এবং সমান্তরাল অপর ধারার সাহিত্য নির্মিত হয়। প্রতিষ্ঠানিকতার জায়গাটি সুদৃঢ় না হলে প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে থাকা কাজগুলোর বৈচিত্র ও অপরত্বের রূপ ও রূপান্তর আমাদের চোখে পড়তো না তীব্রভাবে।

##

আমি অপর কবিতার কথা বলি। অপর কবিতা ভাবনার অন্যতম অবস্থান প্রত্যেকের কবিতা ভাষার ও অবয়বের নিজস্বতা। নিজস্বতা বজায় রাখা শিল্পের কঠিন কাজ। তাই আমার পক্ষে নির্দেশমতো যেমন যেমন পত্রিকা, তেমন তেমন কবিতা লেখা সম্ভব হয় না। চাপের কাছে নত হয়ে কবিতা নির্মাণ ও সরবরাহ করলে অপরত্ব বজায় থাকে না। অপর ভাবনা হলো মুক্ত। অন্যের আ-মূল চিন্তার সামগ্রিক প্রকৃতি দেখি, কিন্তু নিজের লেখার অবস্থানে অন্যের লেখবস্তুকে সসম্মানে দূরে রাখি। আমার মনে হয় একজন বি-শৃঙ্খলিত কবি সেটাই করেন। আমাদের দেশে গড়পড়তা (ধাবৎধমব) কবির সংখ্যাই বেশি। তাঁরা অন্যের ভাবনা, বিষয় ও ভাষাশৈলি অনুসরণ করেন, বিশেষ করে সেইসব পাঠবস্তু যেগুলো ব্যবসায়ীদের হাত ধরে জনপ্রিয়তায় বা অন্য কোনো মাধ্যমে আপাত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সেগুলোকেই তাঁরা অমোঘ সত্য বলে মনে করেন, অপর ভাবনার ঝুঁকি নিতে চান না। এটাও আমি মনে করি, প্রাতিষ্ঠানিক কবি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কবি চিহ্নিতকরণের ব্যাপারটি আপেক্ষিক। অন্তত এখনকার ধারণাটা এমনই। আপেক্ষিকতাকে আমি মান্যতা দিই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি একজন কবিকে যখন প্রাতিষ্ঠানিক বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তখন অন্য কোনো অবস্থানে তিনি অপ্রাতিষ্ঠানিক আচরণ করছেন। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিশেষ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেও বামপন্থী আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, যে বামপন্থী আন্দোলনের ধারকেরা ব্যক্তি পুঁজিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের বিরোধী বলে দাবি করতো। কবিতায় বা যেকোনো শিল্পে শিল্পীর ভূমিকায় চরমতা বলে কিছু থাকে বলে আমার মনে হয় না। আমি একসময় আশিদশক শেষের নতুন কবিতা আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। সেখানে কর্তৃত্বধর্মী রুলস এন্ড রেগুলেশন্স যখন কবিতা ধারার মুক্তির প্রতিবন্ধক বলে মনে হলো, সেখানে সমর্পিত থাকতে পারলাম না। আমার মনে হলো, নতুন কবিতার নামে একটা গিমিক, একটা তুমুল টোকাটুকিকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। মনে হলো, নতুন কবিতা মুক্ত কবিতা থেকে সরে যাচ্ছে। অথচ, নতুন কবিতাকে মুক্ত থাকতেই হবে, স্বতন্ত্র থাকতেই হবে। একদল তরুণ বিভ্রান্ত হয়ে একইরকম পদ্ধতিতে নতুন কবিতা লিখতে শুরু করলে, তার ফল ভালো হয় না। যেভাবে নয়ের দশকের একদল কবি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থাকা এক অগ্রজ কবির বিপুল অনুকরণ করলে, তার ফল ভালো হয়নি।

##

কবিতা লেখার পটভূমি হিসাবে কোনো দর্শন, কোনো শৈল্পিক  তত্ত্ব বা সমাজ বিষয়ক গ্রন্থ অনিবার্য কিনা, সেটা ভাবার  অবকাশ আমার কোনোদিন হয়নি। তবু, আমি ভাবি কবিতার উপকরণ মালমশলা হিসেবে কিছুই ব্রাত্য নয়। শুধু আমি, কবিতার ব্যাপারে মুক্তচিন্তার আসঙ্গ হয়ে থাকতে চাই। কবিতায় কোনো বিষয়, ধর্ম, দর্শন, নাটকীয়তা, স্লোগান, ডায়লগ এবং বিশেষ শৈলিগত রূপকে চাপিয়ে দিতে অনিচ্ছুক আমি। কখনো বলি না, অপর কবিতা লিখি। আমি বলি, অপরত্বের ভাবনায় কবিতা লিখি। অপরত্বের ভাবনা অন্যান্য অপরত্বকে গ্রাহ্যতা দেয়, মান্যতা দেয়। যেমন, আমি পোস্টমডার্ন ভাবনার অনেক সন্দর্ভকে ইতিবাচক মনে করি। পশ্চিমবঙ্গে পোস্টমডার্ন সন্দর্ভ নিয়ে এতো স্পষ্টভাবে কাজ হয়েছে, কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে কারো,  তাকে অস্বীকার করার কোনো যুক্তি দেখি না। যদিও কোনো বিশেষত্বই   শিল্পের একমেবম নয়, অবিভাজ্য নয়। বিভিন্ন ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতেই কবিতাকে চিহ্নিত করা হয় নানান নামে। যেমন, অতিচেতনার কবিতা, পোস্টমডার্ন কবিতা, পুনরাধুনিক কবিতা, অপর কবিতা ইত্যাদি। সবটাই আপেক্ষিক। ভাবনাগুলির চূড়ান্ত বলে কিছু হয় না। এভাবেই মহাচেতনার কবিতা।

##

হ্যাঁ, আমি কবিতার অপর ভাষা নিয়ে ভাবতে চাই অবহমানের মধ্যে থেকেও। কবিতার ভাষা কবিতার সামগ্রিকতার অংশ হলেও এর প্রয়োগ অন্যান্য উপাদান থেকে আলাদা না হলে, কবিতার আপডেটনেস নির্মিত হয় না। নতুন ভাবনায় নতুন ভাষার প্রয়োগই জীবনানন্দ ও নজরুলকে পৃথক স্থান দিয়েছে বাংলা কবিতায়। যদিও আপেক্ষিক কালখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে একজন সাম্প্রতিক কবি র‌্যাবো, মালার্মে বা রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ-বিষ্ণু- জসীমউদ্দীন-শামসুর রাহমানের মতো ভাষায় কবিতা লিখতে পারেন না এখন। আমাকে চল্লিশোর্ধ বয়সের একজন কবি কবিতা ক্যাম্পাসের জন্য একগুচ্ছ কবিতা পাঠিয়ে বললেন, তিনি তাঁর মতো করেই লেখেন। আমি দেখলাম, তাঁর সমস্ত কবিতা কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতার অক্ষম অনুকরণ হয়ে গেছে। একথা জানাতে, উনি খুব রুষ্ট হলেন, কিন্তু আমাকে পাল্টা কোনো প্রশ্ন করতে পারলেন না। পৃথিবী এভাবেই কিছুটা একেবারে পিছন ফিরে তাকাবে, কিছুটা এগোবে। আমার কিছু করার নেই, শুধু স্থা-বিরোধী চেতন অভিজ্ঞতায় কবিতাকে চিহ্নিত করা ছাড়া।

##

গড়পড়তা কবিতা থেকে আমি দূরে থাকতে চাই, পৃথক হতে চাই। চেয়েছি এতোদিন পর্যন্ত। এখনো চাই। নিজের কবিতার ভাষাকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করতে খুব সতর্ক থাকতে হয়। কবিতায় পেলব পংক্তি আমি লিখতে চাই না। একটি ভালো কবিতা পৃথকভাবে লিখিত হয়েছে, এই কারণেই ভালো। কবিতায় রাবিশ আবেগ ঢুকে পড়ার আগেই আমি সতর্ক হই। কবিতা কীকী বিষয় নিয়ে লিখবো, এরকম ভাবি না। বিষয়ভিত্তিক কবিতা লিখে হয়ে ওঠে না আমার। বিষয়ের প্রাধান্য ঘটলেই আমি কবিতার মুখ অন্য দিকে ঘোরাতে থাকি যাতে বিষয়ান্তরে যাওয়া যায়। যেকোনো বিষয়ই যখন কবিতার উপাদান হতে পারে, তখন বিষয় নিয়ে আলাদা করে ভেবে কী লাভ। একটা সূচের ফোঁড় দিয়ে চলার গতিটাই কবিতার বিষয় হতে পারে। চারপাশে অজস্র উপকরণ, অজস্র ওয়েভ, প্রবাহের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। আশ্চর্য হই, যখন কেউ বলেন, লেখার আর বিষয় পাচ্ছি না, সব বিষয় নিয়েই লেখা হয়ে গেছে। আমি বিষয়কে ভেঙে অন্য বিষয় পাই। বিষয়ের ভেতরে কোয়ান্টামের খোঁজ করি। একই বিষয়ের ভিতর থেকে কতো অন্য বিষয় বার করা যায়। বিষয়কে কবিতার বিষয়ে রূপান্তরিত করলে তার প্রাথমিক দশা থাকে না। এক দশা থেকে অন্য দশায় রূপান্তরের কাজ করতে ভালো লাগে। এই রূপান্তরে অন্যান্য ইনগ্রিডিয়েন্টের সহযোগিতা নিই। বিষয়ভিত্তিক একমুখী কবিতা আমি লিখতে চাই না। কবিতার বহুরৈখিকতায় আস্থা আমার। আমি দেখেছি, ফর্ম নিয়েও জোরজবরদস্তি বা চূড়ান্ত মনোভাব কবিতার গঠনটাকেই যেন প্রধান করে তোলে। কবিতাকে মুক্ত মনের খেলা মনে করি। এই খেলায় মেতে থাকার জন্য অন্যান্য মাধ্যমের প্রয়োগ কৌশল লক্ষ্য রাখলে ভালো হয়। শুধু শব্দ-সংস্থাপনের কবিতা লিখতে চাই না। আবার শব্দের সংকীর্ণ ভান্ডার কবিতায় বৈচিত্র আনতে পারে না। কিছু নতুন শব্দ তৈরি করতে আমার ভালো লাগে। এরকম অনেক করেছি। শব্দজোড়কে বাংলা কবিতায় অনেকভাবেই ব্যবহার করা যায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, কিছু শব্দ একেবারেই অচল কবিতায়। কিন্তু হঠাৎ করে সেরকমই এক শব্দ ব্যবহারের কৌশলে ধুন্ধুমার বাঁধিয়ে দিতে পারে। সেইসব শব্দকে নিয়ে খুব চিন্তায় থাকি। চলিত শব্দের সঙ্গে সাধু শব্দ মিশিয়ে সেই শব্দের অন্যমাত্রা পেয়ে গেছি কখনো। কখনো একটি গোটা কবিতাই সাধু ক্রিয়াপদে লিখে ফেলি। এর মধ্যে এক অন্য অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু সেরকম লেখা যেন উনিশ শতকের কবিতার মতো না হয়, সেটা মাথায় রাখতে হয় বেশি করে। সর্বদা ভাবি, বহু ব্যবহৃত শব্দকে কিভাবে ধোপদুরস্তের মাঝখানে বসিয়ে দেওয়া যায়।যদিও নতুন ভাষাবিন্যাসে ও নতুন অবয়বে একটা কবিতা লিখে ফেলা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয় আজকে। আজকের প্রজন্ম খুব সহজেই প্রযুক্তির উদ্ভাবিত রাস্তাকে রপ্ত করে নিতে পারে কয়েক দিনে। এর জন্য বোধের বহু বিস্তারিত থার্মোমিটার ঘাঁটাঘাঁটি না করলেও চলে। টেকনিকই বলে দেয়, কোনটার পর কোনটা অনুসরণ করলে, শব্দকাঠামোর এবং বাক্য বয়ানের নিরীক্ষামূলক অদলবদল করলে একটা নতুন অবয়ব নির্মাণ করা যায়। আমার মনে হয়, সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো, কবিতার ভাষাবিন্যাসে সৌন্দর্যায়ন। কবিতা লেখার সময় আমার মাথার মধ্যে এটাই হন্ট করতে থাকে। এখন আর বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে কবিতা লেখার দিকে ঝোঁক নেই কবিদের, ভাষার সৌন্দর্য নির্মাণের প্রতি অভিনিবেশটাই বেশি দেখা যায়। বোধ তাড়িত ভাবনা এবং ভাবনার অপরত্বই ভাষার অপরত্ব প্রকাশ করছে আজকের কবিতায়।

##

আমি নিয়ম করে লিখতে পারি না। লেখার ব্যাপারে আমি কোনো চাপ নিই না। কিছু দেখানোর নেই আমার। কবিতায় আমি কোথাও প্রতিযোগিতায় যেতে অনিচ্ছুক। আমার বন্ধুদের বছরে একটা দুটো করে বই হচ্ছে, তাতে আমার কোনো ঈর্ষা নেই। বরং তাঁদের বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে থেকে আনন্দ পাই। এতে আমারও বুস্টার হয়। কবিতায় আমি কাউকে প্রতিপক্ষ ভাবি না। তবে, কবিতা সম্পর্কে আমি প্রশ্ন করতে ভালোবাসি। আমি জানতে চাই, কেন এখনো অনেকে নজরুল বা শামসুর রাহমান বা চল্লিশের কবিদের মতো কবিতা লেখেন ? আমি নিজেকেও প্রশ্ন করি। প্রশ্ন করি, আমি কি আপামর কবির থেকে আলাদা হতে পেরেছি ? প্রচলের ক্লিশে ধারাটির সঙ্গে যদি আমার কবিতা মিলে যায়, তালে বলতে হবে আমার কবিতার মৃত্যু ঘটেছে। তবে, লক্ষ্য করেছি, প্রচল ধারাতেও অনেকে ভালো কবিতা লিখেছেন। আমার মনে হয়, প্রচল কবিতা ধারার কতগুলো পৃথক বিভাগ আছে। এর মধ্যে যে বিভাগ বা ধারাটি বেশ  টানটান, সেখানে আমার ফুলবেলপাতা দিতে অসুবিধা নেই। সেই ধারাটিকে আমি সম্মান করি এই কারণে যে, তার ভিতরে আছে এক প্রতি-দর্শনের আবহ, যা আমাকে সচেতন করে নিজের লেখাকে আইডেন্টিফাই করতে। আমি প্রচল কবিতা অনেক পড়লেও, তার দ্বারা আক্রান্ত হই না।

##

বিভিন্ন পত্রিকা দপ্তরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁত কেলিয়ে গল্প শোনার বা সেইসব পত্রিকা সম্পাদকের আজ্ঞা পালনের সময় নেই আমার। আমি কোনো সম্পাদকের কথা অনুসারে কবিতা লিখি না। পশ্চিমবঙ্গে কবিতা পত্রিকার অধিকাংশ সম্পাদককে আমার লাড্ডুমার্কা সম্পাদক বলে মনে হয়, কারণ তাঁরা স্পষ্টভাবে জানেন না কেন তাঁরা পত্রিকার সম্পাদনা করছেন। একটা কবিতা লেখার বা প্রকাশের পর কোনোদিন আত্মসন্তুষ্টি অনুভব হয় না আমার। কোনো পত্রিকার পাতা খুলে অন্যদের কবিতার পাশে নিজের কবিতা পাঠ করে ভাবতে থাকি কতোটা হয়েছে আমার। একই কবিতা আমি অনেকবার সংশোধন করি। আরো ফাইনিজ আনতে চেষ্টা করি পূর্বে প্রকাশিত লেখায়। প্রিন্টমিডিয়া বা ব্লগজিনে নিজের কবিতা দেখলে ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু সেখানে নিয়ম করে হাজিরা দিতে পারি না। তবে নিয়মিত কবিতা পড়া বা লেখা না চললে, নিজেকে কেমন ফাঁপা মানুষ মনে হয়। বিভিন্ন কবিতা পাঠের সভায় গিয়ে নিজেকে এসিড টেস্ট করি। পরীক্ষা করি আমার ভিতরের কবি সত্তাটি কী অবস্থায় আছে। নতুন নতুন কবির সঙ্গে পরিচিত হয়ে, তাঁদের কবিতা যাপনের অভিজ্ঞতা শুনে, মনে হয়, আমার এখনো অনেক কাজ বাকি থেকে গেছে। বইভর্তি লাইব্রেরিতে কাটিয়ে এবং যেমন খুশি গাদাগাদা লিখলেই যে সম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারবো, এবিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।  



















Post a Comment

1 Comments

  1. লেখাটি পড়ে ভাবনার সাথে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো মিলাতে পারিনি। তবে সমৃদ্ধ হলাম। বারবার পড়ার মত একটা গদ্য। ধন্যবাদ অলোক দা।

    ReplyDelete